কথা সামান্যই-মন্ত্রী হাজির by ফজলুল আলম
বাংলাদেশে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তারা খুবই আশা করেন যে তাঁদের অনুষ্ঠানে কোনো না কোনো মন্ত্রী হাজির থাকবেন। গুরুত্বপূর্ণ, অ-গুরুত্বপূর্ণ, প্রাতিষ্ঠানিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, অনর্থনৈতিক, ফালতু, সামাজিক মূল্যহীন,
বেশি হাঁটাহাঁটি করতে হবে না এমন স্থানের সভায়, এয়ার-কন্ডিশনড হোটেলের লবিতে বলরুমে বা মিটিং হলে কোনো অনুষ্ঠানে সম্পৃক্ত বা অসম্পৃক্ত মন্ত্রী, উপমন্ত্রী বা মন্ত্রীপর্যায়ের উপদেষ্টার আগমন অবশ্যই উদ্যোক্তাদের মনে চরম উৎসাহ সৃষ্টি করে। তার সঙ্গে গণমাধ্যমও এসে যায়, শুধু নির্জীব ছাপা পত্রপত্রিকার মাধ্যম নয়, ছবি নড়াচড়া করে, কথা শোনা যায় সেসব ছোট বাঙ্রে গণমাধ্যমও (টেলিভিশন) চলে এসে 'অনুষ্ঠান'টিকে স্বীকৃতি পাইয়ে দেয়।
আমি ব্যক্তিগতভাবে মন্ত্রীদের এই আসা বা আবির্ভাবের বিষয়টা বুঝতে পারতাম না। কারণ আমি যখন দেশ ছেড়েছিলাম ১৯৬৫ সালে প্রথম, তখন পাকিস্তানের সামরিক শাসনের মন্ত্রীরা জনসমক্ষে বা দিনের আলোর ছটায় বেশি বের হতেন না। তাঁরা লুকিয়ে লুকিয়ে যে শাসক তাঁকে অগণতান্ত্রিক মন্ত্রী বানিয়ে দিয়েছেন তাঁর পদলেহন করতেন। 'পাবলিকে'র কাছে এলেই তাঁদের বিপদ, হয় বিক্ষোভ নয় ইটপাটকেলের আশঙ্কা বেশি ছিল বলে।
১৯৬৯ সালে দেশে ফিরলেও মন্ত্রীটন্ত্রী নজরে আসত না। সে সময় গণমাধ্যম বলতে আমরা দৈনিক পত্রিকাই বুঝতাম, 'সচিত্র সন্ধানী' বিনোদন-কাম-সাহিত্য পত্রিকা ছিল, সিকান্দার আবু জাফরের 'সমকাল' বোধ হয় শেষ পর্যায়ে, আমার অগ্রজ ফজলুল হকের 'সিনেমা'রও একই অবস্থা। তবে রমরমা দৈনিক গণমাধ্যম হিসেবে ব্যবসা করত 'দৈনিক ইত্তেফাক'। সেটার সম্পাদকের স্থান গণমাধ্যম ও জনমনে এতই ঊর্ধ্বে ছিল যে একটা নতুন নাপিতের দোকানের উদ্বোধন করার জন্য তাঁকে আনতে পারলেই পরদিন দৈনিক ইত্তেফাকের প্রথম পৃষ্ঠায় খবরটি স্থান পাবেই বলে ধারণা করা হতো। তাতেই দোকানটি সফলভাবে শুরু হতো।
তারপর বাংলাদেশ স্বাধীন হলো, প্রধানমন্ত্রী ও অন্য মন্ত্রীরা গণরায়ে নির্বাচিত হয়ে জনসমক্ষে সমানে হাজির হতেন। সমস্যার অন্ত ছিল না, কিন্তু তাঁরা বীরদর্পে জানের বা অ-জ্ঞানের তোয়াক্কা না করেই চলাফেরা করতেন। বঙ্গবন্ধু তো তাঁর ঝরঝরা গাড়িতেই ভয়ডরহীনভাবে রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তব্য সম্পাদন করতেন।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর এলো সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের প্রত্যক্ষ সমর্থকরা। বঙ্গবন্ধু, মন্ত্রিপরিষদ, গণতন্ত্র, নতুন রাষ্ট্রীয় দর্শন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা- সব বিলুপ্ত হয়ে দেশ অন্য বলয়ে চলে গেল। তখন মন্ত্রীরা গণপ্রতিনিধি না হয়ে নতুন সামরিক, পরবর্তী সময়ে দল তৈরি করে সাজানো নির্বাচন দিয়ে বেসামরিক সরকারের গণপ্রতিনিধি হয়ে গেলেন। সাম্রাজ্যবাদের উৎসাহ বাড়তে বাড়তে তারা বাংলাদেশকে আরেক পাকিস্তান না পারলেও একটি 'ইসলামিক রাষ্ট্রে'র পর্যায়ে নিয়ে যেতে অগ্রসর হলো। তারপর আবার হত্যা, নতুন সামরিক শাসক, নতুন মন্ত্রিদল (আগের অনেকেই তাদের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন বলে আবার মন্ত্রী হলেন)। এই নতুন শাসকরা ১০/১২ বছর নিরবচ্ছিন্ন 'সাংস্কৃতিক' বিপ্লব (?) আনতে নির্দেশিত হয়েছিলেন। প্রায় প্রতিদিনই একটা করে নতুন পত্রিকা সরকারি টাকায় বের হতো ও এরশাদের মুণ্ডুপাত করত। তাতে এরশাদের পাবলিসিটি বা 'রাষ্ট্রপতি' ও 'প্রধানমন্ত্রী'র জনগণকে বাকস্বাধীনতা প্রদানে উজ্জ্বল ভাবমূর্তি সৃষ্টির সুযোগ হলো। এমনকি 'সাতঘাটের কানাকড়ি' নাটক (একজন পীরের অকাম- কুকামসহ) বেইলি রোডের মহিলা মঞ্চ দখল করাতেও বেসরকারি লেবাসের স্বৈরশাসক এতটুকু ঘাবড়াননি। সবচেয়ে বড় কথা, তাঁর মন্ত্রীরাই জনগণের অনুষ্ঠানে যেভাবে হোক, দেশ বা বিদেশে উপস্থিত হতেন। 'মন্ত্রী হাজির' ভালোভাবেই শুরু হয়ে গেল। এই শাসক দলের মধ্যে যে পাঁচমিশালি মতবাদপুষ্ট সমর্থক ছিল, তাদের অনায়াসে কয়েকটা ভাগে ভাগ করা যায়, তবে প্রধান সমর্থকরা সবাই আমেরিকার মদদপুষ্ট ও ভারতবিরোধী ছিল। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে চীন বিবৃতি (সিনুয়া নিউজে প্রকাশিত) দিয়েছিল, এই যুদ্ধে যেন বিদেশি শক্তি হস্তক্ষেপ না করে। তারা সেটা আমেরিকাকেও বলতে পারে অথবা ভারতকেও বলতে পারে। এ নিয়ে যে মতান্তর হলো, তাতে আমার মতো অনেকেই বিভ্রান্ত হয়ে স্বাধীনতাযুদ্ধে ভারতবিরোধী হয়ে উঠেছিল এবং পরে আমরা দেখলাম, দেশের চীনপন্থী কমিউনিস্টরাও এই কারণ দেখিয়ে বঙ্গবন্ধুকে ত্যাগ করে পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের পা-চাটা হয়ে উঠল। তখন আমাদের ভুল অনেকেই সংশোধন করেছিল; কিন্তু তত দিনে ক্ষতি যা হওয়ার তা স্বৈরাচারী শাসক ও তাঁর তাঁবেদারদের কর্মকাণ্ডে নিশ্চিত হয়ে গেছে। এর বহু পরে ফিরে এলো 'গণতন্ত্র'- আমি সেটাকে বলি 'অত্যন্ত কষ্ট করে আসা গণতন্ত্রের একটা ভৌতিক রূপ।'
