জাতির পাপমোচন by বাহাউদ্দীন চৌধুরী
১৯৭৫ সালের পনেরোই আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর হরমানকে হত্যা করা হয়েছিল। এটি ছিল পৃথিবীর অন্যতম জঘন্যতম বর্বর নির্মম নৃশংস রাজনৈতিক হত্যাযজ্ঞ।
এর সঙ্গে একমাত্র তুলনীয় হতে পারে ফোরাত নদীর তীরে এজিদ বাহিনীর হাতে রসুলের দৌহিত্র ইমাম হোসেনের পরিবারবর্গের হত্যা। ইমাম হোসেনকেও সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল এজিদের রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ৰা চরিতার্থ করার জন্য। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর হরমানকেও সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল পিশাচ নরপশু খন্দকার মোশতাকের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করার জন্য। শেখ মুজিবকে হত্যা করে খন্দকার মোশতাক কয়েকদিনের জন্য রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। কিন্তু সেই সিংহাসনে তিনি বেশিদিন থাকতে পারেননি। উচ্চাভিলাষী চক্রানত্মকারী সেনাপতি জিয়াউর রহমান তাঁকে অপসারিত করে সিংহাসন দখল করে নেন। ১৯৭৫ সালের পনেরোই আগস্ট থেকে যে হত্যা ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতির সূচনা হয়েছিল আজও তা অব্যাহত আছে। যে কুচক্রী রাজনৈতিক শক্তি ১৯৭১ সালে বাঙালীর স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধিতা করে পাকিসত্মানী হানাদার বাহিনীর সহযোগিতায় তিরিশ লাখ বাঙালী হত্যা করেছিল, তিন লাখ নারীকে নির্যাতন করেছিল তাদের দোসররাই পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্টের হত্যাকা- ঘটিয়েছিল। তারা এখনও সক্রিয়। তারাই বার বার বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা করেছে। এখন তারা আরও হিংস্র ও মরিয়া হয়ে উঠবে। বাঙালীর মুক্তির প্রতীক শেখ হাসিনাকে হত্যার সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাবে। এই খুনীদের দোসর মৃতু্যদ-প্রাপ্ত যারা বিদেশে অবস্থান করছে তারা এবং দেশের মাটিতে তাদের সহযোগী ও স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের সম্মিলিত চেষ্টা হবে শেখ হাসিনাকে হত্যা করা। তাই তাঁকে সাবধান হতে হবে। তাঁর পিতার মতো নিজের নিরাপত্তার বিষয়টি অবহেলা করা অনুচিত হবে। সরকারেরও এই বিষয়ে সজাগ হয়ে কেবল প্রধানমন্ত্রীর নয়, তাঁর বোন শেখ রেহানাসহ বঙ্গবন্ধু পরিবারের অন্যান্য সদস্যকে বিশেষ নিরাপত্তা দিতে হবে। এই পরিবারের অন্যান্য সদস্যগণও খুনীদের টার্গেট। ব্যারিস্টার তাপসের ওপর আক্রমণই তার প্রমাণ।২৭ জানুয়ারি, ২০১০ দিবাগত রাতে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃতু্যদ-প্রাপ্ত ১২ আসামির পাঁচজনের ফাঁসি কার্যকর হওয়ার মধ্য দিয়ে একটি জাতীয় গস্নানির মোচন ঘটল এবং রাজনৈতিক হত্যাকা-ের ৰেত্রে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ধারা সূচিত হলো। দীর্ঘ ৩৪ বছর ধরে জাতি এই দিনের অপেৰা করেছে।
