হারানের নাতজামাই : শিল্পী ও বিপ্লবী মানিকের সম্মিলন by রাজীব সরকার
গল্পকার
হিসেবেই বাংলাসাহিত্যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের আবির্ভাব। এরপর উপন্যাস
রচনাতেও তিনি অনন্য শিল্প সাফল্যের পরিচয় দিয়েছেন। সাহিত্যচর্চার
প্রারম্ভিক পর্বে মনস্তাত্বিক দর্শনকে ধারণ করেছেন, ফ্রয়েডের একান্ত
অনুসারী হিসেবে বিপন্ন মূল্যবোধ ও বিধ্বস্ত নৈতিকতার বিশ্বস্ত ছবি এঁকেছেন।
এখানেই যদি তিনি থেমে যেতেন, তাহলেও তার অমরত্ব ঘুচে যেত না। তিনি আরেক
ধাপ অগ্রসর হলেন। মার্কসীয় দর্শন তথা বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদী দৃষ্টিতে তিনি
তার সাহিত্যকর্মে জগৎ ও জীবনকে ব্যাখ্যা করলেন এবং এ ক্ষেত্রে তার মতো
উঁচুদরের সাফল্য আর কেউ অর্জন করতে পারেননি। প্রথমে ফ্রয়েড পরবর্তী সময়ে
মার্কস গভীর প্রভাব বিস্তার করেছেন মানিকের চিন্তাজগতে। কোনো সময়েই মানিক
পরিমিতিবোধের অভাব ঘটতে দেননি তার রচনায়, শিল্পমানকে কখনোই ক্ষুণœ করেননি।
ফ্রয়েডীয় দর্শনকে অনুসরণ করতে গিয়ে সমকালীন কবি-লেখকদের কেউ কেউ যখন
নিজেদের সাহিত্যকে যৌনতাসর্বস্ব ও স্থূল করে তুলেছেন, তখনও মানিক আশ্চর্য
সংযমী। ‘প্রাগৈতিহাসিক’-এর মতো চিরস্মরণীয় গল্প এবং ‘চতুষ্কোণ’ এর মতো
অভিনব উপন্যাস এর জ্বলন্ত প্রমাণ। যৌনতাকে নিজের লেখা প্রতিষ্ঠার মূল
হাতিয়ার হতে তিনি কখনোই দেননি। আবার যখন মার্কসের অনুসারী হয়েছেন তখনও তার
কলম সস্তা প্রচারধর্মী রচনায় মনোনিবেশ করেনি। তৎকালীন মার্কসবাদী
তাত্ত্বিক-লেখকদের অনেকেই যখন শ্রেণীচেতনার নামে ফরমায়েশি সাহিত্য রচনা
করেছেন পার্টির নির্দেশ মেনে, মানিক তখনও লেখকের স্বাধীনতাকে বিন্দুমাত্র
বিসর্জন না দিয়ে শ্রেণীচেতনার অসাধারণ প্রতিফলন ঘটিয়েছেন তার বিভিন্ন
গল্প-উপন্যাসে। অথচ তিনি ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। কিন্তু পার্টির
তলপিবাহক হয়ে সাহিত্যচর্চা করেননি। শিল্পীসত্তা ও বিপ্লবীসত্তার অসাধারণ
ভারসাম্য রক্ষা করেছেন জীবনের শেষদিন পর্যন্ত। মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন,
কডওয়েলের রচনা মানিক বন্দ্যোপধ্যায় নিষ্ঠার সঙ্গে পাঠ করেছেন। বুখারিনের
ঐতিহাসিক বস্তুবাদ সম্পর্কে ধারণা অর্জন করেছেন। গভীর অনুশীলন ও পঠন-পাঠনের
মধ্য দিয়ে নিজের জীবনদর্শন নির্মাণ করেছেন। মার্কসবাদের অনুসারী হয়ে
সমাজের নিুশ্রেণীর কৃষক-শ্রমিক ও নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর জীবনসংগ্রামকে ফুটিয়ে
তুলেছেন তার বিভিন্ন গল্পে। ব্যক্তিকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখার
কলাকৈবল্যবাদী বিলাসিতায় তিনি গা ভাসাননি। মানবকল্যাণের আকাক্সক্ষায় তিন
সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন। ‘শিল্পী’, ‘ছোট বকুলপুরের যাত্রী’, ‘কংক্রিট’,
‘হারানের নাতজামাই’-এর মতো গল্প লিখে মানিক প্রমাণ করেছেন নিজের
