শ্রদ্ধাঞ্জলি-বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অন্যতম নেতা অলি আহাদ স্মরণে by বদরুদ্দীন উমর

গত ২০ অক্টোবর ২০১২ অলি আহাদের জীবনাবসান হয়েছে। তিনি বিগত কয়েক বছর ধরেই অসুস্থ ছিলেন। অক্টোবরের প্রথম থেকেই তার শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে ও তাকে ঢাকার শমরিতা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানেই তার মৃত্যু ঘটে।


বাংলাদেশে ইতিহাস চর্চার কোনো ঐতিহ্য আজ পর্যন্ত গড়ে না ওঠায় অলি আহাদের প্রধান কীর্তি বাংলা ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনৈতিক সংগ্রামের কথা এখন প্রায় বিস্মৃত। তার মৃত্যুর পর তার এ কীর্তি বিষয়ে অতিসামান্য কিছু লেখালেখি ও বিবৃতি দেখা গেলেও এটা সত্য। এ কারণে একুশে ফেব্রুয়ারি এলে অনেকের কীর্তি নিয়ে আলোচনা হলেও অলি আহাদ এসব আলোচনাতে বিস্ময়করভাবে উপেক্ষিত থাকেন। অনেকের নগণ্য ভূমিকাকে বাড়িয়ে বলা, কারও ভূমিকা যে পরিমাণ গুরুত্বপূর্ণ তার থেকে বেশি বলা ইত্যাদি হলেও অলি আহাদের কোনো উল্লেখ ভাষা আন্দোলন বিষয়ে গদগদ বক্তব্য দেনেওয়ালাদের কাউকে করতে দেখা যায় না। হতে পারে, অলি আহাদ পরবর্তীকালে বাংলাদেশের রাজনীতির মূল স্রোতের বাইরে থাকাতেই এটা ঘটে। কিন্তু এ দেশে যদি সত্যিকার ইতিহাস চর্চা থাকত তা হলে কার পরবর্তী ভূমিকা কী সেটা দিয়ে তার বিচার না করে ঘটনার সময় তার কী ভূমিকা ও গুরুত্ব ছিল তারই বিচার হতো। সে কারণেই মানুষ তাকে স্মরণ করত। কিন্তু বাংলাদেশ হলো ঐতিহাসিক সত্য হননের দেশ। প্রকৃত ইতিহাস চর্চা এ দেশে অপরাধতুল্য ব্যাপার।
যাই হোক, অলি আহাদের কথায় ফিরে গিয়ে বলা চলে যে, ১৯৪৭ সালে দেশভাগের আগে ছাত্র থাকাকালে তার রাজনৈতিক জীবনের শুরু। মুসলিম লীগের সমর্থক হিসেবে তিনি মুসলিম ছাত্রলীগে যোগ দেন। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তিনি কোনো সময়ই মুসলিম ছাত্রলীগ অথবা অন্য কোনো সাম্প্রদায়িক সংগঠনে যোগ দেননি। এদিক দিয়ে তিনি ছিলেন কমরুদ্দীন আহমদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, তাজউদ্দীন আহমদ প্রমুখের সহযাত্রী। ১৯৫১ সালের মার্চ মাসে পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ নামে একটি অসাম্প্রদায়িক যুব সংগঠন গঠিত হওয়ার সময় অলি আহাদ তার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এ সময় রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে তিনি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ না হলে ওই পদে নির্বাচিত হওয়া তার পক্ষে সম্ভব হতো না।
যুবলীগ গঠিত হওয়ার আগে অলি আহাদ যেসব আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তার মধ্যে অন্যতম ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের আন্দোলন। ১৯৪৯ সালের মার্চ মাসের সেই আন্দোলন শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের আন্দোলন হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বিপুল সংখ্যায় এই আন্দোলনের সমর্থনে সক্রিয়ভাবে এগিয়ে আসার কারণে সেটা ছিল ছাত্র আন্দোলনের দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। অলি আহাদ একজন শক্তিশালী সংগঠক ছিলেন এবং চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের আন্দোলন সংগঠিত করার ক্ষেত্রেও তার অগ্রণী ভূমিকা ছিল। এ কারণে আন্দোলনের শেষে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী যে ছাত্রদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন তার মধ্যে ছিলেন অলি আহাদ। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ ২৭ জন ছাত্রের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। এর মধ্যে ৬ জনকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চার বছরের জন্য বহিষ্কার করা হয়। এই ৬ জনের মধ্যে ছিলেন অলি আহাদ, দবিরুদ্দীন ইসলাম, উমাপতি মিত্র। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেকে যাদের বহিষ্কার করা হয় তার মধ্যে ছিলেন আবদুর রহমান চৌধুরী, দেওয়ান মাহবুব আলী, আবদুস সামাদ, অরবিন্দ বসু ও জে পাত্রনবিশ। পনেরো টাকা হিসেবে যাদের জরিমানা করা হয় তাদের মধ্যে ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান, কল্যাণ দাসগুপ্ত ও নাদিয়া বেগম। দশ টাকা জরিমানা হয় আইন বিভাগের ছাত্রী লুলু বিলকিস বানুর (কলকাতার দৈনিক সত্যযুগ, ৪.৪.১৯৪৯; কলকাতার ঞযব ঝঃধঃবংসধহ, ৪.৪.১৯৪৯; ঢাকা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক সৈনিক, ১৫.৪.১৯৪৯)।
