আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের প্রবন্ধ by রাজীব সরকার
বাংলা
কথাসাহিত্যে সমাজবাদী বিশ্লেষণে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে কেন তিনি সবচেয়ে
সফল মনে করেন তা অনুমান করা কঠিন নয়। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে
ইলিয়াসের পর্যবেক্ষণ তার নিজের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য
গল্পে-উপন্যাসে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস যে শিখরস্পর্শী সাফল্য পেয়েছেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এ নিয়ে দুই বাংলায় বিস্তর লেখালেখি হয়েছে এবং যোগ্য স্বীকৃতিও তিনি পেয়েছেন। গল্পে-উপন্যাসে লেখকের জীবনদর্শন খুঁজে পাওয়া কঠিন নয়, কিন্তু তা বহুমাত্রিক হতে বাধ্য। একই লেখকের ভিন্ন ভিন্ন গল্পে-উপন্যাসে ভিন্ন জীবনদর্শন বা বিশ্বাসের প্রতিফলন ঘটে। প্রবন্ধ সাহিত্যেই একজন বড় লেখকের গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও জীবনদর্শনের পরিচয় মেলে। তাই ‘গীতাঞ্জলি’ বা ‘সোনার তরী’র’ রবীন্দ্রনাথের চেয়ে ‘কালান্তর’ বা ‘সভ্যতার সংকট’ এর রবীন্দ্রনাথ অধিকতর নৈর্ব্যক্তিক ও বাস্তব। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ক্ষেত্রেও অন্যথা ঘটেনি। বর্তমান রচনার উদ্দেশ্য প্রাবন্ধিক ইলিয়াসের বৈভবকে তুলে ধরা।
ইলিয়াসের সাহিত্যের মনোযোগী পাঠক জানেন, আরোপিত ঔচিত্যবোধ, নৈতিকতা, আশাবাদ থেকে মুক্ত হয়ে মানুষকে তার সম্ভাবনা ও বিলয়ের বিপরীতে সম্পূর্ণ দর্পণে ধারণ করাই তার জীবনদর্শন। তার নিজের ভাষায়-
‘যে লেখক মানুষকে যত সাহসের সঙ্গে তার টোটালিটিতে ধরবেন তিনিই তো পাঠককে তত বেশি ইন্সপায়ার করবেন মনে করি। লেখায় মানুষের সম্পূর্ণটুকু দেখতে চাই, সবকিছু। টোটাল ট্রুথের মুখোমুখি হতে চাই। ...কাউকে জাস্টিফাই করার দরকার নেই। যে যেমন সেই পারসপেকটিভে তাকে দেখাতে হবে। মানুষকে আমি যেমন দেখতে চাই সেটা বড় কথা নয় মানুষ কেমন আছে, সেটা বড়। সেখান থেকেই তার স্বপ্ন, তার সম্ভাবনা সবই দেখা যাবে। সমাজবিজ্ঞান, দর্শন বা মনস্তত্ত্ব মানুষকে যতটুকু দেখাতে পারে সাহিত্য তো আমি মনে করি আরেকটু এগিয়েই দেখাতে পারে।’
তার এ উপলব্ধির প্রতিফলন দেখা যায় প্রতিটি প্রবন্ধে। তার কলমে ‘বাংলা ছোট গল্প কি মরে যাচ্ছে’, ‘সংস্কৃতির ভাঙা সেতু’, ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাগী চোখের স্বপ্ন’, ‘সায়েবদের গান্ধি’ প্রভৃতি প্রবন্ধ সমকালীন প্রবন্ধসাহিত্যে বিশিষ্ট সংযোজন। ইলিয়াসের বক্তব্যের সঙ্গে সবসময় সহমত পোষণ করা কঠিন এবং সেটি তার অন্বিষ্ট নয়। কিন্তু তার চিন্তার নির্যাসকে অস্বীকার করা সম্ভব নয়।
গত দুই দশকে আমাদের সংস্কৃতি ও এর বিকাশ নিয়ে নানা আলোচনা হয়েছে। বিশেষ করে বিশ্বায়ন আমাদের এ সংক্রান্ত একটি শব্দ উপহার দিয়েছে-অপসংস্কৃতি। আমাদের যে কোনো সাংস্কৃতিক ব্যর্থতার কারণ হিসেবে আমরা দায়ী করি বিদেশী সংস্কৃতির আগ্রাসনকে। অথচ যে সংস্কৃতির রয়েছে হাজার বছরের সমৃদ্ধ ঐতিহ্য, সেই বাঙালি সংস্কৃতি কেন অপসংস্কৃতি বা বিদেশী সংস্কৃতির অনুপ্রবেশে নতজানু হবে তা খুঁজে দেখি না। ইলিয়াসের অনুসন্ধানী দৃষ্টি যথার্থ কারণটিকে চিহ্নিত করতে পেরেছে। মার্কসীয় পরিভাষায় ‘অ্যালিয়েনেশন’ বা বিচ্ছিন্নতাতত্ত্ব এক্ষেত্রে তার মানসভূমি নির্মাণ করেছে। তাই নির্দ্বিধায় তিনি উচ্চারণ করেন-
‘...আজ মধ্যবিত্তের সংস্কৃতি সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সংস্কৃতি থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। এর ফল সাহিত্যিকেরও জন্য ভালো হয়নি। নিুবিত্তের মধ্যে শিক্ষার প্রসার একেবারেই নেই। সাংস্কৃতিক বিচ্ছিন্নতার ফলে দেশে শিক্ষিত অংশের সঙ্গে নিুবিত্ত-শ্রমজীবীর মানসিক ব্যবধান ক্রমেই বেড়ে চলেছে। ...যাকে ‘বাঙালি সংস্কৃতি’ বলে ঢাক পেটানো হয় তা যদি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কর্মপ্রবাহ ও জীবনযাপন থেকে প্রেরণা নিতে না পারে তো তা-ও অপসংস্কৃতির মতো উটকো ও ভিত্তিহীন হতে বাধ্য। তার বাইরের চেহারা যতই ‘রুচিশীল রুচিশীল’ হোক, তাতে ঘষামাজা ভাব যতই থাকুক, তা রক্তহীন হতে বাধ্য। সংখ্যাগরিষ্ঠের রক্তধারাকে ধারণ না করে কোনো দেশে সংগঠিত সংস্কৃতিচর্চা কখনও প্রাণবন্ত হতে পারে না।’
