পদ্মা সেতু প্রকল্প-অর্থনৈতিক স্বার্থ বনাম জাতীয় মর্যাদা by আবদুল মান্নান চৌধুরী
নিজ অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেওয়ার পর দুর্নীতির সংজ্ঞার হাত-পা গজাতে শুরু করেছে আর বিদগ্ধ সুশীল অর্থনীতিবিদরা এই পদক্ষেপের মধ্যেও জাতীয় বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন। মনে হচ্ছে, শেখ হাসিনা থাকতেও পারবেন না, যেতে চাইলে যেতেও পারবেন না, আর 'কী' করবেন তা জিজ্ঞাসিত হলে 'কী' করতেও নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হচ্ছেন।
আমার ধারণা, তাদের কথা অনেক শোনা হয়েছে, আর শোনার প্রয়োজন নেই
একটা গল্প দিয়ে লেখাটা শুরু করছি। গল্পটির উৎপত্তিস্থল গফরগাঁও বাজার। এক কিশোর ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে বাজার ছেড়ে বাড়িমুখে যাচ্ছে আর উচ্চৈঃস্বরে বলছে, 'মানির মান আল্লাহই রাখে।' তার এই কথার অর্থ জানার জন্য তাকে থামাতে চেষ্টা করে অনেকেই ব্যর্থ হয়; কিন্তু এক সাহসী যুবক তাকে ঠিকই ধরে ফেলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, 'মানির মান আল্লাহই রাখে' কথাটার মানে কী? দৌড় থামিয়ে এবার তরুণটি বলল, 'কিছুসংখ্যক লোক বাজারে বাজানকে (আব্বুকে) জুতা দিয়ে পেটাচ্ছে। সে কাণ্ড দেখে আমি ভোঁ দৌড় দিয়েছি; মানির মান আল্লাহই রাখে।' পদ্মা সেতু প্রসঙ্গে বহু দিন আগে শোনা গল্পটির কথা মনে পড়ে গেল। গল্পটি বলেছিলেন একজন বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ ও বিদগ্ধ শিক্ষক ড. মনোয়ার উদ্দিন আহমদ।
পদ্মা সেতু নিয়ে আমাদের যখন বিবিধ বিতর্ক, মান-অভিমান, লুকোচুরি, অভিযোগ, অনুযোগ চলছে তখন গফরগাঁওয়ের সেই কিশোরটিকে আবছা দেখা যাচ্ছিল। আর ওয়ার্ল্ড ব্যাংক যখন একতরফা ও অন্যায়ভাবে পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়ন বন্ধ করে দিল, তখন আবারও 'মানি' ব্যক্তিদের আবির্ভাব দেখলাম। মনে হলো, কেউ কেউ মুচকি হাসি কিংবা অট্টহাসি হাসছে। তাদের নিবাস এ দেশেই, তারা এ মাটির অন্নজলে মানুষ এবং এ জাতির অর্থবিত্তে তারা প্রাইমারি থেকে উচ্চশিক্ষা নিয়েছে, এ দেশের চাষাভুষা, খেটে খাওয়া মানুষের রক্ত চুষে আর বিদেশিদের উলঙ্গ দালালি করে বিত্ত-বৈভবের অধিকারী হয়ে সুশীল সেজেছেন। তারা বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে সরকারকে দুর্নীতিবাজ আখ্যায়িত করছেন, সরকার ও আওয়ামী লীগকে এক করে দেখেছেন, শেখ হাসিনা ও দেশের ষোলো কোটি মানুষকে একাকার করে দেখছেন। তাতে খারাপ কী? খারাপটা হচ্ছে তারা বাথটাব ছুড়ে ফেলতে গিয়ে হায়েনার হাসি হাসছেন আর ইংরেজি প্রবাদের সেই ঞযৎড়রিহম ঃযব নধনু রিঃয ঃযব নধঃযঃঁন কথাটির সম্যক প্রয়োগ ঘটাচ্ছেন।
বিশ্বব্যাংকের অর্থে কোনো দুর্নীতি যে ঘটেনি তা অনেকটা নিশ্চিত হয়ে তারা বলছেন, শেখ হাসিনার সরকার ঞধপঃষবংং আচরণ করেই বিশ্বব্যাংককে ক্ষেপিয়ে দিয়েছেন; তার আরও একটু আপস ও নমনীয় আচরণ বাঞ্ছনীয় ছিল। তারা শেখ হাসিনার আচরণকে ঞধপঃষবংং বললেও আমরা কিন্তু উচ্চকণ্ঠে শেখ হাসিনার প্রশংসা করছি। শেখ হাসিনার এই আচরণ আবারও বঙ্গবন্ধুকে আমাদের চোখের সামনে নিয়ে এসেছে।
