দুর্গারামপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ঃ মিডডে মিলে বদলেছে দৃশ্যপট by সেরাজুল ইসলাম সিরাজ

গ্রামের রাস্তা থেকে বেশকিছুটা সরু পথ হেঁটে পেয়ে গেলাম বিদ্যালয়টি। খেলার মাঠ বিপরীত দিকে হওয়ায় দূর থেকে বোঝার উপায় ছিল না বিদ্যালয়টি বন্ধ না খোলা। সাধারণত গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থীদের কলরবে থাকে মুখর।

অনেক দূর থেকেই শুনতে পাওয়া যায় তাদের অবস্থান। কিন্তু এখানে একেবারেই ব্যতিক্রম। মাত্র কয়েকগজ দূর থেকেও কোনো ছাত্র-ছাত্রীর অবস্থান বোঝা যাচ্ছিল না।
যিনি পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন, কিছুটা দ্বিধায় পড়ে তাকেই প্রশ্ন করলাম, বিদ্যালয় খোলা আছে তো? তিনি জোর দিয়ে বললেন, এখনতো টিফিন আওয়ার চলছে, আমি মাত্র মিনিট ‍দু’য়েক আগে দেখে গেছি।

তার কথায় মনের সংশয় কাটল না, আরও দৃঢ় হলো। কারণ টিফিন আওয়ার হলে তো শিক্ষার্থীদের কোলাহল গ্রামের সড়ক থেকেই শুনতে পাওয়ার কথা।

সংশয় নিয়েই এগিয়ে চললাম। মাঠেও কোনো শিক্ষার্থী দেখা গেল না। প্রথমেই চোখে পড়ল শিক্ষক কমন রুম। সেখানে প্রধান শিক্ষকসহ অন্যান্য শিক্ষক ও দু’জন অবিভাবক বসে আছেন। durgarampur-22

প্রধান শিক্ষক আকলিমা আক্তার জানালেন, টিফিন আওয়ার চলছে। শিক্ষার্থীরা ক্লাসেই আছে।

তার কথায় কৌতহুল বেড়ে গেল। টিফিন আওয়ারে কেন শিক্ষার্থীরা হৈচৈ খেলাধূলা ছেড়ে ক্লাসরুমে অবস্থান করবে, বুঝতে পারলাম না। বললাম, আমি ক্লাস রুমে যেতে চাই। তিনি বললেন, নিশ্চয়।

কথা না বাড়িয়ে ক্লাস রুমের দিকে গেলাম। সঙ্গে গেলেন প্রধান শিক্ষক। প্রথমেই চতুর্থ শ্রেণীর কক্ষ।

কক্ষে প্রবেশ করে অবাক হওয়ার পালা। সব ছাত্র-ছাত্রীর হাতে ডিম ও সিঙাড়া। সবই আপন মনে খাওয়া নিয়ে ব্যস্ত।

একে একে অন্যান্য শ্রেণীকক্ষে গিয়ে দেখলাম শিক্ষার্থীরা ডিম ও সিঙাড়া দিয়ে টিফিন করছে। শ্রেণীক্ষ কানায় কানায় পূর্ণ।

শিক্ষার্থীদের কাছে জানতে চাইলাম, আজকে কি কোনো বিশেষ দিন? যে কারণে তাদের টিফিন দেওয়া হয়েছে।durgarampur32

ইয়াছির আরাফাত (রোল-১২) বললো, আমাদের স্কুলে প্রতিদিনই টিফিন দেওয়া হয়। আমরা কেউ বাড়ি থেকে খাবার আনি না।

ছাত্রটি আরও জানালো, একেক দিন একেক রকমের খাবার দেওয়া হয়। কোনোদিন ডিম-কলা, কোনোদিন ডিম-আপেল, কলা-রুটি, পরোটা-সবজি আবার পরোটা-কলাও থাকে কোনো দিন।

মুক্তা (রোল-৩৪) জানালো, টিফিনের জন্য তাদের কাছ থেকে কোনো টাকা নেওয়া হয় না। এই টিফিন দেয় বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান (আহমেদ আকবর সোবহান) সাহেব। তার গ্রামের বাড়ি এখানে।

প্রধান শিক্ষক আকলিমা আক্তার জানালেন, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান গত বছরের আগস্ট মাস থেকে এই স্কুলে মিডডে মিল চালু করেছেন। তার আর্থিক সহায়তায় নিয়মিত টিফিন দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া বিদ্যালয়টির শ্রেণীকক্ষের জন্য বৈদ্যুতিক পাখাও দিয়েছেন তিনি।

মিডডে মিলের কারণে তার স্কুলের চেহারা পাল্টে গেছে। আগে টিফিন পিরিয়ডে ছাত্র-ছাত্রীরা বাড়িতে গেলে অনেকেই আর ফিরে আসত না।

আগে উপস্থিতির হার ৭০ শতাংশের নিচে ছিল। এখন প্রায় ৯০ শতাংশ ছাড়িয়েছে। অনেক শিক্ষার্থী রয়েছে, যাদের হাজিরা শতভাগ, গ্রামের ক্ষেত্রে যা একাবারেই আশা করা কঠিন।

প্রধান শিক্ষক আরও জানান, গ্রামের স্কুলগুলোতে শিক্ষার্থীর উপস্থিতির হার এখনও হতাশাজনক। কিন্তু আমাদের স্কুলের চিত্র একেবারেই ভিন্ন।
durgarampur-1
তিনি জানান, উপস্থিতির হারের পাশাপাশি পুষ্টিকর খাবার পরিবেশন করায়, অসুখে পড়ার হার কমে গেছে। অপুষ্টিতে ভুগছে এমন শিক্ষার্থী এখানে নেই। এতে পাঠেরও অগ্রগতি অনেক হয়েছে। পাসের হার শতভাগে উন্নীত হয়েছে। ২০১১ সালের ১ জন বৃত্তি পেয়েছে। আশা করছি এবার বেশ কয়েকজন বৃত্তি পাবে।

শিক্ষকরা জানান, সরকার ঝরে পড়া রোধ এবং পাসের হার বাড়ানোর জন্য নানা রকম চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু সফল হচ্ছে না। মিডডে মিল চালু করতে পারলে সব সমস্যার অনেকটাই সমাধান হয়ে যাবে।

শিক্ষকরা মনে করেন, সরকারের একার পক্ষে এটা সম্ভব নয়। এ জন্য বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান সাহেবের মতো শিল্পপতিরা যদি এগিয়ে আসেন তাহলে দেশের চেহারা বদলে যেতে বাধ্য।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বাঞ্ছাপুর উপজেলায় দুর্গারামপুর গ্রামে অবস্থিত এই বিদ্যালয়টি ১৯৪০ সালে স্থাপিত হয়। পাশ দিয়ে বয়ে গেছে নদী। শব্দ ও দূষণমুক্ত নির্মল পরিবেশে অবস্থিত এই বিদ্যালয়টি শিক্ষার্থীদের কাছে আদর্শ বিদ্যালয় হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছে। পাশের গ্রাম থেকেও অনেক ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি হওয়ার জন্য বিদ্যালয়টিতে আসছে।

No comments

Powered by Blogger.