একুশের মাস আমরা বরকতের ভাই, আমরা সালামের ভাই by নিয়ামত হোসেন
বছর ঘুরে আবার আমাদের কাছে এসেছে আমাদের প্রিয় সেই মাস_ ফেব্রম্নয়ারি। আমাদের আবেগ-অনুভূতির সঙ্গে মিশে আছে যে মাসের স্মৃতি, যে মাস আমাদের সব সময় উজ্জীবিত করে, মনে সাহস এনে দেয়, সেই মাসের নাম ফেব্রম্নয়ারি।
আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন আমাদের স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতার পথে এগিয়ে যাওয়ার সবচেয়ে বড় প্রেরণা পাওয়া গেছে এই ফেব্রম্নয়ারির কাছ থেকে।ফেব্রম্নয়ারি ইংরেজী যে কোন মাসের মতো একটা মাস অন্য সবার কাছে হলেও আমাদের কাছে ফেব্রম্নয়ারি মানে একুশে ফেব্রম্নয়ারি। আমাদের মাতৃভাষা, আমাদের ভাষা সাহিত্য, শিল্পকলা, আচার-ঐতিহ্যকে নতুন করে ভালবাসার, সেগুলোকে সংরৰণ ও সমৃদ্ধ করার প্রেরণা একুশে ফেব্রম্নয়ারি। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রম্নয়ারির পর প্রতিটি একুশে ফেব্রম্নয়ারি আমাদের কাছে প্রেরণার অনন্য উৎস হযে দাঁড়িয়েছে। মাতৃভাষা শিল্পকলা সংস্কৃতির রৰার ব্যাপারে সঙ্কল্প গ্রহণের দিন হয়ে উঠেছে। সেই থেকে গোটা ফেব্রম্নয়ারি মাসটাই আমাদের কাছে হয়ে উঠেছে একুশের মাস।
১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ হওয়ার পর পাকিসত্মান সৃষ্টি হওয়ার অল্প কিছুকাল পরই এদেশের মানুষ বুঝতে পারে এক ঔপনিবেশিক শাসন বিদায় নিলেও গেড়ে বসেছে আরেক ঔপনিবেশিক শাসন। ব্রিটিশ শাসন শেষ হয়েছে, শুরম্ন হয়েছে ঔপনিবেশিক ধরনের পাকিসত্মানী অপশাসন। সেই অপশাসনের একের পর এক নগ্ন চেহারা দেখল এদেশের মানুষ। বাংলাভাষা ও সংস্কৃতির ব্যাপারে তাদের আচরণ ব্যবহার নির্দেশ এদেশের মানুষকে দুঃখিত, ব্যথিত ও ৰুব্ধ করে। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রম্নয়ারির পরই পাকিসত্মানী শাসকদের প্রকৃত চেহারা পরিষ্কার হয়ে ওঠে। বোঝা যায়, তারা কিছুতেই বাংলাকে পাকিসত্মানের রাষ্ট্রভাষা করবে না। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে ভুলিয়ে দেয়া, তাকে বিকৃত ও নষ্ট করে দেয়ার চক্রানত্মে লিপ্ত হয়েছে তারা। ১৯৪৭ সালে পাকিসত্মান প্রতিষ্ঠার পরের বছরই পাকিসত্মানের জনক জিন্নাহ সাহেব ঢাকায় এসেছিলেন। সেটা ১৯৪৮ সাল। ঢাকায় তিনি পরিষ্কারভাবে দৃঢ়তার সঙ্গে বলে যান_ পাকিসত্মানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। তার সে কথার প্রতিবাদ উঠেছিল। তারপর দিন যতই এগোতে থাকে, ভাষার প্রশ্নে পাকিসত্মানী শাসকের অনমনীয় মনোভাব দেখাতে থাকে। একুশে ফেব্রম্নয়ারি তার চরম অভিপ্রকাশ ঘটে। ঢাকায় গুলি চলে মাতৃভাষা বাংলার জন্য আন্দোলনকারীদের ওপর। তারপর পরিষ্কার হয়ে যায় সব। ওরা এদেশের মানুষের মাতৃভাষাকে একেবারেই গ্রাহ্য করে না। এটা যে এদেশের মানুষের পরম প্রিয় সেটা স্বীকার করে না। তাই বাংলাকে বাদ দিতে হবে, তার ৰতি করতে হবে, উদর্ুর প্রসার ঘটাতে হবে, বাংলাভাষা সংস্কৃতিকে বিদায় করে দিয়ে এদেশের মানুষের ওপর পাকিসত্মানী আদব-কায়দা তাহাজিব-তমদ্দুন চাপিয়ে দেয়া হবে_ শুরম্ন হলো এমনি সব উদ্ভট পরিকল্পনা। শুরম্ন হলো বাংলাকে বিকৃত করার চেষ্টা। এতে অতি উৎসাহী একজন তাহজিব প্রেমিক বাঙালীও অতি উৎসাহী হয়ে পড়লেন। কাজী নজরম্নলের কবিতায় যেসব 'ভুল' ছিল সেগুলোকে শোধরানোর মহাদায়িত্ব তারা হাতে নিলেন। নজরম্নলের কবিতায় যেখানে আছে মহাশ্মশান, সেখানে করা হলো গোরসত্মার। কবির আরেকটি কবিতায় 'ভগবান ভগবান' কথার পরিবর্তে লাগানো হলো 'রহমান রহমান।' এঁদের মুরবি্বরা নজরম্নলের মতো বিশ্বমানবতার মহান কবিকে উপস্থাপন করতে শুরম্ন করলেন একপেশে ভাবে, খ-িতভাবে এবং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ করার ঘোষণাও পাকাপোক্ত করলেন। অর্থাৎ আমাদের যুগযুগের আচার ঐতিহ্য সংস্কৃতিকে ত্যাগ করে বিজাতীয় আদর্শে উদ্বুদ্ধ করার যাবতীয় উদ্যোগ পাকিসত্মানী শাসক ও তাদের চাটুকাররা করেছিলেন। এদের কাজকমর্, মানসিকতা সবকিছু ছিল উদ্ভট ধরনের। অন্যের ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি যে সাধারণ শ্রদ্ধা থাকা প্রয়োজন, সেটুকুও এদের ছিল না। বাংলাভাষার জন্য আন্দোলনকে এরা মনে করত বিদেশীদের উস্কানি। অন্য দেশের গোয়েন্দারা বাঙালীদের উস্কে দিয়ে আন্দোলন করাচ্ছে। কিন্তু বাঙালী ছাত্রজনতা ও এদেশের মানুষ ওদের চক্রানত্মের বিরম্নদ্ধে, রক্তচৰুর বিরম্নদ্ধে রম্নখে দাঁড়িয়েছে। প্রতিটি ৰেত্রে সমুচিত জবাব দেয়া হয়েছে। পাকিসত্মানী আমলে রবীন্দ্রনাথের গান নিষিদ্ধ করা হলে তার বিরম্নদ্ধে প্রতিবাদ উঠেছে। রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠান হয়েছে ঢাকায়। প্রবীণ-নবীন, ছাত্রজনতা সবাই তাতে যোগ দিয়েছে। পাকিসত্মানী শাসকদের কোন কিছুকেই বিনাপ্রতিবাদে ছেড়ে দেয়া হয়নি।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রম্নয়ারিতে প্রাণ দিলেন বরকত, সালাম, রফিক, জব্বারসহ অনেকেই। কারও কারও লাশ লুকিয়ে ফেলল পুলিশ। সেদিন নির্বিচারে গুলি চলেছিল। বহু মানুষ হতাহত হয়েছিল। পাকিসত্মানী কতর্ৃপৰ এই ঘটনা চাপা দেয়ার চেষ্টা করেছে। একুশে ফেব্রম্নয়ারির ঘটনার পর পর গড়ে তোলা হয় শহীদ মিনার। সেটাই প্রথম শহীদ মিনার। পাকিসত্মানী পুলিশ সে মিনার ভেঙে নষ্ট করে দেয়। এই মিনারের ওপর তাদের এবং তাদের চাটুকারদের বরাবরই প্রচ- রাগ। এটা বহুবার, বহু ঘটনায় প্রমাণ পাওয়া গেছে। শহীদ মিনার ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মৃতির স্মরণে তৈরি করা হয়। সেখানে শ্রদ্ধা জানানো হয়। বিভিন্ন প্রজন্মের মানুষ সেখানে শ্রদ্ধা জানান। কিন্তু এটা কেন হবে? কেন সেখানে ফুল দেয়া হবে? গাত্রদাহ শুরম্ন হয় পাকিসত্মানী কতর্ৃপৰ ও তাদের মতাদর্শের অনুসারীদের। শহীদ মিনারে শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশে ফুল দেয়ার ঘটনাকে খুব খারাপ কাজ হিসাবে চিহ্নিত করার চেষ্টা বহুবার করেছে ওরা। প্রথম শহীদ মিনার ওরা ধ্বংস করে দিয়েছিল। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পরে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো বাঙালীর গৌরবের ধন শহীদ মিনারকে পাকিসত্মানী হানাদার বাহিনীর সদস্যরা কামান মেরে ধ্বংস করে দিয়েছিল। বাংলাভাষা সংস্কৃতির ওপর ওদের প্রচ- রাগ, বাংলাভাষার জন্য প্রাণদানের স্মারক শহীদ মিনারের ওপরও তাদের প্রচ- রাগ। এক কথায় ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর ওদের অর্থাৎ পাকিসত্মানী শাসকদের ভয়ানক রাগ! হিটলাদের প্রচ- রাগ ছিল শিৰা সংস্কৃতির ওপর। লাইব্রেরি উজাড় করে বই নিয়ে এসে বার্লিন নগরীর রাসত্মায সেগুলোকে সত্মূপীকৃত করে হিটলারের নাৎসী সৈন্যরা আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। হিটলারে বইয়ের অগ্নু্যৎসবের সঙ্গে পাকিসত্মানী নব্য নাৎসীদের কাজের সাদৃশ্য লৰ্য করার মতো।
একুশে আমাদের সাহস জুগিয়েছে। পাকিসত্মানী শাসকদের রক্তচৰুর বিরম্নদ্ধে ওদের ঔদ্ধত্যের বিরম্নদ্ধে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ জানানোর সাহস জুগিয়েছে। এই একুশে এদেশের মানুষকে একের পর এক আন্দোলনের দীর্ঘপথ পার হয়ে নিয়ে গেছে একাত্তরে। তারপর সেই একই ঘাতক নব্য ঔপনিবেশিকদের বিরম্নদ্ধে রম্নখে দাঁড়িয়ে পূর্ণ মুক্তির মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনের দুর্বার সাহস জুগিয়েছে একুশে ফেব্রম্নয়ারি।
একুশে ফেব্রম্নয়ারি ছিল একানত্মভাবে আমাদের। সেই পাকিসত্মানী আমলে একুশের ভোরে খালি পায়ে একুশের গান গেয়ে প্রভাতফেরি হয়েছে। দলে দলে মানুষ গেছে আজিমপুর গোরসত্মানে শহীদদের মাজারে, গেছে শহীদ মিনারে। কোনদিন মানুষ একুশে ফেব্রম্নয়ারিকে ভোলেনি। যে একুশে ফেব্রম্নয়ারি ছিল একানত্মভাবে আমাদের গর্ব এবং গৌরবের ঘটনা। সেই একুশে এখন ছড়িয়ে গেছে বিশ্বময়। আনত্মর্জাতিক অঙ্গনে এখন একুশে ফেব্রম্নয়ারি আনত্মর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। আজ বিশ্বজুড়ে একুশে ফেব্রম্নয়ারি প্রত্যেক জাতিকে তার মাতৃভাষাকে নতুন করে ভালবাসতে উদ্বুদ্ধ করে।