সেই ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ২৮ তারিখের কথা। সেদিন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড স্বহস্তে গাড়ি চালিয়ে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউর অতি সরু রাস্তা ধরে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎ করেন। উত্তাল সে সময়ের আলোচনার বিষয়বস্তু তেমন কেউ জানতে পারেননি। তবে আমি পরম সৌভাগ্যবান। সেদিন দুপুরের পর শেখ ফজলুল হক মনি আমাকে নিয়ে পুরানা পল্টনের আওয়ামী লীগ অফিসে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যান। আমরা দু'জন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একান্তে দেখা করি। বঙ্গবন্ধু তার আলোচনার সারমর্ম আমাদের জানান এবং একটি গুলি খরচ না করেই যুদ্ধজয়ের প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন। এরই মাঝে তিনি একটি টেলিফোন কল পান। এই কলটি ছিল ফারল্যান্ডের।
ফারল্যান্ড যে কথা সকালে বলেননি তা-ই তখন বঙ্গবন্ধুকে জানালেন। বঙ্গবন্ধু অতি উচ্চৈঃস্বরে কথা বলছিলেন; রাগে-উষ্মায় তিনি কাঁপছিলেন। ফারল্যান্ডের প্রস্তাবটি ছিল সিঙ্গাপুর কায়দায় পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নকরণ; বিনিময়ে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নৌঘাঁটি স্থাপনের সুযোগ। মুহূর্তে তিনি ফারল্যান্ডের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন অর্থাৎ আমাদের সুশীল ও বিরুদ্ধবাদীদের ভাষায় ঞধপঃষবংং কাজটা করলেন। সেই ঞধপঃষবংং কাজটা না করলে গোলামির জিঞ্জিরটা আমরা আজও হয়তো পরে বসে থাকতাম।
এ জাতীয় ঞধপঃষবংং কাজটা আমরা শেখ হাসিনার মধ্যেও দেখলাম। বঙ্গবন্ধুকে সে জন্য সপরিবারে চরম মূল্য দিতে হয়েছে। শেখ হাসিনার বরাতে কী আছে জানি না, তবে স্রষ্টা অফুরন্ত মহিমা ও করুণা দিয়ে তাকে যেভাবে বাঁচিয়ে রাখছেন তাতে মনে হয় মহান স্রষ্টা শেখ হাসিনাকে কোনো না কোনো মহৎ কাজের জন্য বাঁচিয়ে রাখছেন।
বিরুদ্ধবাদীদের ঞধপঃষবংং কাজের সংজ্ঞাটা স্পষ্ট নয়। অনেকের মতে, শেখ হাসিনার পক্ষে অতীতে ঞধপঃভঁষ কাজ ছিল বিশ্বব্যাংকের ন্যায়-অন্যায়, সত্যি-মিথ্যা, মনগড়া সবকিছু মাথা পেতে নেওয়া কিংবা ড. ইউনূসকে আজীবন গ্রামীণ ব্যাংকের কর্তাব্যক্তি রাখা। বিশ্বব্যাংকের পর হিউম্যান রাইটস ওয়াচের বক্তব্য আরও স্পষ্ট করেছে যে, যুদ্ধাপরাধী ও বিডিআর বিদ্রোহীদের বিচারসহ সব ধরনের ন্যক্কারজনক ও ঘৃণ্য কাজগুলোকে প্রশ্রয় দেওয়া হবে ঞধপঃভঁষ বা কৌশলী পদক্ষেপ। এই কৌশলী পদক্ষেপ অন্তত বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা নিতে পারেন না; তাকে বাবার মতোই তথাকথিত ঞধপঃষবংং হতে হবে এবং তিনি পদ্মা সেতুর ব্যাপারে অনমনীয় অবস্থান নিয়ে এমনটিই করেছেন। আমরা আর কিছু না পারি তাকে প্রাণ খুলে দোয়া করছি আর তার সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করছি।
