লেজারুসের ইকারুস হতে চাওয়া by জয়া ফারহানা
রঞ্জু
ভুলেও কখনও এ বাড়িতে পা রাখতে চায় না। এ বাড়ি মানে পর্শিয়াদের বাড়ি আর কী।
এ রকম একটা সাহিত্য-বিদ্বেষী পরিবারের মেয়ের নাম কী করে পর্শিয়া হয়ে গেল,
সেও এক রহস্যই রঞ্জুর কাছে। যা হোক, পর্শিয়ার সঙ্গে আপনারা পরিচিত হয়ে নিন।
পর্শিয়া হল রঞ্জুর বউ। তিন মাস হল তাদের বিয়ে হয়েছে। তবে বিয়েটাকে নিজের
মতো করে ভাবার ফুরসত হয়নি তার। হবে কীভাবে? ফিরানির দিন থেকেই পর্শিয়ার
আত্মীয়দের তরফে লাগাতার দাওয়াত চলছে। দাওয়াত-ফাওয়াতের ঝামেলা রঞ্জুর একদম
ভালো লাগে না। বড়লোক বাড়িতে তো মোটেই না। নাহ সেটা এ রকম কোনো নীতিগত কারণে
নয় যে, একটা বড়লোকের বাড়িতে ঢুকে পড়লে তার মনে হয় সে দেশের সেয়ানা এক
চোরের বাড়িতে ঢুকে পড়েছে। ব্যাপারটা মোটেও এমন নয়। বরং রঞ্জু তো মনে মনে
ঠিক প্ল্যান করে রেখেছে, কোনোদিন সুযোগ পেলে সেও দু-একটা ব্যাংক সাফা করে
দেবে অথবা অন্য দেশের কোম্পানির স্বার্থ-টার্থ দেখে একটা বড় দাও মেরে দেবে।
তারপর এই এদের মতো অ্যান্টিক ফায়ার প্লেসের পাশে বসে মাখন মাখানো পমফ্রেট
মাছ খেতে খেতে বলবে কি যেন বাচ্চাটার নাম, ও হ্যাঁ জিহাদ...। এই যে
বাচ্চাটা জিহাদ, একে আমরা সবাই মিলে ঝুলেই খুন করে ফেললাম। আহা, পৌষালী
সুখের আলাপ। রঞ্জু, পর্শিয়াদের নেট ঘেরা বারান্দায় বসে বুনো মশাদের কামড়
খেতে খেতে ভাবছিল, আশ্চর্য কী এত আলাপ এদের। রঞ্জু আসলে নিজে বড়লোক না হতে
পারার বিরক্তিতে ঠিক খেয়াল করেনি, লিভিং রুমে পর্শিয়ার কাজিন বিএ সিদ্দিকীর
লম্বা আলাপের জন্য নয় বরং তার আশ্চর্য হওয়ার কথা ছিল এটা ভেবে যে, এ ঘন
বুনোটের নেট ভেদ করে কী কর বুনো মশারা ঢুকে পড়েছিল পর্শিয়াদের এ ছমছমে
অভিজাত বারান্দায়। কিংবা কে জানে রঞ্জু হয়তো বিরক্ত হচ্ছিল পর্শিয়ার বাসায়
ফেরার গরজ না দেখে। রঞ্জু আরও আশ্চর্য হল এটা ভেবে যে, এ বাড়ির-ই এক অতি
জরুরি সদস্য ডিলিরিয়ামের ঘোরের মধ্যে এখনও আর এটার লিভিং রুম থেকে ড্রইংরুম
পর্যন্ত রীতিমতো টকশো-র আসর বসিয়ে দিয়েছে। এদের আলাপেও দেখি যার পর নাই
বিসঙ্গতি। জিনিসপত্রের দাম কী ভীষণ বেড়ে যাচ্ছে, রঞ্জু বিড় বিড় করে বলল
তাতে তোদের কী শালারা। আবার অন্য আরেকজনের এই ভেবে রাতে ঘুম হচ্ছে না যে,
কিছু দিন পরপরই ব্যাংকে কেন এক একটা অকারেঞ্জ ঘটছে। রঞ্জু আবার ফিস ফিস করে
