কৃষিজমির পরিমাণ হ্রাস ও খাদ্যনিরাপত্তা by এ এম এম শওকত আলী
জুনের ২৩ তারিখে একটি ইংরেজি দৈনিকে কৃষিজমির পরিমাণ দ্রুত হ্রাসের বিষয়ে খাদ্যনিরাপত্তার বিষয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। জমির ব্যবহার সম্পর্কিত বিষয়েও একই দৈনিকে সম্পাদকীয় মন্তব্য প্রকাশ করা হয়েছে। মূলত নব্বইয়ের দশকের শেষার্ধে এ বিষয়ে প্রথম আলোকপাত করা হয়।
তৎকালীন সরকার ২০০০ সালে ভূমি ব্যবহারনীতি প্রণয়ন করেছিল। এ নীতির প্রধান উদ্দেশ্য ছিল কৃষিজমির সুরক্ষা। এ লক্ষ্যে নীতিতে কিছু দিকনির্দেশনাও দেওয়া হয়েছিল, যার আলোকে আইন প্রণয়নের মাধ্যমে এ লক্ষ্য অর্জনের প্রস্তাব করা হয়। প্রণীতব্য আইনের বলে কৃষিজমি অকৃষি খাতে ব্যবহার করলে তা বে-আইনি ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ হবে। ২০০১ সালে ক্ষমতাসীন সরকারের পরিবর্তনের পর গৃহীত নীতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে যথাযোগ্য আইন প্রণয়ন করারও চিন্তাভাবনা ছিল। অর্থের প্রয়োজন ছিল।
অর্থ জোগান দেওয়ার জন্য কিছু বিদেশি উন্নয়ন সহযোগীর প্রাথমিক আলাপ-আলোচনাও শুরু হয়। ওই সময় একটি বহুজাতিক উন্নয়ন সহযোগী এ সাহায্য দিতে রাজি হয়নি। উন্নয়ন সহযোগীদের একটি অদ্ভুত কালচার রয়েছে। কোনো প্রস্তাবে একজন রাজি না হলে অন্যরাও পিছপা হয়। সাহায্য প্রদানে অস্বীকৃতির কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান কর্তৃক যে যুক্তির অবতারণা করা হয়, তা ছিল একটি খোঁড়া যুক্তি। ভূমি ব্যবহার-নীতি প্রণয়ন-প্রক্রিয়ায় বেসরকারি সংস্থার মতামত গ্রহণ করা হয়নি। যদি তা-ই হয় কারণ, তাহলে সে প্রক্রিয়ায় নতুন করে অর্থ সাহায্য দিতে বাধা কোথায়। এ ধরনের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার কারণে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি অবহেলিত হয়, যা হওয়ার কথা নয়। বহুজাতিক সদস্য সংবলিত এ প্রতিষ্ঠানে অর্থের উৎস ওইসব সদস্য দেশের জনমানুষের আয়কর। অবদানটি তাঁদের। প্রতিষ্ঠানের নয়।
২০০৯ সালে বর্তমান সরকার এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি বাস্তবায়নের জন্য আবার উদ্যোগ গ্রহণ করে। মাধ্যমটা ছিল উপকূলীয় অঞ্চল (Zone) ব্যবস্থাপনা প্রকল্প। ভূমি মন্ত্রণালয় নিজস্ব উদ্যোগে ২০০৯-১০ সালে প্রণীতব্য আইনের প্রাথমিক খসড়া প্রণয়ন করে। এর মধ্যে ১০ বছর পার হয়ে গেছে। কিন্তু তবুও উন্নয়ন সহযোগীদের সুবুদ্ধির কোনো লক্ষণ নেই। অর্থাৎ তাঁরা বাস্তবতাকেই অস্বীকার করছে। মূলত নব্বইয়ের দশকের শেষার্ধ থেকেই সময় সময় কৃষিবিশেষজ্ঞরা কৃষিজমির দ্রুত কমে যাওয়ার বিষয়টি বলেছেন। বিভিন্ন সেমিনার ও ওয়ার্কশপে এক দশক পর কিছু উন্নয়ন সহযোগী এ বিষয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছেন বলে জানা যায়। তবে তারা বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে এর জন্য অর্থ জোগান দেওয়ায় উৎসাহী। এর ফলে একটি পর্যালোচনা হবে। সময় তিন থেকে সাড়ে তিন বছর। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে পরবর্তী বিনিয়োগের জন্য ২০১৫-১৬ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এ ধরনের দীর্ঘসূত্রতার কি প্রয়োজন আছে?