নিজ অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেওয়ার পর দুর্নীতির সংজ্ঞার হাত-পা গজাতে শুরু করেছে আর বিদগ্ধ সুশীল অর্থনীতিবিদরা এই পদক্ষেপের মধ্যেও জাতীয় বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন। মনে হচ্ছে, শেখ হাসিনা থাকতেও পারবেন না, যেতে চাইলে যেতেও পারবেন না, আর 'কী' করবেন তা জিজ্ঞাসিত হলে 'কী' করতেও নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হচ্ছেন। আমার ধারণা, তাদের কথা অনেক শোনা হয়েছে, আর শোনার প্রয়োজন নেই। তারা সরকারের ব্যর্থতার সমালোচনা করবেন, ভালো কাজের পরামর্শ দেবেন, কিন্তু ভালো কাজ হাতে নিতে গেলেও বাধা সৃষ্টি করবেন। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ প্রতিহত করে তারা এখন কচুগাছ কাটতে কাটতে ডাকাতে পরিণত হয়েছেন। এই ডাকাতদের ঠেকাতে হবে।
নিদ্বর্িধায় বলছি দেশের অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা অতিশয় সাহসী পদক্ষেপ। আমরা এই পদক্ষেপের সঙ্গে আছি। জ্বলে-পুড়ে ছারখার হতে রাজি আছি, তবুও মাথা নোয়াতে আমরা প্রস্তুত নই। তা আমরা বহুবার প্রমাণ করেছি। আবারও করব।
এ সেতু বানাতে কয়েক পর্বে প্রায় ২২,৫৫৪ কোটি টাকা প্রয়োজন। আমার ধারণা, পদ্মা সেতু নিজ অর্থেই নির্মাণ সম্ভব ও সঙ্গত। তাতে হয়তো বৈদেশিক মুদ্রার সংকট হতে পারে। আমরা ভুলে যাচ্ছি, আমাদের প্রায় এক কোটি শ্রমজীবী মানুষ বিদেশে চাকরি করছেন। পেশাজীবী ও ব্যবসায়ীও কম নন। তাদের দেশপ্রেম সুশীলদের চেয়ে কিংবা অনেক স্বঘোষিত দেশপ্রেমিকের চেয়ে অনেক বেশি। আমার ধারণা, জননেত্রী যদি বিদেশে কর্মরতদের কাছে একটি আহ্বান জানান তাহলে তারা বারো হাজার কোটি টাকা বিদেশ থেকে এ বছরই তুলে দেবেন। মাথাপিছু মাত্র ১৫০ ডলার আমাদের বিদেশে কর্মরত বন্ধুরা পাঠালেই তার সংস্থান হয়ে যাবে। এসব মানুষসহ গার্মেন্ট শিল্প আমার দেশটাকে বাঁচিয়ে রেখেছে আর তারা আমাদের 'জাতীয় বীর' কৃষকদের সন্তান ও সজ্জন। তারা নিশ্চয়ই জাতির এই ক্লান্তিলগ্নে এগিয়ে আসবেন।
ব্যবসায়ীদের দেশপ্রেমবিবর্জিত ভাবা একটি স্টাইলে পরিণত হয়ে গেছে। তাদের সঠিকভাবে প্রণোদিত করতে পারলে ও আস্থায় নিতে পারলে দেশীয় মুদ্রার বিশাল অংশ তাদের কাছ থেকে পাওয়া যাবে। ইতিমধ্যে শেখ কবিরের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশন ১১ হাজার কোটি টাকা পদ্মা সেতুতে বিনিয়োগের প্রস্তাব করেছে। আমার মতে, দেশের ব্যবসায়ী সম্প্রদায় আর একটু নিশ্চয়তা পেলে পিপিপির অধীনে বিনিয়োগে এগিয়ে আসবে। অপ্রদর্শিত অর্থের বিনিয়োগের ক্ষেত্রটা আর একটু সম্প্রসারিত করলে সুফল বৈ কুফল আসবে না। তবে বিনিয়োগকারীদের এনবিআরসহ অন্য কোনো সংস্থা বা এজেন্সির অনল থেকে রক্ষা করলে এক সেতু নয় বহু সেতুর টাকা আপনাআপনি চলে আসবে; হুন্ডি ব্যবসা বিলুপ্ত হবে। দেশি অর্থের বিদেশ গমন প্রয়াস প্রতিহত হবে। আমি ড. মশিউর রহমান সাহেবের কাছে পরামর্শ রেখেছিলাম যে, পদ্মা সেতুর বিনিয়োগে এনবিআর বা অন্যান্য সংস্থার প্রতিবন্ধকতা সম্পূর্ণ তুলে দিতে। তার আগ্রহে আমি এই পরামর্শ দিতে আবারও আগ্রহী হচ্ছি। আয়কর আইনে ১৯বি ধারাটা আরও একটু সম্পাদিত করেও কিন্তু পদ্মা সেতুর অর্থায়নের পথ সুগম করা সম্ভব। বাজেটে বরাদ্দকৃত অর্থ ও বন্ড ছেড়ে এই অর্থ সংগ্রহের পদক্ষেপ প্রশংসার যোগ্য। ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগের মতো অনুরূপ সুবিধা এখানে রাখলে ভালো হয়।
পদ্মা সেতু শুধু অর্থনৈতিক কারণে নয়, আমাদের জাতীয় মর্যাদা সংরক্ষণেও প্রয়োজন। কেউ কেউ বলছেন, দেশীয় সম্পদে সেতু নির্মিত হলে ব্যয় বেড়ে যাবে। তা যদি হয়ই, আমাদের আপত্তি থাকবে কেন, টাকাটা তো দেশেই থাকবে এবং দেশের মানুষই উপকৃত হবে। বিশ্বব্যাংকের ঋণের সুদ নগণ্য বলে চিহ্নিত করলেও তাদের পরামর্শক এবং আমলা-কামলাদের খাই-খাই ও বিবিধ ফরমায়েশ জোগান দিতে প্রকারান্তরে দেখা যাচ্ছে বিশ্বব্যাংকের দান-অনুদানের ৬০ ভাগই তাদের পেটে ফেরত যাবে।
আমার দুঃখ হয়, ষাটের দশকে এসব নিয়ে যারা বিশ্বব্যাংকের সমালোচনায় মুখর ছিলেন তারা কেমন করে আজ বিশ্বব্যাংকের বন্দনায় নেমেছেন অথবা মুখে কুলুপ এঁটে রয়েছেন। নাকি তারা এক ধরনের বৃদ্ধকাল সিনড্রোমে ভুগছেন। আমি একবার এক ব্যাংকে বেশ কিছু অতি সৎ ও সজ্জন ব্যক্তিকে নিয়োগ দিয়েছিলাম। তারা সবাই ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত। আমি এসব সজ্জন ব্যক্তির মাঝেও দুর্নীতি দেখে বিস্মিত হয়েছিলাম। পরে জেনেছি সারাজীবন সৎ থাকায় পরিবারের সদস্যদের খোঁচানিতে তারা জীবনের শেষ সুযোগটি কাজে লাগিয়েছেন। আমার মনে হচ্ছে, এই সিনড্রোম বিশ্বব্যাংকের পক্ষে ওকালতির পক্ষে কাজ করছে।
রাজনীতিবিদদের কথা বলব না। তারা নিজেরাই জানে দলের চেয়ে দেশ বড়, ব্যক্তির চেয়ে সংগঠন বড়। তাই আগামী নির্বাচন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের বিচারের ভার জনগণের হাতে ছেড়ে দিতে পারেন। অন্যান্য দেশের বিরোধী দলের মতো জাতীয় স্বার্থে হিমালয়সদৃশ একতা নিয়ে দাঁড়াতে আমরা সকলকে আহ্বান জানাব। আমরা যেন নিজের নাক কেটে আর পরের যাত্রা ভঙ্গের প্রয়াস না নেই এবং একটি দলের তথাকথিত দুর্নীতির কারণে সারা জাতিকে অহেতুক শূলে তুলে না দেই।
অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী শিক্ষাবিদ ও মুক্তিযোদ্ধা
একটা গল্প দিয়ে লেখাটা শুরু করছি। গল্পটির উৎপত্তিস্থল গফরগাঁও বাজার। এক কিশোর ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে বাজার ছেড়ে বাড়িমুখে যাচ্ছে আর উচ্চৈঃস্বরে বলছে, 'মানির মান আল্লাহই রাখে।' তার এই কথার অর্থ জানার জন্য তাকে থামাতে চেষ্টা করে অনেকেই ব্যর্থ হয়; কিন্তু এক সাহসী যুবক তাকে ঠিকই ধরে ফেলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, 'মানির মান আল্লাহই রাখে' কথাটার মানে কী? দৌড় থামিয়ে এবার তরুণটি বলল, 'কিছুসংখ্যক লোক বাজারে বাজানকে (আব্বুকে) জুতা দিয়ে পেটাচ্ছে। সে কাণ্ড দেখে আমি ভোঁ দৌড় দিয়েছি; মানির মান আল্লাহই রাখে।' পদ্মা সেতু প্রসঙ্গে বহু দিন আগে শোনা গল্পটির কথা মনে পড়ে গেল। গল্পটি বলেছিলেন একজন বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ ও বিদগ্ধ শিক্ষক ড. মনোয়ার উদ্দিন আহমদ।