বলল তোদের কারণেই তো। রঞ্জুর প্রথমে বিএ সিদ্দিকী তারপর পর্শিয়ার ওপর খুব
রাগ হল। আবার শোনা যাচ্ছে বি এ সিদ্দিকীর গলা। সে এখন কথা বলছে শাহজালালে
ধরা পড়া স্মাগসলড গুডস নিয়ে। এই শালা আবার যেন কোনো মিনিস্টারের ভাইপো না
ভাগনে। পর্শিয়া যে এর সঙ্গে এত তেলতেলে মেজাজে কথা বলছে তাকি খালি রঞ্জুকে
কাজটা পাইয়ে দেয়ার জন্য? আসার পথে অবশ্য বলছিল বুঝলা, বরকত ভাইকে যেভাবেই
হোক ম্যানেজ করতেই হবে। বরকত মানে আবুল বরকত। এবি সিদ্দিকী। তো বরকত ভাই
সম্পর্কে জানার পর রঞ্জুর ছটফটানিটা বাড়ে। তার মুখে থু থু চলে আসে। গাড়ির
জানালা দিয়ে একদলা থু থু ফেলে সে তখনও নিজেকে সোনানোর মতো স্বরে বলছিল
‘শালা আবুল বরকতের নামে একটা লোক অ্যায়সা হারামি হতে পারে! পর্শিয়া শুনতে
না পেয়ে বলল ‘রঞ্জু, রঞ্জু নটি বয় ... কী বল? কবিতা? রঞ্জু উত্তর করল
হ্যাঁ। বন্ধু-বান্ধবরা ভাবতে শুরু করেছে পর্শিয়াকে বিয়ে করে সে বোধ হয়
তাদের ভুলতে বসেছে। হায় রে! রঞ্জুর এ বিয়োগান্তক বিয়ের কাহিনী জানে কেবল সে
নিজে। কালচারাল শক জিনিসটা কি এতদিনে বুঝেছে সে। বউয়ের ইচ্ছা মাফিক সে তার
রুচি ইমপ্র“ভ করতে পারছে না। পার্শিয়ার দাবি সে যেন একটু ফিটফাট হয়ে এসে
শ্বশুরবাড়ির সবাইকে ইমপ্রেস করে। কিন্তু রঞ্জু ঠিক পেরে উঠছে না। পর্শিয়ার
চাওয়া, সে অন্তত কয়েকদিন দিন-রাত এখানে পড়ে থেকে তার বাবার বি অ্যান্ড সি
লিমিটেডের ফানির্শড বাড়ি, ভালো গাড়ি আর যা যা দরকার সব কিছুর পাকা
বন্দোবস্ত করে। রঞ্জুর আব্বা-মা-র ও চাওয়া তাই। বড়লোকের মেয়ে বিয়ে করে সে
ভালো রকম ফ্যাসাদেই পড়েছে। বাপ-মা হালুম হয়ে আছে ছেলের বড় লোক শ্বশুরের
জিনিসপত্র দিয়ে ঘর ভর্তি করার। তা এসব অশান্তিতে রঞ্জুর রাতের ঘুমটাও গেছে।
আর ঘুম না হওয়া মানে হ্যাং ওভার। হ্যাংওভার মানে খিটখিটে মেজাজ। আর খিট
খিটে মেজাজ মানে অধীনস্থদের ওপর খানিক ঝাড়ি। তো মুশকিল হল রঞ্জুর অধীনস্থ
কেউ তেমন নেই। বলতে গেলে সে পিওর বেকার-ই। কিন্তু শ্বশুর বাড়িতে নিজের
পেশাগত পরিচয় লুকাতে তার কাল ঘাম ছুটে যায়। কাজ কিছু করে সে কিন্তু তার
কোনোটাই পরিচয় দেয়ার মতো নয়। আবার কাজ যা করে সে সেগুলোকে কাজ না বলে
দালালি বললেই যুৎসই প্রয়োগটা হয়। কিন্তু দালালিও তো আবার বলা যায় না।
শ্বশুর বাড়িতে এই যে এখানে এসে সে দিন-রাত পড়ে থাকছে পর্শিয়া যাকে বলে