শিল্পীসত্তাকে বিসর্জন না দিয়েও শ্রেণীসংগ্রামের নিখুঁত পরিচয় সাহিত্যে
প্রতিফলিত করা সম্ভব। মানিকের এ প্রয়াসের সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ ‘হারানের
নাতজামাই’।
‘হারানের নাতজমাই’ গল্পটি ১৯৪৯ সালে প্রকাশিত হয়। এর কিছুদিন আগে সংঘটিত হয় রক্তক্ষয়ী তেভাগা আন্দোলন। গল্পটি পাঠশেষে বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না নিপীড়িত কৃসকশ্রেণীর সংগঠিত আন্দোলনের প্রতিফলন ঘটেছে এ গল্পে। অথচ গল্পটিতে কোন রাজনৈতিক প্রসঙ্গ নেই, তেভাগার কথাও নেই। অপূর্ব শৈল্পিক সংযমে মানিক এই গল্পটিকে উন্নীত করেন কালোত্তীর্ণ মাত্রায়। ভুবন মণ্ডল, ময়নার মা, ময়না, গফুর আলির মতো চরিত্রগুলো বিপ্লবমানসের প্রতীক হয়ে উঠেছে গল্পটিতে।
গল্পের শুরুতে দেখা যায়, মাঝরাতে সালিগঞ্জ গ্রামে নব্বই বছরের বৃদ্ধ হারানের বাড়ি ঘিরে ফেলে পুলিশ। সঙ্গে জোতদার চণ্ডী ঘোষের লোক কানাই ও শ্রীপতি। সঙ্গে কয়েকজন লাঠিয়াল। রেইডিং পার্টির অতিউৎসাহী নায়ক মন্মথও তাদের সঙ্গী। পুলিশ নিশ্চিত হয়ে এসেছে ওয়ারেন্টপ্রাপ্ত আসামী ভুবন মণ্ডল হারানের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। কৃষকের ধানের তথা জমির অধিকারের জন্য লড়ে ভুবন পরিণত হয়েছে তাদের প্রাণপ্রিয় নেতায়। গ্রামের ভেতর থেকেই যে কেউ তাকে ধরিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্র করেছে তা বুঝতে বাকি থাকে না কারও। ‘এ বজ্জাতি গোপন থাকবে না’ প্রতিবাদী গফুর আলি সেই বিশ্বাসঘাতককে দেখে নেয়ার হুমকি দেয়।
গ্রামবাসী বসে থাকে না। লাঠি, সড়কি, দা, কুড়াল নিয়ে সংঘবদ্ধ হয়ে তারা হাজির হয় হারানের বাড়িতে। বিপদ আঁচ করতে পেরে হারানের মেয়ে অর্থাৎ ময়নার মা নিজের মেয়ের ঘরে আশ্রিত ভুবন মণ্ডলকে লুকিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। ভুবনকে মেয়ের জামাইয়ের অভিনয় করতে বলে। এ প্রস্তাব শুনে হতভম্ব মেয়েকে নাট্যমঞ্চের নির্দেশকের মতোই ময়নার মা বলে, ‘ঘোমটা দিবি। লাজ দেখাবি। জামাইয়ের কাছে যেমন দেখাস’ অত্যন্ত চাতুর্যের সঙ্গে পুলিশের সামনে পরিস্থিতি সামাল দেয় ময়নার মা। এ কাজে তার পারদর্শিতার প্রমাণ আগেও পেয়েছে গ্রামবাসী। কিছুদিন আগে দুপুরবেলা পুরুষশূন্য গ্রামে পুলিশ আমন্ত্রণ করলে ঝাঁটা বঁটি হাতে মেয়ের দল নিয়ে ময়নার মা তাদের তাড়িয়ে দেয় গ্রাম থেকে। চোখের সামনে ময়না ও ভুবন মণ্ডল এক ঘরে ঢুকে ঝাঁপটা ফেলে দিলে পুলিশের সন্দেহ থাকে না যে এরা স্বামী-স্ত্রী। ব্যর্থ মনোরথে তারা ফিরে যায়।
ফিরে যাওয়ার পথেই পুলিশ বুঝতে পারে তারা প্রতারিত হয়েছে। ময়নার ঘরে ভুবনের রাত কাটানোর ঘটনা নানা ডালপালায় সঞ্চারিত হয়ে মুখরোচক ঘটনায় পরিণত হয়। ক্ষুব্ধ পুলিশ পথ থেকে ময়নার যুবক ভাইকে ধরে নিয়ে যায়। এরই মধ্যে হারানের বাড়িতে এসে উপস্থিত হয় তার আসল নাতজামাই জগমোহন। পরপুরুষের সঙ্গে স্ত্রীর রাত কাটানোর রসালো ঘটনা শুনে সে ক্ষুব্ধ। ময়না ও ময়নার মা দু’জনেই তাকে বোঝানোর চেষ্টা করে ভুবন মণ্ডল গ্রামের অন্নদাতা, সবার বাবার মতো। তাকে নিজের ঘরে কিছুক্ষণের জন্য আশ্রয় দিয়ে ময়না কোনো অন্যায় করেনি। জগমোহন কিছুই শুনতে চায় না, তার ক্রোধ প্রশমিত হয় না। ময়না ভেঙে পড়ে, কিন্তু ময়নার মা অটল থাকে। তেজস্বিনী ব্যক্তিত্বের অধিকারী ময়নার মা জোরের সঙ্গে বলে, কোনো অনুচিত কাজ ময়না করেনি। এমন দৃঢ়চেতা মা বাংলাসাহিত্যে বিরল। ধীরে ধীরে জগমোহন শান্ত হয়। পুলিশ আবার হানা দেয় হারানের বাড়িতে। এবার ময়নার সঙ্গে দণ্ডায়মান তার স্বামী জগমোহন। ময়নার নতুন জামাইয়ের পরিচয় পেয়ে পুলিশ ও মন্মথ অশ্লীল রসিকতা শুরু করে। মন্মথ লোলুপ দৃষ্টিতে ময়নাকে নিরীক্ষণ করে এবং তার অঙ্গ স্পর্শ করতে উদ্যত হয়। মুহূর্তের মধ্যেই প্রতিবাদে গর্জে ওঠে জগমোহন এবং প্রতিবাদী গ্রামবাসী মিছিলে সেও শামিল হয়। অগণিত গ্রামবাসী তীব্র প্রতিরোধর মুখে হারানসহ তার বাড়ির সবাইকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তাদের নিয়ে গ্রাম ছাড়ার পথেই ঘটে বিপত্তি-
‘...দলে দলে লোক ছুটে আসে চারিদিক থেকে; জমায়েত মিনিটে মিনিটে বড় হচ্ছে। মথুরার ঘর পার হয়ে পানা-পুকুরটা পর্যন্ত গিয়ে আর এগোনো যায় না। কালের চেয়ে সাত-আট গুণ বেশি লোক পথ আটকায়। রাত বেশি হয়নি, শুধু এ গাঁয়ের নয়, আশপাশের গাঁয়ের লোক ছুটে এসেছে। এটা ভাবতে পারেনি মন্মথ। মণ্ডলের জন্য হলে মানে বোঝা যেত, হারানের বাড়ির লোকের জন্য চারিদিকের গাঁ ভেঙে মানুষ এসেছে। মানুষের সমুদ্রের, ঝড়ের উত্তাল সমুদ্রের সঙ্গে লড়া যায় না।’
উত্তাল জনসমুদ্রের সামনে নিপীড়কের অসহায় আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে এ গল্পের সমাপ্তি ঘটেছে। এ গল্পে কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দর্শনের স্লোগান নেই, নেই কোনো রাজনৈতিক তত্ত্বের কচকচানি। অথচ সমগ্র গল্পটি হয়ে উঠেছে শোষকের বিরুদ্ধে শোষিতের অপরাজেয় প্রতিরোধের প্রতীক। শত দুঃখ, দারিদ্র্য, বঞ্চনার মধ্যেও সাধারণ মানুষ তাদের বিবেক ধর্মকে বিসর্জন দেয়নি। তাদের ধান বাঁচানোর জন্য যে ভুবন মণ্ডল লড়ে যাচ্ছে অত্যাচারীর বিরুদ্ধে, সেই ভুবনের জন্য তারা প্রাণ দিতে প্রস্তুত। এ আত্মাহুতির পালায় কোনো একক নায়কত্ব নেই, আছে সামষ্টিক প্রতিরোধের চেতনা। প্রথাসিদ্ধ একক নায়কের গৌরব বর্জন করে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এখানে গণমানুষের নায়কত্বকে শৈল্পিক সুষমা দান করেছেন। ভুবন, ময়না, ময়নার মা, জগমোহন- প্রত্যেকই নায়কোচিত ভূমিকায় ভূষিত। সাহিত্যের শৈল্পিক দাবিকে সামান্যতম ক্ষুণ্ন না করেও যে রাজনৈতিক অঙ্গীকার দীপ্ত গল্প লেখা যায় ‘হারানের নাতজামাই’ এর উৎকৃষ্ট প্রমাণ, বাংলা সাহিত্যে সম্ভবত উৎকৃষ্টতমও। মানিকের শিল্পী ও বিপ্লবী মানসের অসামান্য সম্মিলন ‘হারানের নাতজামাই’।
