একগুঁয়ে সরকার ও গোঁয়ার বিরোধী দল গণতন্ত্রের জন্য মঙ্গলজনক নয়
বাংলাদেশের
সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ ভারতের জন্য রাজনৈতিকভাবে শিক্ষামূলক। এটা সত্য যে,
আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্রের (বাংলাদেশ) রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতি ভিন্ন বলে
প্রতিভাত হয়। কিন্তু আবরণটা সরিয়ে, মোরগ পোলাও ছাড়িয়ে আরও ভেতরে গেলে
সাদৃশ্যতা সামনে আসতে শুরু করে। বাংলাদেশের রাজনীতি বরাবরই উত্তাল।
জন্মলগ্ন থেকে দেশটির রক্তাক্ত ইতিহাস এর রাষ্ট্রব্যবস্থার ওপর একগুঁয়ে
প্রেতাত্মার মতো আবির্ভূত হয়েছে। এটা এতোটাই যে, মানুষের রাজনৈতিক
সম্পৃক্ততার ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশী সমাজ ঠিক দু’ভাগে বিভক্ত। এমন কি
জনপ্রিয় ভাষা ব্যবহারের মধ্যেও এটা প্রতিফলিত হয়। মানুষজনকে ‘এপারের লোক’
আর ‘ওপারের লোক’ বলে অভিহিত করা হয়। গভীর মনস্তাত্ত্বিক বিভক্তিই নির্দেশ
করে এটা। বাংলাদেশের আজকের রাজনৈতিক পরিস্থিতিই ধরুন। এ লেখার সময় দেশটির
প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল, বিএনপির (যদিও বর্তমানে সংসদে
নেই) নেত্রী খালেদা জিয়াকে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা তার কার্যালয়ে
অবরুদ্ধ করে রেখেছে গত ছয় দিন ধরে। প্রকৃত কারণ গোপন করার চেষ্টায় কারণ
দেখানো হয়েছে যে, এটা করা হয়েছে খালেদা জিয়ার নিরাপত্তা বৃদ্ধির জন্য।
কিন্তু সরকারের এ ব্যাখ্যা কোন বাংলাদেশী কোন কিছুর বিনিময়ে গ্রহণ করছে না।
বাংলাদেশের ১০ম সংসদ নির্বাচন, যেটা বিএনপি ও তার জোট শরিক দলগুলো বর্জন
করেছিল, তার এক বছর পূর্তিতে বিশাল জনসমাবেশের ডাক দিয়েছিলেন খালেদা জিয়া।
ওই নির্বাচনের পর বিরোধীরা ওই দিনটিকে ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ হিসেবে আখ্যা
দেয়। আর সেটা পালনের লক্ষ্যেই সমাবেশের ডাক দেয়া হয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশে
‘সত্য’ কোন কিছু যেন কৌতুকের বিষয়। অনেকটা বাংলাদেশী ইতিহাসের মতো এটা
মানুষের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে বদলায়। বিএনপি যদি বলে এখন রাত,
প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ জোর দিয়ে বলবে- এখন দিন। খালেদা জিয়া আর তার
চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী শেখ হাসিনা- ‘লড়াইরত এ দুই বেগম’ সহসা একে অপরের সঙ্গে
কথা বলেন না। এ কারণেই শেষবার যেদিন এ দু’জন ফোনে কথা বলেছিলেন কয়েক বছর
আগে বাংলাদেশ অত্যধিক আনন্দিত ও উৎসাহিত হয়ে উঠেছিল (না, তারা তাদের প্রিয়
ক্রিকেটার নিয়ে আলোচনা করতে কথা বলেন নি)। এখন, ভারতের বর্তমান রাজনৈতিক
পরিস্থিতি হয়তো বাংলাদেশের মতো চরম বিভক্তির পর্যায়ে পৌঁছায় নি। কিন্তু
সংসদের শীতকালীন অধিবেশনে যেমন দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে, সেখানে ভারতীয়
সরকার এবং বিরোধীরা বলতে গেলে কোন ইস্যুতেই একমত নয়। রাজনৈতিক
প্রতিদ্বন্দ্বিতা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার একটি অংশ সেটা ঠিক আছে। তবে,
রাজনৈতিক শত্রুতা হলো- ওই ফুটবল খেলার মতো, যেখানে একদল বরং বাস্কেটবল
খেলতে পীড়াপীড়ি করবে। কেননা তারা নিশ্চিত নয়, নিয়ম মানা নিয়ে প্রতিপক্ষের
ওপর আস্থা রাখা যেতে পারে কিনা। আস্থার এ ঘাটতি সম্প্রতি ‘সন্ত্রাসী নৌকা’
ঘটনার সরকারি ভার্সন নিয়ে বিরোধী কংগ্রেসের সন্দেহে ফুটে উঠেছে। যদিও ঘটনার
গোপনীয়তা নিয়ে ন্যূনতম কোন তথ্যপ্রমাণ কংগ্রেসের কাছে ছিল না। বিরোধিতার
খাতিরে বিরোধিতা করাই যদি মন্ত্র হয়, তাহলে বাংলাদেশের গণতন্ত্র থেকে
ভারতের গণতন্ত্র আর কতটা আলাদা; যেখানে পরাজিত দল কখনও নির্বাচনের ফল মেনে
নেয় না? গোঁয়াড় একটি বিরোধী দল ভারত ও বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য মোটেই
শুভ নয়। একইভাবে একগুঁয়ে (বা অধ্যাদেশ বুভুক্ষু) কোন সরকারও মঙ্গলজনক নয়,
যারা বিরোধীদের দৃষ্টিভঙ্গিকে স্রেফ বিড়ম্বনা হিসেবে দেখে। বাংলাদেশের
ইতিমধ্যে তাদের ‘ব্যাটলিং বেগমস’ রয়েছে। সুশাসনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং
সমাজকে বিভক্ত করে এমন কোন সরকার-বিরোধী রক্তক্ষয়ী দ্বন্দ্ব ছাড়াই চলতে
পারে ভারত। (গতকাল টাইমস অব ইন্ডিয়ায় প্রকাশিত লেখার অনুবাদ)
লেখক: রুদ্রনীল ঘোষ, বর্তমানে টাইমস অব ইন্ডিয়ার সম্পাদকীয় বিভাগে কর্মরত।
লেখক: রুদ্রনীল ঘোষ, বর্তমানে টাইমস অব ইন্ডিয়ার সম্পাদকীয় বিভাগে কর্মরত।
No comments