জাস্ট ইমপ্রেশনটা ভালো করা। কিন্তু রঞ্জুর তো ধারণা এভাবে দিন-রাত শুয়ে-বসে
কাটানোর জন্য ইমপ্রেশন বরং দিন দিন নাই হয়ে যাচ্ছে তার। যেটুকু ছিল বিয়ের
সময়, তাও গেছে এ ক’মাসে। রঞ্জু বনানী গির্জার পাশের নিঃসঙ্গ জলপাই গাছটার
দিকে তাকিয়ে ভাবে বড় লোক তাকে হতেই হবে। বড়লোক হতে হবে আবুল বরকতের ওপর
প্রতিশোধ নেয়ার জন্য। রঞ্জু কী করবে, যখন তখন আবুল বরকতকে তার মারতে ইচ্ছা
করে। ঠিক সেই সময় একটা গোল্ডলিফ ধরানোয় প্রতিশোধের দাবি আরও বাড়তে থাকে। এই
শালা তার বেডরুম পর্যন্ত হানা দিয়েছে। রাতে যখন পর্শিয়ার মধ্যে একটু খানি
বেড়াল ভাব আসে তখনিই সে খালি আবুল বরকতের প্রতি সামান্য ইন-কাইন্ড সিলিং
আসে। আবার পর্শিয়া যখন জেলি মাখানো গলায় বলতে শুরু করে জানো বরকত ভাই বলে
সেক্সুয়াল ইন্টারফোর্স ইন দি আর্লি মর্নিং কিপস ইওর ফিগার স্লিম। দপ করে
রঞ্জুর মাথায় আগুন জ্বলে ওঠে। শালা কোথাকার কোন বরকত ভাই তার উপদেশ মাফিক
এখন রঞ্জুকে তার সেক্সুয়াল রুটিন ঠিক করতে হবে? খালি তাই? সলিড সেগুন কাঠ
কোথায় পাওয়া যায় থেকে শুরু করে কয় আউন্স পরিমাণ মদ খেলে চিন্তা পরিষ্কার হয়
তা পর্যন্ত এ ভদ্রলোক এই পরিবারকে লেকচার দিয়ে ফেলেছে। রঞ্জুরও বুঝতে সময়
লেগেছে কেন প্লেয়িং ফিল্ডয়ের লেভেলে এত সুন্দর সমতা থাকার পরও পর্শিয়া কেন
তার এ বি সিদ্দিকী ভাই কে বিয়ে না করে তার মতো একটা এইম লেস লাইফ লেস
ছেলেকে বিয়ে করে বসল। সেই পর্শিয়া যার নাকি হাতের আঙুল, চোখের পাতা পাপড়ি
ভঙ্গিটি পর্যন্ত নিখুঁত। সেই বীর কেন পর্শিয়াকে বিয়ে করল না আর রঞ্জু কেন
রাম ভোদাইয়ের মতো এ বি সিদ্দিকীর বীজ পাহারা দিয়ে যাচ্ছে, রঞ্জুই কি ভালো
মতো জানে তা? ক’টা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হাতিয়ে নেয়ার জন্য? আবার একটা
গোল্ডলিফ ধরায় রঞ্জু। কী বোকা-ই বা ভাবে তাকে পর্শিয়া।
আর? আর কিছুও কি ভাবে সে? লোভী? হ্যাঁ লোভী তো ভাবেই পর্শিয়া। ভাবুক। রঞ্জু জানে কেন সে লোভী হয়েছে। সে গরিব বলে পর্শিয়া কি তাকে ঠকায়নি? হ্যাঁ পর্শিয়া কে ভালো বেসেছে। দেখতে সুন্দর মেয়েদের সবাই-ই বাসে। রঞ্জু হয়তো সবার চেয়ে কিছু বেশিই বেসেছে। পর্শিয়াকে সে পাবে না জেনেই বেসেছে। সেই না পাওয়ার মধ্যে অন্তত গ্লানি থাকত না। কিন্তু এখন যা হল তাতে তো রঞ্জুর জীবনটা যাকে বলে, একদম ছ্যাড়া-ব্যাড়া