সমকালীন প্রসঙ্গ-যুক্তরাষ্ট্রের বার্তার মর্মার্থ by তারেক শামসুর রেহমান
সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক উন্নত হলেও তাতে নানা জটিলতা তৈরি হয়েছে। হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফরের পর বাংলাদেশ সম্পর্কে নতুন চিন্তা-চেতনার জন্ম হয়েছে মার্কিন নীতিনির্ধারকদের কাছে। ক্লিনটনের সফরের সময় একটি 'অংশীদারি সংলাপ' চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, যার বিস্তারিত আমরা কিছুই জানি ন
ড্যান মজিনা ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত। গত ১০ জুলাই প্রেস ক্লাবের 'মিট দ্য প্রেস' অনুষ্ঠানে একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। আমার বিবেচনায় ওই মন্তব্যের একটি নেতিবাচক দিক আছে। তিনি বলেছিলেন, 'এ দেশের পণ্য কিনতে মার্কিন ক্রেতারা ঝুঁকি না-ও নিতে পারেন।' এই বক্তব্যটি আসলে এমন একটি সময়ে যখন পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন বন্ধ করে দিয়েছে। বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগ এনেছে। সরকার এখন চেষ্টা করছে এডিবি, আইডিবি কিংবা জাইকা থেকে এই ফান্ড জোগাড় করতে। কিন্তু কাজটি খুব সহজ হবে বলে মনে হয় না। বিশ্বব্যাংক ঋণচুক্তি বাতিলের কারণে অন্য দাতা সংস্থাগুলো আগ্রহী হবে বলেও মনে হয় না। সরকার এরই মাঝে আবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, বিশ্বব্যাংকের কাছে আর ধরনা তারা দেবে না। গত ৯ জুলাই মন্ত্রিসভায় একটি সিদ্ধান্তও হয়েছে যে পদ্মা সেতু সরকার নিজেই করবে।
সরকার যদি নিজেই পদ্মা সেতু নির্মাণ করে, এর প্রতিক্রিয়া, ৩৫ প্রজেক্টে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নের ভবিষ্যৎ ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে বিতর্ক আছে। কিন্তু আমি গুরুত্ব দিতে চাই ড্যান মজিনার বক্তব্যটিতে। যেখানে তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রে অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশি পণ্য বিক্রি বন্ধ হয়ে যেতে পারে(?)। এই বক্তব্যটি যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বক্তব্য নয়। এটি রাষ্ট্রদূত মজিনার উপলব্ধি। তিনি দু'সপ্তাহ যুক্তরাষ্ট্রে থেকে সম্প্রতি ঢাকায় ফিরে এসেছেন। তিনি জানিয়েছেন, এই দু'সপ্তাহে তিনি মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর, পেন্টাগন, মার্কিন কংগ্রেস ছাড়াও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলেছেন। এসব কথাবার্তা থেকে তার মনে হয়েছে বাংলাদেশি পণ্যের ব্যাপারে মার্কিন নীতিনির্ধারকরা তথা ব্যবসায়ীরা একটি নেতিবাচক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। আর বাংলাদেশি পণ্য মানেই তো তৈরি পোশাক। সেই তৈরি পোশাক রফতানিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, তার কী প্রতিক্রিয়া হবে আমরা কি তা আদৌ ভেবে দেখেছি? শুধু বিশ্বব্যাংকের ঋণচুক্তি বাতিলের কারণেই যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের উষ্ণতায় কিছুটা দাগ লেগেছে, তা নয়। বরং শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামের হত্যাকাণ্ড, বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীর 'গুম' হয়ে যাওয়ার ঘটনা, যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের প্রতিবেদনে বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ ইত্যাদি নানা কারণে মাঝে মধ্যেই দু'দেশের সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এর ওপরে রয়েছে ড. ইউনূস ইস্যুটি।
