খন্দকার মোশতাক ফোনে বলেন মোসলেহউদ্দিনসহ ওদের কাজ করতে দাও- জেলহত্যা মামলার আপিলের শুনানি- রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান আইনজীবী আনিসুল হকের বক্তব্য
বহুল আলোচিত জাতীয় চার নেতা হত্যা (জেল হত্যা) মামলায় হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিল আবেদনের ওপর শুনানি শুরু হয়েছে। এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান আইনজীবী আনিসুল হক শুনানিতে বলেন,
‘সাক্ষীদের বক্তব্যে এসেছে, তৎকালীন রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ সে সময়কার কারা মহাপরিদর্শককে ফোনে বলেছেন, মোসলেহ উদ্দিনসহ যে ক’জন গেছে, তাদের কাজ করতে দাও। এ সময় কারা মহাপরিদর্শক রাষ্ট্রপতিকে বলেন, তারা জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করতে চায়। জবাবে রাষ্ট্রপতি বলেন, করতে দাও।’ মঙ্গলবার প্রধান বিচারপতি মোঃ মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে আপীল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে আনিসুল হকের বক্তব্যের মধ্য দিয়েই জাতীয় চার নেতা হত্যা মামলায় হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের করা আপীল আবেদনের শুনানি শুরু হয়। পরে আগামী ২২ জানুয়ারি পর্যন্ত শুনানি মুলতবি করা হয়েছে।আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে অংশ নেন এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান আইনজীবী এ্যাডভোকেট আনিসুল হক, এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এবং আসামি পক্ষে উপস্থিত ছিলেন সরকার কর্তৃক নিযুক্ত আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ আল মামুন।
শুনানিতে আনিসুল হক এ মামলার সাতজন সাক্ষীর বক্তব্যের বিস্তারিত তুলে ধরেন। তিনি বলেন, সাক্ষীরা সকলেই সে সময়ে কারা কর্মকর্তা-কর্মচারী ছিলেন। এরা হলেন- কারা মহাপরিদর্শক এটিএম নুরুজ্জামান, উপ-কারা মহাপরিদর্শক কাজী আব্দুল আউয়াল (মামলার বাদী), জেলার মোঃ আমিনুর রহমান, ডেপুটি জেলার মোহাম্মদ আব্দুর রউফ, কারাগারের নিরাপত্তা প্রহরী মহব্বত আলী, আলাউদ্দিন শিকদার ও মোঃ ইসমাইল হোসেন।
আনিসুল হক শুনানিতে বলেন, ‘সাক্ষীদের বক্তব্যে এসেছে, তৎকালীন রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ সে সময়কার কারা মহাপরিদর্শককে ফোনে বলেছেন, মোসলেহ উদ্দিনসহ যে ক’জন গেছে, তাদের কাজ করতে দাও। এ সময় কারা মহাপরিদর্শক রাষ্ট্রপতিকে বলেন, তারা জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করতে চায়। জবাবে রাষ্ট্রপতি বলেন, করতে দাও।’ তিনি বলেন, ‘সেদিন মোসলেহ উদ্দিনের সঙ্গে ক্যাপ্টেন আব্দুল মাজেদ, দফাদার মারফত আলী ও দফাদার মারফত আলী শাহ ছিল।’
এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম শুনানিতে বলেন, এ মামলায় বঙ্গভবন ও কারাগার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। হাইকোর্টের রায়ের অসঙ্গতি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ৩ নবেম্বর সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে। তাই বঙ্গভবন থেকে বের হওয়া প্রায় অসম্ভব। টেলিফোন সংযোগ কাটা ছিল বলে কথোপকথনের সুযোগ ছিল না বলে যে তথ্য উল্লেখ করা হচ্ছে তা বিভ্রান্তিকর তথ্য। এ দুটি বিষয় বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হবে।