একুশে ফেব্রম্নয়ারি আমাদের অনেক কিছু দিয়েছে। আমাদের কাছেও রয়েছে একুশের অনেক দাবি, রয়েছে একুশের অনেক করণীয়।
এখন আমাদের স্বাধীন দেশে আমাদের মাতৃভাষাকে আমাদের সংস্কৃতিকে রৰা করতে হবে, লালন করতে হবে, সমৃদ্ধ করতে হবে। আমাদের মাতৃভাষাকে আমরা ভালবাসি, অন্যের মাতৃভাষার প্রতিও আমাদের শ্রদ্ধা রয়েছে। ছোট হোক বড় হোক, প্রত্যেক জাতির মাতৃভাষাকে রৰার ব্যাপারে সে জাতিকে সাধ্যমতো আমরা সাহায্য করব। সমর্থন দেব, আমাদের সংস্কৃতিকে রৰা করব এই সংস্কৃতিকে বিকৃতির হাত থেকে, অপসংস্কৃতির কবল থেকে রৰার করব। এসবই একুশের করণীয়, একুশের প্রতি দায়িত্ব পালন। অপসংস্কৃতির প্রসার ঘটে দ্রম্নত। আগাছা খুব দ্রম্নত বাড়ে। ফুলগাছের যত্ন করতে হয়। অপসংস্কৃতির আগাছার মতো ফুলের বাগানকে গ্রাস করতে চায়। ফুলগাছ বাঁচানোর জন্য অপসংস্কৃতির আগাচা পরিষ্কার করা দরকার। অপসংস্কৃতির আগাছা থেকে আমাদের সাবধান থাকতে হবে। আমাদের সংস্কৃতির ফুলগাছগুলোকে রৰা করতে হবে। সংস্কৃতির প্রধান বাহন ভাষা আমাদের বাংলাভাষা খুবই বিজ্ঞানসম্মত। এমনিতেই আমাদের বাংলাভাষা ও সাহিত্য অনেক সমৃদ্ধ। উচ্চারণ ৰমতার দিক থেকেও বাংলাভাষা বিশ্বের অনেক ভাষার চাইতে বেশি সমৃদ্ধ। আমাদের বাংলাভাষা লিখলে সেটা দেখতেও সুন্দর। অথর্াৎ আমাদের বর্ণমালাও সুন্দর। অথচ পাকিসত্মানী আমলে এই বর্ণমালা বদলানোর ষড়যন্ত্র হয়েছিল অ-আ-ক_খ বাদ দিয়ে অন্য ভাষার বর্ণ দিয়ে বাংলা লেখার আবদার করা হয়েছিল। কিন্তু সব অপচেষ্টাই ব্যর্থ হয়ে গেছে। একুশে ফেব্রম্নয়ারি সব অপচেষ্টার প্রতি এনেছে এক প্রবল চপেটাঘাত। বরকত-সালামেরা নিজের জীবন দিয়ে এই ভাষার মহিমা ও মার্যাদা সমুন্নত রেখে গেছেন। আমরা সেই বীরদের উত্তরসূরি। আমরা গর্ব করে বরতে পারি : 'আমরা বরকতের ভাই, আমরা সালামের ভাই।' এই গৌরবের উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের করণীয় হচ্ছে, আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে রৰা করা, দেশের প্রত্যেকের ঘরে ঘরে এই সুস্থ সংস্কৃতিকে পেঁৗছে দেয়া, শিৰার আলো ঘরে ঘরে পেঁৗছে দেয়া। দেশ থেকে নিরৰরতা দূর করা, কাজে সর্বত্তোভাবে চেষ্টা ও সহায়তা করা। প্রাণ দিয়ে একুশের শহীদের যে সংস্কৃতি ভাষা ও তার বর্ণমালা রৰা করে গেছেন সেগুলোকে এদেশের মানুষের ঘরে ঘরে পেঁৗছে দেয়া আমাদের কর্তব্য। একুশেরই অর্পণ করা দায়িত্ব এটা।
No comments