‘হারানের নাতজমাই’ গল্পটি ১৯৪৯ সালে প্রকাশিত হয়। এর কিছুদিন আগে সংঘটিত হয় রক্তক্ষয়ী তেভাগা আন্দোলন। গল্পটি পাঠশেষে বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না নিপীড়িত কৃসকশ্রেণীর সংগঠিত আন্দোলনের প্রতিফলন ঘটেছে এ গল্পে। অথচ গল্পটিতে কোন রাজনৈতিক প্রসঙ্গ নেই, তেভাগার কথাও নেই। অপূর্ব শৈল্পিক সংযমে মানিক এই গল্পটিকে উন্নীত করেন কালোত্তীর্ণ মাত্রায়। ভুবন মণ্ডল, ময়নার মা, ময়না, গফুর আলির মতো চরিত্রগুলো বিপ্লবমানসের প্রতীক হয়ে উঠেছে গল্পটিতে।
গল্পের শুরুতে দেখা যায়, মাঝরাতে সালিগঞ্জ গ্রামে নব্বই বছরের বৃদ্ধ হারানের বাড়ি ঘিরে ফেলে পুলিশ। সঙ্গে জোতদার চণ্ডী ঘোষের লোক কানাই ও শ্রীপতি। সঙ্গে কয়েকজন লাঠিয়াল। রেইডিং পার্টির অতিউৎসাহী নায়ক মন্মথও তাদের সঙ্গী। পুলিশ নিশ্চিত হয়ে এসেছে ওয়ারেন্টপ্রাপ্ত আসামী ভুবন মণ্ডল হারানের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। কৃষকের ধানের তথা জমির অধিকারের জন্য লড়ে ভুবন পরিণত হয়েছে তাদের প্রাণপ্রিয় নেতায়। গ্রামের ভেতর থেকেই যে কেউ তাকে ধরিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্র করেছে তা বুঝতে বাকি থাকে না কারও। ‘এ বজ্জাতি গোপন থাকবে না’ প্রতিবাদী গফুর আলি সেই বিশ্বাসঘাতককে দেখে নেয়ার হুমকি দেয়।
গ্রামবাসী বসে থাকে না। লাঠি, সড়কি, দা, কুড়াল নিয়ে সংঘবদ্ধ হয়ে তারা হাজির হয় হারানের বাড়িতে। বিপদ আঁচ করতে পেরে হারানের মেয়ে অর্থাৎ ময়নার মা নিজের মেয়ের ঘরে আশ্রিত ভুবন মণ্ডলকে লুকিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। ভুবনকে মেয়ের জামাইয়ের অভিনয় করতে বলে। এ প্রস্তাব শুনে হতভম্ব মেয়েকে নাট্যমঞ্চের নির্দেশকের মতোই ময়নার মা বলে, ‘ঘোমটা দিবি। লাজ দেখাবি। জামাইয়ের কাছে যেমন দেখাস’ অত্যন্ত চাতুর্যের সঙ্গে পুলিশের সামনে পরিস্থিতি সামাল দেয় ময়নার মা। এ কাজে তার পারদর্শিতার প্রমাণ আগেও পেয়েছে গ্রামবাসী। কিছুদিন আগে দুপুরবেলা পুরুষশূন্য গ্রামে পুলিশ আমন্ত্রণ করলে ঝাঁটা বঁটি হাতে মেয়ের দল নিয়ে ময়নার মা তাদের তাড়িয়ে দেয় গ্রাম থেকে। চোখের সামনে ময়না ও ভুবন মণ্ডল এক ঘরে ঢুকে ঝাঁপটা ফেলে দিলে পুলিশের সন্দেহ থাকে না যে এরা স্বামী-স্ত্রী। ব্যর্থ মনোরথে তারা ফিরে যায়।