কারণ ভূমি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে একটি খসড়া প্রণীত হয়েছে। খসড়াটি এক বছর আগে ভূমিমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় কিছু রদবদলও করা হয়েছে। কিন্তু তারপর কী হয়েছে তা জানা নেই। এ আইনের খসড়া যথাযোগ্য প্রক্রিয়ায় অনুমোদিত হলে কাজ শুরু করা সম্ভব হবে। কিন্তু আইনের বাস্তবায়নে কিছু চ্যালেঞ্জও অস্বীকার করা যায় না। ভূমি আইন বাস্তবায়নের অতীত ইতিহাস এ সাক্ষ্য দেয়। মূল চ্যালেঞ্জ হলো কৃষি ও অকৃষিজমির অঞ্চলভিত্তিক বিন্যাস। এ কাজটি করার জন্য উন্নতমানের ভূমি জরিপের প্রয়োজন। সময়েরও প্রয়োজন। কৃষিজমির সুরক্ষার মূল উদ্দেশ্য হলো, দেশজ উৎপাদনের মাধ্যমে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা। তবে একই সঙ্গে কৃষিবহির্ভূত খাতের জন্যও জমির প্রয়োজন। বর্তমানে দ্রুত পরিকল্পিত নগরায়ণের জন্যও এ বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি। গত কয়েক বছরে অপরিকল্পিত নগরায়ণের ধারা এখনো সামাল দেওয়া সম্ভব হয়নি। পরিকল্পিত নগরায়ণের জন্যও ভূমির প্রকারভেদে অঞ্চলভিত্তিক বিন্যাস চিহ্নিত করে এর বহুবিধ ও উপযুক্ত ব্যবহারের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হলেও জটিলতায় আবদ্ধ। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা ও কাজের খোঁজে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর শহরে বসবাসের বিষয়টি বাস্তব সত্য ও দৃশ্যমান। এ প্রবণতার জোয়ার রোধ করা সম্ভব নয়। অতীতে কিছু সরকারি উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও তা খুব একটা ফলপ্রসূ হয়নি। রাস্তাঘাটসহ শহরে অন্যান্য অবকাঠামোরও প্রয়োজন। এর মধ্যে বাসস্থানের বিষয়টি প্রধান। কিন্তু এর সঙ্গে সহায়ক কিছু সেবার সংস্থানও জরুরি। যেমন- নিরাপদ পানিসহ পয়ঃনিষ্কাশনব্যবস্থা ইত্যাদি। বিশেষজ্ঞদের মতে, আগামী দুই বা তিন দশকের মধ্যে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৫০ শতাংশ শহরে বাস করবে। প্রয়োজন হবে আরো অধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ চিকিৎসার সুবিধা। যদি নগরায়ণ অপ্রতিরোধ্য হয়, তাহলে আরো অধিক হারে কৃষিজমি হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনাই হবে বাস্তবতা।
বাংলাদেশের ভূমি সংস্কারের সরকারি উদ্যোগ পর্যালোচনা করে এ বিষয়ে কিছু শিক্ষণীয় বিষয় পাওয়া যায়। জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলেও এর ফল প্রকৃত কৃষকরা পায়নি। ১৯৫০ সালে প্রণীত আইনে ভূমির সর্বোচ্চ মালিকানার সীমা নির্ধারিত হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল মহৎ। সীমাবহির্ভূত জমি সরকারি মালিকানায় নিয়ে ভূমিহীনদের পুনর্বাসন। বাস্তবে এ উদ্দেশ্য অর্জন করা যায়নি। কারণ বহুবিধ। বর্তমান নগরায়ণের একটি বৈশিষ্ট্য হলো, উচ্চ থেকে উচ্চতর ইমারত বাসস্থানসহ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্যবহার করা। এর ফলে নগরের জমির সর্বোচ্চ মালিকানা পুনর্নির্ধারণের প্রয়োজন অনুভূত হয়নি।