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের অধিকাংশ সদস্যের নৃশংস হত্যার বিচার রাজনৈতিক কারণে দীর্ঘ সময় ধরে বাধাগ্রসত্ম হয়েছিল। হত্যাকারীদের বিচারের হাত থেকে রৰা করার জন্য দায়মুক্তি (ইনডেমনিটি) অধ্যাদেশ নামের কালাকানুন জারি করা হয়েছিল। শুধু তাই নয়, হত্যাকারীদের পুরস্কৃতও করা হয়েছিল বিদেশী মিশনে লোভনীয় পদে চাকরি দিয়ে। এমনকি পরবতর্ী সময়ে তাদের কাউকে কাউকে রাজনৈতিক দল গঠন ও রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রাথর্ী হওয়ার সুযোগ দেয়া হয়েছিল। দুর্ভাগ্যের বিষয়, ন্যায়বিচার ও মানবতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এসব উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল রাষ্ট্রীয় ও সরকারী উদ্যোগে।
কিন্তু সঙ্কীর্ণ দলীয় রাজনৈতিক স্বার্থ ও গোষ্ঠীস্বার্থের বিপরীতে বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণ সব সময় কামনা করেছে বঙ্গবন্ধু হত্যার সুষ্ঠু বিচার। সেই প্রক্রিয়া শুরম্ন হতে অপেৰা করতে হয়েছিল দীর্ঘ ২১ বছর : ১৯৯৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ জয়ী হয়ে সরকার গঠন পর্যনত্ম। মামলা দায়ের, আসামিদের কয়েকজনের গ্রেফতার ও বিচার প্রক্রিয়া চূড়ানত্ম পর্যায়ে পেঁৗছে যাওয়ার পরও মাঝখানে সরকার পরিবর্তনের ফলে ছেদ পড়ে আবার। ২০০১ সালে নির্বাচিত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের পুরোটা আমল বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা ঝুলে থাকে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত আইনের শাসনের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ কোন সরকার জাতির জন্য এমন গুরম্নত্বপূর্ণ একটি বিষয়কে এভাবে পাশ কাটিয়ে বা অনিষ্পন্ন রেখে দিতে পারে_ এটা সত্যিই ছিল দুর্ভাগ্যজনক।
তবে অনেক দেরিতে হলেও বিচার সম্পন্ন হয়েছে, দ-াদেশ কার্যকর হয়েছে_ এটা জাতির জন্য স্বসত্মির বিষয়। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার একটি উলেস্নখযোগ্য দিক হচ্ছে, এটি হয়েছে দেশের প্রচলিত সাধারণ আইনে, কোন বিশেষ ট্রাইবু্যনাল গঠন করে তড়িঘড়ি আসামিদের ফাঁসি দেয়ার কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এই দৃষ্টানত্ম বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া সব রাজনৈতিক হত্যাকা-ের বিচারের ৰেত্রে এক উজ্জ্বল অনুসরণীয় দৃষ্টানত্ম হয়ে থাকবে। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় কার্যকর করা ছিল সরকারের অন্যতম প্রধান অগ্রাধিকার। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারেও এ অঙ্গীকার ছিল। ৰমতার মেয়াদের এক বছরের মাথায় রায় কার্যকর হওয়ায় সরকার ও আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারকদের মধ্যে স্বসত্মি দেখা গেছে।
বঙ্গবন্ধুর পাঁচ খুনীর ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। এখন পলাতক ছয় খুনীকে দেশে ফিরিয়ে আনতে সরকার সর্বাত্মক চেষ্টা নেবে। বিষয়টি সরকারের অগ্রাধিকারে তাকবে। তা ছাড়া জেলহত্যা মামলার পুনর্বিচার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ শুরম্ন করা, সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ দমন এবং ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার বিচার কার্যক্রম সরকার এগিয়ে নেবে। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের পাঁচটি অগ্রাধিকার তালিকার একটি হলো সুশাসন প্রতিষ্ঠা। নির্বাচনী ইশতেহারে এ অঙ্গীকারের কথা বলা আছে।
