পদ্মা সেতু ॥ পদ্মা সেতু বাস্তবায়নে সরকার এখন আশাবাদী- ফেব্রুয়ারিতে কাজ শুরু হবে দাবি কাদেরের by মহিউদ্দিন আহমেদ
পদ্মা সেতু বাস্তবায়নে আবারও আশাবাদী হয়ে উঠেছে সরকার। দুর্নীতি দমন কমিশনের কার্যক্রমে বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ প্যানেলের ইতিবাচক সাড়া মেলায় এমন আশা জাগে।
যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের মঙ্গলবার দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন, ফেব্রুয়ারিতেই পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হবে। এ ছাড়া চলতি মাসেই বিশ্বব্যাংক তাদের অবস্থান ব্যক্ত করবে বলে জানিয়েছেন সংস্থাটির আবাসিক প্রতিনিধি এ্যালান গোল্ডস্টেইন। একইদিন সন্ধ্যায় প্যানেলপ্রধান ওকাম্পোর পক্ষে বিবৃতি দিয়েছে সংস্থাটির বাংলাদেশ অফিস। এদিকে চলতি মাসের ৯ তারিখে বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ প্যানেলপ্রধান ওকাম্পোর প্রেরিত চিঠিকে দুদক কমিশনার মোঃ সাহাবুদ্দিন চুপ্পুর মতো মঙ্গলবার চেয়ারম্যান গোলাম রহমানও ইতিবাচক বলেছেন। অন্যদিকে রমেশের ডায়েরি অনুলিপি উদ্ধারের বিষয়ে কানাডিয়ান পুলিশের কাছ থেকেও দুদক আশাব্যঞ্জক সাড়া পেয়েছে। তদন্তে যাদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যাবে তাদের মামলার চার্জশীটভুক্ত করা হবে বলে এদিন জানালেন দুদক সচিব ফায়জুর রহমান।দীর্ঘ অনুসন্ধান শেষে গত ১৭ ডিসেম্বর পদ্মা সেতুর প্রকল্পের পরামর্শক প্রাক-যাচাইতে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রেও অভিযোগে সাতজনকে আসামি করে মামলা করে দুদক। মামলা দায়েরের পর পরই মামলার এজাহার কপি প্রেরণ করা হয় বিশ্বব্যাংক বিশেষজ্ঞ প্যানেলের কাছে। তারা এজাহার দেখে চলতি মাসের ৯ তারিখে লিখিত আকারে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। সেই প্রতিক্রিয়া সোমবার আনুষ্ঠানকিভাবে প্রকাশ করে দুদক কমিশনার সাহাবুদ্দিন চুপ্পু। এদিন তিনি বিশেষজ্ঞ প্যানেলের চিঠিকে সন্তোষজনক বলে উল্লেখ করেন। এরপরের দিন মঙ্গলবার সংস্থাটির চেয়ারম্যান গোলাম রহমানও দাবি করেন পদ্মা সেতুর পরামর্শক যাচাই প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির অভিযোগে দুদকের দায়ের করা মামলার প্রতিক্রিয়ায় বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ প্যানেলের প্রেরণ করা চিঠি ইতিবাচক। তিনি বলেন, বিশ্বব্যাংকের চিঠিতে কোথাও হ্যাপি কিংবা আন-হ্যাপি শব্দটির উল্লেখ নেই। অহেতুক কিছু লিখে চায়ের কাপে ঝড় তোলাও ঠিক হবে না। তিনি বলেন, চিঠিতে বিশ্বব্যাংকের প্যানেল অব এক্সপার্টস তদন্তের অগ্রগতির জন্য আমাদের কিছু পরামর্শ দিয়েছে।
দুদক চেয়ারম্যান বলেন, বিশেষজ্ঞ দল চিঠিতে জানিয়েছে, তাদের কাছে দুদকের মামলা গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে। বিশ্বব্যাংক প্যানেলের পাঠানো চিঠি অভিজ্ঞ লোক লিখেছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, তবে এই চিঠির সঙ্গে দুদকের কোন দ্বিমত নেই। তিনি বলেন, তার কাছে বিশ্বব্যাংক প্যানেলের চিঠি অত্যন্ত ইতিবাচক মনে হয়েছে।