সংখ্যাগরিষ্ঠের রক্তধারাকে আজীবন ধারণ করেই ইলিয়াস তার কালের প্রধান শিল্পীদের একজন হয়েছেন। তার বক্তব্যের সারবত্তা অকাট্য। বিভিন্ন চ্যানেলে রকমারি সাংস্কৃতিক (?) অনুষ্ঠান, প্রতিভা অন্বেষণ কার্যক্রমের নামে বহুজাতিক পণ্যের বেসাতি, মেধার পরিবর্তে গ্ল্যামারকে সামনে নিয়ে আসার যে আত্মঘাতী সংস্কৃতি চালু হয়েছে এ দেশে তা কার সংস্কৃতি? গণমাধ্যমগুলোর নাটকে, সিনেমায়, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের শুধু নয়, মধ্যবিত্তের প্রকৃত জীবনযাত্রাও খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
যেহেতু ইলিয়াস কলাকৈবল্যবাদের পোষকতা করেননি, তাই সাহিত্য বিচারে তিনি যে জীবন ও সমাজ বাস্তবতার অন্বেষণকেই প্রাধান্য দেবেন এটি বিস্ময়কর কিছু নয়। সমালোচনার ক্ষেত্রে তিনি এ রীতিটিই অবলম্বন করেছেন। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের স্থপতি বঙ্কিমচন্দ্র থেকে শুরু করে শওকত ওসমান, শামসুর রাহমান পর্যন্ত যে মূল্যায়ন তিনি করেছেন সেখানেও তিনি এ ধারার বাইরে যেতে পারেননি। তিনি বিশ্বাস করেন, যে কোনো লেখকের প্রধান দুর্বলতা সমাজ বিচ্ছিন্নতা। এতে কখনও তার বক্তব্য খণ্ডিত হয়ে পড়েছে, কিন্তু‘ লঘু হয়নি মোটেও। বাংলা কথাসাহিত্যে সমাজবাদী বিশ্লেষণে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে কেন তিনি সবচেয়ে সফল মনে করেন তা অনুমান করা কঠিন নয়। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে ইলিয়াসের পর্যবেক্ষণ তার নিজের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য-
‘সমাজ বাস্তবতার বোধ প্রথম থেকে ছিল বলে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় পরবর্তীকালে মার্কসবাদকে সামাজিক ও ব্যক্তিরোগের সমাধান বলে উপলব্ধি করেছিলেন। তার সমকালীন অনেক লেখকের মতো রোগবিলাস রোগে আক্রান্ত হননি বলে অবক্ষয়ের প্রতিশেধক খোঁজার জন্য তিনি প্রথম থেকেই তৎপর ছিলেন। মাকর্সবাদী হওয়া মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবনে কোনো আকস্মিক ব্যাপার নয়। ব্যক্তি ক্ষয় ও রুগ্নতা যখন তার মনোযোগের প্রধান বিষয় ছিল তখনও সমাজ কাঠামোর ওপর তার নিদারুণ বিতৃষ্ণা প্রকাশিত হয়েছে। ...কিন্তু মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কেবল মনোবিকলনের সফল রূপকার নন। মানুষের ভান ও সমাজব্যবস্থাকে ধিক্কার দিয়েই তিনি দায়িত্ব পালনের তৃপ্তি পাননি। বিশ্লেণের কর্তব্য স্বেচ্ছায় নিজের ঘাড়ে তুলে নেন এবং আর একটু এগিয়ে এ অসহনীয় অবস্থাটি পালটে দেয়ার অঙ্গীকার গ্রহণ করেন।’
ব্যক্তির ক্ষয় মানিক সাহিত্যের অন্যতম উপাদান বললে অত্যুক্তি করা হয় না। এর সমান্তরালে চলে সমাজের অবক্ষয়। এ দুই বিচ্ছিন্ন নয়। ইলিয়াসের সাহিত্যে এ চেতনার প্রতিফলন ঘটেছে।
আগেই উল্লিখিত হয়েছে আরোপিত ঔচিত্যবোধের প্রতি ইলিয়াসের আজীবন অনাস্থার কথা। তার গল্পে-উপন্যাসের চরিত্র বিশ্লেণ করলেই স্পষ্ট হয়ে যায় এ বিষয়টি। নিজের এ বোধ আরও বলিষ্ঠভাবে উঠে এসেছে তার প্রবন্ধে। সেখানে তিনি আরও ক্ষুরধার, ছুঁৎমার্গবিহীন ও নির্বিকার। নিজের সম্পর্কে বলেছেন- ‘কেবল সাহিত্য নয়, এমনিতে সব ব্যাপারেই, যাকে বলে নীতিবোধ, তাতে আমার কোনো আস্থা নেই। নীতিবোধের যে ব্যাপার সেটা আমার মনে হয় ব্রাহ্ম সমাজ টাইপের, সেটা আমার কাছে হাস্যকর মনে হয়। আমি ন্যায়বোধ বা সত্য যেটা, সেটাকে একদম, matter of fact দেখতে চাই। আমি যদি বলি সাধারণ মানুষের ভালো ভাবে বাঁচা, এটা কিন্তু কোনো নীতিবোধ থেকে বলি না, এটা হচ্ছে absolutely কাণ্ডজ্ঞান থেকে। এটা খুব common sense আমি যে ভাতটা খাচ্ছি সেটা যে উৎপাদন করছে, সে এর দামটা পাচ্ছে না, এতে আমি guilty feel করছি, এটা কোনো নীতিবোধের ব্যাপার কিন্তু না। হ্যাঁ, কমিউনিস্টদের মধ্যে এক ধরনের লোক আছে যারা নীতিবাগিশ। কিন্তু নীতিবাগিশ ব্যাপারটা মনে করি Marxism-এর সঙ্গে খাপ খায় না। বুর্জোয়া সমাজ কিন্তু‘ এ নীতিবোধ দিয়েই শোষণের কাজটা চালিয়েছে।’
রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশা থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত এমন কিছু সমালোচক রয়েছেন, রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে যাদের প্রধান অভিযোগ, তার রচনা শ্রমজীবী মানুষের কথা বলে না, বিপ্লব গঠনে ভূমিকা রাখে না। সাহিত্যবোধের এমন অকর্ষিত ও স্থূল দৃষ্টিভঙ্গি অনেক বিদগ্ধ সমালোচকেরও রয়েছে। এ সমালোচনা নিঃসন্দেহে খণ্ডনযোগ্য। ইলিয়াস এ ধারার বিপরীতে রবীন্দ্রনাথের মূল্যায়ন করেছেন। ‘রবীন্দ্রসঙ্গীতের শক্তি’ নামে সংক্ষিপ্ত অথচ লক্ষ্যভেদী প্রবন্ধে তিনি বলেছেন-
‘বাংলাদেশেও ব্যক্তির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের গান যথাযথ মর্যাদা পাচ্ছে এবং শক্তসমর্থ ব্যক্তি গঠনে এ গান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। রবীন্দ্রনাথের গান মানুষকে বিপ্লবের দিকে উদ্বুদ্ধ করবে না। কিন্তু শক্তসমর্থ ব্যক্তিগঠনে রবীন্দ্রনাথের গানের ক্ষমতা অসাধারণ। শক্ত মানুষের সমবেত শক্তি মানববিরোধী অচলায়ন ভাঙার অন্যতম প্রেরণা তো বটেই।’
‘বাংলা ছোটগল্প কি মরে যাচ্ছে?’- ইলিয়াসের বহুল আলোচিত একটি প্রবন্ধ। বাংলাসাহিত্যের ক্ষণজন্মা গল্পকারদের অন্যতম ইলিয়াস নিজেই। সমকালীন সাহিত্যে গড়পড়তা বাজারি উপন্যাসের চাকচিক্য, আকাশ সংস্কৃতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত মধ্যবিত্ত, ছোট প্রাণ ছোট কথার সাম্প্র্রতিক অনুপস্থিতি, সমাজে প্রবল ভাংচুর এবং সমাজব্যবস্থায় নতুন শক্তি ও উপাদানের সংযোগ প্রভৃতি নানা বিষয় পর্যবেক্ষণে অসাধারণ ধীশক্তির পরিচয় দিয়েছেন তিনি-
‘..... খ্যাতি লেখককে প্রেরণা হয়তো খানিকটা দেয়, তবে খ্যাতি তাকে আরও বেশি সতর্ক করে রাখে খ্যাতি নিরাপদ রাখার কাজে। নিজের ব্যবহৃত, পরিচিত ও পরীক্ষিত রীতিটি তার বড় পোষমানা, এর বাইরে যেতে তার বাধোবাধো ঠেকে। কিংবা নিজের রেওয়াজ ভাঙতে তার মায়া হয়। তাই ছোটগল্পের জন্য ভরসা করতে হয় লিটল ম্যাগাজিনের ওপর। প্রচলিত রীতির বাইরে লেখেন বলেই লিটল ম্যাগাজিনের লেখকদের দরকার হয় নিজেদের পত্রিকা বার করার। বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবাংলায় ছোটগল্পের ছিমছাম তনুখানি অনুপস্থিত, সাম্প্র্রতিক মানুষকে তুলে ধরার তাগিদে নিটল গপ্পো ঝেড়ে তারা তৈরি করছেন নানা সংকট, সমালোচকদের প্রশংসা পাওয়ার লোভ অনেকেই সামলাতে না পেরে চলতে শুরু করবেন ছোটগল্পের সনাতন পথে।’
উপরোক্ত উদ্ধৃতি থেকে দুটি বিষয় পরিষ্কার। ছোটগল্পের বহুমাত্রিকতা ও নিরীক্ষাকে স্বাগত জানানোর প্রধান প্লাটফর্ম লিটল ম্যাগাজিন। দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য সাময়িকী প্রচলিত ধারার বাইরে লেখা ছাপাতে নারাজ। আধুনিক বাংলাসাহিত্যের বিবর্তন লক্ষ করলেও বোঝা যায় লিটল ম্যাগাজিন শুধু ছোটগল্প নয়, সাহিত্যের অন্যান্য শাখার জন্যও সোনালি দরজা খুলে দিয়েছে। আর সমালোচকদের প্রশংসা পাওয়ার লোভ সামলাতে না পারা তো সবচেয়ে সুলভ দৃষ্টান্ত। সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও আমাদের কয়েকজন শক্তিমান কথাশিল্পী যে জনপ্রিয়তা ও গতানুগতিকতার আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছেন তা দিবালোকের মতো স্পষ্ট-
‘শ্রমজীবীর জীবনযাপন, তার ভুলভাল বা ঠিকঠাক বিশ্বাস, তার সংস্কার ও কুসংস্কার, তার পছন্দ-অপছন্দ, তার রুচি, তার ভাষা ও প্রকাশ, তার শক্তি ও দুর্বলতা, তার ভালোবাসা ও হিংসা-এসব নিয়ে তো তার সংস্কৃতিচর্চা, তার সংস্কৃতির এ পরিচয় বাংলাসাহিত্যে কোথায়?’