ফিরে যাওয়ার পথেই পুলিশ বুঝতে পারে তারা প্রতারিত হয়েছে। ময়নার ঘরে ভুবনের রাত কাটানোর ঘটনা নানা ডালপালায় সঞ্চারিত হয়ে মুখরোচক ঘটনায় পরিণত হয়। ক্ষুব্ধ পুলিশ পথ থেকে ময়নার যুবক ভাইকে ধরে নিয়ে যায়। এরই মধ্যে হারানের বাড়িতে এসে উপস্থিত হয় তার আসল নাতজামাই জগমোহন। পরপুরুষের সঙ্গে স্ত্রীর রাত কাটানোর রসালো ঘটনা শুনে সে ক্ষুব্ধ। ময়না ও ময়নার মা দু’জনেই তাকে বোঝানোর চেষ্টা করে ভুবন মণ্ডল গ্রামের অন্নদাতা, সবার বাবার মতো। তাকে নিজের ঘরে কিছুক্ষণের জন্য আশ্রয় দিয়ে ময়না কোনো অন্যায় করেনি। জগমোহন কিছুই শুনতে চায় না, তার ক্রোধ প্রশমিত হয় না। ময়না ভেঙে পড়ে, কিন্তু ময়নার মা অটল থাকে। তেজস্বিনী ব্যক্তিত্বের অধিকারী ময়নার মা জোরের সঙ্গে বলে, কোনো অনুচিত কাজ ময়না করেনি। এমন দৃঢ়চেতা মা বাংলাসাহিত্যে বিরল। ধীরে ধীরে জগমোহন শান্ত হয়। পুলিশ আবার হানা দেয় হারানের বাড়িতে। এবার ময়নার সঙ্গে দণ্ডায়মান তার স্বামী জগমোহন। ময়নার নতুন জামাইয়ের পরিচয় পেয়ে পুলিশ ও মন্মথ অশ্লীল রসিকতা শুরু করে। মন্মথ লোলুপ দৃষ্টিতে ময়নাকে নিরীক্ষণ করে এবং তার অঙ্গ স্পর্শ করতে উদ্যত হয়। মুহূর্তের মধ্যেই প্রতিবাদে গর্জে ওঠে জগমোহন এবং প্রতিবাদী গ্রামবাসী মিছিলে সেও শামিল হয়। অগণিত গ্রামবাসী তীব্র প্রতিরোধর মুখে হারানসহ তার বাড়ির সবাইকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তাদের নিয়ে গ্রাম ছাড়ার পথেই ঘটে বিপত্তি-
‘...দলে দলে লোক ছুটে আসে চারিদিক থেকে; জমায়েত মিনিটে মিনিটে বড় হচ্ছে। মথুরার ঘর পার হয়ে পানা-পুকুরটা পর্যন্ত গিয়ে আর এগোনো যায় না। কালের চেয়ে সাত-আট গুণ বেশি লোক পথ আটকায়। রাত বেশি হয়নি, শুধু এ গাঁয়ের নয়, আশপাশের গাঁয়ের লোক ছুটে এসেছে। এটা ভাবতে পারেনি মন্মথ। মণ্ডলের জন্য হলে মানে বোঝা যেত, হারানের বাড়ির লোকের জন্য চারিদিকের গাঁ ভেঙে মানুষ এসেছে। মানুষের সমুদ্রের, ঝড়ের উত্তাল সমুদ্রের সঙ্গে লড়া যায় না।’
উত্তাল জনসমুদ্রের সামনে নিপীড়কের অসহায় আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে এ গল্পের সমাপ্তি ঘটেছে। এ গল্পে কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দর্শনের স্লোগান নেই, নেই কোনো রাজনৈতিক তত্ত্বের কচকচানি। অথচ সমগ্র গল্পটি হয়ে উঠেছে শোষকের বিরুদ্ধে শোষিতের অপরাজেয় প্রতিরোধের প্রতীক। শত দুঃখ, দারিদ্র্য, বঞ্চনার মধ্যেও সাধারণ মানুষ তাদের বিবেক ধর্মকে বিসর্জন দেয়নি। তাদের ধান বাঁচানোর জন্য যে ভুবন মণ্ডল লড়ে যাচ্ছে অত্যাচারীর বিরুদ্ধে, সেই ভুবনের জন্য তারা প্রাণ দিতে প্রস্তুত। এ আত্মাহুতির পালায় কোনো একক নায়কত্ব নেই, আছে সামষ্টিক প্রতিরোধের চেতনা। প্রথাসিদ্ধ একক নায়কের গৌরব বর্জন করে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এখানে গণমানুষের নায়কত্বকে শৈল্পিক সুষমা দান করেছেন। ভুবন, ময়না, ময়নার মা, জগমোহন- প্রত্যেকই নায়কোচিত ভূমিকায় ভূষিত। সাহিত্যের শৈল্পিক দাবিকে সামান্যতম ক্ষুণ্ন না করেও যে রাজনৈতিক অঙ্গীকার দীপ্ত গল্প লেখা যায় ‘হারানের নাতজামাই’ এর উৎকৃষ্ট প্রমাণ, বাংলা সাহিত্যে সম্ভবত উৎকৃষ্টতমও। মানিকের শিল্পী ও বিপ্লবী মানসের অসামান্য সম্মিলন ‘হারানের নাতজামাই’।
No comments