রম্য-ভাষাপ্রেম by সাইফুল আলম
আমার প্রাচীন বন্ধু কিসমিস আলীর সঙ্গে নিয়মিতভাবে চক্ষু বিনিময় না হলে আমার সারা অঙ্গটা যেন ছমছম করে। ক'দিন আগে আমার সে দশাই হলো। প্রায় সাত সাতটা দিন কিসমিসবিহীন আমি যেন শুকিয়ে আমচুর হয়ে যাচ্ছিলাম।
শেষে একদিন অনেকটা অসময়েই আমি ওর দরজায় গিয়ে আমার উপস্থিতিটা জানান দেওয়ার জন্য কলিংবেলটায় দু'বার দাম্পত্য চাপ দিলাম। কিঞ্চিৎ বাদে স্বয়ং কিসমিস আলী দরজাটা খুলে ওর মুখের সামনের দু'পাটি দাঁতগুলোর দুই-তৃতীয়াংশ নগ্ন করে হেসে বলল, 'আরে ইয়ার, কিয়া হাল হ্যায়? আ যাও- আনদার মে আও যাও।'
আমি চিরকালের বাংলা ভাষাপ্রেমী কিসমিসের মুখে খাঁটি বিদেশি ভাষার সম্ভাষণ শুনে নিজের কান দুটোয় যেন চিমটি কাটতে উদ্যত হলাম। কোনো রকমে বিস্ময়কে সামলে বললাম, সেকি! এই অতি ঘনীভূত বয়সে তোমার এসব বিদেশি ভাষাপ্রীতি মাথাচাড়া দিল কেন? আমার কথার কোনো উত্তর না দিয়ে ও আমার ডান হাতটা ধরে ঘরের ভেতর প্রবেশ করাতে করাতে বলল, 'ছোড়া ইয়ার ও বাত বাদমে পুছো। পহলে আন্দার তো আ যাও।' ওর এ ধরনের অদ্ভুত আচরণে আমার বুকের খাঁচার ভেতরের হৃদযন্ত্রটা যেন লাফালাফি করতে লাগল। আমাকে একটা সোফায় স্থাপন করে এবার কিসমিস খাঁটি বাংলা ভাষায় বলল, 'কী? খুব অবাক হয়েছ, তাই না দোস্ত? আমি আমার মুখের বিস্মিত হাঁ-টাকে আরও ইঞ্চিখানেক প্রসারিত করে ওর মুখমণ্ডলের মানচিত্রটার দিকে তাকালাম। ও সেদিক পানে লক্ষ্য করে বলল, 'দোস্ত অবাক হওয়ার কিছু নেই। লক্ষ্য করেছ নিশ্চয় ইদানীং টিভি চ্যানেলগুলোয় হিন্দি সিরিয়াল দেখার দর্শক সংখ্যাটা আমাদের দেশে কী হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
'তাতে কী হয়েছে? মানুষের কর্মময় জীবনে বিনোদনের তো প্রয়োজন আছে? আমি বললাম।
'তা আছে, তবে নিছক কোনো বিনোদন যদি কারও জাতীয় সত্তায় বিরূপ প্রভাব ফেলে সেটা নিশ্চয়ই খেয়াল করতে হবে।' কিসমিসের কণ্ঠে যেন দৃঢ়তা ভর করেছিল। আমি তাৎক্ষণিক কোনো উত্তর নিক্ষেপ না করে ওর দীপিত চিন্তাধারাটাকে আমার মনের সর্বোত্তম স্থানটায় স্থাপন করতে সচেষ্ট হলাম। নীরবতার আয়ুটাকে ক্ষয় করে কিসমিস বলল, 'দোস্ত বিদেশি ভাষা আর সংস্কৃতির প্রভাব আমাদের বর্তমান আর ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নিয়ে যেন ভলিবল খেলতে শুরু করেছে।' আমি বললাম, 'কিন্তু এ পৃথিবীতে তো নানা ভাষাভাষী আর বিচিত্র সংস্কৃতির মানুষের বসবাস। সেসব জানাটা দোষের কিছু না।'
'বিভিন্ন ভাষা শেখাটা উত্তম বিষয়। তবে মাতৃভাষা যে সবার ঊধর্ে্ব সেটা আমরা অনেক সময় ভুলে যাই।' আমি কিসমিসের শেষের উক্তিটার লেজে তালোয়ার চালিয়ে প্রতিবাদী কণ্ঠে বললাম, 'না দোস্ত, এ পৃথিবীতে আমরাই সেই জাতি যারা ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছি।' আমার কথা শুনে কিসমিস তার অভিজ্ঞ কণ্ঠস্বরটায় শ্রদ্ধা চন্দন ঢেলে বলল, 'সত্যি, এটা আমাদের গর্বের বিষয়, কিন্তু দুঃখের বিষয় আমাদের মাতৃভাষা প্রেমটায় যেন ফরমালিনের গন্ধ।'
'সেটা কেমন?' আমি জানতে চাইলাম।
'কেন?' আমাদের ভাষাপ্রেমে কি ভেজালের গন্ধ অনুভব করনি?