শুধু প্রশ্ন করে ইলিয়াস তার দায়িত্ব শেষ করেননি। আফ্রিকার উপন্যাসের উদাহরণ উপস্থাপন করে তিনি দেখালেন গ্রামীণ জীবনের স্বতঃস্ফূর্ততা কত জীবন্ত হয়ে উঠেছে নাইজেরীয় সাহিত্যিকের কলমে-
‘নাইজিরীয় লেখক চিনুয়া আচিবির উপন্যাসে নাইজিরিয়ার গ্রাম্যজীবনের গভীর ভেতরে ঢোকার সফল প্রচেষ্টা লক্ষ করা যায়। সেখানকার মানুষের জীবনযাপনের পরিচয় তো আছেই, উপরন্তু সেই জীবনযাপন জীবন্ত হয়ে উঠেছে আঞ্চলিক ভাষা বা উপভাষার প্রবাদ-প্রবচন, শ্লোক এবং তাদের বিশ্বাস ও সন্দেহ, সংস্কার ও কুসংস্কারের অপূর্ব ব্যবহারের ফলে।’
চিনুয়া আচিবির মানের লেখক বাংলাসাহিত্যে অবশ্যই রয়েছে। তাদের কেউ কেউ আচিবির চেয়েও প্রতিভাবান। কিন্তু দায়বদ্ধতাহীন প্রতিভা বাংলাসাহিত্যের লেখকদের ক্ষমতাকে সংকুচিত করেছে-
‘চিনুয়া আচিবির মানের লেখক বাংলাসাহিত্যেও পাওয়া যাবে, দক্ষতা ও নৈপুণ্য তাদের কোনো অংশে কম নয়। কিন্তু গল্পের জায়গা-জমি ও মানুষের জন্য যে মর্যাদাবোধ ও দায়িত্ববোধ নাইজেরীয় লেখককে উপন্যাস রচনার উদ্বুদ্ধ করে তার শোচনীয় অভাবে মাতৃভাষায় লিখেও আমাদের শ্রেষ্ঠ লেখকরা বাংলাভাষার প্রবাদ, প্রবচন, শ্লোক, ছড়া এবং সামগ্রিকভাবে লোকসংস্কৃতির উপযুক্ত ব্যবহার করতে পারেন না।’
গল্প, কবিতা, উপন্যাস, চলচ্চিত্র নানা বিষয় বিশ্লেষণে পারদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন ইলিয়াস। ঔপনিবেশিক পরাধীনতা থেকে মুক্ত হওয়ার পরও কেন ‘গান্ধী’ চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য পশ্চিমাদের দ্বারস্থ হতে হয় সেটি তার অজানা নয়। নিপুণ বিশ্লেষণে তিনি অভিনন্দিত করেন ‘সূর্যদীঘল বাড়ির’ চলচ্চিত্রায়নকে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা, আদিবাসী সংস্কৃতি, গুন্টার গ্রাসের সাহিত্য-কী নেই তার আগ্রহের তালিকায়? সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রবল অনুপ্রেরণায় ইলিয়াস তাড়িত হয়েছেন সারাটি জীবন। ‘সংস্কৃতি’ পত্রিকায় প্রকাশিত বিভিন্ন প্রবন্ধে ধরা পড়েছে তার ক্ষোভ, ক্রোধ, কৌতুক কখনও কখনও আশাবাদও। অভিমানী মানুষ প্রায়ই গণবিচ্ছিন্ন। ইলিয়াস তা হননি। একজন সমাজবিজ্ঞানীর মতোই তিনি ঢুকে পড়েছেন সমাজের অলিগলিতে। বের করে এনেছেন রাষ্ট্রের ও সমাজের প্রচলিত কাঠামোর দুর্বলতাকে, কখনও ধিক্কার দিয়েছেন, কখনও হাততালি দিয়েছেন। আমাদের কথাসাহিত্যিকদের দায়বদ্ধতা নিয়ে সন্দিহান ইলিয়াস যথার্থই বলেছেন-
‘বাংলাদেশের প্রধান ঔপন্যাসিক প্রয়াত সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ ধর্মীয় কিংবা সামাজিক কুসংস্কারকে গৌরব দেয়ার কাজে লিপ্ত হননি বরং এ সমাজের ধর্মান্ধতাকেই তিনি প্রবল শক্তিতে আঘাত করেছেন। নিজ সম্প্রদায়ের শেকড় সন্ধানের প্রয়াস এবং পশ্চাৎপদ সংস্কারকে আঘাত করার চেষ্টা তিনি করেছিলেন একই সঙ্গে। তার শেষ উপন্যাসে তাই তাকে একটি স্বকীয় ভাষারীতি তৈরি করতে হয়েছে। কিন্তু তার দৃষ্টান্ত অনুসরণ না করে আমরা বরং পাঠকের মনোরঞ্জনের কাজেই নিয়োজিত রয়েছি। আমরা কৃশকায় মধ্যবিত্ত ব্যক্তির তরল ও পানসে দুঃখ-বেদনার পাঁচালি গাই, কিন্তু এতে উপন্যাসে কি ব্যক্তির যথার্থ সামাজিক অবস্থানটি কোনোভাবেই প্রকাশিত হয়? এতে যে শেষ যে ব্যক্তিটিকে উদ্ধার করি সে কিন্তুু রেনেসাঁসের সেই শক্তসমর্থ, উচ্চাকাক্সক্ষী মানুষ নয়, বরং দায়িত্ববোধহীন ফাঁপা এক প্রাণী মাত্র।’
সেই শক্তসমর্থ ও উচ্চাকাক্সক্ষী মানুষের সন্ধান যে কোনো সৎ সাহিত্যিকের মতো ইলিয়াসও করেছেন। এক্ষেত্রে তিনি নিঃসঙ্গ। তার আকাক্সক্ষা কোনো সমবেত সমর্থনের অপেক্ষা করেনি। তার নিঃসঙ্গতা তার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও শক্তিমত্তারই পরিচায়ক। ইবসেনের ‘এন এনিমি অব দি পিপল’ নাটকের ড. স্টকম্যানের মতোই ইলিয়াসের অবস্থান- ‘The strongest man in the world is the man who stands most alone’. প্রাবন্ধিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের অন্বেষাও সেই সম্পন্ন ও শক্তসমর্থ ব্যক্তির জন্য।
