ড. ইউনূস, পঙ্গু লিমন বনাম সরকার ও রাষ্ট্রযন্ত্র by মোহাম্মদ শাহ্ নওয়াজ
বাস্তবে যাই প্রতিফলিত হোক বা ঘটুক,
চরিত্রের দিক দিয়ে বাংলাদেশ সাংবিধানিকভাবে গণপ্রজাতন্ত্র। এখানে জনগণই এ
রাষ্ট্রের মালিক। কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী কিংবা দলবিশেষ নয়। ব্যাপক
সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ইচ্ছা আর আকাঙ্ক্ষার মধ্য দিয়েই এর মালিকানা,
স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব প্রকাশিত, সংহত ও সুরক্ষিত থাকে।
এখানে একজন নাগরিকের ধর্ম, বর্ণ, গোত্র
কৌলিন্য, সম্পদ আর প্রভাবের কারণে তার জন্ম আর সাংবিধানিক সূত্রে অর্জিত
মৌলিক অধিকার ভোগ আর প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হবার সুযোগ নেই।
করা হলে তা হবে সাংবিধানিক অধিকার ভঙ্গ আর আইনের সুস্পষ্ট বরখেলাপ।
নাগরিকের আচরণ, কার্যকলাপ, তার বেড়ে ওঠা ও বেঁচে থাকার সমস্ত প্রয়োজনে যত
আয়োজন আর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া তাও আইন দ্বারা সুনিয়ন্ত্রিত। আর সরকার এখানে
তার নাগরিকের সব ন্যায়সিদ্ধ অধিকার ভোগ করতে দেয়ার আর বঞ্চিত হবার আশঙ্কা
দেখা দিলে সুরক্ষা দেয়ার প্রহরী মাত্র। এ জায়গার রাষ্ট্রের বিচ্যুতি ঘটলে
বিচার বিভাগ তা সুরক্ষার দায়িত্ব নেয়।
নাগরিকের সম্মান-সম্ভ্রম রক্ষা, নিরাপত্তাদান থেকে শুরু করে স্বাধীন সত্তা নিয়ে বেঁচে থাকার গ্যারান্টি দেয়ার কাজটি রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সুপারভাইজ করে সরকার। নাগরিকের এ সব বিষয়াদি দেখভালের জন্য রাষ্ট্রে গড়ে তোলা হয়েছে বিচারালয়, সংসদ, প্রশাসনযন্ত্র, প্রতিরক্ষা বাহিনীসহ নানা প্রতিষ্ঠান। এ সব প্রতিষ্ঠানকে নাগরিকের স্বার্থ রক্ষা ও কল্যাণের কাজে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ম্যান্ডেটে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত পরিচালনার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে গঠিত হয় সরকার। এ কারণে সরকার কিংবা রাষ্ট্র এখানে কোনো বিমূর্ত ধারণার নাম নয়। যে নাগরিক বা জনগণের পক্ষে কাজ করার দায়িত্ব পালনের অঙ্গীকার দিয়ে ক্ষমতা গ্রহণকারী ব্যক্তিবর্গ যখন সংঘবদ্ধভাবে নাগরিকের স্বার্থের বিরুদ্ধে, তার কল্যাণের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়, তখন শুধু সরকার নয়, পুরো রাষ্ট্রযন্ত্র হয়ে ওঠে নিপীড়ক আর ভক্ষক।
কারণ কতিপয় ব্যক্তিবর্গকে নিয়ে গঠিত সরকারই তখন জনগণের প্রয়োজনে সৃষ্ট রাষ্ট্রের নানা প্রতিষ্ঠানকে তার প্রকৃত মালিক অর্থাৎ জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে। এটাকে শুধু ক্ষমতার অপব্যবহার বললে যথেষ্ট হয় না, বরং বলা উচিত নাগরিকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ আর গাদ্দারি। আরো কঠিন করে বললে, মালিকের বিরুদ্ধে প্রহরীর অন্যায় বিদ্রোহ কিংবা আপন জন্মদাতা যিনি আদরে-সেবায়, খাইয়ে, পরিয়ে এ ব্রম্মাণ্ডের আলো-বাতাস-রূপ-রস-গন্ধ ভোগের সুযোগ করে দিয়েছেন, সুযোগ বুঝে নিজ স্বার্থে তাকে আঘাত করার মতো।
জনগণের দেয়া আমানত খেয়ানতকারী ব্যক্তিবর্গ বা সরকারের এ ধরনের বিরূপ ভূমিকা দেখা যায় বলেই নাগরিকের ন্যায় ক্ষমতাপ্রাপ্ত বা নির্বাচিত ব্যক্তিবর্গের আচরণ, কার্যকলাপ আইন বা বৃহত্তর অর্থে সংবিধান দ্বারা সুনির্দিষ্ট করে দেয়া আছে। একইভাবে জনগণের প্রয়োজনে সৃষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজের ধরন ও কার্যপরিধিও সুনির্দিষ্টভাবে বেঁধে দেয়া হয়। যাতে প্রজাতন্ত্র যাদের দ্বারা, যাদের জন্য যে উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করা হয়েছে ও বলবৎ আছে তার যেন ব্যত্যয় না ঘটে। কিন্তু কেতাবে বা সংবিধানে তো অনেক কিছুই বিবৃত আছে। বাস্তবে কী ঘটছে?
দুই.
নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস আর ঝালকাঠির দরিদ্র কলেজছাত্র লিমন হোসেনকে আমরা কেন, বিশ্বের অনেকেই চেনেন। দু’জনই বাংলাদেশের নাগরিক। কে সাধারণ কে অসাধারণ সে বিতর্ক এখানে অহেতুক। এ দু’জনের মিল-অমিলের জায়গারও ফারাক বিস্তর। সম্প্রতি ও নিকট অতীতের কিছু ঘটনাপ্রবাহ এ দুজনের একটি বিষয়ে মিলকে- একই সমান্তরাল রেখায় প্রতিস্থাপিত করেছে। সেটা হচ্ছে দু’জনই তাদের ওপর সংঘবদ্ধভাবে রাষ্ট্রযন্ত্রের হামলে পড়ার ঘটনায় বেসামাল হয়ে আপন মান-সম্ভ্রম আর নিরাপত্তা নিয়ে চরমভাবে উৎকণ্ঠিত। রাষ্ট্রযন্ত্রের যে অংশকে যার জন্য উপযুক্ত মনে করা হয়েছে তার জন্য সে অংশ সব হিংসা, বিদ্বেষ আর আক্রোশ নিয়ে তাদের দু’জনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
ড. ইউনূস নোবেল লরিয়েট হিসেবে নয়, নানা কারণে একজন সম্মানিত ব্যক্তি। নোবেল পুরস্কার অর্জনের বিষয়টি বাদ দিলেও অর্থনীতির একজন প্রাজ্ঞ ব্যক্তিত্ব আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে তিনি তো প্রথম শ্রেণীর নাগরিক। ব্যতিক্রমী ক্ষুদ্রঋণ ধারণার প্রবর্তক হিসেবে, যে ধারণায় হত দরিদ্র, সহায়-সম্বলহীন কোলেটারেল সিকিউরিটি দিতে অসমর্থ একজন মহিলা ঋণ পেয়ে স্বাবলম্বিতার পথ খুঁজে বেড়াবার সংগ্রামে অবতীর্ণ হবার সাহস পায়, তিনি এখন বিশ্বব্যাপী সমাদৃত এক মানুষ। তার এ ধারণার বাস্তব রূপায়ন ঘটাতে মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন গ্রামীণ ব্যাংক। তার সরাসরি পরিচালনা আর নেতৃত্বে এ ব্যাংক এখন গ্রাহকসংখ্যার দিক দিয়ে দেশের এক নম্বর ব্যাংক। প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যবস্থায় ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে অপাঙক্তেয় ঘোষিত- এমন হতদরিদ্র শ্রেণীভুক্ত ৮৪ লাখ মহিলা এর গ্রাহক-কাম-শেয়ার হোল্ডার। সরকারের শেয়ার এখানে মাত্র তিন শতাংশ। মালিকানা, পরিচালনা পদ্ধতি আর ঋণ বিতরণে ব্যতিক্রমী নীতি অনুসরণের কারণে এটি একদিকে যেমন বেসরকারি ব্যাংক অন্যদিকে একটি বিশেষায়িত ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানও বটে।