কিসমিসের মন্তব্যের আবর্তে আমার চিন্তাশক্তিটি যেন হুমড়ি খেয়ে পড়ল। বললাম, 'বিষয়টা একটু স্পষ্ট করেই উপস্থাপন কর না দোস্ত। উপলব্ধি করতে সুবিধা হবে।'
আজকাল টিভি চ্যানেলে হিন্দি সিরিয়াল দেখে আমাদের দেশের অনেক বাচ্চা ছেলেমেয়ে ঘরে ওই ভাষায় কথা বলতে চেষ্টা করছে। আর_
এটুকু বলে কিসমিস নিঃশব্দে তার ঘরের ছাদে ঝোলানো দুরন্ত সিলিং ফ্যানটার দিকে তাকিয়ে রইল, আমিও ওকে অনুকরণ করলাম। তবে বুঝলাম না ও কী ইঙ্গিত করতে চাইছে। ও এবার দৃষ্টি নামিয়ে অসমাপ্ত কথাটার জের টেনে বলল, আর অনেক অভিভাবক পরিচিত মহলে বিষয়টির বর্ণনা দিয়ে পরিতৃপ্তির সুইমিং পুলে চিত সাঁতার দিচ্ছেন। আমি শীতল কণ্ঠে বললাম, 'তা তুমি সত্যই বলেছ।' কিসমিস এবার বেশ সহজ ভঙ্গিমায় বলল, 'দোস্ত, আমরা রেগে গেলে বা কারও সঙ্গে চুটিয়ে ঝগড়া করতে গেলে অনেক সময় মনের অজান্তেই বিদেশি ভাষায় গালাগালি করি আর মনের খেদও দূর করি। যেমন_ গেট আউট, শাটআপ, ইডিয়ট, উল্লু কা পাঁঠা ইত্যাদি ইত্যাদি। কথাগুলোর শেষ ধাপে কিসমিস যেন তার মনের গহিন কোণের আনন্দটাকে একটা সূক্ষ্ম ছাকনি দিয়ে ছেকে আনছিল। 'আমি বিলম্বকে প্রশ্রয় না দিয়ে চটজলদি বললাম, 'হয়তো দীর্ঘদিন ব্রিটিশ আর পাকিস্তানিদের অধীনে থাকায় এটা আমাদের সহজাত অভ্যাস।
'হয়তো তাই।' কিসমিস যেন ছটাকখানেক ওজনের হালকা মন্তব্যটা ছুড়ে দিল। আমি এবার বললাম, 'দোস্ত এ প্রসঙ্গে আমার ছেলেবেলায় শোনা। একটা শ্লোকের কথা মনে পড়ছে।
'কী সেটা? বলেই ফেল না। আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইল কিসমিস। আমি আমার বায়সের মতো কর্কশ কণ্ঠ স্বরটাকে খানিক সুরেলা করে বললাম, 'আমরা বিলেতি ধরনের হাসি জাপানি ধরনের কাশি আর পাকিস্তানি পান-জর্দা বড়ই ভালোবাসি।'
আমার পরিবেশনটা শেষ হতেই কিসমিস উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলল, 'দোস্ত সত্যি, তোমার রসিকতায় আজও বয়সের ভাটা পড়েনি। আমি যেন আড়াইশ' গ্রাম ওজনের টাটকা লজ্জা পেয়ে নিশ্চুপ রইলাম। কিসমিস এবার কণ্ঠে কিছুটা আক্ষেপের ঝালমসলা মেখে বলল, 'আমাদের দেশের বিত্তবানরা তাদের বাচ্চাদের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পাঠিয়ে আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর তোলেন আর নিম্নবিত্তরা বাচ্চাদের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বা মাদ্রাসা-মক্তবে পাঠিয়ে নীরব মনোবেদনায় ভোগেন। অথচ পৃথিবীতে এমন অনেক জাতি আছে যারা বিদেশি ভাষা জানলেও মাতৃভাষা ছাড়া কথা বলতে নারাজ।' এক মাত্রায় কথাগুলো বলে কিসমিস যেন তার দমে কিছুটা হাতল মেরে নিল। আমি আমার দেহটা একটু নাড়াচাড়া দিয়ে বললাম,