গল্পে-উপন্যাসে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস যে শিখরস্পর্শী সাফল্য পেয়েছেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এ নিয়ে দুই বাংলায় বিস্তর লেখালেখি হয়েছে এবং যোগ্য স্বীকৃতিও তিনি পেয়েছেন। গল্পে-উপন্যাসে লেখকের জীবনদর্শন খুঁজে পাওয়া কঠিন নয়, কিন্তু তা বহুমাত্রিক হতে বাধ্য। একই লেখকের ভিন্ন ভিন্ন গল্পে-উপন্যাসে ভিন্ন জীবনদর্শন বা বিশ্বাসের প্রতিফলন ঘটে। প্রবন্ধ সাহিত্যেই একজন বড় লেখকের গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও জীবনদর্শনের পরিচয় মেলে। তাই ‘গীতাঞ্জলি’ বা ‘সোনার তরী’র’ রবীন্দ্রনাথের চেয়ে ‘কালান্তর’ বা ‘সভ্যতার সংকট’ এর রবীন্দ্রনাথ অধিকতর নৈর্ব্যক্তিক ও বাস্তব। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ক্ষেত্রেও অন্যথা ঘটেনি। বর্তমান রচনার উদ্দেশ্য প্রাবন্ধিক ইলিয়াসের বৈভবকে তুলে ধরা।
ইলিয়াসের সাহিত্যের মনোযোগী পাঠক জানেন, আরোপিত ঔচিত্যবোধ, নৈতিকতা, আশাবাদ থেকে মুক্ত হয়ে মানুষকে তার সম্ভাবনা ও বিলয়ের বিপরীতে সম্পূর্ণ দর্পণে ধারণ করাই তার জীবনদর্শন। তার নিজের ভাষায়-
‘যে লেখক মানুষকে যত সাহসের সঙ্গে তার টোটালিটিতে ধরবেন তিনিই তো পাঠককে তত বেশি ইন্সপায়ার করবেন মনে করি। লেখায় মানুষের সম্পূর্ণটুকু দেখতে চাই, সবকিছু। টোটাল ট্রুথের মুখোমুখি হতে চাই। ...কাউকে জাস্টিফাই করার দরকার নেই। যে যেমন সেই পারসপেকটিভে তাকে দেখাতে হবে। মানুষকে আমি যেমন দেখতে চাই সেটা বড় কথা নয় মানুষ কেমন আছে, সেটা বড়। সেখান থেকেই তার স্বপ্ন, তার সম্ভাবনা সবই দেখা যাবে। সমাজবিজ্ঞান, দর্শন বা মনস্তত্ত্ব মানুষকে যতটুকু দেখাতে পারে সাহিত্য তো আমি মনে করি আরেকটু এগিয়েই দেখাতে পারে।’
তার এ উপলব্ধির প্রতিফলন দেখা যায় প্রতিটি প্রবন্ধে। তার কলমে ‘বাংলা ছোট গল্প কি মরে যাচ্ছে’, ‘সংস্কৃতির ভাঙা সেতু’, ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাগী চোখের স্বপ্ন’, ‘সায়েবদের গান্ধি’ প্রভৃতি প্রবন্ধ সমকালীন প্রবন্ধসাহিত্যে বিশিষ্ট সংযোজন। ইলিয়াসের বক্তব্যের সঙ্গে সবসময় সহমত পোষণ করা কঠিন এবং সেটি তার অন্বিষ্ট নয়। কিন্তু তার চিন্তার নির্যাসকে অস্বীকার করা সম্ভব নয়।
গত দুই দশকে আমাদের সংস্কৃতি ও এর বিকাশ নিয়ে নানা আলোচনা হয়েছে। বিশেষ করে বিশ্বায়ন আমাদের এ সংক্রান্ত একটি শব্দ উপহার দিয়েছে-অপসংস্কৃতি। আমাদের যে কোনো সাংস্কৃতিক ব্যর্থতার কারণ হিসেবে আমরা দায়ী করি বিদেশী সংস্কৃতির আগ্রাসনকে। অথচ যে সংস্কৃতির রয়েছে হাজার বছরের সমৃদ্ধ ঐতিহ্য, সেই বাঙালি সংস্কৃতি কেন অপসংস্কৃতি বা বিদেশী সংস্কৃতির অনুপ্রবেশে নতজানু হবে তা খুঁজে দেখি না। ইলিয়াসের অনুসন্ধানী দৃষ্টি যথার্থ কারণটিকে চিহ্নিত করতে পেরেছে। মার্কসীয় পরিভাষায় ‘অ্যালিয়েনেশন’ বা বিচ্ছিন্নতাতত্ত্ব এক্ষেত্রে তার মানসভূমি নির্মাণ করেছে। তাই নির্দ্বিধায় তিনি উচ্চারণ করেন-
‘...আজ মধ্যবিত্তের সংস্কৃতি সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সংস্কৃতি থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। এর ফল সাহিত্যিকেরও জন্য ভালো হয়নি। নিুবিত্তের মধ্যে শিক্ষার প্রসার একেবারেই নেই। সাংস্কৃতিক বিচ্ছিন্নতার ফলে দেশে শিক্ষিত অংশের সঙ্গে নিুবিত্ত-শ্রমজীবীর মানসিক ব্যবধান ক্রমেই বেড়ে চলেছে। ...যাকে ‘বাঙালি সংস্কৃতি’ বলে ঢাক পেটানো হয় তা যদি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কর্মপ্রবাহ ও জীবনযাপন থেকে প্রেরণা নিতে না পারে তো তা-ও অপসংস্কৃতির মতো উটকো ও ভিত্তিহীন হতে বাধ্য। তার বাইরের চেহারা যতই ‘রুচিশীল রুচিশীল’ হোক, তাতে ঘষামাজা ভাব যতই থাকুক, তা রক্তহীন হতে বাধ্য। সংখ্যাগরিষ্ঠের রক্তধারাকে ধারণ না করে কোনো দেশে সংগঠিত সংস্কৃতিচর্চা কখনও প্রাণবন্ত হতে পারে না।’
