হালাতন বিবির শীত কখনও মরে না by সিদ্দিক আলম দয়াল
রাতে
কিংবা ভোরে গ্রাম ঘুরে দেখলে চোখে পড়বে অন্য এক দৃশ্য। ছোট ছোট কুঁড়েঘরে
আগুন জ্বলছে। এর চারদিকে জবুথবু বসে আছে ৮-১০ জন। এ দৃশ্য গোটা
উত্তরাঞ্চলের গ্রাম এবং চরাঞ্চলের। বিশেষ করে তিস্তার ‘বাসন্তিরচরের’। এ
চরের হাজারো বাসিন্দা ছেঁড়া কাপড় শরীরে জড়িয়ে কাঁপছে। কুয়াশা নয়, বৃষ্টি
ঝরছে। উত্তরের হিমেল হাওয়া। তিস্তার পানিতে ভেজা ঠাণ্ডা হওয়া এসব দরিদ্র
বাসিন্দার জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছে। এরা রাতে খড়ের বিছানায় কাঁথা মুড়ি দিয়ে
ঘুমিয়ে থাকেন। বাসন্তির মতো ছেড়িমারারচরের মানুষেরও একই অবস্থা। শীত কষ্টের
এমন কথা বললেন ওই চরের বাসিন্দা হালাতন বিবি। তিনি থাকেন বাসন্তিরচরে।
পাশেই ছেড়িমারারচর। এর চারদিকে কাশবন। মাঝখানে নতুন গ্রাম। এ গ্রামেও ঘর
করেছেন বেশ ক’টি পরিবার। এদেরও সুখ কেড়ে নিয়েছে নদী। এ দুটি চরের ওপারে
কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারী। এপাড়ে গাইবান্ধা। মাঝখানে বহমান তিস্তা নদী। দুই
জেলার মধ্যখানে ২০টি চর। এসব চরের মধ্যে রমনা, ডাকাতেরচর, লাটশালারচর,
রাঘব, ছেড়িমারারচর, লালচামার, ভাটিবুড়াইলসহ ২০টি চরের মানুষ সবচেয়ে
অবহেলিত। তারা ভাল মন্দ কোন কাজেই নেই। দুর্গম এই চরাঞ্চলের মানুষ কখনো
পরিচয় দেয় গাইবান্ধা জেলার নয়তো কুড়িগ্রাম জেলার। গাইবান্ধার দরিদ্র ও
নদীভাঙনের শিকার বাসিন্দারা চরে গিয়ে ঠাঁই নিয়েছেন। ফলে এরা শুধু মাথা
গুজেই আছে। হালাতন বিবির হালহকিকত কেউ জানতে চায়নি কোনদিন। তার ১ ছেলে ৩
মেয়ে। সবার বিয়ে হয়েছে। সবার আলাদা সংসার। স্বামী মারা গেছে বেশ কয়েক বছর
আগে। এখন যেখানে রাত সেখানেই কাত। ৫-৬ বছর আগে কে যেন একটা কম্বল
দিয়েছিলেন। তখন থেকেই কষ্ট। গেলো কোরবানি ঈদে সাদা মুরগির গোশত দিয়েছে
পাশের বাড়ির লোকজন। বৃদ্ধ হালাতন বিবির কষ্টের কথা ভেবে তার এক মেয়ে তাকে
নিয়ে আসেন ব্রহ্মপুত্র নদীর বাঁধে। মেয়ে আছমারও কষ্টের সংসারে। জামাই দিন
আনে দিন খায়। মেয়ে ও জামাইর ৩ ছেলে মেয়ে নিয়ে কোনমতে দিন যায়। তবে রাতটা হয়
কষ্টের। শীতের কাপড় বলতে একটি কাঁথা। ভাঙা একটা চৌকি। পাশে থাকে বকনা
বাছুর। মেয়ে জামাই এই শীতে কোনমতো কাঁথা মুড়ি দিয়ে খড়ের বিছানায় শুয়ে পড়লেও
বৃদ্ধ হালাতন বিবির শীত মরে না। গরুর পাশে টং। সেই টংয়ে খড় দিয়ে বিছানা
হালাতন বিবির। নিচে গরম হলেও উপরে ঠাণ্ডা আর হিমেল হাওয়া তামাশা করে। চালের
পানি বৃদ্ধ হালাতনের গায়ে টপটপ করে পড়ে। সে কারণে তার ঘুম হয় না। ঠাণ্ডায়
খড়ের ওপর কাঁথা মুড়ি দিয়ে মাটিতে শুকনো গোবরে আগুন জ্বালিয়ে বসে থাকেন। বছর
দশেক পার করেছেন এভাবেই। কিন্তু তার ভাগ্যে শীতবস্ত্র বা কম্বল জোটেনি।
হালাতন বিবির কথা- ‘আল্লায় ক্যা মোক তুলি নেয় না। এই কষ্টের চায়া মরণ ভাল।’
ভাতের কষ্ট সহ্য করা গেলেও হালাতন বিবি শীতের কষ্ট সহ্য করতে পারেন না।
সুন্দরগঞ্জের তীর জুড়ে নদীভাঙা মানুষ সারি সারি করে বাঁধে ঠাই নিয়েছে।
হালাতন বিবির মতো একই অবস্থা রোকেয়া খালা, নুরুল মিয়া, সাবিনা ইয়াসমিন,
লালমতি বেওয়াসহ প্রায় ৪শ’ পরিবারের। গত ৭ই জানুয়ারি গাইবান্ধার জেলা
প্রশাসনের পক্ষ থেকে কম্বল বিতরণ করতে গিয়ে হালাতন বিবির মতো অনেক অসহায়
পরিবার প্রশাসনের নজরে আসে। কিন্তু তাদেরও কিছু করার নেই। কারণ বরাদ্দ নেই।
মাত্র কয়েকটি কম্বল দিয়েই ফিরে আসতে হয়েছে সরকারি কর্মকর্তাদের। হালাতন
বিবির ভাগ্যে এবারও কম্বল জোটেনি। তার মতো ওই এলাকার শতাধিক বাড়িতে গিয়ে
দেখা যায় শীত কাটাতে ঘরের মধ্যে খড়কুটোর আগুন অথবা শুকনো গোবরে আগুন
জ্বালিয়ে খড়ের বিছানায় শুয়ে বসে রাত কাটাচ্ছেন। ওই এলাকার ইউপি চেয়ারম্যান
সাদেকুল ইসলাম লেবু বলেন, এই নদী পারের মানুষকে শীতবস্ত্র দেয়া দরকার ।
কিন্তু তার হাতে এসেছে মাত্র ৩০টি কম্বল। তিনি আবার মেম্বারদের ৩টি করে
কম্বল ভাগ করে দিয়েছেন বিতরণের জন্য। জেলা প্রশাসক এহছানে এলাহী জানান,
এবার শীতবস্ত্র এসেছে মাত্র ১২ হাজার। সব বিতরণ করা হয়েছে। চাহিদা অনেক
বেশি। কিন্তু কুলিয়ে ওঠা যাচ্ছে না।
No comments