কৃষিজমির ব্যবহারভিত্তিক বিন্যাসের সমস্যা রয়েছে। বৃহৎ সংজ্ঞায় কৃষি শুধু ফসলি জমি নয়। প্রাণিসম্পদসহ মৎস্য চাষের জন্যও এর প্রয়োজন হয়। দেশে প্রায় এক লাখ মুরগির খামার রয়েছে। আধুনিক প্রক্রিয়ায় মৎস্য চাষ (Aquaculture) অল্প পরিমাণ জমিতে করা হয়। এ ব্যবহারও তো কৃষিভিত্তিক ব্যবহার। কিছু কৃষি বিশেষজ্ঞের মতে, বৃহৎ কৃষি সংজ্ঞার আওতাভুক্ত ব্যবহারও খাদ্যনিরাপত্তার জন্য সহায়ক উৎস। বিদ্যমান ভূমি মালিকানা আইনে কৃষিভিত্তিক বৃহৎ প্রতিষ্ঠান ও সমবায় সমিতির ভূমি মালিকানা সীমার ওপর কোনো বাধানিষেধ নেই। দেশে এখন কৃষিভিত্তিক ব্যবসা যেমন- ফসল প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের প্রসার হয়েছে। জানা যায়, অনেক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান বর্তমানে বৃহৎ এলাকাসম্পন্ন কৃষিজমি ক্রয় করেছে। এটাকে কি কৃষিজমির হ্রাস হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে? অতীতে ব্যক্তিগত মালিকানার ঊর্ধ্বসীমার আইনি বিধান সত্ত্বেও তা অনেকাংশে ফলপ্রসূ হয়নি। এর কারণ হিসেবে বলা হয়, ভূমি মালিকানা-সংক্রান্ত সরকারি কাগজপত্রের দুর্বলতাসহ ভূমি নিবন্ধনকরণ আইনেরও জটিলতা। বিকল্প হিসেবে বর্তমানে ভূমি মালিকানার দলিল ডিজিটাল পদ্ধতির আওতায় আনার প্রক্রিয়া পরীক্ষামূলক শুরু হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাস্তব চ্যালেঞ্জ হলো, এর জন্য অধিক সময়ের প্রয়োজন। এ ছাড়া এ দেশে নদীভাঙনের কারণে অনেক কৃষিজমি নদীগর্ভে বিলীন হয়। ডিজিটাল পদ্ধতিতে প্রণীত জমির মালিকানা যে বছর হবে, পরের বছর তা খুঁজে পাওয়া যাবে না।
জানা গেছে, খসড়া কৃষিজমি বিন্যাস-সংক্রান্ত আইনে দুই ফসলি ও তিন ফসলি জমির অধিগ্রহণ বা বিক্রয় অকৃষি খাতের জন্য ব্যবহার করা যাবে না। এ ধরনের জমি সেচাবাদের আওতাভুক্ত। সেসব স্থানে যদি ভূ-পরিস্থ পানি ব্যবহার হয়, তাহলেও আশঙ্কা। কারণ প্রায় সব নদী ও খাল-বিলই শুকিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে দুই ফসলি জমি এক ফসলি হয়ে যাবে। অন্যদিকে নদী ও খাল-বিলের জমি প্রভাবশালী ভূমিদস্যুরা ছলে-বলে-কৌশলে নিজস্ব মালিকানায় নিয়ে আসে। এর একটি ছবি সংশ্লিষ্ট দৈনিকেও ছাপা হয়েছে। এ ছবিতে সিরাজদিখান উপজেলা, যা আড়িয়ল বিলের অংশ, সেসব স্থানে বেসরকারি আবাসন প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড দৃশ্যমান। বলা বাহুল্য, এসব জমি বর্ষাকালে জলমগ্ন থাকে। মাছ ধরা এ অঞ্চলের বাসিন্দাদের জীবিকার উৎস। শীতকালে বোরো ধান চাষ হয়। বিদ্যমান আইন অনুযায়ী এসব জমি রাষ্ট্রের। টঙ্গী-কালীগঞ্জ মহাসড়কের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগস্থল হলো ঘোড়াশাল। এ মহাসড়কে গেলে একই দৃশ্য দেখা যাবে। হাইকোর্টের নির্দেশসহ সরকারের নিজস্ব চেষ্টা সত্ত্বেও রাজধানীর চারপাশের নদী তীরবর্তী জমির বৃহৎ অংশ বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান দখল করেছে। নদী তীরবর্তী জমির ব্যাপারে রাষ্ট্র তিন বছর চেষ্টা করেও এখন পর্যন্ত এসব এলাকার সীমানা চিহ্নিত করার কাজ শেষ করতে পারেনি।
কৃষিজমিসহ নদী তীরবর্তী রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন জমির সুষম ও পরিবেশ উপযোগী ব্যবহার নিশ্চিত করার বিষয়টি অত্যন্ত জটিল। তবে এ চেষ্টা বিরামহীন চালানো প্রয়োজন। সরকারি-বেসরকারি ভূমি বিশেষজ্ঞরা একসঙ্গে মিলিত হয়ে এর স্থায়ী সমাধান করতে পারবেন। এটাই সবার প্রত্যাশা। আইন প্রণীত হওয়ার পরও এর সঠিক বাস্তবায়ন করা উচিত হবে। এর জন্য প্রয়োজন ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ হয়ে যারা এ কাজ করবে তাদের দক্ষতা এবং সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি। এই দুটি বিষয়েরই বড় অভাব। যারা কাজ করবে, তাদের নিরপেক্ষ হওয়ার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। এ দায়িত্ব ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের। এ দায়িত্ব পালনে শিথিলতা হলে রাষ্ট্রীয় কাজে নিয়োজিত দক্ষ কর্মীরাও ব্যর্থ হবে। সম্পূর্ণ বিষয়টি বহুবিধ।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা
অর্থ জোগান দেওয়ার জন্য কিছু বিদেশি উন্নয়ন সহযোগীর প্রাথমিক আলাপ-আলোচনাও শুরু হয়। ওই সময় একটি বহুজাতিক উন্নয়ন সহযোগী এ সাহায্য দিতে রাজি হয়নি। উন্নয়ন সহযোগীদের একটি অদ্ভুত কালচার রয়েছে। কোনো প্রস্তাবে একজন রাজি না হলে অন্যরাও পিছপা হয়। সাহায্য প্রদানে অস্বীকৃতির কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান কর্তৃক যে যুক্তির অবতারণা করা হয়, তা ছিল একটি খোঁড়া যুক্তি। ভূমি ব্যবহার-নীতি প্রণয়ন-প্রক্রিয়ায় বেসরকারি সংস্থার মতামত গ্রহণ করা হয়নি। যদি তা-ই হয় কারণ, তাহলে সে প্রক্রিয়ায় নতুন করে অর্থ সাহায্য দিতে বাধা কোথায়। এ ধরনের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার কারণে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি অবহেলিত হয়, যা হওয়ার কথা নয়। বহুজাতিক সদস্য সংবলিত এ প্রতিষ্ঠানে অর্থের উৎস ওইসব সদস্য দেশের জনমানুষের আয়কর। অবদানটি তাঁদের। প্রতিষ্ঠানের নয়।