যদিও মজিনা বলেছেন, 'পদ্মা সেতুর ঘটনায় ইউনূসের হাত নেই।' এটাই সত্য এবং বাস্তব। কিন্তু ড. ইউনূসের আরেক 'বন্ধু' রয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রে, বিশেষ করে নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে তার পরিচয় রয়েছে ব্যক্তিগত পর্যায়ে। তাদের অনেকেই গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ড. ইউনূসের অপসারণে খুশি হননি। খোদ হিলারি ক্লিনটনও অখুশি। ড. ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে তার উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এই সংবাদটি যে মার্কিন নীতিনির্ধারকদের কাছে পেঁৗছে গেছে এটা স্বাভাবিক। হিলারি ক্লিনটনের ঢাকা সফরের সময় রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য তিনি সময় বের করতে পারেননি। কিন্তু ঠিকই ড. ইউনূসের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। এর মধ্যে দিয়ে তিনি একটি মেসেজ দিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু আমাদের নীতিনির্ধারকরা ওই মেসেজটি বুঝতে পেরেছিলেন বলে মনে হয় না। ঢাকা সফরে হিলারি ক্লিনটন ইলিয়াস আলীর অন্তর্ধান ও গার্মেন্ট শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামের হত্যাকাণ্ড নিয়ে মন্তব্য করেছিলেন। এরপর অনেক সময় পার হয়ে গেছে। আজও ইলিয়াস আলী ফিরে আসেননি। তিনি মৃত, কি বেঁচে আছেন, আমরা কেউ তা জানি না। রাষ্ট্রের এতগুলো এজেন্সি তার অন্তর্ধান সম্পর্কে কোনো তথ্য দিতে পারবে না_ এটা আশা করা যায় না। ঠিক তেমনি শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামকে কারা হত্যা করল, তা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জানবে না, তা তো হতে পারে না। বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এই ভূমিকা তাদের আরও বিতর্কিত করেছে।
সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক উন্নত হলেও তাতে নানা জটিলতা তৈরি হয়েছে। হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফরের পর বাংলাদেশ সম্পর্কে নতুন চিন্তা-চেতনার জন্ম হয়েছে মার্কিন নীতিনির্ধারকদের কাছে। ক্লিনটনের সফরের সময় একটি 'অংশীদারি সংলাপ' চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, যার বিস্তারিত আমরা কিছুই জানি না। অভিযোগ আছে, যুক্তরাষ্ট্র চীনকে ঘিরে ফেলার যে স্ট্র্যাটেজি রচনা করছে, তাতে এই চুক্তি একটা ভূমিকা পালন করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবিত 'আকসা' চুক্তি নিয়েও কথা আছে। 'আকসা' চুক্তি অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের বাহিনীর বাংলাদেশে উপস্থিতির সুযোগ সৃষ্টি হবে। প্রস্তাবিত এই চুক্তি অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনীর জ্বালানি সংগ্রহ, যাত্রাবিরতি, সাময়িক অবস্থানসহ বিভিন্ন সুবিধার জন্য 'পোর্ট অব কল' সুবিধা পাবে। এই চুক্তি নিয়েও কথা আছে। প্রস্তাবিত এই চুক্তি বাংলাদেশে মার্কিন ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। যদিও বাংলাদেশ এখনও চুক্তি স্বাক্ষরে রাজি হয়নি।
এর আগে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের যে সুযোগ চেয়েছিল তা পায়নি। বাংলাদেশকে তার তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে যে শুল্ক দিতে হয়, তাতে প্রতিযোগিতায় আমরা টিকতে পারছি না। অথচ এলএসডির দেশ হিসেবে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের সুযোগ আমাদের পাওয়ার কথা। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক সাহায্য সংস্থা 'মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ করপোরেশন' থেকে বাংলাদেশ কোনো সাহায্য পাচ্ছে না। এ ব্যাপারে হিলারি ক্লিনটনের সফরের সময় কোনো বক্তব্য বা সহযোগিতার আশ্বাসও আমরা পাইনি। ঢাকায় হিলারি ক্লিনটন 'গণতন্ত্রের জন্য সংলাপ' ও 'পার্লামেন্টারি ডিবেট'-এর কথা বলেছিলেন। এগুলো হচ্ছে তত্ত্বের কথা। আমরা সবাই জানি, গণতন্ত্রে সরকার ও বিরোধী দলের মাঝে সংলাপ ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা রাখাটা যে জরুরি_ এ কথাটা আমরা বারবার বলে আসছি। কিন্তু এই 'সংলাপ' বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হয়নি। এমনকি 'সংসদীয় ডিবেট'ও তেমন কার্যকর নয় বাংলাদেশে। হিলারি ক্লিনটনের মুখ থেকে এ কথাটা বেরিয়ে এসেছিল সত্য, কিন্তু আদৌ 'সংলাপ' অনুষ্ঠিত হবে_ এ আস্থাটা রাখতে পারছি না।