পদ্মা সেতু নিয়ে আমাদের যখন বিবিধ বিতর্ক, মান-অভিমান, লুকোচুরি, অভিযোগ, অনুযোগ চলছে তখন গফরগাঁওয়ের সেই কিশোরটিকে আবছা দেখা যাচ্ছিল। আর ওয়ার্ল্ড ব্যাংক যখন একতরফা ও অন্যায়ভাবে পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়ন বন্ধ করে দিল, তখন আবারও 'মানি' ব্যক্তিদের আবির্ভাব দেখলাম। মনে হলো, কেউ কেউ মুচকি হাসি কিংবা অট্টহাসি হাসছে। তাদের নিবাস এ দেশেই, তারা এ মাটির অন্নজলে মানুষ এবং এ জাতির অর্থবিত্তে তারা প্রাইমারি থেকে উচ্চশিক্ষা নিয়েছে, এ দেশের চাষাভুষা, খেটে খাওয়া মানুষের রক্ত চুষে আর বিদেশিদের উলঙ্গ দালালি করে বিত্ত-বৈভবের অধিকারী হয়ে সুশীল সেজেছেন। তারা বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে সরকারকে দুর্নীতিবাজ আখ্যায়িত করছেন, সরকার ও আওয়ামী লীগকে এক করে দেখেছেন, শেখ হাসিনা ও দেশের ষোলো কোটি মানুষকে একাকার করে দেখছেন। তাতে খারাপ কী? খারাপটা হচ্ছে তারা বাথটাব ছুড়ে ফেলতে গিয়ে হায়েনার হাসি হাসছেন আর ইংরেজি প্রবাদের সেই ঞযৎড়রিহম ঃযব নধনু রিঃয ঃযব নধঃযঃঁন কথাটির সম্যক প্রয়োগ ঘটাচ্ছেন।
বিশ্বব্যাংকের অর্থে কোনো দুর্নীতি যে ঘটেনি তা অনেকটা নিশ্চিত হয়ে তারা বলছেন, শেখ হাসিনার সরকার ঞধপঃষবংং আচরণ করেই বিশ্বব্যাংককে ক্ষেপিয়ে দিয়েছেন; তার আরও একটু আপস ও নমনীয় আচরণ বাঞ্ছনীয় ছিল। তারা শেখ হাসিনার আচরণকে ঞধপঃষবংং বললেও আমরা কিন্তু উচ্চকণ্ঠে শেখ হাসিনার প্রশংসা করছি। শেখ হাসিনার এই আচরণ আবারও বঙ্গবন্ধুকে আমাদের চোখের সামনে নিয়ে এসেছে।
সেই ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ২৮ তারিখের কথা। সেদিন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড স্বহস্তে গাড়ি চালিয়ে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউর অতি সরু রাস্তা ধরে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎ করেন। উত্তাল সে সময়ের আলোচনার বিষয়বস্তু তেমন কেউ জানতে পারেননি। তবে আমি পরম সৌভাগ্যবান। সেদিন দুপুরের পর শেখ ফজলুল হক মনি আমাকে নিয়ে পুরানা পল্টনের আওয়ামী লীগ অফিসে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যান। আমরা দু'জন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একান্তে দেখা করি। বঙ্গবন্ধু তার আলোচনার সারমর্ম আমাদের জানান এবং একটি গুলি খরচ না করেই যুদ্ধজয়ের প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন। এরই মাঝে তিনি একটি টেলিফোন কল পান। এই কলটি ছিল ফারল্যান্ডের।