রবীন্দ্রনাথ, অমর্ত্য সেনের পর ক্ষুদ্র ঋণ আর গ্রামীণ ব্যাংকের কারণেই তৃতীয় বাঙালি হিসেবে আর স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম নাগরিক হিসেবে ড. ইউনূস নোবেল পুরস্কার অর্জন করে গোটা বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে নতুন মর্যাদা আর পরিচয়ে সমাসীন করেন। ক্ষুদ্র ঋণ ধারণা এবং এর প্রায়োগিক ভুল-ত্রুটি নিয়ে অনেক কথা বলা যায়। এর যে একদম যৌক্তিক ভিত্তি নেই তাও বলা যাবে না। আপত্তি আর বিতর্ক আছে গ্রামীণ ব্যাংকের সুদের হার নিয়ে। কথা আছে, ক্ষুদ্র ঋণ ধারণা নিয়ে উন্নত তথা পুঁজিবাদী বিশ্বের এত মাতোয়ারা হবার পেছনের কারণ নিয়ে।
বলা হচ্ছে, ভঙ্গুর আর ধ্বংসোম্মুখ পুঁজিবাদের আসন্ন পতনের পরের যে ক্ষত আর প্রভাব তা নিরাময়ে কিছুটা দরিদ্রবান্ধব একটা তাৎক্ষণিক হিলার, কিউরেবল অয়েন্টমেন্ট হিসেবে এ মুহূর্তে ক্ষুদ্র ঋণের বিকল্প কারো হাতে নেই। এত সব প্রচারণার বুদবুদে মাতাল হয়ে যাবার এবং এ আশঙ্কা ভবিষ্যতে সত্যি হলে বিশ্ব অর্থনীতির অতিশয় ক্ষুদ্র অংশীদার হিসেবে আমাদের কী হবে তা নিয়ে ভাবার সময় এখনো আসেনি। তাহলে কি কারণে আমাদের গর্বিত মানুষ ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে পুরো সরকার তার হাতে থাকা রাষ্ট্রযন্ত্রের সব শক্তি জড়ো করে ক্রমাগত আঘাত করে চলছে?
ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে একটা বিরুদ্ধ বলয় সৃষ্টি হয় যখন তিনি ওয়ান ইলেভেনের কুশীলবদের প্রচ্ছন্ন ছত্রছায়ায় এমন একটা সময় নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠনে উদ্যোগ নিয়েছিলেন, যখন খালেদা-হাসিনা কারাগারে আর রাজনীতিকে বিরাজনীতিকরণের একটা হীন চেষ্টা প্রবল হয়ে উঠেছিল। পরে অবশ্য ড. ইউনূস রনে ভঙ্গ দিয়ে শরীরে আর ইমেজে বাংলাদেশের প্রচলিত কদর্য রাজনীতির কোনো রকম কাদা-কালিমা লেপ্টে যাবার আগেই এ উদ্যোগ কবরস্থ করেছিলেন।
গ্রামীণফোনের বৃহদাংশ শেয়ারের অংশীদার নরওয়ের টেলিনরের সঙ্গে গ্রামীণফোনের শেয়ার নিয়ে ড. ইউনূসের বিরোধের বিষয়ে আমরা অনেকেই জানি। এটা নিয়ে বেকায়দায় পড়া টেলিনর কর্তৃপক্ষ। ড. ইউনূসকে ফাঁসানোর ফন্দি-ফিকির যে তারা আড়ালে আবড়ালে করছে না তা কিভাবে নিশ্চিত হওয়া যাবে? যা হোক, তার একটা আলামত মিলে, যখন দেখি নরওয়ের অখ্যাত এক টেলিভিশন চ্যানেল ড. ইউনূসের হালখাতা উদঘাটনের মিশনে নেমে মোটামুটি বড় ঘাপলা নয় এমন একটা ইস্যুকে ফুলিয়ে ফাপিয়ে ফিচার তৈরি করে বিশ্বময় হুলস্থুল বাঁধানোর চেষ্টা করে। সে ফিচারটি বিশ্বময় হুলস্থুল বাঁধানোতে সফল না হলেও বাংলাদেশে শাসক শ্রেণীর হাতে ইউনূস-বধের একটা বড় উপলক্ষ বানিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে।
বছরখানেক আগে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ড. ইউনূসের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করে বলেছিলেন, ড. ইউনূস নয়, ১৯৯৮ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির জন্য শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়া উচিত ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও জনসংহতি সমিতির প্রধান সন্তু লারমার। একই ঘরানার (একাডেমিক ডিসিপ্লিন বিবেচনায়) মানুষ হয়েও অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত ক্ষুদ্র ঋণ ও গ্রামীণ ব্যাংকসংক্রান্ত এক মন্তব্যে ‘অল রাবিশ’ বলে ড. ইউনূসকে যেভাবে শ্লেষাত্মক বাক্যবানে ঘায়েল করলেন তা অভাবনীয়। আজীবন আকাশচুম্বী জনপ্রিয় (!) ছয় প্লটের ভারে ন্যূব্জ শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়ার কথা বাদ দিলেও দল ও সরকারের দ্বিতীয় ব্যক্তি সৈয়দ আশরাফ ড. ইউনূসের নোবেল পুরস্কার অর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে ‘রেড় ওয়াইন আর চিপস’ খেয়ে একাধিক নোবেল পুরস্কার পাবার আজগুবি গল্প জাতিকে খাওয়ানোর অপচেষ্টা করতে পিছপা হননি। সৈয়দ আশরাফের মতো সম্ভ্রান্ত ঘরের সজ্জন রাজনীতিবিদ ‘রেড ওয়াইন, চিপস সান্ডউইচ’ তত্ত্ব দিয়ে এদেশের একমাত্র নোবেল লরিয়েটকে কিভাবে রাস্তার ফালতু মানুষের মতো তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করলেন তা কোনো ভদ্র রুচিবান মানুষ দ্বিতীয়বার শুনতে চাইবেন না। জাতি এও দেখেছে ড. ইউনূস ও তার গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে সরকার যখন টানাহেচড়া করছিল, গ্রামীণ ব্যাংক থেকে অপসারিত ড. ইউনূস আইনি প্রতিকার পেতে আদালতের বারান্দায় বারান্দায় ছুটোছুটি করছিলেন, তখন বাংলা একাডেমীর একুশে বইমেলার উদ্ভোধনী অনুষ্ঠানে অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ী ভারতের অমর্ত্য সেনকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে অতিথি করে সম্মানিত করা হয়েছিল। কথায় বলে ‘গেয়ো যোগী ভিখ পায় না’ আর ‘আপন ঘরনীর নয়, পর ঘরনীর তৈরি পিঠার স্বাদ বেশি’।