হয়ে গেল। পর্শিয়াকে না পাওয়ার পিওর দুঃখ নিয়ে সে অন্তত কবিতা লিখতে পারত। আর এখন যা করতে পারে তা কেবল খুন। আবার সেই খুনের জন্যও তার কোনো প্রস্তুতি নেই। সে অস্ত্র চালাতে জানে না। তার পয়সা নেই। খুন-খারাবি নিয়ে আলাপ করবে, তাকে বুদ্ধি পরামর্শ দেবে এমন কোনো বন্ধুও তার নেই। চেনা-জানার মধ্যে তাকে একটুখানি পছন্দ করে; থাকার মধ্যে এমন আছে খালি মারুফ। সরকারবিরোধী একটা পত্রিকার সিনিয়র সাব-এডিটর। বেতন মাসের কুড়ি তারিখেও হয় না। বোনাস হিসেবে আছে চাকরি যাওয়ার হুমকি। সম্পাদক নাকি টেবিলে অফিসের সবার নামের লিস্টি রেখে দিয়েছেন। যারা যারা ছাঁটাই হবে তাদের তালিকা আর কী। পর্শিয়া ভাবে, রঞ্জু মানে তার স্বামীটা বেশ ভালোই পেয়েছে। বেশ অনুগত। সারা দিন সে চকোলেট মুখের বালিকাদের মতো আহ্লাদ করে কথা বলবে এ বি সিদ্দকীর সঙ্গে আর রঞ্জু বারান্দায় বসে বসে পাহারা দেবে। পর্শিয়ার ভাবনা অবশ্য একেবারে ভুলও নয়। রঞ্জু তো পাহারাদার-ই। এ বি সিদ্দিকী আর পর্শিয়ার সন্তান পাহারা দিচ্ছে। এখন যেমন আবার পাহারা দিচ্ছে পর্শিয়া আর এবি সিদ্দিকীকে। বারান্দা থেকে কান খাড়া করে সে। এবি সিদ্দিকী গলায় মাখন মাখিয়ে বলছে বুঝলে সেই যে হ্যাভার স্যাক কাঁধে নিয়ে প্রতি দিন অন্তত দুই মাইল দৌড়াতে হতো। পর্শিয়া হেসে প্রায় তার কাঁধের ওপর গিয়ে পড়ে আর কী। হ্যাভার স্যাক কাঁধে দৌড়ানোর সঙ্গে হাসির সম্পর্কটা কী। রঞ্জুর হাত নিশপিশ করছে। একটা ফ্যামিলি সাইজের রড এনে যদি এবি’র মাথার তালুর বরাবর ...। মাথা ফুঁড়ে দিব্যি ভেতরে ঢুকে যেত। এবি সিদ্দিকীর ফিনকী দিয়ে রক্তের ধারা ছুটছে এ দৃশ্য কল্পনায় আপাতত সান্ত্বনা নিয়ে ভেতরে ঢুকল রঞ্জু। এবি সিদ্দিকীর গলায় আন্তরিক উষ্ণতা। আরে বসেন রঞ্জু। আমার রেজিমেন্টেড রুটিনের কথা বলছিলাম। তো সেই দুই মাইল হাঁটার পর পনের মিনিটের ফ্রি হ্যান্ড এক্সার সাইজ। তারপর প্যারেড। তারপর ব্রেকফার্স্ট। ম্যাপ রিভিউয়ের ক্লাস, লাইট মেশিন-গান শুটিং, লেপার্ড-ক্রলিং শেখা। এক হাতে রাইফেল নিয়ে প্রায় শুয়ে হামাগুড়ি দিয়ে বুকে হেঁটে রুক্ষ পাথুরে কংকর পথে কল্পিত শত্রুর দিকে চিতাবাঘের মতো চতুর হয়ে এগোনো ...। তারপর সিগন্যাল ক্লাস, ব্রেক। লাঞ্চ। ফের ক্লাস। বিকাল চারটার টি-টাইম। তারপর একটু ব্রেক। এরপর ক্যাম্প ফায়ার। রাত ৯টার মধ্যে লাইটস অফ। তো এসব ...