ফারল্যান্ড যে কথা সকালে বলেননি তা-ই তখন বঙ্গবন্ধুকে জানালেন। বঙ্গবন্ধু অতি উচ্চৈঃস্বরে কথা বলছিলেন; রাগে-উষ্মায় তিনি কাঁপছিলেন। ফারল্যান্ডের প্রস্তাবটি ছিল সিঙ্গাপুর কায়দায় পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নকরণ; বিনিময়ে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নৌঘাঁটি স্থাপনের সুযোগ। মুহূর্তে তিনি ফারল্যান্ডের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন অর্থাৎ আমাদের সুশীল ও বিরুদ্ধবাদীদের ভাষায় ঞধপঃষবংং কাজটা করলেন। সেই ঞধপঃষবংং কাজটা না করলে গোলামির জিঞ্জিরটা আমরা আজও হয়তো পরে বসে থাকতাম।
এ জাতীয় ঞধপঃষবংং কাজটা আমরা শেখ হাসিনার মধ্যেও দেখলাম। বঙ্গবন্ধুকে সে জন্য সপরিবারে চরম মূল্য দিতে হয়েছে। শেখ হাসিনার বরাতে কী আছে জানি না, তবে স্রষ্টা অফুরন্ত মহিমা ও করুণা দিয়ে তাকে যেভাবে বাঁচিয়ে রাখছেন তাতে মনে হয় মহান স্রষ্টা শেখ হাসিনাকে কোনো না কোনো মহৎ কাজের জন্য বাঁচিয়ে রাখছেন।
বিরুদ্ধবাদীদের ঞধপঃষবংং কাজের সংজ্ঞাটা স্পষ্ট নয়। অনেকের মতে, শেখ হাসিনার পক্ষে অতীতে ঞধপঃভঁষ কাজ ছিল বিশ্বব্যাংকের ন্যায়-অন্যায়, সত্যি-মিথ্যা, মনগড়া সবকিছু মাথা পেতে নেওয়া কিংবা ড. ইউনূসকে আজীবন গ্রামীণ ব্যাংকের কর্তাব্যক্তি রাখা। বিশ্বব্যাংকের পর হিউম্যান রাইটস ওয়াচের বক্তব্য আরও স্পষ্ট করেছে যে, যুদ্ধাপরাধী ও বিডিআর বিদ্রোহীদের বিচারসহ সব ধরনের ন্যক্কারজনক ও ঘৃণ্য কাজগুলোকে প্রশ্রয় দেওয়া হবে ঞধপঃভঁষ বা কৌশলী পদক্ষেপ। এই কৌশলী পদক্ষেপ অন্তত বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা নিতে পারেন না; তাকে বাবার মতোই তথাকথিত ঞধপঃষবংং হতে হবে এবং তিনি পদ্মা সেতুর ব্যাপারে অনমনীয় অবস্থান নিয়ে এমনটিই করেছেন। আমরা আর কিছু না পারি তাকে প্রাণ খুলে দোয়া করছি আর তার সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করছি।
নিজ অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেওয়ার পর দুর্নীতির সংজ্ঞার হাত-পা গজাতে শুরু করেছে আর বিদগ্ধ সুশীল অর্থনীতিবিদরা এই পদক্ষেপের মধ্যেও জাতীয় বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন। মনে হচ্ছে, শেখ হাসিনা থাকতেও পারবেন না, যেতে চাইলে যেতেও পারবেন না, আর 'কী' করবেন তা জিজ্ঞাসিত হলে 'কী' করতেও নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হচ্ছেন। আমার ধারণা, তাদের কথা অনেক শোনা হয়েছে, আর শোনার প্রয়োজন নেই। তারা সরকারের ব্যর্থতার সমালোচনা করবেন, ভালো কাজের পরামর্শ দেবেন, কিন্তু ভালো কাজ হাতে নিতে গেলেও বাধা সৃষ্টি করবেন। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ প্রতিহত করে তারা এখন কচুগাছ কাটতে কাটতে ডাকাতে পরিণত হয়েছেন। এই ডাকাতদের ঠেকাতে হবে।
নিদ্বর্িধায় বলছি দেশের অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা অতিশয় সাহসী পদক্ষেপ। আমরা এই পদক্ষেপের সঙ্গে আছি। জ্বলে-পুড়ে ছারখার হতে রাজি আছি, তবুও মাথা নোয়াতে আমরা প্রস্তুত নই। তা আমরা বহুবার প্রমাণ করেছি। আবারও করব।