ভারবাল অ্যাটাকের মাধ্যমে গ্রাউন্ড তৈরির পর শুরু হয় সরাসরি আঘাত করে ড. ইউনূসকে কুপোকাৎ করার মিশন। কায়দা-কানুন করে শুরু করা হলো সে কালো উপখ্যানের মঞ্চায়ন পর্ব। টার্গেটে করা হয় ড. ইউনূসের হাতে গড়া ক্ষুদ্র ঋণের মডেল প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংককে। অতিরিক্ত বয়স দেখিয়ে ব্যাংকিং অধ্যাদেশের একটা মনমত ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর মাধ্যমে তাকে শুধু গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদ থেকেই অপসারণ করা হয়নি, এ ব্যাংকে বিশেষায়িত বেসরকারি ব্যাংকের ক্যাটাগরি থেকে স্ট্যাটাস পরিবর্তন করে সরকারি ব্যাংকে পরিণত করার একটা কুৎসিত খেলাও শুরু হয়। এ নিয়ে কমিশন করা থেকে শুরু করে পছন্দসই লোককে চেয়ারম্যান পদে বসানো, দেশ-বিদেশের বিশিষ্টজনদের অনুরোধ, প্রতিবাদকে উপেক্ষা করে অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে গরিব মহিলাদের ৯৭ মালিকানার এ ব্যাংকে সরকারের পুরো নিয়ন্ত্রণে নিতে যতসব কলাকৌশল তার কিছুই বাদ রাখা হচ্ছে না।
এ অধ্যাদেশ জারির পর তাৎক্ষণিক এক প্রতিক্রিয়ায় ড. ইউনূস বলেছিলেন, “বহুজনের ব্যক্তি মালিকানায় পরিচালিত একটি বেসরকারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের তিন শতাংশের মালিক হয়েও প্রধান নির্বাহী নিয়োগের ক্ষমতা নিয়ে নেয়ার মাধ্যমে গ্রামীণ ব্যাংকের সমাপ্তি পর্ব শুরু করল সরকার।”
তিনি আরো বলেন, “জাতির জীবনে এটা একটা কালো দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। এ দুঃখ ধারণ করার ক্ষমতা আমার নেই।”
এ নির্দেশ জারির পরদিনই দেশের শীর্ষস্থানীয় তিন অর্থনীতিবিদ -ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, ড. আবু আহমেদ ও ড. মুহাম্মদ মাহবুব আলী তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে বলেছেন, এতে করে গ্রামীণ ব্যাংকের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে। গ্রামীণ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নিতে সরকারের ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করতেই এ অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে।
সরকার যে ব্যাংক পরিচালনা করতে, জনগণের আমানত রক্ষা করতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে তার জ্বলন্ত প্রমাণ হচ্ছে সোনালী ব্যাংকসহ রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকগুলো থেকে হাজার কোটি টাকা লুটপাটের মহোৎসব প্রদর্শন। হলমার্কের ২৬০০ কোটিরও বেশি টাকা ঋণের নামে সরকারের উপদেষ্টা, প্রভাবশালীদের সহায়তায় যেভাবে লুটপাট করা হলো তা ব্যাংকিং ইতিহাসে নজীরবিহীন কেলেঙ্কারি। এমন কেলেঙ্কারি ইসলামী ব্যাংকসহ সরকারের পছন্দের লোকদের নিয়ন্ত্রণে নেই এমন পরিচালকদের মালিকানার কোনো বেসরকারি ব্যাংকে ঘটতো তাহলে এক রাত পেরিয়ে নতুন দিনের সূর্যোদয়ের আগে কোনো আইনি প্রক্রিয়ার ধার না ধেরে এ ধরনের ব্যাংক সরকার তার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে মালিকদের লালদালানে চালান করে দিতো। বয়সের অজুহাত দেখিয়ে ড. ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদ থেকে সরানো হলো অথচ হলমার্ক কেলেঙ্কারির মতো জনগণের টাকার এমন ‘সমুদ্র চুরির’ পর এ সোনালী ব্যাংকের সাধু চেয়ারম্যান আর রাজনৈতিক আশীর্বাদপুষ্ট পরিচালনা পরিষদ সদস্যদের ক্ষমতার মেয়াদ বাড়ানো হলো। তাহলে নোবেল বিজয়ী হলেও ড. ইউনূস তো আইনের ঊর্ধ্বে নয় বলে আইনমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রীসহ যারা তার বিরুদ্ধে নেয়া আক্রোশমূলক পদক্ষেপকে জায়েজ করতে চেয়েছিলেন তাদের কাছে সহজেই একটি প্রশ্ন করা যায়। প্রশ্নটি হলো, সোনালী ব্যাংকে লুটপাটের সাঙ্গপাঙ্গদের ক্ষেত্রে আইনের ঊর্ধ্বে কেউ নয় এ নীতির পরিবর্তে কেন আইনকে মাটির নিচে চাপা দিয়ে রাখা হয়েছে?
তিন.
এ ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে জাতি কী দেখলো? শুধু একজন নাগরিক হিসেবে ড. ইউনূস তার সাংবিধানিকভাবে অর্জিত ব্যক্তির মান-সম্ভ্রম, মর্যাদা রক্ষা ও সমান আইনি প্রতিকার পাবার সব অধিকার সরকার ও রাষ্ট্রযন্ত্রের হাতে খুইয়ে বসলেন। এখানে তাকে প্রটেকশন দেয়ার কোনো শক্তিই আর অবশিষ্ট রইলো না। এখন সোনালী ব্যাংক চেটেপুটে খাবার দায়ে অভিযুক্ত হলমার্কের মালিক তানভীর মাহমুদকে খোদা নাখাস্তা যদি কোনো কারণে জেলে যেতেও হয়, তারও আগে হয়ত গ্রামীণ ব্যাংকের গরিব মহিলাদের তহবিল লোপাটের অভিযোগ খাড়া করে ড. ইউনূসকে জেলে যেতে হতে পারে। কারণ, ইতিমধ্যেই তার বয়স অতিক্রম পরবর্তী নেয়া বেতন-ভাতা আর তার হাতে থাকা নানা প্রতিষ্ঠানের আয়কর কিভাবে ফাঁকি দিয়েছেন সে অনুসন্ধান শুরু হয়ে গেছে। সুতরাং, ড. ইউনূসকে জেলে নেয়ার মতো ঘটনা ঘটলে বিস্ময়ের কিছুই থাকবে না। কারণ আমরাই তো দেখলাম, যে প্রধানমন্ত্রী ড. ইউনূসকে সুদখোর, গরিবের রক্তচোষা বলে আক্রমণ করলেন, কদিন পর ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের এক প্রতিনিধি দলের কাছে ড. ইউনূসকে বিশ্বব্যাংকের প্রধান করার প্রস্তাবনা দিলেন, যদিও এটাকে অনেকেই অন্যরকমভাবে নিয়েছিলেন। জাতিই তো কদিন আগে প্রত্যক্ষ করলো, যে প্রধানমন্ত্রী সংসদে দাঁড়িয়ে পদ্মা সেতু ইস্যুতে বিশ্বব্যাংকের কঠোর সমালোচনা করে দেশের টাকায় এ সেতু নির্মাণের জিহাদি জজবা দেখালেন, তার সরকারই কিনা এখন এ ঋণের জন্য বিশ্বব্যাংকের কাছে করজোড়ে ভিক্ষা করছেন। সুতরাং, গ্রামীণ ব্যাংকের অর্থ লোপাট কিংবা দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনে ড. ইউনূসকে জেলে দেয়া হলে বিস্মিত হবার মতো কিছুই ঘটবে না। কারণ এটা সব সম্ভবের দেশ, আলেকজান্ডার স্বয়ং বলে গেছেন ‘সেলুকাস, কি বিচিত্র এ দেশ!’
চার.