প্যালের চিঠির এ বিবরণ প্রসঙ্গে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, মামলা করার পর আমাদের তদন্ত সম্পর্কে তাদের কিছু প্রশ্ন রয়েছে। এখন আমরা সেসব প্রশ্নের উত্তর যথাসময়ে দেব। তবে সেটা আপনাদের (সাংবাদিবকদের) বলব না। দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের বিষয়ে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের ভূমিকা চিঠিতে উল্লেখ আছে দুদকের এজাহারে সেভাবে উল্লেখ নেই কেন? এমন প্রশ্নের জাবাবে তিনি বলেন, প্যানেল আমাদের সঙ্গে বৈঠকেও কানাডার প্রতিষ্ঠান এসএনসি লাভালিনের সঙ্গে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের সাক্ষাতের বিষয়টি উল্লেখ করে তাঁকে আসামি করার ব্যাপারে বলেছেন। কিন্তু কমিশনের কাছে তখন পর্যন্ত মামলার আসামি করার মতো যথেষ্ট তথ্য-উপাত্ত ছিল না। সেটা প্যানেলও মেনে নিয়েছে। তিনি বলেন, মামলা করবে দুদক। মামলা হবে দেশের আইনে। এই ক্ষেত্রে অন্য কিছু দেখার বিষয় নয়। দুদকের দায়ের করা মামলার এজাহারে কেন আবুল হোসেনের ঘুষের পার্সেন্ট উল্লেখ করা হয়নি? এমন প্রশ্নের জবাবে গোলাম রহমান বলেন, প্যানেল তাদের চিঠিতে সেটা উল্লেখ করার প্রয়োজন মনে করেছে তাই উল্লেখ করেছে। আমার উল্লেখ করার প্রয়োজন মনে করিনি সে কারণে করা হয়নি। তদন্তাধীন বিষয় নিয়ে এভাবে খোলামেলা কথা ঠিক নয় বলে মন্তব্য করে বলেন, তাহলে তদন্তকাজ বাধাগ্রস্ত হয়। মামলার চার্জশীটে আবুল হোসেন ও আবুল হাসানের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হবে কি না জানতে চাইলে চেয়ারম্যান বলেন, সেটা তদন্ত শেষে দেখা যাবে। এখন বলা যাবে না। সোমবার গণমাধ্যমে দেয়া বক্তব্যের বিষয়ে সাহাবুদ্দিন চুপ্পু বলেন, নিজের বক্তব্য সঠিক দাবি করে মঙ্গলবারও তিনি বলেন, ‘আইএম ক্লিয়ার টু মাই কনশিয়েন্স। বিশ্বব্যাংকের সন্তুষ্ট হওয়ার বিষয়ে সাংবাদিকরা তাঁর বক্তব্য খ-ন করতে চাইলে তিনি ফের দাবি করেন, ‘আমি যা বলেছি, বুঝে-শুনেই বলেছি।’ কারণ তাঁরা অসন্তুষ্টির কথা বলেননি। তা ছাড়া তাঁরা অসন্তুষ্ট হলে দুদকের তদন্ত পর্যবেক্ষণে আসার আগ্রহ প্রকাশ করার প্রশ্ন আসে না।
একইদিন রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্প নিয়ে তৈরি হওয়া সব অনিশ্চয়তা আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যে কেটে যাবে। এ সময় দৃঢ়তার সঙ্গে তিনি আরও বলেন, সরকারের বাকি মেয়াদের মধ্যে আমরা পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শুরু করতে পারব। একই সঙ্গে ফেব্রুয়ারির মধ্যে মূল সেতুর নির্মাণকাজের ব্যাপারে সব অনিশ্চয়তার অবসান এবং সবকিছু দিবালোকের মতো পরিষ্কার হয়ে যাবে বলে মন্তব্য করেন তিনি। যোগাযোগমন্ত্রী বলেন, ‘বিশ্বব্যাংক কী ভাবছে, সেটি বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধি বলবেন। সরকারের বক্তব্য অর্থ মন্ত্রণালয়, ইআরডি আর দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের মামলার বিষয়ে দুদক বলবে।
একই অনুষ্ঠানে পদ্মা সেতুর পরামর্শক যাচাই প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের মামলার প্রতিক্রিয়ার বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের তিন সদস্যের প্যানেলের দুদকের কাছে প্রেরিত প্রতিক্রিয়ার বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের আবাসিক প্রতিনিধি এ্যালান গোল্ডস্টেইন বলেন, বিশ্বব্যাংকের মতামত প্যানেল দেয়নি। বিশ্বব্যাংকও প্যানেলের মতামত দেয় না। এ্যালেন গোল্ডস্টেইন বলেন, এটি বিশ্বব্যাংকের মতামত নয়। তবে বিশেষজ্ঞ দলের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে পরবর্তী সময়ে বিশ্বব্যাংক তাদের নিজস্ব অবস্থান ব্যাখ্যা করবে। গোল্ডস্টেইন আরও বলেন, ‘গণমাধ্যমে যে খবর প্রকাশিত হচ্ছে, তা বিশেষজ্ঞ দলের বক্তব্য। ওই