এই সময়ের মধ্যে গণমাধ্যম আর আগের গ্রাম্য পরিস্থিতিতে ছিল না। টেলিভিশন, বিশেষত স্যাটেলাইট টেলিভিশন টাটকা খবর সরবরাহসহ ঘরে ঘরে পৌঁছে গেল। 'গণতন্ত্র' সেটাকে ব্যবহার করতে শুরু করল এই ভেবে যে জনসাধারণের কাছে যেতে হবে। শুরু হলো টক শো, আলোচনা, সমালোচনা, বাগ্যুদ্ধ ইত্যাদি। সাধারণ অনুষ্ঠানেও কথাবার্তা প্রচারিত হতো। এ অবস্থায় লক্ষণীয় একটা বিষয় হলো যে গণতন্ত্রের নামে মন্ত্রী-সংসদ সদস্য- সবাই গণমাধ্যমে নিজেদের প্রসারিত করার কম্পিটিশনে লেগে গেলেন। এখন ক্যামেরা ও মাইক সামনে পেলেই তাঁরা বক্তব্য দিতে শুরু করেন। সেই বক্তব্য তাঁদের পার্টির পক্ষে বটে; কিন্তু প্রায় সব কথাই লাগামহীন উল্টাপাল্টা ও যৌক্তিকতাহীন। তাতে পার্টির লাভের চেয়ে ক্ষতির আশঙ্কাই বেশি থাকে।
বিশ্বের গণতন্ত্রগুলোতে এ ধরনের বক্তব্য রাখে সরকারি বা বিরোধী দলের পূর্বনির্ধারিত 'স্পোকসম্যান' বা কথা জনসমক্ষে হাজির করার দায়িত্বপ্রাপ্ত উচ্চ কর্মকর্তারা। সেগুলো অত্যন্ত কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। আগে পার্টির অনুমোদন প্রয়োজন হয়ে পড়ে।
বাংলাদেশ এ বিষয়ে একেবারেই ব্যতিক্রম। এখানে সংসদ সদস্যদের 'বাকস্বাধীনতা'য় ও চলাফেরা আশ্চর্য রকম সহজ। তাঁরা টেলিভিশনের ক্যামেরা ও মাইক থাকা কোনো অনুষ্ঠানে ডাক পেলেই ছুটতে থাকেন এবং বক্তব্য রাখেন। আমি কয়েকজন টেলিভিশনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, 'এই বিশিষ্ট ব্যক্তিদের, অর্থাৎ মন্ত্রীদের কি আপনারা হাতে-পায়ে ধরে নিয়ে এসেছেন?' উত্তরের ভাষা এক না হলেও সবাই যা বলেছেন, তার মর্ম এ রূপ, 'আমরা রুটিন অনুযায়ী আমন্ত্রণ পাঠাই জনপ্রতিনিধিদের; কিন্তু তাঁদের উপস্থিতি তাঁরাই ঠিক করেন। আমরাই অবাক হই তাঁরা এত সময় পান কী করে? আবার কয়েকজনের কথা ভালোভাবে প্রচার না করলে কথা শুনতে হয়।'
দেশের কাজ হোক বা না হোক, মন্ত্রী যখন হয়েছেন, তখন জনগণের সামনে হাজির তো হতেই হবে!
লেখক : কথাশিল্পী ও সংস্কৃতিবিষয়ক গবেষক
আমি ব্যক্তিগতভাবে মন্ত্রীদের এই আসা বা আবির্ভাবের বিষয়টা বুঝতে পারতাম না। কারণ আমি যখন দেশ ছেড়েছিলাম ১৯৬৫ সালে প্রথম, তখন পাকিস্তানের সামরিক শাসনের মন্ত্রীরা জনসমক্ষে বা দিনের আলোর ছটায় বেশি বের হতেন না। তাঁরা লুকিয়ে লুকিয়ে যে শাসক তাঁকে অগণতান্ত্রিক মন্ত্রী বানিয়ে দিয়েছেন তাঁর পদলেহন করতেন। 'পাবলিকে'র কাছে এলেই তাঁদের বিপদ, হয় বিক্ষোভ নয় ইটপাটকেলের আশঙ্কা বেশি ছিল বলে।
১৯৬৯ সালে দেশে ফিরলেও মন্ত্রীটন্ত্রী নজরে আসত না। সে সময় গণমাধ্যম বলতে আমরা দৈনিক পত্রিকাই বুঝতাম, 'সচিত্র সন্ধানী' বিনোদন-কাম-সাহিত্য পত্রিকা ছিল, সিকান্দার আবু জাফরের 'সমকাল' বোধ হয় শেষ পর্যায়ে, আমার অগ্রজ ফজলুল হকের 'সিনেমা'রও একই অবস্থা। তবে রমরমা দৈনিক গণমাধ্যম হিসেবে ব্যবসা করত 'দৈনিক ইত্তেফাক'। সেটার সম্পাদকের স্থান গণমাধ্যম ও জনমনে এতই ঊর্ধ্বে ছিল যে একটা নতুন নাপিতের দোকানের উদ্বোধন করার জন্য তাঁকে আনতে পারলেই পরদিন দৈনিক ইত্তেফাকের প্রথম পৃষ্ঠায় খবরটি স্থান পাবেই বলে ধারণা করা হতো। তাতেই দোকানটি সফলভাবে শুরু হতো।