'দোস্ত, এমনও দেখা যায় আমাদের দেশের অনেক বুদ্ধিজীবী বিভিন্ন বক্তৃতা, সেমিনার অথবা টক শো ইত্যাদি অনুষ্ঠানে নিজেদের কথামালার ফাঁকফোকরে ইংরেজি ঢুকিয়ে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। আমার কথাটার উত্তর না দিয়ে কিসমিস যেন মোলায়েম দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল। আমি আবার বললাম,
'দোস্ত, আমাদের এসব আচরণ আর অভ্যাস থেকে উত্তরণের পথই-বা কী? কিসমিস বলল, 'দোস্ত, বিজ্ঞানের কল্যাণে আজ পৃথিবী ছোট হয়ে এসেছে। বিভিন্ন ভাষাভাষী আর সংস্কৃতির মানুষ আজ কাছাকাছি এসে পড়েছে। তাই নানা ভাষা আর সংস্কৃতির প্রভাব সব জাতির ওপরই ভর করছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে সব জাতির জন্য তার নিজস্ব ভাষা আর সংস্কৃতিই ঊধর্ে্ব। সামাজিক অবক্ষয়কে রোধ করার জন্য আমাদের সুশিক্ষা, ভাষাপ্রেম আর শক্ত মনোবলই যথেষ্ট। কিসমিসের সুচিন্তাগর্ভ মন্তব্যটা যেন আমার দু'কানের টিম্পেনিক মেমব্রেন দুটোয় অনুরণন তুলছিল। আমাকে মোহমুক্ত করে ও এবার প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, 'দোস্ত চা খাবে? আজ আমি তোমাকে নিজের হাতে তৈরি চা খাওয়াব। আদা আর লেবুর রসের সঙ্গে লিকারের হুটোপুটি। দুধ আর চিনির অস্তিত্ব নেই। হেঃ হেঃ হেঃ।' কিসমিস যেন একটা অট্টহাসির সঞ্চারী ইথারের স্যাটেলাইটে ছেড়ে দিয়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াল।
ডা. সাইফুল আলম : ডেন্টাল সার্জন
উত্তরা আধুনিক মেডিকেল
কলেজ হাসপাতাল
আমি চিরকালের বাংলা ভাষাপ্রেমী কিসমিসের মুখে খাঁটি বিদেশি ভাষার সম্ভাষণ শুনে নিজের কান দুটোয় যেন চিমটি কাটতে উদ্যত হলাম। কোনো রকমে বিস্ময়কে সামলে বললাম, সেকি! এই অতি ঘনীভূত বয়সে তোমার এসব বিদেশি ভাষাপ্রীতি মাথাচাড়া দিল কেন? আমার কথার কোনো উত্তর না দিয়ে ও আমার ডান হাতটা ধরে ঘরের ভেতর প্রবেশ করাতে করাতে বলল, 'ছোড়া ইয়ার ও বাত বাদমে পুছো। পহলে আন্দার তো আ যাও।' ওর এ ধরনের অদ্ভুত আচরণে আমার বুকের খাঁচার ভেতরের হৃদযন্ত্রটা যেন লাফালাফি করতে লাগল। আমাকে একটা সোফায় স্থাপন করে এবার কিসমিস খাঁটি বাংলা ভাষায় বলল, 'কী? খুব অবাক হয়েছ, তাই না দোস্ত? আমি আমার মুখের বিস্মিত হাঁ-টাকে আরও ইঞ্চিখানেক প্রসারিত করে ওর মুখমণ্ডলের মানচিত্রটার দিকে তাকালাম। ও সেদিক পানে লক্ষ্য করে বলল, 'দোস্ত অবাক হওয়ার কিছু নেই। লক্ষ্য করেছ নিশ্চয় ইদানীং টিভি চ্যানেলগুলোয় হিন্দি সিরিয়াল দেখার দর্শক সংখ্যাটা আমাদের দেশে কী হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
'তাতে কী হয়েছে? মানুষের কর্মময় জীবনে বিনোদনের তো প্রয়োজন আছে? আমি বললাম।