সংখ্যাগরিষ্ঠের রক্তধারাকে আজীবন ধারণ করেই ইলিয়াস তার কালের প্রধান শিল্পীদের একজন হয়েছেন। তার বক্তব্যের সারবত্তা অকাট্য। বিভিন্ন চ্যানেলে রকমারি সাংস্কৃতিক (?) অনুষ্ঠান, প্রতিভা অন্বেষণ কার্যক্রমের নামে বহুজাতিক পণ্যের বেসাতি, মেধার পরিবর্তে গ্ল্যামারকে সামনে নিয়ে আসার যে আত্মঘাতী সংস্কৃতি চালু হয়েছে এ দেশে তা কার সংস্কৃতি? গণমাধ্যমগুলোর নাটকে, সিনেমায়, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের শুধু নয়, মধ্যবিত্তের প্রকৃত জীবনযাত্রাও খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
যেহেতু ইলিয়াস কলাকৈবল্যবাদের পোষকতা করেননি, তাই সাহিত্য বিচারে তিনি যে জীবন ও সমাজ বাস্তবতার অন্বেষণকেই প্রাধান্য দেবেন এটি বিস্ময়কর কিছু নয়। সমালোচনার ক্ষেত্রে তিনি এ রীতিটিই অবলম্বন করেছেন। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের স্থপতি বঙ্কিমচন্দ্র থেকে শুরু করে শওকত ওসমান, শামসুর রাহমান পর্যন্ত যে মূল্যায়ন তিনি করেছেন সেখানেও তিনি এ ধারার বাইরে যেতে পারেননি। তিনি বিশ্বাস করেন, যে কোনো লেখকের প্রধান দুর্বলতা সমাজ বিচ্ছিন্নতা। এতে কখনও তার বক্তব্য খণ্ডিত হয়ে পড়েছে, কিন্তু‘ লঘু হয়নি মোটেও। বাংলা কথাসাহিত্যে সমাজবাদী বিশ্লেষণে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে কেন তিনি সবচেয়ে সফল মনে করেন তা অনুমান করা কঠিন নয়। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে ইলিয়াসের পর্যবেক্ষণ তার নিজের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য-
‘সমাজ বাস্তবতার বোধ প্রথম থেকে ছিল বলে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় পরবর্তীকালে মার্কসবাদকে সামাজিক ও ব্যক্তিরোগের সমাধান বলে উপলব্ধি করেছিলেন। তার সমকালীন অনেক লেখকের মতো রোগবিলাস রোগে আক্রান্ত হননি বলে অবক্ষয়ের প্রতিশেধক খোঁজার জন্য তিনি প্রথম থেকেই তৎপর ছিলেন। মাকর্সবাদী হওয়া মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবনে কোনো আকস্মিক ব্যাপার নয়। ব্যক্তি ক্ষয় ও রুগ্নতা যখন তার মনোযোগের প্রধান বিষয় ছিল তখনও সমাজ কাঠামোর ওপর তার নিদারুণ বিতৃষ্ণা প্রকাশিত হয়েছে। ...কিন্তু মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কেবল মনোবিকলনের সফল রূপকার নন। মানুষের ভান ও সমাজব্যবস্থাকে ধিক্কার দিয়েই তিনি দায়িত্ব পালনের তৃপ্তি পাননি। বিশ্লেণের কর্তব্য স্বেচ্ছায় নিজের ঘাড়ে তুলে নেন এবং আর একটু এগিয়ে এ অসহনীয় অবস্থাটি পালটে দেয়ার অঙ্গীকার গ্রহণ করেন।’
ব্যক্তির ক্ষয় মানিক সাহিত্যের অন্যতম উপাদান বললে অত্যুক্তি করা হয় না। এর সমান্তরালে চলে সমাজের অবক্ষয়। এ দুই বিচ্ছিন্ন নয়। ইলিয়াসের সাহিত্যে এ চেতনার প্রতিফলন ঘটেছে।
আগেই উল্লিখিত হয়েছে আরোপিত ঔচিত্যবোধের প্রতি ইলিয়াসের আজীবন অনাস্থার কথা। তার গল্পে-উপন্যাসের চরিত্র বিশ্লেণ করলেই স্পষ্ট হয়ে যায় এ বিষয়টি। নিজের এ বোধ আরও বলিষ্ঠভাবে উঠে এসেছে তার প্রবন্ধে। সেখানে তিনি আরও ক্ষুরধার, ছুঁৎমার্গবিহীন ও নির্বিকার। নিজের সম্পর্কে বলেছেন- ‘কেবল সাহিত্য নয়, এমনিতে সব ব্যাপারেই, যাকে বলে নীতিবোধ, তাতে আমার কোনো আস্থা নেই। নীতিবোধের যে ব্যাপার সেটা আমার মনে হয় ব্রাহ্ম সমাজ টাইপের, সেটা আমার কাছে হাস্যকর মনে হয়। আমি ন্যায়বোধ বা সত্য যেটা, সেটাকে একদম, matter of fact দেখতে চাই। আমি যদি বলি সাধারণ মানুষের ভালো ভাবে বাঁচা, এটা কিন্তু কোনো নীতিবোধ থেকে বলি না, এটা হচ্ছে absolutely কাণ্ডজ্ঞান থেকে। এটা খুব common sense আমি যে ভাতটা খাচ্ছি সেটা যে উৎপাদন করছে, সে এর দামটা পাচ্ছে না, এতে আমি guilty feel করছি, এটা কোনো নীতিবোধের ব্যাপার কিন্তু না। হ্যাঁ, কমিউনিস্টদের মধ্যে এক ধরনের লোক আছে যারা নীতিবাগিশ। কিন্তু নীতিবাগিশ ব্যাপারটা মনে করি Marxism-এর সঙ্গে খাপ খায় না। বুর্জোয়া সমাজ কিন্তু‘ এ নীতিবোধ দিয়েই শোষণের কাজটা চালিয়েছে।’
রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশা থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত এমন কিছু সমালোচক রয়েছেন, রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে যাদের প্রধান অভিযোগ, তার রচনা শ্রমজীবী মানুষের কথা বলে না, বিপ্লব গঠনে ভূমিকা রাখে না। সাহিত্যবোধের এমন অকর্ষিত ও স্থূল দৃষ্টিভঙ্গি অনেক বিদগ্ধ সমালোচকেরও রয়েছে। এ সমালোচনা নিঃসন্দেহে খণ্ডনযোগ্য। ইলিয়াস এ ধারার বিপরীতে রবীন্দ্রনাথের মূল্যায়ন করেছেন। ‘রবীন্দ্রসঙ্গীতের শক্তি’ নামে সংক্ষিপ্ত অথচ লক্ষ্যভেদী প্রবন্ধে তিনি বলেছেন-
‘বাংলাদেশেও ব্যক্তির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের গান যথাযথ মর্যাদা পাচ্ছে এবং শক্তসমর্থ ব্যক্তি গঠনে এ গান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। রবীন্দ্রনাথের গান মানুষকে বিপ্লবের দিকে উদ্বুদ্ধ করবে না। কিন্তু শক্তসমর্থ ব্যক্তিগঠনে রবীন্দ্রনাথের গানের ক্ষমতা অসাধারণ। শক্ত মানুষের সমবেত শক্তি মানববিরোধী অচলায়ন ভাঙার অন্যতম প্রেরণা তো বটেই।’
‘বাংলা ছোটগল্প কি মরে যাচ্ছে?’- ইলিয়াসের বহুল আলোচিত একটি প্রবন্ধ। বাংলাসাহিত্যের ক্ষণজন্মা গল্পকারদের অন্যতম ইলিয়াস নিজেই। সমকালীন সাহিত্যে গড়পড়তা বাজারি উপন্যাসের চাকচিক্য, আকাশ সংস্কৃতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত মধ্যবিত্ত, ছোট প্রাণ ছোট কথার সাম্প্র্রতিক অনুপস্থিতি, সমাজে প্রবল ভাংচুর এবং সমাজব্যবস্থায় নতুন শক্তি ও উপাদানের সংযোগ প্রভৃতি নানা বিষয় পর্যবেক্ষণে অসাধারণ ধীশক্তির পরিচয় দিয়েছেন তিনি-
‘..... খ্যাতি লেখককে প্রেরণা হয়তো খানিকটা দেয়, তবে খ্যাতি তাকে আরও বেশি সতর্ক করে রাখে খ্যাতি নিরাপদ রাখার কাজে। নিজের ব্যবহৃত, পরিচিত ও পরীক্ষিত রীতিটি তার বড় পোষমানা, এর বাইরে যেতে তার বাধোবাধো ঠেকে। কিংবা নিজের রেওয়াজ ভাঙতে তার মায়া হয়। তাই ছোটগল্পের জন্য ভরসা করতে হয় লিটল ম্যাগাজিনের ওপর। প্রচলিত রীতির বাইরে লেখেন বলেই লিটল ম্যাগাজিনের লেখকদের দরকার হয় নিজেদের পত্রিকা বার করার। বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবাংলায় ছোটগল্পের ছিমছাম তনুখানি অনুপস্থিত, সাম্প্র্রতিক মানুষকে তুলে ধরার তাগিদে নিটল গপ্পো ঝেড়ে তারা তৈরি করছেন নানা সংকট, সমালোচকদের প্রশংসা পাওয়ার লোভ অনেকেই সামলাতে না পেরে চলতে শুরু করবেন ছোটগল্পের সনাতন পথে।’
উপরোক্ত উদ্ধৃতি থেকে দুটি বিষয় পরিষ্কার। ছোটগল্পের বহুমাত্রিকতা ও নিরীক্ষাকে স্বাগত জানানোর প্রধান প্লাটফর্ম লিটল ম্যাগাজিন। দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য সাময়িকী প্রচলিত ধারার বাইরে লেখা ছাপাতে নারাজ। আধুনিক বাংলাসাহিত্যের বিবর্তন লক্ষ করলেও বোঝা যায় লিটল ম্যাগাজিন শুধু ছোটগল্প নয়, সাহিত্যের অন্যান্য শাখার জন্যও সোনালি দরজা খুলে দিয়েছে। আর সমালোচকদের প্রশংসা পাওয়ার লোভ সামলাতে না পারা তো সবচেয়ে সুলভ দৃষ্টান্ত। সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও আমাদের কয়েকজন শক্তিমান কথাশিল্পী যে জনপ্রিয়তা ও গতানুগতিকতার আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছেন তা দিবালোকের মতো স্পষ্ট-
‘শ্রমজীবীর জীবনযাপন, তার ভুলভাল বা ঠিকঠাক বিশ্বাস, তার সংস্কার ও কুসংস্কার, তার পছন্দ-অপছন্দ, তার রুচি, তার ভাষা ও প্রকাশ, তার শক্তি ও দুর্বলতা, তার ভালোবাসা ও হিংসা-এসব নিয়ে তো তার সংস্কৃতিচর্চা, তার সংস্কৃতির এ পরিচয় বাংলাসাহিত্যে কোথায়?’
