‘মানুষ যে কঠোর আন্দোলন চাচ্ছে সেটি সময় এলেই হবে’ -মির্জা ফখরুল
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, আন্দোলনের পরিবর্তে আন্দোলনের শপথের কথা আমরা বলছি রাজনৈতিক অলঙ্কার হিসেবে। আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা আমরা বারবার বলছি। আন্দোলনে তো আমাদের আসতেই হবে। এর কোনো বিকল্প নেই এবং আন্দোলনে আমরা আছি। মানুষ যে কঠোর কঠিন আন্দোলন চাচ্ছে সেটি সময় এলেই হবে। আন্দোলনের কতগুলো পর্যায় আছে, সেই পর্যায়গুলো আমরা পার করছি। আমরা জনগণকে সম্পৃক্ত করছি জনসভাগুলোর মধ্য দিয়ে। এরই মধ্যে সরকার যদি দাবিগুলো মেনে না নেয় তবে আমাদের সেই কঠিন আন্দোলন করতেই হবে।” দৈনিক নয়া দিগন্তের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে এক প্রশ্নের জবাবে ফখরুল এসব কথা বলেন। সরকারের এক বছরের মূল্যায়ন করতে গিয়ে ফখরুল বলেন, “এটি অনৈতিক অবৈধ সরকার। প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে বসে আছে। এটিকে তো আমার বলছি দখলদার সরকার। এটি কোনো বৈধ এবং নৈতিক সরকার নয়। দেশের কোনো মানুষ যেমন ৫ জানুয়ারির নির্বাচন গ্রহণ করেনি তেমনি বিদেশের কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রও এটিকে গ্রহণ করেনি। পরিষ্কার করে বলেছে যে, নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। এ জন্য তারা বলেছে অতি দ্রুত সংলাপের মাধ্যমে আলাপ-আলোচনা করে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা গ্রহণ করুন। কিন্তু এখন পর্যন্ত তারা ক্ষমতা দখল করে বসে আছে। এখন পর্যন্ত তারা বিশ্ব জনমত এবং বাংলাদেশের জনগণের কাছে নতি স্বীকার করেনি।” তিনি বলেন, “বাংলাদেশের ইতিহাসে এ ধরনের সরকার বেশি দিন টিকতে পারে না। আমরা বিরোধী দলে আছি। আমাদের বিশদলীয় জোটের পক্ষ থেকে জনসংযোগ করছি। আমরা জনগণের কাছে যাচ্ছি। বিভিন্ন জায়গায় আমরা জনসভা করছি। এরপর আমরা এই অনৈতিক সরকারকে বলব তোমরা দ্রুত একটি গ্রহণযোগ নির্বাচনের ব্যবস্থা কর। তা না হলে তীব্র আন্দোলনের দিকেই যাবো আমরা “ বিএনপির প্রতি জনগণের আন্দোলনে চাপ আছে, সেই সাথে তাদের আশঙ্কাও আছে বিএনপি আন্দোলন করতে পারবে কি না...এমন প্রশ্নের জবাবে ফখরুল বলেন, “না এটি সঠিক না। আপনারা দেখেছেন যে, বিগত ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বন্ধ করার জন্য আন্দোলন করেছি। সে সময় সারা দেশ তিন মাস অচল হয়েছিল। রাজধানী ঢাকা কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল পুরো বাংলাদেশ থেকে। গণতান্ত্রিক আন্দোলন নিয়ে যখন ফ্যাসিস্ট শক্তির সাথে মোকাবেলা করতে হয়, তখন সেটি সহজ হয় না। বরং অত্যন্ত কষ্টসাধ্য হয় এবং জনগণকে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। ইতোমধ্যে জনগণ কিন্তু অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছে। আপনারা দেখেছেন যে, ওই তিন মাসের আন্দোলনে আমাদের দলেরই শুধু ৩১০ জনের প্রাণ গেছে। অন্যান্য দলেরও আছে। জামায়াতে ইসলামীর আছে। শরিক দলগুলোর রয়েছে। সব মিলিয়ে কমপক্ষে ৬০০ ব্যক্তির প্রাণ গেছে। এতগুলো প্রাণ কিন্তু কোনো আন্দোলনে যায়নি। বিএনপিরই শুধু ৬৫ জন গুম হয়েছে। ঢাকা সিটিতেই নিখোঁজ ২৫ জন। এই যে ফ্যাসিবাদ, নির্মম নিষ্ঠুর দলন-নিপীড়ন এটি অতীতে কিন্তু আমরা কখনো দেখিনি। এ ধরনের দলন নিপীড়নের মধ্য দিয়ে জনগণের চূড়ান্ত বিজয় অর্জনে হয়তো সময় একটু সময় লাগতে পারে; কিন্তু আমরা বিশ্বাস করি খুব বেশি সময় লাগবে না। এই সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের চূড়ান্ত যে আন্দোলন হবে তাতে করে সরকারের পতন হবে।” ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর বিএনপির হঠাৎ করে আন্দোলন থেকে পিছিয়ে আসা প্রসঙ্গে ফখরুল বলেন, “প্রশ্ন থাকতেই পারে। এটি জনগণের অতীত অভিজ্ঞতা। অতীতে আওয়ামী লীগ আমাদের (বিএনপির) বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিল তাদের জোট নিয়ে। ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনের পরে তারা (আওয়ামী লীগ) আন্দোলন চালিয়ে গেছে। তার সাথে পার্থক্যটা কোথায়? আমরা কিন্তু তখন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলাম যে, ওই নির্বাচনটা ছিল একটি সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার নির্বাচন। তারপর কিন্তু আমরা নিজেরাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান তৈরি করেছি এবং সেটি সংসদে অতি দ্রুত পাস করেছি। কোনো চাপে পড়ে নয়। আমরা আমাদের প্রতিশ্রুতি পূরণ করেছি।” তিনি বলেন, “কিন্তু ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পরে যে ব্যাপারটা ছিল তা হচ্ছে- আমরা নির্বাচন বর্জনের আন্দোলন করেছি এবং সফল হয়েছি। একশত ভাগ সফল হয়েছি। কেননা ১৫৩টি আসনে নৈতিকতা এবং গণতান্ত্রিক রীতিনীতিকে বিসর্জন দিয়ে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ‘নির্বাচিত’ ঘোষণা করতে হয়েছে। এরপর এরশাদ সাহেবকে নিয়ে টানাহেঁচড়া করেছে। ১৪৭টি আসনের যে নির্বাচন সেখানেও ৫ শতাংশ ভোটারও ভোট কেন্দ্রে যায়নি। সুতরাং ওই সময়ে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়াটা একটু কষ্টসাধ্য ছিল। এ জন্য যে, একটানা তিন মাস গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে চালিয়ে যাওয়া একটি কষ্টকর কাজ। তারপরও আমরা ভেবে দেখেছি এবং সময় নিয়েছি যে, পরবর্তী সময় আবার আন্দোলন করব। এখন সেটিই আমরা করতে যাচ্ছি।” অনেকে এমন কথা বলছেন যে দেশের অবস্থা যদি নাজুকই হয় তাহলে দেশের মানুষ কেন রাস্তায় নামছে না? এই প্রশ্নের জবাবে বিএনপির এই মুখপাত্র বলেন, “জনগণ রাস্তায় নামছে না বলতে তারা কী বুঝাচ্ছে? কখনোই কোনো দেশে কিন্তু জনগণ হঠাৎ করেই রাস্তায় নেমে পড়েনি। তখনই নামে যখন দেখা যায় যে, গণতন্ত্রের সব পক্ষগুলো এক হয়ে জনগণের পক্ষে নামছে তখন জনগণ নামে। এখন আমরা কাজ করছি জনগণের কাছে যাচ্ছি। গণতন্ত্রের প্রশ্নে একটি জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার জন্য। আমরা সব গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করে এই আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে যেতে চাচ্ছি। এটা হচ্ছে আমাদের লক্ষ্য। কারণটা হচ্ছেÑ আজকে শুধু বিএনপি বিপদগ্রস্ত তা কিন্তু নয়। সমগ্র গণতান্ত্রিক শক্তি আজ বিপদগ্রস্ত। ব্যাপারটা হচ্ছে তথাকথিত বুদ্ধিজীবী যারা আওয়ামী লীগের পক্ষে কথা বলছেন তারা কেউই গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না। এই নির্বাচনকে কোনো গণতন্ত্রমনস্ক লোক সমর্থন দিতে পারে না। কারণ এই নির্বাচনের নৈতিকতার কোনো ভিত্তি নেই। এই নির্বাচন ছিল প্রতারণামূলক নির্বাচন। অনেকে এটাকে খেলার সাথে তুলনা করে যে, ‘তোমরা খেলা খেলতে আস নাই আমরা ওয়াক ওভার নিয়ে গেছি।’ গণতন্ত্র বাংলাদেশের মানুষের ভবিষ্যৎ, রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ। সুতরাং আমরা বারবার বলার চেষ্টা করছি- ইট ইজ নট এ গেম। এটা মানুষের ভবিষ্যৎ। এখানে সংবিধান লঙ্ঘন হয়েছে। আমি ভোট দিতে পারিনি। দেশের অর্ধেকের বেশি মানুষ তাদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। সুতরাং সংবিধান লঙ্ঘন হয়েছে। এটাকে হালকা করে দেখার তো কোনো কারণ নেই।”