এবার ঝালকাঠির দরিদ্র কলেজছাত্র কিশোর লিমন হোসেনের কথায় আসা যাক। আশরাফুল মাখলুকাতের অংশ হিসেবে, শুধু একজন নাগরিক হিসেবে ড. ইউনূস আর এই লিমনের মধ্যে কোনো ফারাক নেই। আর পরিচয়, ইমেজ, অর্জন আর অবস্থানের ব্যাপ্তি হিসেবে নিলে ড. ইউনূস আর লিমনের অবস্থান হবে আকাশ আর পাতালে। রূপক অর্থে ইউনূস এভারেস্ট শৃঙ্গে হলে লিমনের অবস্থান ঝালকাঠির একটি ছোট্ট টিলায়। এমন একজন লিমন যে কিশোর র্যাবের গুলিতে পঙ্গু হবার আগে স্থানীয় কোনো অখ্যাত দেয়ালিকায় নাম ওঠার মতো কোনো অর্জন আর উপলক্ষের জন্ম দিতে পারেনি, সে কিনা আজ সারা দেশেতো বটেই, মানবাধিকার সংগঠনগুলোর সোচ্চার কণ্ঠের কারণে বিদেশেও পরিচিতির গণ্ডি ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। ড. ইউনূস হয়ত রাজনৈতিক দল করতে চেয়ে, বিশ্বব্যাপী পরিচিতি আর ইমেজ তৈরি করে, দরিদ্র মহিলাদের বিশাল এক গোষ্ঠীকে জড়ো করে, হিলারি ক্লিনটনের কাছে ফজলে হাসান আবেদসহ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে ওকালতি করে বর্তমান সরকার আর রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতিপক্ষ হিসাবে আভির্ভূত হয়েছেন। কিন্তু চুনোপটি লিমন যে এমনকি কোনো প্রভাবশালী ছাত্রসংগঠনের সঙ্গেও সম্পৃক্ত নয় সে কিভাবে সরকার আর রাষ্ট্রযন্ত্রের জন্য এমন এক বৈরী প্রতিপক্ষ হয়ে উঠলো?
লিমনের গ্রামের এক ভয়ঙ্কর সন্ত্রসীকে মহাধুসধামের সঙ্গে গ্রেফতার অভিযানে গিয়ে ওই সন্ত্রাসীর টিকিটি তো পানইনি, র্যাব বরং উক্ত সন্ত্রাসী ভেবে লিমনকে গুলি করে ধরে নিয়ে আসে। পরে যখন র্যাবের হুঁশ হলো যে, আহত কিশোর ওই সন্ত্রাসী নয়, তখন তাকে এ সন্ত্রাসীর ঘনিষ্ট সহযোগী প্রমাণের সব পাঁয়তারা শুরু করলো। ভুল করে একজন নিরাপরাধ কিশোরকে পঙ্গু করার পর কথিত এলিট ফোর্সের উক্ত অপারেশনের দায়িত্ববান কর্তাব্যক্তিরা ক্ষমা চেয়ে তার ক্ষতিপূরণ ও সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করার পরিবর্তে তার বিরুদ্ধে র্যাবকে হামলা ও তার কাছ থেকে অস্ত্র উদ্ধারের বানোয়াট কাহিনী ফাঁদা হলো। মিডিয়াসহ চতুর্দিকে সমালোচনার মুখে পড়ে স্বয়ং র্যাবের ডিজি হাসান মাহমুদ খন্দকারই মিডিয়ার কাছে স্বীকার করলেন, লিমন সন্ত্রাসী নয়, তার বিরুদ্ধে কোনো থানায় কখনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড তো দূরের কথা, অন্য কোনো অভিযোগেও মামলা দায়ের হয়নি। তাহলে উদ্ধারকৃত অস্ত্রটি র্যাব কোত্থেকে পেল? কেন লিমনের বিরুদ্ধে আক্রমণ ও অবৈধ অস্ত্র রাখার দুটি মামলা দায়ের করা হলো? এ ধরনের অমানবিক ও নিষ্ঠুর আঘাতের পর যে আঘাতে দরিদ্র কিশোর লিমনের একটি পা কেটে ফেলতে হয়েছে এবং তাকে চিরতরে পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়েছে, সে সূত্রে কোনো র্যাব জোয়ান কিংবা কর্মকর্তার কি ন্যূনতম শাস্তি দেয়া হয়েছে? না, হয়নি। উল্টো একের পর এক হয়রানি, হামলা, ভয়-ভীতি প্রদর্শন, তার মায়ের দায়ের করা মামলা প্রত্যাহারে চাপ সৃষ্টি থেকে শুরু করে এ দরিদ্র কিশোর ও তার পরিবারকে পর্যুদস্থ করার জন্য এমন কোনো বেআইনি কৌশল নেই প্রয়োগ করা হয়নি, করা হচ্ছে না। তার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা দুটিতেই প্রাথমিক অভিযোগে দোষী সাব্যস্থ করে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। আর র্যাবের বিরুদ্ধে তার মায়ের দায়ের করা মামলা গত ঈদের ছুটির সময় গোপনে র্যাবের অভিযুক্তদের নির্দোষ দেখিয়ে আদালতে পুলিশের পক্ষ থেকে চূড়ান্ত প্রতিবেদন (ফাইনাল রিপোর্ট) দেয়া হয়েছে। সেখানেই ঘটনা থামেনি, গত ঈদের পর র্যাবের স্থানীয় সোর্স বলে কথিত ইব্রাহিমের ওপর হামলা ও তার শ্যালকেকে হত্যার অভিযোগে লিমন ও তার মায়ের বিরুদ্ধে থানায় দায়ের করা হয় হত্যা মামলা।
নিউ ইয়র্কভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ওয়াচডগ ‘হিউমান রাইটস ওয়াচ’ থেকে শুরু করে স্থানীয় মানবাধিকার সংগঠনগুলো ও মিডিয়া একযোগে একজন দরিদ্র কিশোরকে নিয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের এমন ভয়ানক ও নিষ্ঠুর কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদে সোচ্চার হলেও রাষ্ট্রযন্ত্রের কিংবা সরকারের কারো সেদিকে খেয়ালই নেই। এমনকি রাষ্ট্রীয় খরচে পরিচালিত মানবাধিকার কমিশনের বাচন আর কথামালায় পারদর্শী চেয়ারম্যানের নানা আশ্বাস, কমিশনের পক্ষ থেকে লিমনকে সব নিবর্তনমূলক পদক্ষেপের হাত থেকে রক্ষার প্রতিশ্রুতি এবং হাসপাতালে পঙ্গু লিমনকে দেখে অশ্রুপাত করলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। চরম নিরাপত্তাহীনতা আর অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আশঙ্কার মধ্য দিয়ে বসবাস করছে দ্ররিদ্র লিমন ও তার পরিবার। যে প্রধানমন্ত্রী লালবাগে অগ্নিকাণ্ডে মৃত কয়েক ভিকটিমের এতিম মেয়েদের অভিভাবকত্ব গ্রহণ করে, তাদের বিয়ে-শাদীর ব্যবস্থা করে বেশ আনন্দ বোধ করেছিলেন আর আমরা রাষ্ট্রীয় প্রচারণা দিয়ে একে প্রধানমন্ত্রীর ‘মমত্ববোধ আর মহিমা’ বলে প্রচার করলাম। কিন্তু দরিদ্র কিশোর লিমন কেন চারদিক থেকে এত অনুরোধ সত্ত্বেও এমন গরির অন্তঃপ্রাণ প্রধানমন্ত্রীর সামান্য অনুকম্পা পেলেন না তা বিস্ময়কর। অবশ্য দুর্মুখেরা বলতেই পারেন, অনুকম্পা পেয়েছে বলেই তো লিমনের একটি পা এখনো ভালো আছে আর তাকে ‘ক্রসফায়ারে’ পড়ে জীবন দিতে হয়নি।
পাঁচ.