'তা আছে, তবে নিছক কোনো বিনোদন যদি কারও জাতীয় সত্তায় বিরূপ প্রভাব ফেলে সেটা নিশ্চয়ই খেয়াল করতে হবে।' কিসমিসের কণ্ঠে যেন দৃঢ়তা ভর করেছিল। আমি তাৎক্ষণিক কোনো উত্তর নিক্ষেপ না করে ওর দীপিত চিন্তাধারাটাকে আমার মনের সর্বোত্তম স্থানটায় স্থাপন করতে সচেষ্ট হলাম। নীরবতার আয়ুটাকে ক্ষয় করে কিসমিস বলল, 'দোস্ত বিদেশি ভাষা আর সংস্কৃতির প্রভাব আমাদের বর্তমান আর ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নিয়ে যেন ভলিবল খেলতে শুরু করেছে।' আমি বললাম, 'কিন্তু এ পৃথিবীতে তো নানা ভাষাভাষী আর বিচিত্র সংস্কৃতির মানুষের বসবাস। সেসব জানাটা দোষের কিছু না।'
'বিভিন্ন ভাষা শেখাটা উত্তম বিষয়। তবে মাতৃভাষা যে সবার ঊধর্ে্ব সেটা আমরা অনেক সময় ভুলে যাই।' আমি কিসমিসের শেষের উক্তিটার লেজে তালোয়ার চালিয়ে প্রতিবাদী কণ্ঠে বললাম, 'না দোস্ত, এ পৃথিবীতে আমরাই সেই জাতি যারা ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছি।' আমার কথা শুনে কিসমিস তার অভিজ্ঞ কণ্ঠস্বরটায় শ্রদ্ধা চন্দন ঢেলে বলল, 'সত্যি, এটা আমাদের গর্বের বিষয়, কিন্তু দুঃখের বিষয় আমাদের মাতৃভাষা প্রেমটায় যেন ফরমালিনের গন্ধ।'
'সেটা কেমন?' আমি জানতে চাইলাম।
'কেন?' আমাদের ভাষাপ্রেমে কি ভেজালের গন্ধ অনুভব করনি?
কিসমিসের মন্তব্যের আবর্তে আমার চিন্তাশক্তিটি যেন হুমড়ি খেয়ে পড়ল। বললাম, 'বিষয়টা একটু স্পষ্ট করেই উপস্থাপন কর না দোস্ত। উপলব্ধি করতে সুবিধা হবে।'
আজকাল টিভি চ্যানেলে হিন্দি সিরিয়াল দেখে আমাদের দেশের অনেক বাচ্চা ছেলেমেয়ে ঘরে ওই ভাষায় কথা বলতে চেষ্টা করছে। আর_
এটুকু বলে কিসমিস নিঃশব্দে তার ঘরের ছাদে ঝোলানো দুরন্ত সিলিং ফ্যানটার দিকে তাকিয়ে রইল, আমিও ওকে অনুকরণ করলাম। তবে বুঝলাম না ও কী ইঙ্গিত করতে চাইছে। ও এবার দৃষ্টি নামিয়ে অসমাপ্ত কথাটার জের টেনে বলল, আর অনেক অভিভাবক পরিচিত মহলে বিষয়টির বর্ণনা দিয়ে পরিতৃপ্তির সুইমিং পুলে চিত সাঁতার দিচ্ছেন। আমি শীতল কণ্ঠে বললাম, 'তা তুমি সত্যই বলেছ।' কিসমিস এবার বেশ সহজ ভঙ্গিমায় বলল, 'দোস্ত, আমরা রেগে গেলে বা কারও সঙ্গে চুটিয়ে ঝগড়া করতে গেলে অনেক সময় মনের অজান্তেই বিদেশি ভাষায় গালাগালি করি আর মনের খেদও দূর করি। যেমন_ গেট আউট, শাটআপ, ইডিয়ট, উল্লু কা পাঁঠা ইত্যাদি ইত্যাদি। কথাগুলোর শেষ ধাপে কিসমিস যেন তার মনের গহিন কোণের আনন্দটাকে একটা সূক্ষ্ম ছাকনি দিয়ে ছেকে আনছিল। 'আমি বিলম্বকে প্রশ্রয় না দিয়ে চটজলদি বললাম, 'হয়তো দীর্ঘদিন ব্রিটিশ আর পাকিস্তানিদের অধীনে থাকায় এটা আমাদের সহজাত অভ্যাস।
'হয়তো তাই।' কিসমিস যেন ছটাকখানেক ওজনের হালকা মন্তব্যটা ছুড়ে দিল। আমি এবার বললাম, 'দোস্ত এ প্রসঙ্গে আমার ছেলেবেলায় শোনা। একটা শ্লোকের কথা মনে পড়ছে।