কুমিল্লার জনসভায় বাধা দেয়ার অভিযোগ বিএনপির
২০ দলীয় জোট আয়োজিত কুমিল্লায় শনিবারের জনসভা বাধাগ্রস্ত করতে সরকারের লোক ও প্রশাসন বিভিন্নভাবে বাধা দিচ্ছে, ভয় দেখাচ্ছে’ বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ। শুক্রবার সকালে নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে রিজভী এ অভিযোগ করেন। রিজভী বলেন, “কুমিল্লায় আগামীকালের জনসভা উপলক্ষে কুমিল্লা ও আশপাশের এলাকায় উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে। আগামীকাল কুমিল্লা টাউন হল মাঠে জনসভা অনুষ্ঠিত হবে। এজন্য কুমিল্লায় সাজ সাজ রব পড়ে গেছে। কিন্তু সরকার ও কুমিল্লা প্রশাসন বিভিন্নভাবে বাধা দিচ্ছে। তারা ব্যানার-ফেস্টুন লাগাতে বাধা দিচ্ছে ও ছিড়ে ফেলছে। এত কিছুর পরেও কুমিল্লার জনসভায় জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে জনতার ঢল নামবে।” সংবাদ সম্মেলনে রিজভী বলেন, “জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়া একটি পরগাছা সরকার জাতির জন্য অপমানজনক। এই সরকার জনগণের দ্বারা সমর্থিত নয় বলেই নতুন বিশ্ব পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক, জাতি গঠন এবং গণতন্ত্র চর্চার জন্য যে ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার সেটি সচেতনভাবেই অগ্রাহ্য করে শুধুমাত্র ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের তীব্রতা বৃদ্ধি করে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারগুলোকে ধ্বংস করা হয়েছে। রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকার শর্ত যে গণসম্মতি, যেটি একমাত্র ভোটের মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়- এটি তারা বিশ্বাস করে না। এইজন্য তাদের বিশ্বাসের একমাত্র ভিত্তি হচ্ছে মানুষকে ভয় দেখানো। তাই অত্যন্ত নির্দয়ভাবে তারা মানুষের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়েছে।” রিজভী বলেন, “সরকারের মুখে দুর্নীতি বিষয়ে কথা এখন রঙ্গরসে পরিণত হয়েছে। রাবিশ ও বোগাস শব্দের ট্রেডমার্ক অর্থমন্ত্রী ‘ঘুষ দেয়া নাকি অবৈধ নয়’-বলে যে ভয়ঙ্কর ফতোয়া দিয়েছেন তাতে অর্থমন্ত্রীর এই কথায় আশকারা পেয়ে সুড়ঙ্গ কেটে ব্যাংক ডাকাতিসহ কাগজ জালিয়াতি করে সরকারী অর্থ আত্মসাৎকারী, ঘুষখোর, নির্লজ্জ দুর্নীতিবাজ এবং রাষ্ট্রের পুঁজি লুন্ঠনকারীরা আরো বেশি দুষ্কর্ম করার জন্য উৎসাহে মেতে উঠেছে।” তিনি বলেন, “আর দুদক আরব্য উপন্যাসের একচোখা দৈত্যের ন্যায় প্রভাবশালী ক্ষমতাসীনদের রেহাই দিয়ে যাচ্ছে। দুদকের ধোয়া মোছার সার্টিফিকেটে পদ্মা সেতু কেলেঙ্কারিতে সৈয়দ আবুল হোসেন, আবুল হাসান চৌধুরীসহ দশজন দায়মুক্তি পেয়েছেন। সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হক, সাবেক সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী মোজাম্মেল হোসেন, সাংসদ আসলামুল হক ও বিটিএমসির সাবেক চেয়ারম্যান আবুল কালামের দুর্নীতির মামলা উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। রেল কেলেঙ্কারির ঘটনায় সাবেক রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বিরুদ্ধে অভিযোগের কোনো অনুসন্ধানই হয়নি। অথচ জিয়া পরিবারের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলাকে কিভাবে গায়ের জোরে টিকিয়ে রাখা হয়েছে সেটাও দেশবাসী লক্ষ্য করছে।”
No comments