নাগরিক অধিকার হরণে, নিবর্তন-নির্যাতনের এমন আগ্রাসী রূপ ধারণ করে রাষ্ট্র আর সরকার যখন এককাতারে এসে দাঁড়ায়, তখন বিচারালয়, সংবিধান, সংসদ, আমলাতন্ত্র, সবই নাগরিকের কাছে অর্থহীন, অস্তিত্ব থাকলেও এগুলো দৃশ্যমান নয়, ধোয়াশায় ঘেরা বিমূর্ত ধারণা, বাস্তবতা হলেও মনে হয় ইউটোপিয়া।
এখানে নোবেলজয়ী ড. ইউনূস আর দ্ররিদ্র পঙ্গু কিশোর লিমনের মধ্যে কোনো ফারাক নেই। তাদের মালিকানাধীন রাষ্ট্রে তারাই চরম অসহায়। সরকার আর রাষ্ট্র এ জায়গায় দু’জনের জন্যই চরম বৈরী প্রতিপক্ষ। উল্টো বললে দাড়াঁয়, এক্ষেত্রে, ড. ইউনূস, লিমন দু’জনই রাষ্ট্র আর সরকারের চরম বৈরী প্রতিপক্ষ। কেন? জবাবটা সময়ই বলে দেবে। কারণ টাইম ইজ দ্যা বেস্ট হিলার।
মোহাম্মদ শাহনওয়াজ: সাংবাদিক।
ইমেইল: shahnowaz2002@yahoo.com
নাগরিকের সম্মান-সম্ভ্রম রক্ষা, নিরাপত্তাদান থেকে শুরু করে স্বাধীন সত্তা নিয়ে বেঁচে থাকার গ্যারান্টি দেয়ার কাজটি রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সুপারভাইজ করে সরকার। নাগরিকের এ সব বিষয়াদি দেখভালের জন্য রাষ্ট্রে গড়ে তোলা হয়েছে বিচারালয়, সংসদ, প্রশাসনযন্ত্র, প্রতিরক্ষা বাহিনীসহ নানা প্রতিষ্ঠান। এ সব প্রতিষ্ঠানকে নাগরিকের স্বার্থ রক্ষা ও কল্যাণের কাজে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ম্যান্ডেটে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত পরিচালনার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে গঠিত হয় সরকার। এ কারণে সরকার কিংবা রাষ্ট্র এখানে কোনো বিমূর্ত ধারণার নাম নয়। যে নাগরিক বা জনগণের পক্ষে কাজ করার দায়িত্ব পালনের অঙ্গীকার দিয়ে ক্ষমতা গ্রহণকারী ব্যক্তিবর্গ যখন সংঘবদ্ধভাবে নাগরিকের স্বার্থের বিরুদ্ধে, তার কল্যাণের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়, তখন শুধু সরকার নয়, পুরো রাষ্ট্রযন্ত্র হয়ে ওঠে নিপীড়ক আর ভক্ষক।
কারণ কতিপয় ব্যক্তিবর্গকে নিয়ে গঠিত সরকারই তখন জনগণের প্রয়োজনে সৃষ্ট রাষ্ট্রের নানা প্রতিষ্ঠানকে তার প্রকৃত মালিক অর্থাৎ জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে। এটাকে শুধু ক্ষমতার অপব্যবহার বললে যথেষ্ট হয় না, বরং বলা উচিত নাগরিকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ আর গাদ্দারি। আরো কঠিন করে বললে, মালিকের বিরুদ্ধে প্রহরীর অন্যায় বিদ্রোহ কিংবা আপন জন্মদাতা যিনি আদরে-সেবায়, খাইয়ে, পরিয়ে এ ব্রম্মাণ্ডের আলো-বাতাস-রূপ-রস-গন্ধ ভোগের সুযোগ করে দিয়েছেন, সুযোগ বুঝে নিজ স্বার্থে তাকে আঘাত করার মতো।
জনগণের দেয়া আমানত খেয়ানতকারী ব্যক্তিবর্গ বা সরকারের এ ধরনের বিরূপ ভূমিকা দেখা যায় বলেই নাগরিকের ন্যায় ক্ষমতাপ্রাপ্ত বা নির্বাচিত ব্যক্তিবর্গের আচরণ, কার্যকলাপ আইন বা বৃহত্তর অর্থে সংবিধান দ্বারা সুনির্দিষ্ট করে দেয়া আছে। একইভাবে জনগণের প্রয়োজনে সৃষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজের ধরন ও কার্যপরিধিও সুনির্দিষ্টভাবে বেঁধে দেয়া হয়। যাতে প্রজাতন্ত্র যাদের দ্বারা, যাদের জন্য যে উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করা হয়েছে ও বলবৎ আছে তার যেন ব্যত্যয় না ঘটে। কিন্তু কেতাবে বা সংবিধানে তো অনেক কিছুই বিবৃত আছে। বাস্তবে কী ঘটছে?
দুই.
নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস আর ঝালকাঠির দরিদ্র কলেজছাত্র লিমন হোসেনকে আমরা কেন, বিশ্বের অনেকেই চেনেন। দু’জনই বাংলাদেশের নাগরিক। কে সাধারণ কে অসাধারণ সে বিতর্ক এখানে অহেতুক। এ দু’জনের মিল-অমিলের জায়গারও ফারাক বিস্তর। সম্প্রতি ও নিকট অতীতের কিছু ঘটনাপ্রবাহ এ দুজনের একটি বিষয়ে মিলকে- একই সমান্তরাল রেখায় প্রতিস্থাপিত করেছে। সেটা হচ্ছে দু’জনই তাদের ওপর সংঘবদ্ধভাবে রাষ্ট্রযন্ত্রের হামলে পড়ার ঘটনায় বেসামাল হয়ে আপন মান-সম্ভ্রম আর নিরাপত্তা নিয়ে চরমভাবে উৎকণ্ঠিত। রাষ্ট্রযন্ত্রের যে অংশকে যার জন্য উপযুক্ত মনে করা হয়েছে তার জন্য সে অংশ সব হিংসা, বিদ্বেষ আর আক্রোশ নিয়ে তাদের দু’জনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
ড. ইউনূস নোবেল লরিয়েট হিসেবে নয়, নানা কারণে একজন সম্মানিত ব্যক্তি। নোবেল পুরস্কার অর্জনের বিষয়টি বাদ দিলেও অর্থনীতির একজন প্রাজ্ঞ ব্যক্তিত্ব আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে তিনি তো প্রথম শ্রেণীর নাগরিক। ব্যতিক্রমী ক্ষুদ্রঋণ ধারণার প্রবর্তক হিসেবে, যে ধারণায় হত দরিদ্র, সহায়-সম্বলহীন কোলেটারেল সিকিউরিটি দিতে অসমর্থ একজন মহিলা ঋণ পেয়ে স্বাবলম্বিতার পথ খুঁজে বেড়াবার সংগ্রামে অবতীর্ণ হবার সাহস পায়, তিনি এখন বিশ্বব্যাপী সমাদৃত এক মানুষ। তার এ ধারণার বাস্তব রূপায়ন ঘটাতে মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন গ্রামীণ ব্যাংক। তার সরাসরি পরিচালনা আর নেতৃত্বে এ ব্যাংক এখন গ্রাহকসংখ্যার দিক দিয়ে দেশের এক নম্বর ব্যাংক। প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যবস্থায় ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে অপাঙক্তেয় ঘোষিত- এমন হতদরিদ্র শ্রেণীভুক্ত ৮৪ লাখ মহিলা এর গ্রাহক-কাম-শেয়ার হোল্ডার। সরকারের শেয়ার এখানে মাত্র তিন শতাংশ। মালিকানা, পরিচালনা পদ্ধতি আর ঋণ বিতরণে ব্যতিক্রমী নীতি অনুসরণের কারণে এটি একদিকে যেমন বেসরকারি ব্যাংক অন্যদিকে একটি বিশেষায়িত ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানও বটে।
রবীন্দ্রনাথ, অমর্ত্য সেনের পর ক্ষুদ্র ঋণ আর গ্রামীণ ব্যাংকের কারণেই তৃতীয় বাঙালি হিসেবে আর স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম নাগরিক হিসেবে ড. ইউনূস নোবেল পুরস্কার অর্জন করে গোটা বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে নতুন মর্যাদা আর পরিচয়ে সমাসীন করেন। ক্ষুদ্র ঋণ ধারণা এবং এর প্রায়োগিক ভুল-ত্রুটি নিয়ে অনেক কথা বলা যায়। এর যে একদম যৌক্তিক ভিত্তি নেই তাও বলা যাবে না। আপত্তি আর বিতর্ক আছে গ্রামীণ ব্যাংকের সুদের হার নিয়ে। কথা আছে, ক্ষুদ্র ঋণ ধারণা নিয়ে উন্নত তথা পুঁজিবাদী বিশ্বের এত মাতোয়ারা হবার পেছনের কারণ নিয়ে।
বলা হচ্ছে, ভঙ্গুর আর ধ্বংসোম্মুখ পুঁজিবাদের আসন্ন পতনের পরের যে ক্ষত আর প্রভাব তা নিরাময়ে কিছুটা দরিদ্রবান্ধব একটা তাৎক্ষণিক হিলার, কিউরেবল অয়েন্টমেন্ট হিসেবে এ মুহূর্তে ক্ষুদ্র ঋণের বিকল্প কারো হাতে নেই। এত সব প্রচারণার বুদবুদে মাতাল হয়ে যাবার এবং এ আশঙ্কা ভবিষ্যতে সত্যি হলে বিশ্ব অর্থনীতির অতিশয় ক্ষুদ্র অংশীদার হিসেবে আমাদের কী হবে তা নিয়ে ভাবার সময় এখনো আসেনি। তাহলে কি কারণে আমাদের গর্বিত মানুষ ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে পুরো সরকার তার হাতে থাকা রাষ্ট্রযন্ত্রের সব শক্তি জড়ো করে ক্রমাগত আঘাত করে চলছে?
ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে একটা বিরুদ্ধ বলয় সৃষ্টি হয় যখন তিনি ওয়ান ইলেভেনের কুশীলবদের প্রচ্ছন্ন ছত্রছায়ায় এমন একটা সময় নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠনে উদ্যোগ নিয়েছিলেন, যখন খালেদা-হাসিনা কারাগারে আর রাজনীতিকে বিরাজনীতিকরণের একটা হীন চেষ্টা প্রবল হয়ে উঠেছিল। পরে অবশ্য ড. ইউনূস রনে ভঙ্গ দিয়ে শরীরে আর ইমেজে বাংলাদেশের প্রচলিত কদর্য রাজনীতির কোনো রকম কাদা-কালিমা লেপ্টে যাবার আগেই এ উদ্যোগ কবরস্থ করেছিলেন।
গ্রামীণফোনের বৃহদাংশ শেয়ারের অংশীদার নরওয়ের টেলিনরের সঙ্গে গ্রামীণফোনের শেয়ার নিয়ে ড. ইউনূসের বিরোধের বিষয়ে আমরা অনেকেই জানি। এটা নিয়ে বেকায়দায় পড়া টেলিনর কর্তৃপক্ষ। ড. ইউনূসকে ফাঁসানোর ফন্দি-ফিকির যে তারা আড়ালে আবড়ালে করছে না তা কিভাবে নিশ্চিত হওয়া যাবে? যা হোক, তার একটা আলামত মিলে, যখন দেখি নরওয়ের অখ্যাত এক টেলিভিশন চ্যানেল ড. ইউনূসের হালখাতা উদঘাটনের মিশনে নেমে মোটামুটি বড় ঘাপলা নয় এমন একটা ইস্যুকে ফুলিয়ে ফাপিয়ে ফিচার তৈরি করে বিশ্বময় হুলস্থুল বাঁধানোর চেষ্টা করে। সে ফিচারটি বিশ্বময় হুলস্থুল বাঁধানোতে সফল না হলেও বাংলাদেশে শাসক শ্রেণীর হাতে ইউনূস-বধের একটা বড় উপলক্ষ বানিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে।
বছরখানেক আগে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ড. ইউনূসের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করে বলেছিলেন, ড. ইউনূস নয়, ১৯৯৮ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির জন্য শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়া উচিত ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও জনসংহতি সমিতির প্রধান সন্তু লারমার। একই ঘরানার (একাডেমিক ডিসিপ্লিন বিবেচনায়) মানুষ হয়েও অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত ক্ষুদ্র ঋণ ও গ্রামীণ ব্যাংকসংক্রান্ত এক মন্তব্যে ‘অল রাবিশ’ বলে ড. ইউনূসকে যেভাবে শ্লেষাত্মক বাক্যবানে ঘায়েল করলেন তা অভাবনীয়। আজীবন আকাশচুম্বী জনপ্রিয় (!) ছয় প্লটের ভারে ন্যূব্জ শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়ার কথা বাদ দিলেও দল ও সরকারের দ্বিতীয় ব্যক্তি সৈয়দ আশরাফ ড. ইউনূসের নোবেল পুরস্কার অর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে ‘রেড় ওয়াইন আর চিপস’ খেয়ে একাধিক নোবেল পুরস্কার পাবার আজগুবি গল্প জাতিকে খাওয়ানোর অপচেষ্টা করতে পিছপা হননি। সৈয়দ আশরাফের মতো সম্ভ্রান্ত ঘরের সজ্জন রাজনীতিবিদ ‘রেড ওয়াইন, চিপস সান্ডউইচ’ তত্ত্ব দিয়ে এদেশের একমাত্র নোবেল লরিয়েটকে কিভাবে রাস্তার ফালতু মানুষের মতো তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করলেন তা কোনো ভদ্র রুচিবান মানুষ দ্বিতীয়বার শুনতে চাইবেন না। জাতি এও দেখেছে ড. ইউনূস ও তার গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে সরকার যখন টানাহেচড়া করছিল, গ্রামীণ ব্যাংক থেকে অপসারিত ড. ইউনূস আইনি প্রতিকার পেতে আদালতের বারান্দায় বারান্দায় ছুটোছুটি করছিলেন, তখন বাংলা একাডেমীর একুশে বইমেলার উদ্ভোধনী অনুষ্ঠানে অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ী ভারতের অমর্ত্য সেনকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে অতিথি করে সম্মানিত করা হয়েছিল। কথায় বলে ‘গেয়ো যোগী ভিখ পায় না’ আর ‘আপন ঘরনীর নয়, পর ঘরনীর তৈরি পিঠার স্বাদ বেশি’।
ভারবাল অ্যাটাকের মাধ্যমে গ্রাউন্ড তৈরির পর শুরু হয় সরাসরি আঘাত করে ড. ইউনূসকে কুপোকাৎ করার মিশন। কায়দা-কানুন করে শুরু করা হলো সে কালো উপখ্যানের মঞ্চায়ন পর্ব। টার্গেটে করা হয় ড. ইউনূসের হাতে গড়া ক্ষুদ্র ঋণের মডেল প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংককে। অতিরিক্ত বয়স দেখিয়ে ব্যাংকিং অধ্যাদেশের একটা মনমত ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর মাধ্যমে তাকে শুধু গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদ থেকেই অপসারণ করা হয়নি, এ ব্যাংকে বিশেষায়িত বেসরকারি ব্যাংকের ক্যাটাগরি থেকে স্ট্যাটাস পরিবর্তন করে সরকারি ব্যাংকে পরিণত করার একটা কুৎসিত খেলাও শুরু হয়। এ নিয়ে কমিশন করা থেকে শুরু করে পছন্দসই লোককে চেয়ারম্যান পদে বসানো, দেশ-বিদেশের বিশিষ্টজনদের অনুরোধ, প্রতিবাদকে উপেক্ষা করে অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে গরিব মহিলাদের ৯৭ মালিকানার এ ব্যাংকে সরকারের পুরো নিয়ন্ত্রণে নিতে যতসব কলাকৌশল তার কিছুই বাদ রাখা হচ্ছে না।
এ অধ্যাদেশ জারির পর তাৎক্ষণিক এক প্রতিক্রিয়ায় ড. ইউনূস বলেছিলেন, “বহুজনের ব্যক্তি মালিকানায় পরিচালিত একটি বেসরকারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের তিন শতাংশের মালিক হয়েও প্রধান নির্বাহী নিয়োগের ক্ষমতা নিয়ে নেয়ার মাধ্যমে গ্রামীণ ব্যাংকের সমাপ্তি পর্ব শুরু করল সরকার।”
তিনি আরো বলেন, “জাতির জীবনে এটা একটা কালো দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। এ দুঃখ ধারণ করার ক্ষমতা আমার নেই।”