হিলারি ক্লিনটনের বক্তব্যের বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ ছিল_ বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের 'নাক গলানো'। ভারত কিংবা অন্য কোনো দেশের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র এমনটা করে না। আমরা তেমন একটা 'ক্ষেত্র' তৈরি করেছি, যেখানে বিদেশিরা আমাদের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় মন্তব্য করছে। ড্যান মজিনাও বললেন। আমরা একটা প্রেক্ষাপট তৈরি করেছি। যাতে বিদেশিরা আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় প্রভাব খাটাচ্ছে। সরকার যদি আরও সতর্ক হতো, আমার বিশ্বাস তারা এ ধরনের মন্তব্য করতে সাহস পেত না।
পদ্মা সেতু নিয়ে অনেক কথা বলা হয়েছে। এর সঙ্গে অনেকের আবেগ জড়িত। সরকারের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিও রয়েছে। সুতরাং যেভাবেই হোক সরকারকে পদ্মা সেতুর কাজ শুরু করতে হবে। নিজস্ব অর্থায়নে কাজটি করা সম্ভব। কিন্তু তাতে অন্যান্য উন্নয়ন প্রকল্প বাধাগ্রস্ত হবে। সেতুটির স্থায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন থাকবে। সর্বোপরি দুর্নীতির প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দেবে তখন। যারা বিশ্বব্যাংক সম্পর্কে ধারণা রাখেন, তারা জানেন বিশ্বব্যাংক উন্নয়নশীল বিশ্বে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। এ সংক্রান্ত অনেক গবেষণা গ্রন্থ রয়েছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে একটি প্রকল্প নিয়ে প্রশ্ন তুললে, ছলে-বলে-কৌশলে বাকি প্রকল্পগুলোও আটকে দেয় বিশ্বব্যাংক। আজ সে রকম একটি পরিস্থিতিরই মুখোমুখি হতে যাচ্ছি আমরা। তাদের এই সিদ্ধান্তে অন্যরাও প্রভাবিত হবে।
ড্যান মজিনার মন্তব্যে আমি একটি অন্য গন্ধ পাচ্ছি। মার্কিন আইন প্রণেতারা যদি সত্যি সত্যিই সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে কোনো আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেন, তাহলে তা আমাদের জন্য কোনো মঙ্গল ডেকে আনবে না। তাই বাস্তবমুখী হওয়া প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমরা এই বাস্তবমুখী নীতি প্রণয়নের কথাই বলি। বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সমঝোতায় যাওয়া এখনও সম্ভব। উন্নয়নশীল বিশ্বে পুঁজি বিনিয়োগ করেই বিশ্বব্যাংক টিকে আছে। এটাই তাদের ব্যবসা। উন্নয়নশীল বিশ্বে সাহায্য না দিলে বিশ্বব্যাংক তার অস্তিত্ব নিয়ে হুমকির মুখে থাকবে। তাই অর্থায়নের ব্যাপারে অর্থমন্ত্রী পুনর্বিবেচনার যে কথা বলেছেন, সরকার এই নীতিটি গ্রহণ করলে ভালো করবে।
ড. তারেক শামসুর রেহমান : প্রফেসর
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com
www.tsrahmanbd.blogspot.com
সরকার যদি নিজেই পদ্মা সেতু নির্মাণ করে, এর প্রতিক্রিয়া, ৩৫ প্রজেক্টে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নের ভবিষ্যৎ ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে বিতর্ক আছে। কিন্তু আমি গুরুত্ব দিতে চাই ড্যান মজিনার বক্তব্যটিতে। যেখানে তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রে অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশি পণ্য বিক্রি বন্ধ হয়ে যেতে পারে(?)। এই বক্তব্যটি যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বক্তব্য নয়। এটি রাষ্ট্রদূত মজিনার উপলব্ধি। তিনি দু'সপ্তাহ যুক্তরাষ্ট্রে থেকে সম্প্রতি ঢাকায় ফিরে এসেছেন। তিনি জানিয়েছেন, এই দু'সপ্তাহে তিনি মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর, পেন্টাগন, মার্কিন কংগ্রেস ছাড়াও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলেছেন। এসব কথাবার্তা থেকে তার মনে হয়েছে বাংলাদেশি পণ্যের ব্যাপারে মার্কিন নীতিনির্ধারকরা তথা ব্যবসায়ীরা একটি নেতিবাচক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। আর বাংলাদেশি পণ্য মানেই তো তৈরি পোশাক। সেই তৈরি পোশাক রফতানিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, তার কী প্রতিক্রিয়া হবে আমরা কি তা আদৌ ভেবে দেখেছি? শুধু বিশ্বব্যাংকের ঋণচুক্তি বাতিলের কারণেই যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের উষ্ণতায় কিছুটা দাগ লেগেছে, তা নয়। বরং শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামের হত্যাকাণ্ড, বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীর 'গুম' হয়ে যাওয়ার ঘটনা, যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের প্রতিবেদনে বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ ইত্যাদি নানা কারণে মাঝে মধ্যেই দু'দেশের সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এর ওপরে রয়েছে ড. ইউনূস ইস্যুটি।
যদিও মজিনা বলেছেন, 'পদ্মা সেতুর ঘটনায় ইউনূসের হাত নেই।' এটাই সত্য এবং বাস্তব। কিন্তু ড. ইউনূসের আরেক 'বন্ধু' রয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রে, বিশেষ করে নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে তার পরিচয় রয়েছে ব্যক্তিগত পর্যায়ে। তাদের অনেকেই গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ড. ইউনূসের অপসারণে খুশি হননি। খোদ হিলারি ক্লিনটনও অখুশি। ড. ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে তার উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এই সংবাদটি যে মার্কিন নীতিনির্ধারকদের কাছে পেঁৗছে গেছে এটা স্বাভাবিক। হিলারি ক্লিনটনের ঢাকা সফরের সময় রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য তিনি সময় বের করতে পারেননি। কিন্তু ঠিকই ড. ইউনূসের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। এর মধ্যে দিয়ে তিনি একটি মেসেজ দিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু আমাদের নীতিনির্ধারকরা ওই মেসেজটি বুঝতে পেরেছিলেন বলে মনে হয় না। ঢাকা সফরে হিলারি ক্লিনটন ইলিয়াস আলীর অন্তর্ধান ও গার্মেন্ট শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামের হত্যাকাণ্ড নিয়ে মন্তব্য করেছিলেন। এরপর অনেক সময় পার হয়ে গেছে। আজও ইলিয়াস আলী ফিরে আসেননি। তিনি মৃত, কি বেঁচে আছেন, আমরা কেউ তা জানি না। রাষ্ট্রের এতগুলো এজেন্সি তার অন্তর্ধান সম্পর্কে কোনো তথ্য দিতে পারবে না_ এটা আশা করা যায় না। ঠিক তেমনি শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামকে কারা হত্যা করল, তা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জানবে না, তা তো হতে পারে না। বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এই ভূমিকা তাদের আরও বিতর্কিত করেছে।
সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক উন্নত হলেও তাতে নানা জটিলতা তৈরি হয়েছে। হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফরের পর বাংলাদেশ সম্পর্কে নতুন চিন্তা-চেতনার জন্ম হয়েছে মার্কিন নীতিনির্ধারকদের কাছে। ক্লিনটনের সফরের সময় একটি 'অংশীদারি সংলাপ' চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, যার বিস্তারিত আমরা কিছুই জানি না। অভিযোগ আছে, যুক্তরাষ্ট্র চীনকে ঘিরে ফেলার যে স্ট্র্যাটেজি রচনা করছে, তাতে এই চুক্তি একটা ভূমিকা পালন করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবিত 'আকসা' চুক্তি নিয়েও কথা আছে। 'আকসা' চুক্তি অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের বাহিনীর বাংলাদেশে উপস্থিতির সুযোগ সৃষ্টি হবে। প্রস্তাবিত এই চুক্তি অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনীর জ্বালানি সংগ্রহ, যাত্রাবিরতি, সাময়িক অবস্থানসহ বিভিন্ন সুবিধার জন্য 'পোর্ট অব কল' সুবিধা পাবে। এই চুক্তি নিয়েও কথা আছে। প্রস্তাবিত এই চুক্তি বাংলাদেশে মার্কিন ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। যদিও বাংলাদেশ এখনও চুক্তি স্বাক্ষরে রাজি হয়নি।