নির্দোষ কথাবার্তা শুনেও রাগ কমল না রঞ্জুর। তার খালি মনে হতে থাকল এইভাবে হবে না। এবিকে মারতে হলে মারতে হবে তার নিজের হাতে। রঞ্জুর মনে হতে থাকে এ বাড়ির চারদিকের দেয়াল যেন তার অক্ষমতাকে ভেংচি কাটছে। খুনের ভাবনায় চমকে উঠে রঞ্জু দেখে যে, আবুল বরকত না কথা বলছে তার শ্বশুর আবুল হাসেম। দু’জনের কথার মধ্যেই ঝিমুনি ধরে রঞ্জুর। আবুল বরকত আবার সেই রকম মোলয়েম স্বরে বলে রঞ্জু বোধ হয় আমাদের পারপাসটা ঠিক ধরতে পারনি। রঞ্জুর মনে হতে থাকে কেউ তার বুকে লাথি মারছে। বারান্দায় রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে পর্শিয়া।
সে তাকিয়ে ছিল উদাসীন। রঞ্জু ওই উদাসীন দৃষ্টিকে সাক্ষী করে মনে মনে বলল, তুমি ভেব না পর্শিয়া যে পুরুষ এমন হতভাগ্য দোষ তারই। তোমার কোনো দোষ নেই। তারপর সোজা চলে এলো ছাদে, যেখানে আবুল বরকত আর আবুল হাসেম পলিটিক্স নিয়ে আলাপ করছে। পলিটিক্সে রঞ্জুর ইন্টারেস্ট কম। তবু সে প্ল্যান করেছে আজ রাতে আবুল হাসেমকে খুউব তোয়াজ করবে সে। তারপর খাওয়া-দাওয়া। ফের গল্প। গল্প করা কী আর এমন কঠিন কাজ। তুললেই হল একটা প্রসঙ্গ। আবুল হাসেমের পার্টি সরকারে নেই। সুতরাং গল্প করার হাজারটা টপিক আছে। এই যেমন কার গাফিলতিতে জিহাদ মরল? আজকাল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোও হয়েছে সেই রকম ফেরেববাজ অথবা বলা যেতে পারে প্রশাসন কীরকম চেপে যেতে চেয়েছিল বা জিহাদকে কেন্দ্র করে জনতার জাগরণ। জনতার জাগরণ জাতীয় টপিক অবশ্য আবুল হাসেমের ভালো লাগবে না। থাক এসব ঝুঁকিপূর্ণ টপিক এড়িয়ে সে বরং বলতে পারে পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ওই রকম চৌকস ব্যাটেলিয়নের চোখ এড়িয়ে শিয়াল কোট সীমান্ত পার হয়ে কীভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। এ টপিকটাই সম্ভবত আবুল হাসেমের সবচেয়ে প্রিয়। কারণ বলতে শুরু করলে আর কোনো দিকেই তার মনোযোগ থাকে না। হ্যাঁ শিয়াল কোটের দু’পাশেই তো পাহাড় বুঝলে, রাতের অন্ধকারে জঙ্গলের মধ্যে হাঁটতে হবে দশ মাইলের মতো। আমরা ক’জন বাঙালি আর্মি অফিসার পালিয়ে এসেছিলাম। চেকপোস্টে মিলিটারি চেকিংয়ের ভয়। তারপর পেট্রল আর রেকি করার গল্প। বহুবার শোনা। শুনতে শুনতে এমন কায়দায় মুখস্থ হয়েছে রঞ্জুর যে এ গল্প যদি সে কারও কাছে করে তবে তার বয়স বিবেচনায় না আনলে যে কেউ-ই ভাববে সে মুক্তিযোদ্ধা। তালমা ব্রিজের ২০০ গজ সামনে পানি মাছ-হাঁড়ি ভাসা জেলা বোর্ডের রাস্তার ওপর ১৫ ফুট স্প্যানের কালভার্টটি কীভাবে উড়িয়ে দেয়া হল সে গল্প তো গড়গড় করে সে বলে দিতে পারে।