এ নির্দেশ জারির পরদিনই দেশের শীর্ষস্থানীয় তিন অর্থনীতিবিদ -ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, ড. আবু আহমেদ ও ড. মুহাম্মদ মাহবুব আলী তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে বলেছেন, এতে করে গ্রামীণ ব্যাংকের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে। গ্রামীণ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নিতে সরকারের ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করতেই এ অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে।
সরকার যে ব্যাংক পরিচালনা করতে, জনগণের আমানত রক্ষা করতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে তার জ্বলন্ত প্রমাণ হচ্ছে সোনালী ব্যাংকসহ রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকগুলো থেকে হাজার কোটি টাকা লুটপাটের মহোৎসব প্রদর্শন। হলমার্কের ২৬০০ কোটিরও বেশি টাকা ঋণের নামে সরকারের উপদেষ্টা, প্রভাবশালীদের সহায়তায় যেভাবে লুটপাট করা হলো তা ব্যাংকিং ইতিহাসে নজীরবিহীন কেলেঙ্কারি। এমন কেলেঙ্কারি ইসলামী ব্যাংকসহ সরকারের পছন্দের লোকদের নিয়ন্ত্রণে নেই এমন পরিচালকদের মালিকানার কোনো বেসরকারি ব্যাংকে ঘটতো তাহলে এক রাত পেরিয়ে নতুন দিনের সূর্যোদয়ের আগে কোনো আইনি প্রক্রিয়ার ধার না ধেরে এ ধরনের ব্যাংক সরকার তার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে মালিকদের লালদালানে চালান করে দিতো। বয়সের অজুহাত দেখিয়ে ড. ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদ থেকে সরানো হলো অথচ হলমার্ক কেলেঙ্কারির মতো জনগণের টাকার এমন ‘সমুদ্র চুরির’ পর এ সোনালী ব্যাংকের সাধু চেয়ারম্যান আর রাজনৈতিক আশীর্বাদপুষ্ট পরিচালনা পরিষদ সদস্যদের ক্ষমতার মেয়াদ বাড়ানো হলো। তাহলে নোবেল বিজয়ী হলেও ড. ইউনূস তো আইনের ঊর্ধ্বে নয় বলে আইনমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রীসহ যারা তার বিরুদ্ধে নেয়া আক্রোশমূলক পদক্ষেপকে জায়েজ করতে চেয়েছিলেন তাদের কাছে সহজেই একটি প্রশ্ন করা যায়। প্রশ্নটি হলো, সোনালী ব্যাংকে লুটপাটের সাঙ্গপাঙ্গদের ক্ষেত্রে আইনের ঊর্ধ্বে কেউ নয় এ নীতির পরিবর্তে কেন আইনকে মাটির নিচে চাপা দিয়ে রাখা হয়েছে?
তিন.
এ ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে জাতি কী দেখলো? শুধু একজন নাগরিক হিসেবে ড. ইউনূস তার সাংবিধানিকভাবে অর্জিত ব্যক্তির মান-সম্ভ্রম, মর্যাদা রক্ষা ও সমান আইনি প্রতিকার পাবার সব অধিকার সরকার ও রাষ্ট্রযন্ত্রের হাতে খুইয়ে বসলেন। এখানে তাকে প্রটেকশন দেয়ার কোনো শক্তিই আর অবশিষ্ট রইলো না। এখন সোনালী ব্যাংক চেটেপুটে খাবার দায়ে অভিযুক্ত হলমার্কের মালিক তানভীর মাহমুদকে খোদা নাখাস্তা যদি কোনো কারণে জেলে যেতেও হয়, তারও আগে হয়ত গ্রামীণ ব্যাংকের গরিব মহিলাদের তহবিল লোপাটের অভিযোগ খাড়া করে ড. ইউনূসকে জেলে যেতে হতে পারে। কারণ, ইতিমধ্যেই তার বয়স অতিক্রম পরবর্তী নেয়া বেতন-ভাতা আর তার হাতে থাকা নানা প্রতিষ্ঠানের আয়কর কিভাবে ফাঁকি দিয়েছেন সে অনুসন্ধান শুরু হয়ে গেছে। সুতরাং, ড. ইউনূসকে জেলে নেয়ার মতো ঘটনা ঘটলে বিস্ময়ের কিছুই থাকবে না। কারণ আমরাই তো দেখলাম, যে প্রধানমন্ত্রী ড. ইউনূসকে সুদখোর, গরিবের রক্তচোষা বলে আক্রমণ করলেন, কদিন পর ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের এক প্রতিনিধি দলের কাছে ড. ইউনূসকে বিশ্বব্যাংকের প্রধান করার প্রস্তাবনা দিলেন, যদিও এটাকে অনেকেই অন্যরকমভাবে নিয়েছিলেন। জাতিই তো কদিন আগে প্রত্যক্ষ করলো, যে প্রধানমন্ত্রী সংসদে দাঁড়িয়ে পদ্মা সেতু ইস্যুতে বিশ্বব্যাংকের কঠোর সমালোচনা করে দেশের টাকায় এ সেতু নির্মাণের জিহাদি জজবা দেখালেন, তার সরকারই কিনা এখন এ ঋণের জন্য বিশ্বব্যাংকের কাছে করজোড়ে ভিক্ষা করছেন। সুতরাং, গ্রামীণ ব্যাংকের অর্থ লোপাট কিংবা দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনে ড. ইউনূসকে জেলে দেয়া হলে বিস্মিত হবার মতো কিছুই ঘটবে না। কারণ এটা সব সম্ভবের দেশ, আলেকজান্ডার স্বয়ং বলে গেছেন ‘সেলুকাস, কি বিচিত্র এ দেশ!’
চার.
এবার ঝালকাঠির দরিদ্র কলেজছাত্র কিশোর লিমন হোসেনের কথায় আসা যাক। আশরাফুল মাখলুকাতের অংশ হিসেবে, শুধু একজন নাগরিক হিসেবে ড. ইউনূস আর এই লিমনের মধ্যে কোনো ফারাক নেই। আর পরিচয়, ইমেজ, অর্জন আর অবস্থানের ব্যাপ্তি হিসেবে নিলে ড. ইউনূস আর লিমনের অবস্থান হবে আকাশ আর পাতালে। রূপক অর্থে ইউনূস এভারেস্ট শৃঙ্গে হলে লিমনের অবস্থান ঝালকাঠির একটি ছোট্ট টিলায়। এমন একজন লিমন যে কিশোর র্যাবের গুলিতে পঙ্গু হবার আগে স্থানীয় কোনো অখ্যাত দেয়ালিকায় নাম ওঠার মতো কোনো অর্জন আর উপলক্ষের জন্ম দিতে পারেনি, সে কিনা আজ সারা দেশেতো বটেই, মানবাধিকার সংগঠনগুলোর সোচ্চার কণ্ঠের কারণে বিদেশেও পরিচিতির গণ্ডি ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। ড. ইউনূস হয়ত রাজনৈতিক দল করতে চেয়ে, বিশ্বব্যাপী পরিচিতি আর ইমেজ তৈরি করে, দরিদ্র মহিলাদের বিশাল এক গোষ্ঠীকে জড়ো করে, হিলারি ক্লিনটনের কাছে ফজলে হাসান আবেদসহ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে ওকালতি করে বর্তমান সরকার আর রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতিপক্ষ হিসাবে আভির্ভূত হয়েছেন। কিন্তু চুনোপটি লিমন যে এমনকি কোনো প্রভাবশালী ছাত্রসংগঠনের সঙ্গেও সম্পৃক্ত নয় সে কিভাবে সরকার আর রাষ্ট্রযন্ত্রের জন্য এমন এক বৈরী প্রতিপক্ষ হয়ে উঠলো?