১৯৫১ সালের মার্চ মাসে যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার পর অলি আহাদ সংগঠনটিকে শক্তিশালী যুব সংগঠন হিসেবে দাঁড় করানোর জন্য আত্মনিয়োগ করেন। এ ক্ষেত্রে তার সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী ছিলেন এমাদুল্লাহ ও মহম্মদ সুলতান। তৎকালীন এ দুই উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক কর্মীও এখন বিস্মৃত। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস আলোচনার সময়ও তাদের নাম উচ্চারিত হতে দেখা যায় না। যুবলীগ সংগঠিত হতে থাকার সময়ই ভাষা আন্দোলন নতুনভাবে সংগঠিত করার চেষ্টা শুরু হয়। পাবনার আবদুল মতিনের উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ নতুনভাবে গঠিত হয়।
১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন পল্টন ময়দানে এক জনসভায় উর্দু পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে এটা ঘোষণার পর ভাষা আন্দোলন এক নতুন মাত্রা অর্জন করে। বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষার সপক্ষে উত্তাল আন্দোলন শুরু হয়। বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদ ছাড়াও ৩১ জানুয়ারি গঠিত হয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি। এর সভাপতি হন মওলানা ভাসানী, সম্পাদক হন মুসলিম ছাত্রলীগের নেতা গোলাম মাহবুব। সিদ্ধান্ত হয় ভাষার দাবিতে ২১ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘটের। ২০ ফেব্রুয়ারি বিকেলে সরকার ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করায় আন্দোলনে এক নতুন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। সাধারণভাবে ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে থাকলেও সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কমিটির অধিকাংশ সদস্য ছিলেন ভঙ্গের বিরোধী। এ সময় অলি আহাদ, আবদুল মতিনসহ ৪ জন এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেন। পরদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলার সমাবেশে তারা ছাত্রদের সংগঠিত করে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেন।
২১ ফেব্রুয়ারি দুপুরের পর মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের মধ্যে ও পার্শ্ববর্তী স্থানে পুলিশ গুলিবর্ষণ করে। এতে বরকত, সালাম, রফিক প্রমুখ কয়েকজন ছাত্র এবং সাধারণ লোক নিহত হন। গুলিবর্ষণের পর পরিস্থিতি যা দাঁড়ায় তাতে অলি আহাদই হয়ে দাঁড়ান আন্দোলনের সর্বপ্রধান নেতা। গুলিতে ছাত্র নিহত হওয়ার পর আবদুল মতিন কতখানি অনুতপ্ত হন ও ভেঙে পড়েন তা আমাকে দেওয়া তার সাক্ষাৎকারে বলেন। এরপর তার আর কোনো ভূমিকা তখনকার আন্দোলনে থাকেনি। সর্বদলীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক গোলাম মাহমুদ এরপর আন্দোলনের বিরোধিতা করে সরে দাঁড়ান। সেই অবস্থায় যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে অলি আহাদই আন্দোলনের হাল ধরেন। এখানে অবশ্য বলা দরকার যে, ভাষা আন্দোলন কোনো দলের দ্বারাই এককভাবে পরিচালিত হয়নি। তার কোনো দৃঢ় কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ছিল না। কোনো একক নেতা ছিলেন না। কিন্তু তা সত্ত্বেও এ পর্যায়ে অলি আহাদই আবির্ভূত হন সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ নেতা হিসেবে। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস লেখার কোনো সুযোগ এখানে নেই, তবে ওপরের কথাগুলো বলার প্রয়োজন আছে। কারণ ভাষা আন্দোলন নিয়ে অনেক বিভ্রান্তি ও মিথ্যাচার বাংলাদেশে চালু হয়েছে।
ভাষা আন্দোলনই ছিল অলি আহাদের রাজনৈতিক জীবনের শীর্ষতম পর্যায়। অল্প বয়সে তিনি সেই শীর্ষে পেঁৗছালেও পরবর্তী জীবনে তার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। তিনি সবসময়ই সরকারের নির্যাতন, ফ্যাসিস্ট আচরণ ইত্যাদির বিরোধিতা করে গণতান্ত্রিক রাজনীতি গড়ে তোলার পক্ষে কাজ করলেও রাজনীতির মূল স্রোত থেকে সরে যাওয়ার কারণে তার মতো একজন শক্তিশালী রাজনৈতিক সংগঠক এ দেশের রাজনীতিতে যে অবস্থান অর্জন করার কথা সেটা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। কিন্তু তার পক্ষে কী সম্ভব হয়নি, তার বিচার করার চেষ্টা না করে তিনি নিজের জীবনে কী সম্ভব করেছিলেন এবং দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের এক সংকটজনক পরিস্থিতিতে কী ইতিবাচক অবদান রেখেছিলেন সেটা মূল্যায়ন ও স্মরণ করা শুধু তার তিরোধান উপলক্ষেই নয়, এ দেশের রাজনীতিকে বিভ্রান্তি ও মিথ্যাচারের হাত থেকে রক্ষার জন্যও আমাদের এক গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য।
২২.১০.২০১২

বদরুদ্দীন উমর :সভাপতি, জাতীয়
মুক্তি কাউন্সিল

No comments

Powered by Blogger.