তা এসব শুনে রঞ্জুর ফায়দা কী? বরং রঞ্জুকে যদি আবুল হাসেম বলত, রঞ্জু তুমি আমার ফেমাস বেঙ্গল কোম্পানির প্যাকেজ অ্যান্ড প্রিন্ট সেকশনটা দ্যাখো...। এরকম একটা অফার দিলে খেটে-খুটে ব্যবসাটাকে সে ঠিক দাঁড় করিয়ে ফেলতে পারত। কিন্তু আবুল হাসেমের কাছে রঞ্জুর চাকরির চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় তার অ্যালসেশিয়ানটার ঠিকঠাক এক্সার সাইজ করানো। অ্যালসেশিয়ানের শরীরে একটুখানি বাড়তি মেদ জমেছে কি জমেনি অমনি আবুল হাসেম তৎপর হয়ে ওঠেন। এ আসগর টুম্পাকে জগিং করানো হয়েছে কি না, এ আসগর টুম্পার বাওয়েল ক্লিয়ার হল কি না, এই আসগর ডাক্তারকে ফোনে আসতে বলত, এসে দেখে যাক টুম্পার স্টমাক ঠিকঠাক কি না। টুম্পা হল আবুল হাসেমের কুকুর আর আসগর কুকুর দেখনেওয়ালা। এ বাড়িতে অবশ্য কুকুরকে কুকুর বলে না। আবুল হাসেম ডাকেন নটি গার্ল। কেন সে নটি গার্ল কে জানে তা। রঞ্জু তো তার মধ্যে নটি কিছু দেখে না। বেশ শান্ত, চুপচাপ, বাওয়েলও বেশ ক্লিয়ার। আর তাকে যদি নটি গার্ল নামেই ডাকা হবে তো টুম্পা নাম-ই বা রাখা কেন? অবশ্য টুম্পা নামে তার অধরা প্রেমিকা ছিল কি না, রঞ্জু তা জানে না। রঞ্জু দিনের শেষ সিগারেট ধরায়। যা হোক আজকে একটা এসপার-ওসপার করে ফেলতে হবে, এরকমই সিদ্ধান্ত তার। ড্রইং রুমে আবার সবাই আলাপে মত্ত। দূর থেকে দেখে রঞ্জু ভাবে বোধহয় খুব সিরিয়াস কিছু। ডিলিরিয়ামের রোগীর কিছু হল নাকি। কাচে আসতে রঞ্জুর কাছে বিষয়টা পরিষ্কার হল। না, রঞ্জু নয় তার ব্যবসা বা চাকরিও নয়। জিহাদ প্রসঙ্গও চাপা পড়ে গেছে। তারা আলাপ করছে টুম্পার কন্সট্রিপেশনের সমস্যা নিয়ে।
আর? আর কিছুও কি ভাবে সে? লোভী? হ্যাঁ লোভী তো ভাবেই পর্শিয়া। ভাবুক। রঞ্জু জানে কেন সে লোভী হয়েছে। সে গরিব বলে পর্শিয়া কি তাকে ঠকায়নি? হ্যাঁ পর্শিয়া কে ভালো বেসেছে। দেখতে সুন্দর মেয়েদের সবাই-ই বাসে। রঞ্জু হয়তো সবার চেয়ে কিছু বেশিই বেসেছে। পর্শিয়াকে সে পাবে না জেনেই বেসেছে। সেই না পাওয়ার মধ্যে অন্তত গ্লানি থাকত না। কিন্তু এখন যা হল তাতে তো রঞ্জুর জীবনটা যাকে বলে, একদম ছ্যাড়া-ব্যাড়া হয়ে গেল। পর্শিয়াকে না পাওয়ার পিওর দুঃখ নিয়ে সে অন্তত কবিতা লিখতে পারত। আর এখন যা করতে পারে তা কেবল খুন। আবার সেই খুনের জন্যও তার কোনো প্রস্তুতি নেই। সে অস্ত্র চালাতে জানে না। তার পয়সা নেই। খুন-খারাবি নিয়ে আলাপ করবে, তাকে বুদ্ধি পরামর্শ দেবে এমন কোনো বন্ধুও তার নেই। চেনা-জানার মধ্যে তাকে একটুখানি পছন্দ করে; থাকার মধ্যে এমন আছে খালি মারুফ। সরকারবিরোধী একটা পত্রিকার সিনিয়র সাব-এডিটর। বেতন মাসের কুড়ি তারিখেও হয় না। বোনাস হিসেবে আছে চাকরি যাওয়ার হুমকি। সম্পাদক নাকি টেবিলে অফিসের সবার নামের লিস্টি রেখে দিয়েছেন। যারা যারা ছাঁটাই হবে তাদের তালিকা আর কী। পর্শিয়া ভাবে, রঞ্জু মানে তার স্বামীটা বেশ ভালোই পেয়েছে। বেশ অনুগত। সারা দিন সে চকোলেট মুখের বালিকাদের মতো আহ্লাদ করে কথা বলবে এ বি সিদ্দকীর সঙ্গে আর রঞ্জু বারান্দায় বসে বসে পাহারা দেবে। পর্শিয়ার ভাবনা অবশ্য