লিমনের গ্রামের এক ভয়ঙ্কর সন্ত্রসীকে মহাধুসধামের সঙ্গে গ্রেফতার অভিযানে গিয়ে ওই সন্ত্রাসীর টিকিটি তো পানইনি, র্যাব বরং উক্ত সন্ত্রাসী ভেবে লিমনকে গুলি করে ধরে নিয়ে আসে। পরে যখন র্যাবের হুঁশ হলো যে, আহত কিশোর ওই সন্ত্রাসী নয়, তখন তাকে এ সন্ত্রাসীর ঘনিষ্ট সহযোগী প্রমাণের সব পাঁয়তারা শুরু করলো। ভুল করে একজন নিরাপরাধ কিশোরকে পঙ্গু করার পর কথিত এলিট ফোর্সের উক্ত অপারেশনের দায়িত্ববান কর্তাব্যক্তিরা ক্ষমা চেয়ে তার ক্ষতিপূরণ ও সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করার পরিবর্তে তার বিরুদ্ধে র্যাবকে হামলা ও তার কাছ থেকে অস্ত্র উদ্ধারের বানোয়াট কাহিনী ফাঁদা হলো। মিডিয়াসহ চতুর্দিকে সমালোচনার মুখে পড়ে স্বয়ং র্যাবের ডিজি হাসান মাহমুদ খন্দকারই মিডিয়ার কাছে স্বীকার করলেন, লিমন সন্ত্রাসী নয়, তার বিরুদ্ধে কোনো থানায় কখনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড তো দূরের কথা, অন্য কোনো অভিযোগেও মামলা দায়ের হয়নি। তাহলে উদ্ধারকৃত অস্ত্রটি র্যাব কোত্থেকে পেল? কেন লিমনের বিরুদ্ধে আক্রমণ ও অবৈধ অস্ত্র রাখার দুটি মামলা দায়ের করা হলো? এ ধরনের অমানবিক ও নিষ্ঠুর আঘাতের পর যে আঘাতে দরিদ্র কিশোর লিমনের একটি পা কেটে ফেলতে হয়েছে এবং তাকে চিরতরে পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়েছে, সে সূত্রে কোনো র্যাব জোয়ান কিংবা কর্মকর্তার কি ন্যূনতম শাস্তি দেয়া হয়েছে? না, হয়নি। উল্টো একের পর এক হয়রানি, হামলা, ভয়-ভীতি প্রদর্শন, তার মায়ের দায়ের করা মামলা প্রত্যাহারে চাপ সৃষ্টি থেকে শুরু করে এ দরিদ্র কিশোর ও তার পরিবারকে পর্যুদস্থ করার জন্য এমন কোনো বেআইনি কৌশল নেই প্রয়োগ করা হয়নি, করা হচ্ছে না। তার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা দুটিতেই প্রাথমিক অভিযোগে দোষী সাব্যস্থ করে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। আর র্যাবের বিরুদ্ধে তার মায়ের দায়ের করা মামলা গত ঈদের ছুটির সময় গোপনে র্যাবের অভিযুক্তদের নির্দোষ দেখিয়ে আদালতে পুলিশের পক্ষ থেকে চূড়ান্ত প্রতিবেদন (ফাইনাল রিপোর্ট) দেয়া হয়েছে। সেখানেই ঘটনা থামেনি, গত ঈদের পর র্যাবের স্থানীয় সোর্স বলে কথিত ইব্রাহিমের ওপর হামলা ও তার শ্যালকেকে হত্যার অভিযোগে লিমন ও তার মায়ের বিরুদ্ধে থানায় দায়ের করা হয় হত্যা মামলা।
নিউ ইয়র্কভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ওয়াচডগ ‘হিউমান রাইটস ওয়াচ’ থেকে শুরু করে স্থানীয় মানবাধিকার সংগঠনগুলো ও মিডিয়া একযোগে একজন দরিদ্র কিশোরকে নিয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের এমন ভয়ানক ও নিষ্ঠুর কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদে সোচ্চার হলেও রাষ্ট্রযন্ত্রের কিংবা সরকারের কারো সেদিকে খেয়ালই নেই। এমনকি রাষ্ট্রীয় খরচে পরিচালিত মানবাধিকার কমিশনের বাচন আর কথামালায় পারদর্শী চেয়ারম্যানের নানা আশ্বাস, কমিশনের পক্ষ থেকে লিমনকে সব নিবর্তনমূলক পদক্ষেপের হাত থেকে রক্ষার প্রতিশ্রুতি এবং হাসপাতালে পঙ্গু লিমনকে দেখে অশ্রুপাত করলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। চরম নিরাপত্তাহীনতা আর অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আশঙ্কার মধ্য দিয়ে বসবাস করছে দ্ররিদ্র লিমন ও তার পরিবার। যে প্রধানমন্ত্রী লালবাগে অগ্নিকাণ্ডে মৃত কয়েক ভিকটিমের এতিম মেয়েদের অভিভাবকত্ব গ্রহণ করে, তাদের বিয়ে-শাদীর ব্যবস্থা করে বেশ আনন্দ বোধ করেছিলেন আর আমরা রাষ্ট্রীয় প্রচারণা দিয়ে একে প্রধানমন্ত্রীর ‘মমত্ববোধ আর মহিমা’ বলে প্রচার করলাম। কিন্তু দরিদ্র কিশোর লিমন কেন চারদিক থেকে এত অনুরোধ সত্ত্বেও এমন গরির অন্তঃপ্রাণ প্রধানমন্ত্রীর সামান্য অনুকম্পা পেলেন না তা বিস্ময়কর। অবশ্য দুর্মুখেরা বলতেই পারেন, অনুকম্পা পেয়েছে বলেই তো লিমনের একটি পা এখনো ভালো আছে আর তাকে ‘ক্রসফায়ারে’ পড়ে জীবন দিতে হয়নি।
পাঁচ.
নাগরিক অধিকার হরণে, নিবর্তন-নির্যাতনের এমন আগ্রাসী রূপ ধারণ করে রাষ্ট্র আর সরকার যখন এককাতারে এসে দাঁড়ায়, তখন বিচারালয়, সংবিধান, সংসদ, আমলাতন্ত্র, সবই নাগরিকের কাছে অর্থহীন, অস্তিত্ব থাকলেও এগুলো দৃশ্যমান নয়, ধোয়াশায় ঘেরা বিমূর্ত ধারণা, বাস্তবতা হলেও মনে হয় ইউটোপিয়া।
এখানে নোবেলজয়ী ড. ইউনূস আর দ্ররিদ্র পঙ্গু কিশোর লিমনের মধ্যে কোনো ফারাক নেই। তাদের মালিকানাধীন রাষ্ট্রে তারাই চরম অসহায়। সরকার আর রাষ্ট্র এ জায়গায় দু’জনের জন্যই চরম বৈরী প্রতিপক্ষ। উল্টো বললে দাড়াঁয়, এক্ষেত্রে, ড. ইউনূস, লিমন দু’জনই রাষ্ট্র আর সরকারের চরম বৈরী প্রতিপক্ষ। কেন? জবাবটা সময়ই বলে দেবে। কারণ টাইম ইজ দ্যা বেস্ট হিলার।
মোহাম্মদ শাহনওয়াজ: সাংবাদিক।
ইমেইল: shahnowaz2002@yahoo.com
salam
ReplyDeletewww.facebook.com/OnlineBanglaMedia te ekta like korer reqest. & www.onlinebanglamedia.com bangla portal ta circulate korer request rilo:) appreciate any useful website link, articles and of course valuable idea!!
Thanks