২০০৯ সালে বর্তমান সরকার এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি বাস্তবায়নের জন্য আবার উদ্যোগ গ্রহণ করে। মাধ্যমটা ছিল উপকূলীয় অঞ্চল (Zone) ব্যবস্থাপনা প্রকল্প। ভূমি মন্ত্রণালয় নিজস্ব উদ্যোগে ২০০৯-১০ সালে প্রণীতব্য আইনের প্রাথমিক খসড়া প্রণয়ন করে। এর মধ্যে ১০ বছর পার হয়ে গেছে। কিন্তু তবুও উন্নয়ন সহযোগীদের সুবুদ্ধির কোনো লক্ষণ নেই। অর্থাৎ তাঁরা বাস্তবতাকেই অস্বীকার করছে। মূলত নব্বইয়ের দশকের শেষার্ধ থেকেই সময় সময় কৃষিবিশেষজ্ঞরা কৃষিজমির দ্রুত কমে যাওয়ার বিষয়টি বলেছেন। বিভিন্ন সেমিনার ও ওয়ার্কশপে এক দশক পর কিছু উন্নয়ন সহযোগী এ বিষয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছেন বলে জানা যায়। তবে তারা বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে এর জন্য অর্থ জোগান দেওয়ায় উৎসাহী। এর ফলে একটি পর্যালোচনা হবে। সময় তিন থেকে সাড়ে তিন বছর। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে পরবর্তী বিনিয়োগের জন্য ২০১৫-১৬ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এ ধরনের দীর্ঘসূত্রতার কি প্রয়োজন আছে?
কারণ ভূমি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে একটি খসড়া প্রণীত হয়েছে। খসড়াটি এক বছর আগে ভূমিমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় কিছু রদবদলও করা হয়েছে। কিন্তু তারপর কী হয়েছে তা জানা নেই। এ আইনের খসড়া যথাযোগ্য প্রক্রিয়ায় অনুমোদিত হলে কাজ শুরু করা সম্ভব হবে। কিন্তু আইনের বাস্তবায়নে কিছু চ্যালেঞ্জও অস্বীকার করা যায় না। ভূমি আইন বাস্তবায়নের অতীত ইতিহাস এ সাক্ষ্য দেয়। মূল চ্যালেঞ্জ হলো কৃষি ও অকৃষিজমির অঞ্চলভিত্তিক বিন্যাস। এ কাজটি করার জন্য উন্নতমানের ভূমি জরিপের প্রয়োজন। সময়েরও প্রয়োজন। কৃষিজমির সুরক্ষার মূল উদ্দেশ্য হলো, দেশজ উৎপাদনের মাধ্যমে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা। তবে একই সঙ্গে কৃষিবহির্ভূত খাতের জন্যও জমির প্রয়োজন। বর্তমানে দ্রুত পরিকল্পিত নগরায়ণের জন্যও এ বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি। গত কয়েক বছরে অপরিকল্পিত নগরায়ণের ধারা এখনো সামাল দেওয়া সম্ভব হয়নি। পরিকল্পিত নগরায়ণের জন্যও ভূমির প্রকারভেদে অঞ্চলভিত্তিক বিন্যাস চিহ্নিত করে এর বহুবিধ ও উপযুক্ত ব্যবহারের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হলেও জটিলতায় আবদ্ধ। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা ও কাজের খোঁজে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর শহরে বসবাসের বিষয়টি বাস্তব সত্য ও দৃশ্যমান। এ প্রবণতার জোয়ার রোধ করা সম্ভব নয়। অতীতে কিছু সরকারি উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও তা খুব একটা ফলপ্রসূ হয়নি। রাস্তাঘাটসহ শহরে অন্যান্য অবকাঠামোরও প্রয়োজন। এর মধ্যে বাসস্থানের বিষয়টি প্রধান। কিন্তু এর সঙ্গে সহায়ক কিছু সেবার সংস্থানও জরুরি। যেমন- নিরাপদ পানিসহ পয়ঃনিষ্কাশনব্যবস্থা ইত্যাদি। বিশেষজ্ঞদের মতে, আগামী দুই বা তিন দশকের মধ্যে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৫০ শতাংশ শহরে বাস করবে। প্রয়োজন হবে আরো অধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ চিকিৎসার সুবিধা। যদি নগরায়ণ অপ্রতিরোধ্য হয়, তাহলে আরো অধিক হারে কৃষিজমি হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনাই হবে বাস্তবতা।
বাংলাদেশের ভূমি সংস্কারের সরকারি উদ্যোগ পর্যালোচনা করে এ বিষয়ে কিছু শিক্ষণীয় বিষয় পাওয়া যায়। জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলেও এর ফল প্রকৃত কৃষকরা পায়নি। ১৯৫০ সালে প্রণীত আইনে ভূমির সর্বোচ্চ মালিকানার সীমা নির্ধারিত হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল মহৎ। সীমাবহির্ভূত জমি সরকারি মালিকানায় নিয়ে ভূমিহীনদের পুনর্বাসন। বাস্তবে এ উদ্দেশ্য অর্জন করা যায়নি। কারণ বহুবিধ। বর্তমান নগরায়ণের একটি বৈশিষ্ট্য হলো, উচ্চ থেকে উচ্চতর ইমারত বাসস্থানসহ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্যবহার করা। এর ফলে নগরের জমির সর্বোচ্চ মালিকানা পুনর্নির্ধারণের প্রয়োজন অনুভূত হয়নি।
কৃষিজমির ব্যবহারভিত্তিক বিন্যাসের সমস্যা রয়েছে। বৃহৎ সংজ্ঞায় কৃষি শুধু ফসলি জমি নয়। প্রাণিসম্পদসহ মৎস্য চাষের জন্যও এর প্রয়োজন হয়। দেশে প্রায় এক লাখ মুরগির খামার রয়েছে। আধুনিক প্রক্রিয়ায় মৎস্য চাষ (Aquaculture) অল্প পরিমাণ জমিতে করা হয়। এ ব্যবহারও তো কৃষিভিত্তিক ব্যবহার। কিছু কৃষি বিশেষজ্ঞের মতে, বৃহৎ কৃষি সংজ্ঞার আওতাভুক্ত ব্যবহারও খাদ্যনিরাপত্তার জন্য সহায়ক উৎস। বিদ্যমান ভূমি মালিকানা আইনে কৃষিভিত্তিক বৃহৎ প্রতিষ্ঠান ও সমবায় সমিতির ভূমি মালিকানা সীমার ওপর কোনো বাধানিষেধ নেই। দেশে এখন কৃষিভিত্তিক ব্যবসা যেমন- ফসল প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের প্রসার হয়েছে। জানা যায়, অনেক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান বর্তমানে বৃহৎ এলাকাসম্পন্ন কৃষিজমি ক্রয় করেছে। এটাকে কি কৃষিজমির হ্রাস হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে? অতীতে ব্যক্তিগত মালিকানার ঊর্ধ্বসীমার আইনি বিধান সত্ত্বেও তা অনেকাংশে ফলপ্রসূ হয়নি। এর কারণ হিসেবে বলা হয়, ভূমি মালিকানা-সংক্রান্ত সরকারি কাগজপত্রের দুর্বলতাসহ ভূমি নিবন্ধনকরণ আইনেরও জটিলতা। বিকল্প হিসেবে বর্তমানে ভূমি মালিকানার দলিল ডিজিটাল পদ্ধতির আওতায় আনার প্রক্রিয়া পরীক্ষামূলক শুরু হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাস্তব চ্যালেঞ্জ হলো, এর জন্য অধিক সময়ের প্রয়োজন। এ ছাড়া এ দেশে নদীভাঙনের কারণে অনেক কৃষিজমি নদীগর্ভে বিলীন হয়। ডিজিটাল পদ্ধতিতে প্রণীত জমির মালিকানা যে বছর হবে, পরের বছর তা খুঁজে পাওয়া যাবে না।