একেবারে ভুলও নয়। রঞ্জু তো পাহারাদার-ই। এ বি সিদ্দিকী আর পর্শিয়ার সন্তান পাহারা দিচ্ছে। এখন যেমন আবার পাহারা দিচ্ছে পর্শিয়া আর এবি সিদ্দিকীকে। বারান্দা থেকে কান খাড়া করে সে। এবি সিদ্দিকী গলায় মাখন মাখিয়ে বলছে বুঝলে সেই যে হ্যাভার স্যাক কাঁধে নিয়ে প্রতি দিন অন্তত দুই মাইল দৌড়াতে হতো। পর্শিয়া হেসে প্রায় তার কাঁধের ওপর গিয়ে পড়ে আর কী। হ্যাভার স্যাক কাঁধে দৌড়ানোর সঙ্গে হাসির সম্পর্কটা কী। রঞ্জুর হাত নিশপিশ করছে। একটা ফ্যামিলি সাইজের রড এনে যদি এবি’র মাথার তালুর বরাবর ...। মাথা ফুঁড়ে দিব্যি ভেতরে ঢুকে যেত। এবি সিদ্দিকীর ফিনকী দিয়ে রক্তের ধারা ছুটছে এ দৃশ্য কল্পনায় আপাতত সান্ত্বনা নিয়ে ভেতরে ঢুকল রঞ্জু। এবি সিদ্দিকীর গলায় আন্তরিক উষ্ণতা। আরে বসেন রঞ্জু। আমার রেজিমেন্টেড রুটিনের কথা বলছিলাম। তো সেই দুই মাইল হাঁটার পর পনের মিনিটের ফ্রি হ্যান্ড এক্সার সাইজ। তারপর প্যারেড। তারপর ব্রেকফার্স্ট। ম্যাপ রিভিউয়ের ক্লাস, লাইট মেশিন-গান শুটিং, লেপার্ড-ক্রলিং শেখা। এক হাতে রাইফেল নিয়ে প্রায় শুয়ে হামাগুড়ি দিয়ে বুকে হেঁটে রুক্ষ পাথুরে কংকর পথে কল্পিত শত্রুর দিকে চিতাবাঘের মতো চতুর হয়ে এগোনো ...। তারপর সিগন্যাল ক্লাস, ব্রেক। লাঞ্চ। ফের ক্লাস। বিকাল চারটার টি-টাইম। তারপর একটু ব্রেক। এরপর ক্যাম্প ফায়ার। রাত ৯টার মধ্যে লাইটস অফ। তো এসব ...
নির্দোষ কথাবার্তা শুনেও রাগ কমল না রঞ্জুর। তার খালি মনে হতে থাকল এইভাবে হবে না। এবিকে মারতে হলে মারতে হবে তার নিজের হাতে। রঞ্জুর মনে হতে থাকে এ বাড়ির চারদিকের দেয়াল যেন তার অক্ষমতাকে ভেংচি কাটছে। খুনের ভাবনায় চমকে উঠে রঞ্জু দেখে যে, আবুল বরকত না কথা বলছে তার শ্বশুর আবুল হাসেম। দু’জনের কথার মধ্যেই ঝিমুনি ধরে রঞ্জুর। আবুল বরকত আবার সেই রকম মোলয়েম স্বরে বলে রঞ্জু বোধ হয় আমাদের পারপাসটা ঠিক ধরতে পারনি। রঞ্জুর মনে হতে থাকে কেউ তার বুকে লাথি মারছে। বারান্দায় রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে পর্শিয়া।
সে তাকিয়ে ছিল উদাসীন। রঞ্জু ওই উদাসীন দৃষ্টিকে সাক্ষী করে মনে মনে বলল, তুমি ভেব না পর্শিয়া যে পুরুষ এমন হতভাগ্য দোষ তারই। তোমার কোনো দোষ নেই। তারপর সোজা চলে এলো ছাদে, যেখানে আবুল বরকত আর আবুল হাসেম পলিটিক্স নিয়ে আলাপ করছে। পলিটিক্সে রঞ্জুর ইন্টারেস্ট কম। তবু সে প্ল্যান করেছে আজ রাতে আবুল হাসেমকে খুউব তোয়াজ করবে সে। তারপর খাওয়া-দাওয়া। ফের গল্প। গল্প করা কী আর এমন কঠিন কাজ। তুললেই হল একটা প্রসঙ্গ। আবুল হাসেমের পার্টি সরকারে নেই। সুতরাং গল্প করার হাজারটা টপিক আছে। এই যেমন কার গাফিলতিতে জিহাদ মরল? আজকাল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোও হয়েছে সেই রকম ফেরেববাজ অথবা বলা যেতে পারে প্রশাসন কীরকম চেপে যেতে চেয়েছিল বা জিহাদকে কেন্দ্র করে জনতার জাগরণ। জনতার জাগরণ জাতীয় টপিক অবশ্য আবুল হাসেমের ভালো লাগবে না। থাক এসব ঝুঁকিপূর্ণ টপিক এড়িয়ে সে বরং বলতে পারে পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ওই রকম চৌকস ব্যাটেলিয়নের চোখ এড়িয়ে শিয়াল কোট সীমান্ত পার হয়ে কীভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। এ টপিকটাই সম্ভবত আবুল হাসেমের সবচেয়ে প্রিয়। কারণ বলতে শুরু করলে আর কোনো দিকেই তার মনোযোগ থাকে না। হ্যাঁ শিয়াল কোটের দু’পাশেই তো পাহাড় বুঝলে, রাতের অন্ধকারে জঙ্গলের মধ্যে হাঁটতে হবে দশ মাইলের মতো। আমরা ক’জন বাঙালি আর্মি অফিসার পালিয়ে এসেছিলাম। চেকপোস্টে মিলিটারি চেকিংয়ের ভয়। তারপর পেট্রল আর রেকি করার গল্প। বহুবার শোনা। শুনতে শুনতে এমন কায়দায় মুখস্থ হয়েছে রঞ্জুর যে এ গল্প যদি সে কারও কাছে করে তবে তার বয়স বিবেচনায় না আনলে যে কেউ-ই ভাববে সে মুক্তিযোদ্ধা। তালমা ব্রিজের ২০০ গজ সামনে পানি মাছ-হাঁড়ি ভাসা জেলা বোর্ডের রাস্তার ওপর ১৫ ফুট স্প্যানের কালভার্টটি কীভাবে উড়িয়ে দেয়া হল সে গল্প তো গড়গড় করে সে বলে দিতে পারে।
তা এসব শুনে রঞ্জুর ফায়দা কী? বরং রঞ্জুকে যদি আবুল হাসেম বলত, রঞ্জু তুমি আমার ফেমাস বেঙ্গল কোম্পানির প্যাকেজ অ্যান্ড প্রিন্ট সেকশনটা দ্যাখো...। এরকম একটা অফার দিলে খেটে-খুটে ব্যবসাটাকে সে ঠিক দাঁড় করিয়ে ফেলতে পারত। কিন্তু আবুল হাসেমের কাছে রঞ্জুর চাকরির চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় তার অ্যালসেশিয়ানটার ঠিকঠাক এক্সার সাইজ করানো। অ্যালসেশিয়ানের শরীরে একটুখানি বাড়তি মেদ জমেছে কি জমেনি অমনি আবুল হাসেম তৎপর হয়ে ওঠেন। এ আসগর টুম্পাকে জগিং করানো হয়েছে কি না, এ আসগর টুম্পার বাওয়েল ক্লিয়ার হল কি না, এই আসগর ডাক্তারকে ফোনে আসতে বলত, এসে দেখে যাক টুম্পার স্টমাক ঠিকঠাক কি না। টুম্পা হল আবুল হাসেমের কুকুর আর আসগর কুকুর দেখনেওয়ালা। এ বাড়িতে অবশ্য কুকুরকে কুকুর বলে না। আবুল হাসেম ডাকেন নটি গার্ল। কেন সে নটি গার্ল কে জানে তা। রঞ্জু তো তার মধ্যে নটি কিছু দেখে না। বেশ শান্ত, চুপচাপ, বাওয়েলও বেশ ক্লিয়ার। আর তাকে যদি নটি গার্ল নামেই ডাকা হবে তো টুম্পা নাম-ই বা রাখা কেন? অবশ্য টুম্পা নামে তার অধরা প্রেমিকা ছিল কি না, রঞ্জু তা জানে না। রঞ্জু দিনের শেষ সিগারেট ধরায়। যা হোক আজকে একটা এসপার-ওসপার করে ফেলতে হবে, এরকমই সিদ্ধান্ত তার। ড্রইং রুমে আবার সবাই আলাপে মত্ত। দূর থেকে দেখে রঞ্জু ভাবে বোধহয় খুব সিরিয়াস কিছু। ডিলিরিয়ামের রোগীর কিছু হল নাকি। কাচে আসতে রঞ্জুর কাছে বিষয়টা পরিষ্কার হল। না, রঞ্জু নয় তার ব্যবসা বা চাকরিও নয়। জিহাদ প্রসঙ্গও চাপা পড়ে গেছে। তারা আলাপ করছে টুম্পার কন্সট্রিপেশনের সমস্যা নিয়ে।
No comments