'কী সেটা? বলেই ফেল না। আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইল কিসমিস। আমি আমার বায়সের মতো কর্কশ কণ্ঠ স্বরটাকে খানিক সুরেলা করে বললাম, 'আমরা বিলেতি ধরনের হাসি জাপানি ধরনের কাশি আর পাকিস্তানি পান-জর্দা বড়ই ভালোবাসি।'
আমার পরিবেশনটা শেষ হতেই কিসমিস উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলল, 'দোস্ত সত্যি, তোমার রসিকতায় আজও বয়সের ভাটা পড়েনি। আমি যেন আড়াইশ' গ্রাম ওজনের টাটকা লজ্জা পেয়ে নিশ্চুপ রইলাম। কিসমিস এবার কণ্ঠে কিছুটা আক্ষেপের ঝালমসলা মেখে বলল, 'আমাদের দেশের বিত্তবানরা তাদের বাচ্চাদের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পাঠিয়ে আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর তোলেন আর নিম্নবিত্তরা বাচ্চাদের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বা মাদ্রাসা-মক্তবে পাঠিয়ে নীরব মনোবেদনায় ভোগেন। অথচ পৃথিবীতে এমন অনেক জাতি আছে যারা বিদেশি ভাষা জানলেও মাতৃভাষা ছাড়া কথা বলতে নারাজ।' এক মাত্রায় কথাগুলো বলে কিসমিস যেন তার দমে কিছুটা হাতল মেরে নিল। আমি আমার দেহটা একটু নাড়াচাড়া দিয়ে বললাম,
'দোস্ত, এমনও দেখা যায় আমাদের দেশের অনেক বুদ্ধিজীবী বিভিন্ন বক্তৃতা, সেমিনার অথবা টক শো ইত্যাদি অনুষ্ঠানে নিজেদের কথামালার ফাঁকফোকরে ইংরেজি ঢুকিয়ে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। আমার কথাটার উত্তর না দিয়ে কিসমিস যেন মোলায়েম দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল। আমি আবার বললাম,
'দোস্ত, আমাদের এসব আচরণ আর অভ্যাস থেকে উত্তরণের পথই-বা কী? কিসমিস বলল, 'দোস্ত, বিজ্ঞানের কল্যাণে আজ পৃথিবী ছোট হয়ে এসেছে। বিভিন্ন ভাষাভাষী আর সংস্কৃতির মানুষ আজ কাছাকাছি এসে পড়েছে। তাই নানা ভাষা আর সংস্কৃতির প্রভাব সব জাতির ওপরই ভর করছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে সব জাতির জন্য তার নিজস্ব ভাষা আর সংস্কৃতিই ঊধর্ে্ব। সামাজিক অবক্ষয়কে রোধ করার জন্য আমাদের সুশিক্ষা, ভাষাপ্রেম আর শক্ত মনোবলই যথেষ্ট। কিসমিসের সুচিন্তাগর্ভ মন্তব্যটা যেন আমার দু'কানের টিম্পেনিক মেমব্রেন দুটোয় অনুরণন তুলছিল। আমাকে মোহমুক্ত করে ও এবার প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, 'দোস্ত চা খাবে? আজ আমি তোমাকে নিজের হাতে তৈরি চা খাওয়াব। আদা আর লেবুর রসের সঙ্গে লিকারের হুটোপুটি। দুধ আর চিনির অস্তিত্ব নেই। হেঃ হেঃ হেঃ।' কিসমিস যেন একটা অট্টহাসির সঞ্চারী ইথারের স্যাটেলাইটে ছেড়ে দিয়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াল।
ডা. সাইফুল আলম : ডেন্টাল সার্জন
উত্তরা আধুনিক মেডিকেল
কলেজ হাসপাতাল
No comments