জানা গেছে, খসড়া কৃষিজমি বিন্যাস-সংক্রান্ত আইনে দুই ফসলি ও তিন ফসলি জমির অধিগ্রহণ বা বিক্রয় অকৃষি খাতের জন্য ব্যবহার করা যাবে না। এ ধরনের জমি সেচাবাদের আওতাভুক্ত। সেসব স্থানে যদি ভূ-পরিস্থ পানি ব্যবহার হয়, তাহলেও আশঙ্কা। কারণ প্রায় সব নদী ও খাল-বিলই শুকিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে দুই ফসলি জমি এক ফসলি হয়ে যাবে। অন্যদিকে নদী ও খাল-বিলের জমি প্রভাবশালী ভূমিদস্যুরা ছলে-বলে-কৌশলে নিজস্ব মালিকানায় নিয়ে আসে। এর একটি ছবি সংশ্লিষ্ট দৈনিকেও ছাপা হয়েছে। এ ছবিতে সিরাজদিখান উপজেলা, যা আড়িয়ল বিলের অংশ, সেসব স্থানে বেসরকারি আবাসন প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড দৃশ্যমান। বলা বাহুল্য, এসব জমি বর্ষাকালে জলমগ্ন থাকে। মাছ ধরা এ অঞ্চলের বাসিন্দাদের জীবিকার উৎস। শীতকালে বোরো ধান চাষ হয়। বিদ্যমান আইন অনুযায়ী এসব জমি রাষ্ট্রের। টঙ্গী-কালীগঞ্জ মহাসড়কের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগস্থল হলো ঘোড়াশাল। এ মহাসড়কে গেলে একই দৃশ্য দেখা যাবে। হাইকোর্টের নির্দেশসহ সরকারের নিজস্ব চেষ্টা সত্ত্বেও রাজধানীর চারপাশের নদী তীরবর্তী জমির বৃহৎ অংশ বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান দখল করেছে। নদী তীরবর্তী জমির ব্যাপারে রাষ্ট্র তিন বছর চেষ্টা করেও এখন পর্যন্ত এসব এলাকার সীমানা চিহ্নিত করার কাজ শেষ করতে পারেনি।
কৃষিজমিসহ নদী তীরবর্তী রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন জমির সুষম ও পরিবেশ উপযোগী ব্যবহার নিশ্চিত করার বিষয়টি অত্যন্ত জটিল। তবে এ চেষ্টা বিরামহীন চালানো প্রয়োজন। সরকারি-বেসরকারি ভূমি বিশেষজ্ঞরা একসঙ্গে মিলিত হয়ে এর স্থায়ী সমাধান করতে পারবেন। এটাই সবার প্রত্যাশা। আইন প্রণীত হওয়ার পরও এর সঠিক বাস্তবায়ন করা উচিত হবে। এর জন্য প্রয়োজন ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ হয়ে যারা এ কাজ করবে তাদের দক্ষতা এবং সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি। এই দুটি বিষয়েরই বড় অভাব। যারা কাজ করবে, তাদের নিরপেক্ষ হওয়ার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। এ দায়িত্ব ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের। এ দায়িত্ব পালনে শিথিলতা হলে রাষ্ট্রীয় কাজে নিয়োজিত দক্ষ কর্মীরাও ব্যর্থ হবে। সম্পূর্ণ বিষয়টি বহুবিধ।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা
No comments