সরকারের নীতিনির্ধারকরা জানান, ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলা ও বিডিআর বিদ্রোহের বিচার করাও সরকারের অন্যতম লৰ্য। আইনের শাসন ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় এসব বিচার হওয়ার দরকার। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার মতো স্বাভাবিক আইনী প্রক্রিয়ায় এসব অপরাধের বিচার করা সম্ভব হলে দেশে আর রাজনৈতিক হত্যাকা- ঘটাতে কেউ সাহস পাবে না বলে তারা মনে করেন।
দলীয় নেতারা জানান, বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি ও তাঁর আদর্শকে কেন্দ্র করেই মূলত তাঁদের রাজনীতি। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের দাবি ছিল আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক কর্মসূচি। এ হত্যার বিচারের দাবিতে বছরের পর বছর আওয়ামী লীগের নেতা কমর্ীরা আন্দোলন সংগ্রাম করেছেন। দীর্ঘ ৩৪ বছর পর দাবি পূরণ হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারকরা খুশি। জাতীয় সংসদ এবং দলীয়ভাবে বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউয়ের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে মিলাদ মাহফিল করে আলস্নাহর দরবারে শোকরিয়া আদায় করা হয়।
দলীয় নীতিনির্ধারকরা মনে করেন যত শক্তিশালী বা ৰমতাধরই হোক, অন্যায় করে কেউ পার পায় না, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার বড় প্রমাণ। বঙ্গবন্ধুকে আর ফিরে পাওয়া যাবে না। তবে জাতি কিছুটা হলেও কলঙ্কমুক্ত হলো। আইনের শাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় এটি একটি বড় পদৰেপ।
রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন খারিজ হওয়ার পর রায় কার্যকর ও এর পরবতর্ী সময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছিলেন খুবই আবেগতাড়িত। সারাৰণ তাঁর হাতে ছিল তসবিহ আর চোখ ছিল অশ্রম্নসজল। সকালে যমুনায় দলীয় নেতা, মন্ত্রিসভার সদস্য ও আত্মীয়স্বজনদের সাৰাত দেন তিনি। এছাড়া দিনের অন্যান্য কর্মসূচিতে তিনি যোগ দেননি। কিছু সময়ের জন্য সংসদে গেলেও কোন কথা বলেননি।
২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে বিজয়ের পর আওয়ামী লীগের অন্যতম অগ্রাধিকার ছিল বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচারের রায় কার্যকর করা। আপিল বিভাগে বিচারক সঙ্কট থাকায় গত সাত বছর মামলার কাজ হয়নি। সরকার গত বছরের মার্চে আপিল বিভাগে দু'জন বিচারক নিয়োগ দেয়। ১৪ জুলাই আরও চারজন বিচারক নিয়োগ দেয়া হয়। ফলে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারকাজ শুরম্ন হয়।
বঙ্গবন্ধু হত্যার রায় কার্যকর হওয়ায় স্বসত্মি প্রকাশ করে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত বলেন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় রায় কার্যকরের ঘটনা একটি বড় পদৰেপ। পাশাপাশি এটা জাতির শাপমোচনেরও বিষয়।
কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেন, প্রমাণ হলো_ পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়। অন্যায় করে কেউ পার পায় না। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন পাপ ঢেকে রাখার চেষ্টা করা হয়েছিল। খুনীদের রৰা করার চেষ্টা করা হয়েছিল। পাপের পৰে সাফাই গাওয়ার জন্য অনেক সরকার এসেছিল। কিন্তু শেষ পর্যনত্ম জনগণকে বিভ্রানত্ম করতে পারেনি।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম রায় কার্যকরের পর সরকারের পরবতর্ী পরিকল্পনা সম্পর্কে বলেন, বঙ্গবন্ধুর পলাতক খুনীদের যত দ্রম্নত সম্ভব দেশে ফিরিয়ে এনে তাদেরও ফাঁসি কার্যকর করা হবে। তা ছাড়া এবার কেন্দ্রীয় কারাগারে জাতীয় চার নেতা হত্যা ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হবে।
বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া পনেরোই আগস্ট নিজের বানোয়াট জন্মদিন ঘোষণা করে যে অমানবিক নিকৃষ্ট নিম্নরম্নচির পরিচয় দিয়েছেন, তেমনি খুনীদের ফাঁসির রায় কার্যকর করার পরে প্রতিক্রিয়া দেয়ার ৰেত্রেও তাই-ই করেছেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খুনীদের ফাঁসির রায় কার্যকরের বিষয়ে দলীয় বা ব্যক্তিগত প্রতিক্রিয়া দেয়া থেকে বিরত থাকতে বিএনপির নেতাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ কারণে কোন প্রতিক্রিয়া জানায়নি বিএনপি ও এর কেন্দ্রীয় নেতারা।
কোন প্রতিক্রিয়া জানায়নি জামায়াতে ইসলামীও। দলের বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতাকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তারা হয় ফোন ধরেননি, নয়ত ব্যক্তিগত সহকারী ফোন ধরে বলেছেন, স্যার মিটিংয়ে আছেন।
বেশির ভাগ ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলও নিজ থেকে এ ঘটনার কোন প্রতিক্রিয়া জানায়নি। তবে যোগাযোগ করা হলে কয়েকজন নেতা দায়সারা কিছু কথা বলেন।
বঙ্গবন্ধুর খুনীদের ফাঁসি কার্যকর করার বিষয়ে বিএনপির শীর্ষ কয়েকজন নেতা বলেন, এ ব্যাপারে দলীয় বা ব্যক্তিগত প্রতিক্রিয়া না জানানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে একে কীভাবে দেখছেন জানতে চাইলেও তারা অপারগতা জানান। কয়েকজন নেতা শুধু বলেছেন এটা আইনী ব্যাপার। এ নিয়ে মনত্মব্য করা ঠিক হবে না।
জাতীয় প্রেসকাবের সামনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব মির্জা ফখরম্নল ইসলাম আলমগীরের প্রতিক্রিয়া ছিল একটা কথাই বলেন যেতে দাও।
তবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহাবুবুর রহমান মিডিয়াকে বলেন, বিষয়টি আইনী প্রক্রিয়ার মধ্যে শেষ হয়েছে। তাই বলার কিছু নেই। তিনি নিজের ব্যক্তিগত মত উলেস্নখ করে বলেন, তবে রাষ্ট্রপতি খুনীদের প্রাণভিৰা দিলে পারতেন।
বিএনপি সূত্র জানায়, দলের চেয়ারপারর্সন খালেদা জিয়া এ বিষয়ে কোন প্রতিক্রিয়া না জানাতে দলের নেতাদের নির্দেশ দিয়েছেন।
এবারে আমি পঁচাত্তরের পনোরোই আগস্টের রাতের কিছুটা স্মৃতিচারণ করতে চাই। সেই ভয়াবহ রাতের কথা মনে হলে আমি এখনও শিহরিত হই, আবেগাকুল হয়ে পড়ি। বলতে গেলে আমি ছিলাম এই হত্যাকা-ের প্রত্যৰদশর্ী। আমার বাড়িটি ছিল ধানম-ির বঙ্গবন্ধুর বত্রিশ নম্বর রাসত্মার পরের রাসত্মা একত্রিশ নম্বর রোডে। পনেরোই আগস্ট গভীর রাত্রে গোলাগুলির শব্দে আমাদের ঘুম ভেঙ্গে যায়। মনে হলো, বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিক থেকেই গুলির শব্দ হচ্ছে। এই রকম গোলাগুঠির শব্দ আমরা একাত্তরের পঁচিশে মার্চেও শুনেছিলাম। আমি বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সব টেলিফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলাম। সম্ভব হলো না। মনে হলো, লাইন কাটা। টেলিফোন করলাম বঙ্গবন্ধুর সচিব রফিকুলস্নাহ চৌধুরীকে পেলাম না। টেলিফোন করলাম কাদের সিদ্দিকিকে, পেলাম না। তখন আমার বন্ধু পাটমন্ত্রী শামসুল হককে টেলিফোনে সব জানালাম। তিনি আমাকে খন্দকার মোশতাককে টেলিফোন করতে বললেন। টেলিফোনে একটি রিং হবার পরেই খন্দকার মোশতাক নিজে টেলিফোন ধরলেন। মনে হলো, তিনি কোন টেলিফোন আবার অপেৰায় টেলিফোনের কাছেই বসে ছিলেন। বললেন কি হয় আমাকে জানিও। এরপরে আবার টেলিফোন করলাম। বললেন, বাইরে গাড়ির শব্দ পাচ্ছি, হয়ত আমাকেও ধরতে এসেছে। তার কিছুৰণ পরে রেডিওতে খুনী ডালিমের ঘোষণা শুনলাম এবং পরে খন্দকার মোশতাকের ভাষণ। সবই বোঝা গেল। কিন্তু বিধাতার পরিহাস। খন্দকার মোশতাক মাত্র কয়েকদিন রাষ্ট্রপতি থাকতে পারলেন। ইতিহাসের অন্যতম জঘন্যতম হত্যাকারী হিসাবে মীরজাফরের চাইতেও নিকৃষ্টতম ঘাতক হিসেবেই মানুষ তাকে মনে রাখবে। খন্দকার মোশতাক একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলার সময় থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিসত্মানের সঙ্গে যোগসাজশে আমাদের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছে। স্বাধীনতা পরবতর্ী সময়ে নানা কানকথা ও মিথ্যা দিয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সম্পর্ক পদত্যাগে বাধ্য করেছে। অবশেষে নিজেই বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করেছে। এই হত্যা কেবল এক ব্যক্তি ও একটি পরিবারকে হত্যা নয়, এটি একটি আদর্শের হত্যা। বাঙালীর স্বাধীনতার আকাঙ্ৰাকে হত্যা। এই হত্যা দিয়ে বাঙালীর বাঙালিত্বকে হত্যা করার চেষ্টা হয়েছে। যে মৌল আদর্শ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল সেই আদর্শকে হত্যার চেষ্টা হয়েছে। এদেশকে ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র পাকিসত্মান বানানোর চেষ্টা হয়েছে। বাঙালীর হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য, ভাষা সংস্কৃতিকে অস্বীকার করার চেষ্টা হয়েছে। এই হত্যায় বাঙালী জাতিকে অন্ধকার মধ্যযুগে ফিরিয়ে নেয়ার অপচেষ্টা করা হয়েছে। ইতিহাসের অগ্রযাত্রা ব্যাহত করে বাঙালীকে অভীষ্ট লৰ্যে পেঁৗছাতে বাধা সৃষ্টি করেছে।
পরিশেষে একটি কথা গুরম্নত্বের সঙ্গে বিবেচনার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানাব। তা হলো এই হত্যাকা-ের নিবিড় তদনত্ম করে পরিকল্পনাকারী ও ষড়যন্ত্রকারীদের চিহ্নিত করে শাসত্মি দিতে হবে। এখনও এই হত্যার পূর্ণ রহস্য উদ্ঘাটিত হয়নি। এই ষড়যন্ত্রকারীদের নেটওয়ার্ক এখনও দেশে-বিদেশে কাজ করে যাচ্ছে। এই নেপথ্যে থাকা কুশীলবদের খুঁজে বের করতে হবে। তারা সমাজের বিভিন্ন সত্মরে বিভ্রানত্মি ছড়াচ্ছে। এমনকি তারা সেনাবাহিনী, পুলিশবাহিনী ও প্রশাসনে ঘাপটি মেরে আছে। তারাই দেশে ধর্মান্ধ মৌলবাদী জঙ্গীদের প্রশ্রয় দিচ্ছে, জঙ্গীদের নিরাপত্তা দিচ্ছে। ধর্মের নামে তারা দেশে অরাজকতা- বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করবে। সর্বোপরি, বঙ্গবন্ধু কন্যা বাঙালীর আশার প্রদীপ শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা করবে। তাদের এই ষড়যন্ত্রকে ব্যর্থ করতে হবে। তা না হলে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন কখনও বাসত্মবায়িত হবে না।
লেখক : ভাষাসৈনিক, মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক ও সাবেক সচিব
No comments