রাজনৈতিক অস্পৃশ্যতা ঘুচাতে এখনই সংলাপ দরকার by রুদ্রনীল ঘোষ
বাংলাদেশের
রাজনৈতিক পরিস্থিতি এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে। গত শনিবার থেকে
বিরোধী বিএনপি প্রধান বেগম খালেদা জিয়াকে তার কার্যালয়ে পুলিশ ও
নিরাপত্তারক্ষীরা অন্তরীণ রেখেছে। (তবে এই লেখার সময় জানা গেছে, অফিসের গেট
খোলা হয়েছে) কিন্তু আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তারা প্রবেশদ্বার অবরোধ করে
রাখা অব্যাহত রেখেছে। তার দল গত বছরের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রথম
বার্ষিকীতে একটি সমাবেশ ডেকেছিল। সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করেই এই পরিস্থিতির
উদ্ভব ঘটেছে। বিএনপি ও তার মিত্ররা ওই নির্বাচন বয়কট করে। যার ফলে আওয়ামী
লীগ ও তার মিত্রদের পক্ষে জয়লাভ করা সহজ হয়। এরপর থেকে বিএনপি ৫ই জানুয়ারির
নির্বাচনকে গণতন্ত্র হত্যা দিবস হিসেবে চিহ্নিত করে আসছে। কিন্তু বেগম
জিয়ার অন্তরীণ রাখাকে কেন্দ্র করে দল সারা দেশে অনির্দিষ্টকাল ধরে অবরোধের
ডাক দিয়েছে। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, গত নির্বাচনে অংশ না নিয়ে বিএনপি বিরাট
ভুল করেছে। এতে করে স্পষ্ট হয়েছে, দলটির যারা নেতৃত্বে রয়েছেন, তাদের
নেতৃত্বদান অকার্যকর ও অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে। এই নেতৃত্ব বলছে, দশম জাতীয়
নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি কারণ তা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত
হয়নি। তাদের এই দাবি শিশুসুলভ। বাংলাদেশ সংবিধানের ১৫তম সংশোধনীর মাধ্যমে
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিলোপ ঘটেছে কিন্তু সরকার ওই সংশোধনী আইনি প্রক্রিয়ায়
সম্পন্ন করেছে। পার্লামেন্টে ভোটাভুটির মাধ্যমে তা পাস হয়েছে। তখনও বিএনপি
সংসদে থেকে ওই বিল পাসের কার্যধারা বয়কট করে চলছিল। আওয়ামী লীগকে বিল
পাসে সেজন্য তেমন কোন বেগ পেতে হয়নি। এছাড়া পূর্ববর্তী সরকারের পক্ষে
তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয়ার ভাল কারণ ছিল। আওয়ামী লীগই
একদা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করেছিল। এমনকি সেজন্য তারা ১৯৯৬
সালের ষষ্ঠ সংসদ বয়কট করেছিল। এর ফলে বিএনপি বাংলাদেশের সংবিধানে
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংযোজনে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু শেষবার ২০০১
থেকে ২০০৬ সালে ক্ষমতায় থেকে বিএনপি যখন তত্ত্বাবধায়ক প্রশাসনের কাছে
ক্ষমতা হস্তান্তর করলো, তখন বিপত্তি দেখা দিলো। ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকার
গণতন্ত্রকে প্রায় ২ বছর ধরে স্থগিত করে দিলো। তারা বেগম খালেদা জিয়া এবং
বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে জেলে পুরলো। যদিও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মুখ্য কাজ
হচ্ছে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন পরিচালনা করা কিন্তু ২০০৭ সােেলর জানুয়ারি থেকে
২০০৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাংলাদেশে
গণতন্ত্রের প্রতি আঘাত হানলো। এই কারণেই পূর্ববর্তী সরকার তত্ত্বাবধায়ক
সরকার বাতিল করে দিলো। তারা যুক্তি দিলো, এই বিষয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে
দ্বিমত করতে বিএনপি’র পুরোপুরি স্বাধীনতা রয়েছে। এমনকি তারা ক্ষমতায় গিয়ে
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনরুজ্জীবনের অধিকার করতে পারে। কিন্তু
বাস্তবতা হলো আজকের যুক্তি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে
অনুপস্থিত। এবং বিএনপি যদি সত্যিই আইন প্রণয়নে সংসদের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার
করে তাহলে তাকে অবশ্যই বাস্তবতা স্বীকার করতে হবে এবং পরিবর্তিত
প্রেক্ষাপট মেনে নিয়েই তাকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে হবে। তবে এসব সত্ত্বেও
আওয়ামী লীগ বিএনপি’র সঙ্গে একটি সংলাপের উদ্যোগ না নিয়ে ভুল করেছে। সত্য
বটে, তারা নৈতিকভাবে এবং আইনগতভাবে সঠিক। কিন্তু তারা আজকের বাংলাদেশের
রাজনৈতিক গোলযোগ উপেক্ষা করতে পারে না। বিএনপি যদিও সংসদের বাইরে রয়েছে,
তদুপরি তারা জনগণের উল্লেখযোগ্য অংশের প্রতিনিধিত্ব করে। এটা এমন একটি সরল
সত্য, আওয়ামী লীগ যা এড়িয়ে যেতে পারে না। বাংলাদেশের সমাজ ইতিমধ্যেই জনগণের
রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার দিক থেকে একেবারে মাঝখান থেকে বিভক্ত হয়ে পড়েছে।
এটা বাংলাদেশী গণতন্ত্রের জন্য একেবারেই স্বাস্থ্যকর নয়। রক্তস্নাত এবং
ডামাডোলপূর্ণ ইতিহাসে এফোঁড়-ওফোঁড় হওয়া বাংলাদেশ যদি এখন সমৃদ্ধি ও সামনের
দিকে অগ্রসর হতে চায়, তাহলে তাকে এই বিভক্তির মধ্যে সেতু স্থাপন করতে হবে।
এটা সুখপ্রদ যে, বাংলাদেশের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও জাতীয় পার্টির প্রধান
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ মতপার্থক্য ঘুচাতে সংলাপের জন্য সকল দলকে বৈঠকে বসতে
আহ্বান জানিয়েছেন। বাংলাদেশের এখন দারুণভাবে একটি নতুন রাজনৈতিক ঐকমত্য
দরকার। সেটা কেবল গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার স্বাভাবিকীকরণের জন্য নয়। বিদেশী
বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার স্বার্থেও দরকার। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে
রাজনৈতিক অস্পৃশ্যতা ঘুচিয়ে ফেলার এখনই সময়। (গতকালের টাইমস অব ইন্ডিয়া থেকে)।
No comments