লড়াই হবে হাড্ডাহাডি
৩০ ডিসেম্বর, ২০১৪। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সপ্তাহ খানেক বাকি। রাজধানী কলম্বোতে কয়েকজন জ্যোতিষীর সঙ্গে ছোট্ট একটা বৈঠক সেরে নিলেন প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপক্ষে। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন নিজের ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টাও। হিসাব-নিকাশ কষে ওই জ্যোতিষীরা একবাক্যে রাজাপক্ষের জয়ের পূর্বাভাস দিলেন। শ্রীলঙ্কায় আজ অনুষ্ঠেয় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের লড়াইটা কতটা হাড্ডাহাড্ডি হবে ওই জ্যোতিষীদের তলব করা হয়তো তারই প্রমাণ। জ্যোতিষীরা মুখে রাজাপক্ষের জয়ের ব্যাপারে খই ফোটালেও আড়ালে স্বীকার করছেন তাঁরা চাকরি হারানো নিয়ে শঙ্কিত।
কয়েক মাস আগেও কেউ ঘুণাক্ষরে চিন্তা করেনি, শ্রীলঙ্কার এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের লড়াইটা এতটা হাড্ডাহাড্ডি হবে। রাজাপক্ষের চেহারায় তখন অজেয় ভাব। ২০০৯ সালে বিদ্রোহী গোষ্ঠী লিবারেশন টাইগার্স অব তামিল ইলমকে (এলটিটিই) পর্যুদস্ত করে কয়েক দশকের গৃহযুদ্ধের অবসান করেছিলেন তিনিই। পুরস্কারস্বরূপ ২০১০ সালের নির্বাচনে ৫৮ শতাংশের বেশি ভোট পেয়ে দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। আর একই বছরের সেপ্টেম্বর নাগাদ পার্লামেন্টের দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসনও তাঁর দলের দখলে চলে যায়। জনসমর্থন আরও বাড়তে পারে, এমন ধারণা থেকেই রাজাপক্ষে কয়েক মাস আগে আগাম নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। গত আগস্ট মাসে এক বৈঠকে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে আমি দুশ্চিন্তা করি না। আমি আগামী পাঁচ বছর এবং তারও পরের মেয়াদগুলো নিয়ে এখন পরিকল্পনা করছি।’ রাজাপক্ষের আন্দাজ ছিল, নির্বাচন হলে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে পাবেন হয় রানিল উইকরামসিংহে বা সাবেক প্রেসিডেন্ট চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গাকে। উইকরামসিংহেকেই ২০০৫ সালের নির্বাচনে পরাজিত করে প্রথম ক্ষমতার স্বাদ নিয়েছিলেন রাজাপক্ষে। আর দলের সাবেক জ্যেষ্ঠ নেতা কুমারাতুঙ্গাকে সুকৌশলে হারিয়ে দিয়েই তিনি প্রেসিডেন্ট পদে লড়ার টিকিট পেয়েছিলেন। এই দুজনের একজনকে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে পেলে রাজাপক্ষে সহজেই নির্বাচনী বৈতরণী পার হয়ে যাবেন বলেই অনুমান করা হচ্ছিল। তবে রাজাপক্ষের সব হিসাব-নিকাশের গোলমাল হয়ে গেছে নিজ দল থেকে পক্ষত্যাগের মিছিল শুরু হওয়ায়। এই মিছিলের নেতৃত্বে ছিলেন মাইথ্রিপালা সিরিসেনা,
যিনি ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে রাজাপক্ষের ডানহাত ছিলেন। দুই মাস আগেও তিনি রাজাপক্ষের রাজনৈতিক দল শ্রীলঙ্কা ফ্রিডম পার্টির (এসএলএফপি) সাধারণ সম্পাদকের পদে ছিলেন। পক্ষ ত্যাগ করেই সিরিসেনা রাজাপক্ষের বিরুদ্ধে দেশকে স্বৈরতন্ত্রের দিকে নিয়ে যাওয়া এবং পরিবারতন্ত্র কায়েম করার অভিযোগ তোলেন। এরপর ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টির নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোট সিরিসেনাকে নিজেদের প্রার্থী ঘোষণা করলে নির্বাচনী লড়াইয়ের হিসাব পাল্টে যায়। সিরিসেনা মূলত তিনটি ঘটনায় ভোটারদের মধ্যে রাজাপক্ষবিরোধী যে মনোভাব সৃষ্টি হয়েছে, তা নির্বাচনী প্রচারণায় কাজে লাগিয়েছেন। প্রথমটি হচ্ছে, রাজাপক্ষের একনায়কসুলভভাবে ২০১০ সালে সংবিধান সংশোধন করে তৃতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হওয়ার পথ পরিষ্কার করা। দ্বিতীয়ত, প্রেসিডেন্টের নিজের তিন ভাইকে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়ে ‘স্বজনপ্রীতির’ বড় নজির সৃষ্টি করা। তৃতীয় বিষয়টি হচ্ছে, রাজাপক্ষের শাসনামলে দুর্নীতির লাগামছাড়া অবস্থা। পাশাপাশি রয়েছে দেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতা। গৃহযুদ্ধ অবসান ঘটার সময়কার গড় জাতীয় প্রবৃদ্ধি মাত্র ২ শতাংশ থেকে গত বছরের শেষ নাগাদ ৭ দশমিক ৭ শতাংশে উঠেছে, এটা সত্য। তবে তা সত্ত্বেও মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরতে পারেনি সরকার। দেশের সবচেয়ে বড় সংখ্যালঘু গোষ্ঠী তামিলরা না চাইলেও সিরিসেনাকে ভোট দেবেন। রাজাপক্ষের শাসনের অবসান ঘটার আশাতেই সিরিসেনাকে ভোট দেবেন তাঁরা। তামিল রাজনৈতিক নেতারা আগেই সেই ঘোষণা দিয়েছেন।
No comments