দলটি পুরোপুরি স্বাধীন। এ মুহূর্তে বিশেষজ্ঞ দলের বক্তব্য জানার জন্য অপেক্ষা করছে বিশ্বব্যাংক। সে বক্তব্য জানার পরই আমরা সিদ্ধান্ত ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব। বিশেষজ্ঞ প্যানেল প্রধান মেরিনো ওকাম্পোর পক্ষে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ অফিস মঙ্গলবার সন্ধ্যায় একটি সংক্ষিপ্ত বিবৃতি দেয়। এতে বলা হয়েছে, ঢাকা সফরের সময় দুদকের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনার প্রশংসা করেছে বিশেষজ্ঞ প্যানেল। দুদকের মামলার এজাহারকে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে দেখে তারা। এজাহারটি পর্যালোচনা করে তারা তদন্তের পরিধির বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে প্যানেল। সম্প্রতি দেয়া চিঠির মাধ্যমে পরবর্তী পর্যায় অধিকতর স্বচ্ছ তদন্তের জন্য কিছু বিষয়ে ষ্পষ্ট ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে। এখন আমরা (প্যানেল) দুদকের উত্তরের অপেক্ষায় আছি। উত্তর পাওয়ার পর পরবর্তী মতামত জানানো হবে।
অন্যদিকে মামলার সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে কানাডিয়ান পুলিশের কাছে থাকা রমেশ সাহার ডায়েরির অনুলিপি পাওয়ার জন্য দুদকের তদন্ত টিম কানাডায় যাওয়ার জন্য এ্যাটর্নি জেনারেলের মাধ্যমে কানাডা সরকারের কাছে বার বার আবেদন করার পর সম্প্রতি সাড়া মিলেছে। সম্প্রতি কানাডা সরকারের পক্ষে রয়্যাল কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশের (আরসিএমপি) পাঠানো ওই চিঠিতে কিছু তথ্য-উপাত্ত চাওয়া হয়েছে দুদকের কাছে। চিঠিতে দুর্নীতি ষড়যন্ত্রের অভিযোগে দায়ের করা মামলার কপি, তথ্য সংগ্রহের জন্য দুদকের টিম কানাডায় গিয়ে কী কী কাজ করবে তার একটি কর্মপরিকল্পনা চাওয়া হয়। এ ছাড়া বিদেশ থেকে প্রাপ্ত তথ্য-প্রমাণের নথি কোন আইনের আওতায় গ্রহণ করা হয়ে থাকে সে আইনের কপিও চাওয়া হয়েছে।
আবুল হোসেনের বক্তব্য ॥ পদ্মা সেতু প্রকল্পে পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের মামলার পর বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ প্যানেল ৯ জানুয়ারি যে চিঠি দিয়েছে, তার বক্তব্য আপত্তিকর বলেছেন সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন। মঙ্গলবার গণমাধ্যমে প্রেরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে তিনি বলেন, যেহেতু বিষয়টি বিচারাধীন, সেহেতু চিঠির পুরো অংশ সম্পর্কে কিছু বলতে চাই না। চিঠির ভাষা, শব্দবিন্যাস ও বক্তব্য আপত্তিকর এবং তারা একটি বিশেষ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে যে তৎপর তা যে কোন মানুষের কাছে প্রতিভাত হবে।
আবুল হোসেন বিবৃতিতে আরও বলেন, দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সুপারিশ অনুসারেই বিশ্বব্যাংকের বিভিন্ন স্তরের অনুমোদন অতিক্রম করে দরপত্র মূল্যায়ন চূড়ান্ত পর্যায়ে অগ্রসর হয়েছে। এক্ষেত্রে মন্ত্রী হিসেবে সুপারিশ গ্রহণ ছাড়া আমার কোন সম্পৃক্ততা ছিল না। আমি মূল্যায়ন কমিটির কোন সদস্যের কাছে কোন প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে কোন তদবির করিনি। আমি তদবির করেছি, এ কথা কোন সদস্য বলেননি, বলতে পারবেন না। মূল্যায়ন স্তরে যদি মন্ত্রীর কোন ভূমিকা রাখার সম্ভাবনা না থাকে তাহলে মন্ত্রীর সম্পৃক্ততা কিভাবে থাকে? কেন আমাকে অহেতুক সম্পৃক্ত করার চেষ্টা এটা ষড়যন্ত্র বৈ আর কিছু নয়।
No comments