কুলাউড়ায় ট্রেন লাইনচ্যুত- তদন্ত কমিটি, প্রকৌশলী সাসপেন্ড by ইমাদ উদদীন, মাসুদ আহমেদ ও আলাউদ্দিন কবির
মৌলভীবাজারের
কুলাউড়ায় ভয়াবহ দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে সিলেট থেকে ছেড়ে আসা চট্টগ্রামগামী
আন্তঃনগর উদয়ন এক্সপ্রেস ট্রেন। ট্রেনের ৭টি বগি লাইনচ্যুত হয়েছে।
দুর্ঘটনায় অর্ধশতাধিক যাত্রী আহত হয়েছে। দুর্ঘটনার পর থেকে সারা দেশের
সঙ্গে সিলেটের ট্রেন যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে ৪ সদস্যের
একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। একইসঙ্গে শ্রীমঙ্গলের উপ-সহকারি
প্রকৌশলী (পথ) আলী আযমকে কর্তব্যে অবহেলার কারণে সাসপেন্ড করা হয়েছে।
কুলাউড়া রেলওয়ে জংশন স্টেশন মাস্টার মির্জা মো. শামসুল ইসলাম জানান, সিলেট
থেকে বুধবার রাত সাড়ে ১০টায় চট্টগ্রামের উদ্দেশে ছেড়ে আসে উদয়ন এক্সপ্রেস।
মাইজগাঁও স্টেশনে আসার পর ট্রেনটিতে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেয়। ত্রুটি
সারিয়ে ৩টায় কুলাউড়া স্টেশনে পৌঁছায়। কুলাউড়া স্টেশন ছেড়ে যাওয়ার পর রাত
আনুমানিক সাড়ে ৩টায় টিলাগাঁও ও মনু রেলওয়ে স্টেশনের মাঝখানে দুর্ঘটনা কবলিত
হয়। এতে ট্রেনের ইঞ্জিনসহ ৬টি বগি লাইনচ্যুত হয়। বগিগুলো হলো- ৮৪৯৭, ৯১৭১,
৮৩০৯, ৭০১১, ২১৪৩ ও ৯৩৯৬। তবে দুটি বগি পার্শ্ববর্তী জমিতে ছিটকে পড়ে। এতে
কমপক্ষে ৩০ জন আহত হয়েছে। আহতদের উদ্ধার করে কুলাউড়া ও মৌলভীবাজার সদর
হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। দুর্ঘটনার কারণে ৮টি ট্রেন কুলাউড়াসহ পার্শ্ববর্তী
বিভিন্ন স্টেশনে আটকা পড়েছে। সিলেট রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ ও ট্রেনের চালক
সূত্রে জানা যায়, বুধবার রাতে চট্টগ্রামগামী উদয়ন আন্তঃনগর ট্রেন সিলেট
রেলস্টেশন থেকে ছেড়ে মাইজগাঁও স্টেশনে পৌঁছে। এ সময় এক যাত্রী চালককে
জানান, রেলের একটি বগিতে শব্দ হচ্ছে। তখন তিনি মাইজগাঁও স্টেশন ছেড়েছে
মাত্র। সেখানেই চালক ট্রেন থামিয়ে দেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কিছু ত্রুটির
আলামত দেখে সিলেটে নির্ধারিত বিভাগের (যান্ত্রিক বিভাগ) প্রকৌশলীদের ব্রেক
গিয়ার সমস্যার কথা জানান। সেখান থেকে উপসহকারী প্রকৌশলী শ্রীপদ দত্ত ও মো.
শাহীন হোসেন ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ইঞ্জিনের সঙ্গে থাকা
বগির পরবর্তী বগির বাফার হেড ল্যুজ দেখে গ্যালভানাইজ তার দিয়ে বেঁধে নিরাপদ
ঘোষণা দেন। চালক আবুল কালাম জানান, প্রকৌশলীদের নিকট থেকে মৌখিক ছাড়পত্র
পাওয়ার পর ১টা ৫৫ মিনিটে মাইজগাঁও স্টেশন ছাড়েন। তারপর আবার কুলাউড়া
স্টেশনে পৌঁছে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ত্রুটিমুক্ত মনে হওয়ায় ২টা ৩৬ মিনিটে
স্টেশন ছাড়া হয়। পরে ইছবপুর নামক স্থানে ২টা ৫৮ মিনিটে দুর্ঘটনায় পড়ে। এ
সময় ৬টি বগি লাইনচ্যুত হয়ে কাত হয়ে যায়। একটি বগি ছিটকে পড়ে পার্শ্ববর্তী
ধানিজমিতে। পুলিশ ও রেলওয়ে সূত্র জানিয়েছে, এ সময় কমপক্ষে ৩০ জন যাত্রী আহত
হন। দুর্ঘটনার খবর পেয়ে কুলাউড়া পুলিশ ও ফায়ার ব্রিগেডের কর্মীরা
ঘটনাস্থলে পৌঁছে উদ্ধারকাজ শুরু করেন। খবর জানাজানি হলে আশপাশের গ্রামের
লোকজনও ছুটে আসেন। গতকাল ঘটনাস্থলে গেলে কথা হয় এ ট্রেনের প্রথম শ্রেণীর
যাত্রী কুলাউড়ার রাতগাঁওয়ের আবদুল হকের সঙ্গে। তিনি জানান, তিনি সিলেট থেকে
আসছিলেন। মাইজগাঁও স্টেশনের সামান্য দূরে আসার পর ত্রুটি দেখা দিলে তিনিসহ
অনেক যাত্রী নেমে পড়েন এবং চালককে অনুরোধ করেন ট্রেন না ছাড়তে। কিন্তু
চালক তাদের অনুরোধ রাখেন নি। আবদুল হক আরও জানান, তিনি ও অনেক যাত্রী
বিকল্প পথে বাড়ি ফেরেন। তারপর জানতে পারেন এ দুর্ঘটনার কথা। ঘটনাস্থলে কথা
হয় সিলেট রেলওয়ের যান্ত্রিক বিভাগের উপসহকারী প্রকৌশলী শ্রীপদ দত্ত ও মো.