শুধু প্রশ্ন করে ইলিয়াস তার দায়িত্ব শেষ করেননি। আফ্রিকার উপন্যাসের উদাহরণ উপস্থাপন করে তিনি দেখালেন গ্রামীণ জীবনের স্বতঃস্ফূর্ততা কত জীবন্ত হয়ে উঠেছে নাইজেরীয় সাহিত্যিকের কলমে-
‘নাইজিরীয় লেখক চিনুয়া আচিবির উপন্যাসে নাইজিরিয়ার গ্রাম্যজীবনের গভীর ভেতরে ঢোকার সফল প্রচেষ্টা লক্ষ করা যায়। সেখানকার মানুষের জীবনযাপনের পরিচয় তো আছেই, উপরন্তু সেই জীবনযাপন জীবন্ত হয়ে উঠেছে আঞ্চলিক ভাষা বা উপভাষার প্রবাদ-প্রবচন, শ্লোক এবং তাদের বিশ্বাস ও সন্দেহ, সংস্কার ও কুসংস্কারের অপূর্ব ব্যবহারের ফলে।’
চিনুয়া আচিবির মানের লেখক বাংলাসাহিত্যে অবশ্যই রয়েছে। তাদের কেউ কেউ আচিবির চেয়েও প্রতিভাবান। কিন্তু দায়বদ্ধতাহীন প্রতিভা বাংলাসাহিত্যের লেখকদের ক্ষমতাকে সংকুচিত করেছে-
‘চিনুয়া আচিবির মানের লেখক বাংলাসাহিত্যেও পাওয়া যাবে, দক্ষতা ও নৈপুণ্য তাদের কোনো অংশে কম নয়। কিন্তু গল্পের জায়গা-জমি ও মানুষের জন্য যে মর্যাদাবোধ ও দায়িত্ববোধ নাইজেরীয় লেখককে উপন্যাস রচনার উদ্বুদ্ধ করে তার শোচনীয় অভাবে মাতৃভাষায় লিখেও আমাদের শ্রেষ্ঠ লেখকরা বাংলাভাষার প্রবাদ, প্রবচন, শ্লোক, ছড়া এবং সামগ্রিকভাবে লোকসংস্কৃতির উপযুক্ত ব্যবহার করতে পারেন না।’
গল্প, কবিতা, উপন্যাস, চলচ্চিত্র নানা বিষয় বিশ্লেষণে পারদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন ইলিয়াস। ঔপনিবেশিক পরাধীনতা থেকে মুক্ত হওয়ার পরও কেন ‘গান্ধী’ চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য পশ্চিমাদের দ্বারস্থ হতে হয় সেটি তার অজানা নয়। নিপুণ বিশ্লেষণে তিনি অভিনন্দিত করেন ‘সূর্যদীঘল বাড়ির’ চলচ্চিত্রায়নকে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা, আদিবাসী সংস্কৃতি, গুন্টার গ্রাসের সাহিত্য-কী নেই তার আগ্রহের তালিকায়? সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রবল অনুপ্রেরণায় ইলিয়াস তাড়িত হয়েছেন সারাটি জীবন। ‘সংস্কৃতি’ পত্রিকায় প্রকাশিত বিভিন্ন প্রবন্ধে ধরা পড়েছে তার ক্ষোভ, ক্রোধ, কৌতুক কখনও কখনও আশাবাদও। অভিমানী মানুষ প্রায়ই গণবিচ্ছিন্ন। ইলিয়াস তা হননি। একজন সমাজবিজ্ঞানীর মতোই তিনি ঢুকে পড়েছেন সমাজের অলিগলিতে। বের করে এনেছেন রাষ্ট্রের ও সমাজের প্রচলিত কাঠামোর দুর্বলতাকে, কখনও ধিক্কার দিয়েছেন, কখনও হাততালি দিয়েছেন। আমাদের কথাসাহিত্যিকদের দায়বদ্ধতা নিয়ে সন্দিহান ইলিয়াস যথার্থই বলেছেন-
‘বাংলাদেশের প্রধান ঔপন্যাসিক প্রয়াত সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ ধর্মীয় কিংবা সামাজিক কুসংস্কারকে গৌরব দেয়ার কাজে লিপ্ত হননি বরং এ সমাজের ধর্মান্ধতাকেই তিনি প্রবল শক্তিতে আঘাত করেছেন। নিজ সম্প্রদায়ের শেকড় সন্ধানের প্রয়াস এবং পশ্চাৎপদ সংস্কারকে আঘাত করার চেষ্টা তিনি করেছিলেন একই সঙ্গে। তার শেষ উপন্যাসে তাই তাকে একটি স্বকীয় ভাষারীতি তৈরি করতে হয়েছে। কিন্তু তার দৃষ্টান্ত অনুসরণ না করে আমরা বরং পাঠকের মনোরঞ্জনের কাজেই নিয়োজিত রয়েছি। আমরা কৃশকায় মধ্যবিত্ত ব্যক্তির তরল ও পানসে দুঃখ-বেদনার পাঁচালি গাই, কিন্তু এতে উপন্যাসে কি ব্যক্তির যথার্থ সামাজিক অবস্থানটি কোনোভাবেই প্রকাশিত হয়? এতে যে শেষ যে ব্যক্তিটিকে উদ্ধার করি সে কিন্তুু রেনেসাঁসের সেই শক্তসমর্থ, উচ্চাকাক্সক্ষী মানুষ নয়, বরং দায়িত্ববোধহীন ফাঁপা এক প্রাণী মাত্র।’
সেই শক্তসমর্থ ও উচ্চাকাক্সক্ষী মানুষের সন্ধান যে কোনো সৎ সাহিত্যিকের মতো ইলিয়াসও করেছেন। এক্ষেত্রে তিনি নিঃসঙ্গ। তার আকাক্সক্ষা কোনো সমবেত সমর্থনের অপেক্ষা করেনি। তার নিঃসঙ্গতা তার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও শক্তিমত্তারই পরিচায়ক। ইবসেনের ‘এন এনিমি অব দি পিপল’ নাটকের ড. স্টকম্যানের মতোই ইলিয়াসের অবস্থান- ‘The strongest man in the world is the man who stands most alone’. প্রাবন্ধিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের অন্বেষাও সেই সম্পন্ন ও শক্তসমর্থ ব্যক্তির জন্য।
No comments