এর আগে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের যে সুযোগ চেয়েছিল তা পায়নি। বাংলাদেশকে তার তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে যে শুল্ক দিতে হয়, তাতে প্রতিযোগিতায় আমরা টিকতে পারছি না। অথচ এলএসডির দেশ হিসেবে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের সুযোগ আমাদের পাওয়ার কথা। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক সাহায্য সংস্থা 'মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ করপোরেশন' থেকে বাংলাদেশ কোনো সাহায্য পাচ্ছে না। এ ব্যাপারে হিলারি ক্লিনটনের সফরের সময় কোনো বক্তব্য বা সহযোগিতার আশ্বাসও আমরা পাইনি। ঢাকায় হিলারি ক্লিনটন 'গণতন্ত্রের জন্য সংলাপ' ও 'পার্লামেন্টারি ডিবেট'-এর কথা বলেছিলেন। এগুলো হচ্ছে তত্ত্বের কথা। আমরা সবাই জানি, গণতন্ত্রে সরকার ও বিরোধী দলের মাঝে সংলাপ ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা রাখাটা যে জরুরি_ এ কথাটা আমরা বারবার বলে আসছি। কিন্তু এই 'সংলাপ' বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হয়নি। এমনকি 'সংসদীয় ডিবেট'ও তেমন কার্যকর নয় বাংলাদেশে। হিলারি ক্লিনটনের মুখ থেকে এ কথাটা বেরিয়ে এসেছিল সত্য, কিন্তু আদৌ 'সংলাপ' অনুষ্ঠিত হবে_ এ আস্থাটা রাখতে পারছি না।
হিলারি ক্লিনটনের বক্তব্যের বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ ছিল_ বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের 'নাক গলানো'। ভারত কিংবা অন্য কোনো দেশের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র এমনটা করে না। আমরা তেমন একটা 'ক্ষেত্র' তৈরি করেছি, যেখানে বিদেশিরা আমাদের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় মন্তব্য করছে। ড্যান মজিনাও বললেন। আমরা একটা প্রেক্ষাপট তৈরি করেছি। যাতে বিদেশিরা আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় প্রভাব খাটাচ্ছে। সরকার যদি আরও সতর্ক হতো, আমার বিশ্বাস তারা এ ধরনের মন্তব্য করতে সাহস পেত না।
পদ্মা সেতু নিয়ে অনেক কথা বলা হয়েছে। এর সঙ্গে অনেকের আবেগ জড়িত। সরকারের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিও রয়েছে। সুতরাং যেভাবেই হোক সরকারকে পদ্মা সেতুর কাজ শুরু করতে হবে। নিজস্ব অর্থায়নে কাজটি করা সম্ভব। কিন্তু তাতে অন্যান্য উন্নয়ন প্রকল্প বাধাগ্রস্ত হবে। সেতুটির স্থায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন থাকবে। সর্বোপরি দুর্নীতির প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দেবে তখন। যারা বিশ্বব্যাংক সম্পর্কে ধারণা রাখেন, তারা জানেন বিশ্বব্যাংক উন্নয়নশীল বিশ্বে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। এ সংক্রান্ত অনেক গবেষণা গ্রন্থ রয়েছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে একটি প্রকল্প নিয়ে প্রশ্ন তুললে, ছলে-বলে-কৌশলে বাকি প্রকল্পগুলোও আটকে দেয় বিশ্বব্যাংক। আজ সে রকম একটি পরিস্থিতিরই মুখোমুখি হতে যাচ্ছি আমরা। তাদের এই সিদ্ধান্তে অন্যরাও প্রভাবিত হবে।
ড্যান মজিনার মন্তব্যে আমি একটি অন্য গন্ধ পাচ্ছি। মার্কিন আইন প্রণেতারা যদি সত্যি সত্যিই সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে কোনো আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেন, তাহলে তা আমাদের জন্য কোনো মঙ্গল ডেকে আনবে না। তাই বাস্তবমুখী হওয়া প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমরা এই বাস্তবমুখী নীতি প্রণয়নের কথাই বলি। বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সমঝোতায় যাওয়া এখনও সম্ভব। উন্নয়নশীল বিশ্বে পুঁজি বিনিয়োগ করেই বিশ্বব্যাংক টিকে আছে। এটাই তাদের ব্যবসা। উন্নয়নশীল বিশ্বে সাহায্য না দিলে বিশ্বব্যাংক তার অস্তিত্ব নিয়ে হুমকির মুখে থাকবে। তাই অর্থায়নের ব্যাপারে অর্থমন্ত্রী পুনর্বিবেচনার যে কথা বলেছেন, সরকার এই নীতিটি গ্রহণ করলে ভালো করবে।
ড. তারেক শামসুর রেহমান : প্রফেসর
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com
www.tsrahmanbd.blogspot.com
No comments