তারপর বাংলাদেশ স্বাধীন হলো, প্রধানমন্ত্রী ও অন্য মন্ত্রীরা গণরায়ে নির্বাচিত হয়ে জনসমক্ষে সমানে হাজির হতেন। সমস্যার অন্ত ছিল না, কিন্তু তাঁরা বীরদর্পে জানের বা অ-জ্ঞানের তোয়াক্কা না করেই চলাফেরা করতেন। বঙ্গবন্ধু তো তাঁর ঝরঝরা গাড়িতেই ভয়ডরহীনভাবে রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তব্য সম্পাদন করতেন।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর এলো সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের প্রত্যক্ষ সমর্থকরা। বঙ্গবন্ধু, মন্ত্রিপরিষদ, গণতন্ত্র, নতুন রাষ্ট্রীয় দর্শন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা- সব বিলুপ্ত হয়ে দেশ অন্য বলয়ে চলে গেল। তখন মন্ত্রীরা গণপ্রতিনিধি না হয়ে নতুন সামরিক, পরবর্তী সময়ে দল তৈরি করে সাজানো নির্বাচন দিয়ে বেসামরিক সরকারের গণপ্রতিনিধি হয়ে গেলেন। সাম্রাজ্যবাদের উৎসাহ বাড়তে বাড়তে তারা বাংলাদেশকে আরেক পাকিস্তান না পারলেও একটি 'ইসলামিক রাষ্ট্রে'র পর্যায়ে নিয়ে যেতে অগ্রসর হলো। তারপর আবার হত্যা, নতুন সামরিক শাসক, নতুন মন্ত্রিদল (আগের অনেকেই তাদের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন বলে আবার মন্ত্রী হলেন)। এই নতুন শাসকরা ১০/১২ বছর নিরবচ্ছিন্ন 'সাংস্কৃতিক' বিপ্লব (?) আনতে নির্দেশিত হয়েছিলেন। প্রায় প্রতিদিনই একটা করে নতুন পত্রিকা সরকারি টাকায় বের হতো ও এরশাদের মুণ্ডুপাত করত। তাতে এরশাদের পাবলিসিটি বা 'রাষ্ট্রপতি' ও 'প্রধানমন্ত্রী'র জনগণকে বাকস্বাধীনতা প্রদানে উজ্জ্বল ভাবমূর্তি সৃষ্টির সুযোগ হলো। এমনকি 'সাতঘাটের কানাকড়ি' নাটক (একজন পীরের অকাম- কুকামসহ) বেইলি রোডের মহিলা মঞ্চ দখল করাতেও বেসরকারি লেবাসের স্বৈরশাসক এতটুকু ঘাবড়াননি। সবচেয়ে বড় কথা, তাঁর মন্ত্রীরাই জনগণের অনুষ্ঠানে যেভাবে হোক, দেশ বা বিদেশে উপস্থিত হতেন। 'মন্ত্রী হাজির' ভালোভাবেই শুরু হয়ে গেল। এই শাসক দলের মধ্যে যে পাঁচমিশালি মতবাদপুষ্ট সমর্থক ছিল, তাদের অনায়াসে কয়েকটা ভাগে ভাগ করা যায়, তবে প্রধান সমর্থকরা সবাই আমেরিকার মদদপুষ্ট ও ভারতবিরোধী ছিল। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে চীন বিবৃতি (সিনুয়া নিউজে প্রকাশিত) দিয়েছিল, এই যুদ্ধে যেন বিদেশি শক্তি হস্তক্ষেপ না করে। তারা সেটা আমেরিকাকেও বলতে পারে অথবা ভারতকেও বলতে পারে। এ নিয়ে যে মতান্তর হলো, তাতে আমার মতো অনেকেই বিভ্রান্ত হয়ে স্বাধীনতাযুদ্ধে ভারতবিরোধী হয়ে উঠেছিল এবং পরে আমরা দেখলাম, দেশের চীনপন্থী কমিউনিস্টরাও এই কারণ দেখিয়ে বঙ্গবন্ধুকে ত্যাগ করে পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের পা-চাটা হয়ে উঠল। তখন আমাদের ভুল অনেকেই সংশোধন করেছিল; কিন্তু তত দিনে ক্ষতি যা হওয়ার তা স্বৈরাচারী শাসক ও তাঁর তাঁবেদারদের কর্মকাণ্ডে নিশ্চিত হয়ে গেছে। এর বহু পরে ফিরে এলো 'গণতন্ত্র'- আমি সেটাকে বলি 'অত্যন্ত কষ্ট করে আসা গণতন্ত্রের একটা ভৌতিক রূপ।'
এই সময়ের মধ্যে গণমাধ্যম আর আগের গ্রাম্য পরিস্থিতিতে ছিল না। টেলিভিশন, বিশেষত স্যাটেলাইট টেলিভিশন টাটকা খবর সরবরাহসহ ঘরে ঘরে পৌঁছে গেল। 'গণতন্ত্র' সেটাকে ব্যবহার করতে শুরু করল এই ভেবে যে জনসাধারণের কাছে যেতে হবে। শুরু হলো টক শো, আলোচনা, সমালোচনা, বাগ্যুদ্ধ ইত্যাদি। সাধারণ অনুষ্ঠানেও কথাবার্তা প্রচারিত হতো। এ অবস্থায় লক্ষণীয় একটা বিষয় হলো যে গণতন্ত্রের নামে মন্ত্রী-সংসদ সদস্য- সবাই গণমাধ্যমে নিজেদের প্রসারিত করার কম্পিটিশনে লেগে গেলেন। এখন ক্যামেরা ও মাইক সামনে পেলেই তাঁরা বক্তব্য দিতে শুরু করেন। সেই বক্তব্য তাঁদের পার্টির পক্ষে বটে; কিন্তু প্রায় সব কথাই লাগামহীন উল্টাপাল্টা ও যৌক্তিকতাহীন। তাতে পার্টির লাভের চেয়ে ক্ষতির আশঙ্কাই বেশি থাকে।
বিশ্বের গণতন্ত্রগুলোতে এ ধরনের বক্তব্য রাখে সরকারি বা বিরোধী দলের পূর্বনির্ধারিত 'স্পোকসম্যান' বা কথা জনসমক্ষে হাজির করার দায়িত্বপ্রাপ্ত উচ্চ কর্মকর্তারা। সেগুলো অত্যন্ত কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। আগে পার্টির অনুমোদন প্রয়োজন হয়ে পড়ে।
বাংলাদেশ এ বিষয়ে একেবারেই ব্যতিক্রম। এখানে সংসদ সদস্যদের 'বাকস্বাধীনতা'য় ও চলাফেরা আশ্চর্য রকম সহজ। তাঁরা টেলিভিশনের ক্যামেরা ও মাইক থাকা কোনো অনুষ্ঠানে ডাক পেলেই ছুটতে থাকেন এবং বক্তব্য রাখেন। আমি কয়েকজন টেলিভিশনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, 'এই বিশিষ্ট ব্যক্তিদের, অর্থাৎ মন্ত্রীদের কি আপনারা হাতে-পায়ে ধরে নিয়ে এসেছেন?' উত্তরের ভাষা এক না হলেও সবাই যা বলেছেন, তার মর্ম এ রূপ, 'আমরা রুটিন অনুযায়ী আমন্ত্রণ পাঠাই জনপ্রতিনিধিদের; কিন্তু তাঁদের উপস্থিতি তাঁরাই ঠিক করেন। আমরাই অবাক হই তাঁরা এত সময় পান কী করে? আবার কয়েকজনের কথা ভালোভাবে প্রচার না করলে কথা শুনতে হয়।'
দেশের কাজ হোক বা না হোক, মন্ত্রী যখন হয়েছেন, তখন জনগণের সামনে হাজির তো হতেই হবে!
লেখক : কথাশিল্পী ও সংস্কৃতিবিষয়ক গবেষক
No comments