শাহীন হোসেনের সঙ্গে। তারা জানান, মাইজগাঁও স্টেশনে ত্রুটি ধরা পড়ার পর তা
সারানো হয়। এখানে দুর্ঘটনার মূল কারণ স্যাবোটাজ। তাদের দাবি, দুর্বৃত্তরা
১০ ফুট রেল তোলে নেয়ায় এবং ৩টি ফিশ প্লেট খুলে নেয়ায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। এ সময়
কুলাউড়া থানার পুলিশ রেলের এই প্রকৌশলীদের দাবির প্রতিবাদ করে ঘটনাস্থলেই
তর্কে জড়িয়ে পড়ে। কুলাউড়া থানার এএসআই বাশার ঘটনার পরপরই ঘটনাস্থলে পৌঁছে
যা দেখেন তা তাদের সামনে তুলে ধরেন। এ সময় চালক তাকে জানিয়েছেন, ত্রুটির
কারণেই এ ঘটনা ঘটেছে। তখন পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, তারা আহত যাত্রী এবং
অন্যদের সঙ্গে আলাপ করে স্যাবোটাজের কোন আলামত পাননি। কারণ এ রেলপথ দিয়ে
অল্পকিছুক্ষণ আগে উপবন ট্রেনটি সিলেট থেকে ছেড়ে যায়। যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা
দেয়ার পর উদয়নের অনেক যাত্রী মাইজগাঁও থেকে এ উপবন চড়ে নিজ গন্তব্যে যায়।
এর কিছু সময় পড়েই উদয়ন দুর্ঘটনায় পড়ে। তখন প্রকৌশলীরা তাদের দাবির পক্ষে
যুক্তি দেখিয়ে বলেন, পুলিশ বগির বাফার হেড গ্যালভানাইজ তার দিয়ে বেঁধে
চালানোর কথা বললেও এ কারণে দুর্ঘটনা ঘটেনি। তখন সরজমিন দেখা গেছে, দুই
নম্বর বগির বাফার হেডে সাদা গ্যালভানাইজ তার দিয়ে মুড়ানো ছিল। এ সময় সহকারী
প্রকৌশলী শাহিন হোসেন বলেন, বাফার হেড কিছু ল্যুজ থাকায় এটি বাঁধা হয়। তার
দাবি, এটি প্রচলিত নিয়ম। এ সময় একই দাবি করেন সিলেট রেলের সহকারী নির্বাহী
প্রকৌশলী মুজিবুর রহমান। তিনি এ সময় জোর দিয়ে বলেন, এটি মূলত স্যাবোটাজ।
ট্রেনের কোন ত্রুটির কারণে এ ঘটনা ঘটেনি। এদিকে গতকাল মৌলভীবাজার পুলিশ
সুপার তোফায়েল আহমদ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে জানিয়েছেন, এটি স্যাবোটাজ বলে
মনে হয়নি। তিনি আরও বলেন, তার দিয়ে বেঁধে ট্রেন চালানো ঠিক হয়নি। কিছু
যাত্রী মাইজগাঁও নেমে যাওয়ায় এবং ট্রেনের গতি কম থাকায় হতাহতের সংখ্যা কম
হয়েছে। কুলাউড়া স্টেশন মাস্টার মির্জা শামছুল আলম জানিয়েছেন, প্রাথমিকভাবে
ধারণা করা হচ্ছে, এটি নাশকতা। জানা গেছে, রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ এ ঘটনায় বিভাগীয়
পরিবহন কর্মকর্তা নাজমুল ইসলামকে প্রধান করে ৪ সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি
গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে ৫ দিনের মধ্যে রিপোর্ট দেয়ার কথা বলা হয়েছে। কমিটি
প্রধান নাজমুল ইসলাম গতকাল জানিয়েছেন, তিনি ঘটনাস্থলে আছেন এবং কাজ শুরু
করেছেন।
No comments