শুনানি শেষে আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেন, এ মামলায় হাইকোর্ট আপীলকারী সকল আসামিকে খালাস দিয়ে একমাত্র রিসালদার মোসলেহ উদ্দিনের মৃত্যুদ- বহাল রাখে। আমরা এ রায়ের বিরুদ্ধে আপীলে বলেছি, হাইকোর্টের রায় বিকৃত, পক্ষপাতদুষ্ট ও ন্যায়বিচারের পরিপন্থী। আমরা ন্যায়বিচারের জন্য আপীল বিভাগে আবেদন করেছি। তিনি বলেন, শুনানিতে সাতজন সাক্ষীর সাক্ষ্য তুলে ধরেছি। কারণ হচ্ছে, হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়েছে একজন হত্যাকা- ঘটিয়েছে। একজন হত্যাকা- ঘটায়নি সেটা প্রমান করার জন্যই সাতজন সাক্ষীর বক্তব্য উপস্থাপন করা হচ্ছে।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ১৯৭৫ সালের ৭ নবেম্বর থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে এ মামলার কার্যক্রম বন্ধ করে রাখা হয়। তিনি আরও বলেন, বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর যাতে গণতান্ত্রিক সরকার আর ক্ষমতায় আসতে না পারে সেটা নিশ্চিত করতেই কারাগারে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়।
১৯৭৫ সালের ৩ নবেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জাতীয় চারনেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী এবং এএইচএম কামারুজ্জামানকে হত্যা করা হয়। ওই ঘটনায় দায়ের করা মামলায় ২০০৪ সালের ২০ অক্টোবর ঢাকা মহানগর দায়রা জজ মোঃ মতিউর রহমান রায় দেন। রায়ে রিসালদার মোসলেম উদ্দিন (পলাতক), দফাদার মারফত আলী শাহ (পলাতক) ও এলডি (দফাদার) আবুল হাসেম মৃধাকে (পলাতক) মৃত্যুদ- দেয়া হয়। এছাড়া বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদ-প্রাপ্ত চার আসামি সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, বজলুল হুদা ও একেএম মহিউদ্দিন আহমেদসহ ১২ জনকে যাবজ্জীবন কারাদ- দেয়া হয়। সাবেক মন্ত্রী কেএম ওবায়দুর রহমান, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, নুরুল ইসলাম মঞ্জুর ও তাহেরউদ্দিন ঠাকুরকে খালাস দেয়া হয়।
ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপীল হলে হাইকোর্ট ২০০৮ সালে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত দুই আসামি মারফত আলী ও হাশেম মৃধাকে খালাস দেন। রায়ে মোসলেমের মৃত্যুদ- বহাল রাখা হয়। যাবজ্জীবন কারাদ-প্রাপ্ত ফারুক, শাহরিয়ার রশিদ, বজলুল হুদা ও একেএম মহিউদ্দিন আহমেদকেও খালাস দেয় হাইকোর্ট। হাইকোর্টের এ রায়ের বিরুদ্ধে ২০০৯ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর আপীলের আবেদন (লিভ টু আপীল) করে রাষ্ট্রপক্ষ। পরে ২০১১ সালের ১১ জানুয়ারি হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের করা লিভ টু আপীল আবেদন (আপীল করার অনুমতি চেয়ে আবেদন) তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের নেতৃত্বে আপীল বিভাগ মঞ্জুর করে। একইসঙ্গে ওই আদেশে দফাদার মারফত আলী শাহ ও এল ডি (দফাদার) আবুল হাসেম মৃধাকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেয় আপীল বিভাগ। অন্যথায় এ দু’জনকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেয় আদালত। এছাড়া আদালত ৩০ দিনের মধ্যে আপীলের সংক্ষিপ্তসার তৈরি করে জমা দিতে নির্দেশ দেয়। কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষ গত বছর ৪ নবেম্বর তা জমা দেয়। এরপর মঙ্গলবার আপীল আবেদনের শুনানি শুরু হলো।
No comments