এ সেতু বানাতে কয়েক পর্বে প্রায় ২২,৫৫৪ কোটি টাকা প্রয়োজন। আমার ধারণা, পদ্মা সেতু নিজ অর্থেই নির্মাণ সম্ভব ও সঙ্গত। তাতে হয়তো বৈদেশিক মুদ্রার সংকট হতে পারে। আমরা ভুলে যাচ্ছি, আমাদের প্রায় এক কোটি শ্রমজীবী মানুষ বিদেশে চাকরি করছেন। পেশাজীবী ও ব্যবসায়ীও কম নন। তাদের দেশপ্রেম সুশীলদের চেয়ে কিংবা অনেক স্বঘোষিত দেশপ্রেমিকের চেয়ে অনেক বেশি। আমার ধারণা, জননেত্রী যদি বিদেশে কর্মরতদের কাছে একটি আহ্বান জানান তাহলে তারা বারো হাজার কোটি টাকা বিদেশ থেকে এ বছরই তুলে দেবেন। মাথাপিছু মাত্র ১৫০ ডলার আমাদের বিদেশে কর্মরত বন্ধুরা পাঠালেই তার সংস্থান হয়ে যাবে। এসব মানুষসহ গার্মেন্ট শিল্প আমার দেশটাকে বাঁচিয়ে রেখেছে আর তারা আমাদের 'জাতীয় বীর' কৃষকদের সন্তান ও সজ্জন। তারা নিশ্চয়ই জাতির এই ক্লান্তিলগ্নে এগিয়ে আসবেন।
ব্যবসায়ীদের দেশপ্রেমবিবর্জিত ভাবা একটি স্টাইলে পরিণত হয়ে গেছে। তাদের সঠিকভাবে প্রণোদিত করতে পারলে ও আস্থায় নিতে পারলে দেশীয় মুদ্রার বিশাল অংশ তাদের কাছ থেকে পাওয়া যাবে। ইতিমধ্যে শেখ কবিরের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশন ১১ হাজার কোটি টাকা পদ্মা সেতুতে বিনিয়োগের প্রস্তাব করেছে। আমার মতে, দেশের ব্যবসায়ী সম্প্রদায় আর একটু নিশ্চয়তা পেলে পিপিপির অধীনে বিনিয়োগে এগিয়ে আসবে। অপ্রদর্শিত অর্থের বিনিয়োগের ক্ষেত্রটা আর একটু সম্প্রসারিত করলে সুফল বৈ কুফল আসবে না। তবে বিনিয়োগকারীদের এনবিআরসহ অন্য কোনো সংস্থা বা এজেন্সির অনল থেকে রক্ষা করলে এক সেতু নয় বহু সেতুর টাকা আপনাআপনি চলে আসবে; হুন্ডি ব্যবসা বিলুপ্ত হবে। দেশি অর্থের বিদেশ গমন প্রয়াস প্রতিহত হবে। আমি ড. মশিউর রহমান সাহেবের কাছে পরামর্শ রেখেছিলাম যে, পদ্মা সেতুর বিনিয়োগে এনবিআর বা অন্যান্য সংস্থার প্রতিবন্ধকতা সম্পূর্ণ তুলে দিতে। তার আগ্রহে আমি এই পরামর্শ দিতে আবারও আগ্রহী হচ্ছি। আয়কর আইনে ১৯বি ধারাটা আরও একটু সম্পাদিত করেও কিন্তু পদ্মা সেতুর অর্থায়নের পথ সুগম করা সম্ভব। বাজেটে বরাদ্দকৃত অর্থ ও বন্ড ছেড়ে এই অর্থ সংগ্রহের পদক্ষেপ প্রশংসার যোগ্য। ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগের মতো অনুরূপ সুবিধা এখানে রাখলে ভালো হয়।
পদ্মা সেতু শুধু অর্থনৈতিক কারণে নয়, আমাদের জাতীয় মর্যাদা সংরক্ষণেও প্রয়োজন। কেউ কেউ বলছেন, দেশীয় সম্পদে সেতু নির্মিত হলে ব্যয় বেড়ে যাবে। তা যদি হয়ই, আমাদের আপত্তি থাকবে কেন, টাকাটা তো দেশেই থাকবে এবং দেশের মানুষই উপকৃত হবে। বিশ্বব্যাংকের ঋণের সুদ নগণ্য বলে চিহ্নিত করলেও তাদের পরামর্শক এবং আমলা-কামলাদের খাই-খাই ও বিবিধ ফরমায়েশ জোগান দিতে প্রকারান্তরে দেখা যাচ্ছে বিশ্বব্যাংকের দান-অনুদানের ৬০ ভাগই তাদের পেটে ফেরত যাবে।
আমার দুঃখ হয়, ষাটের দশকে এসব নিয়ে যারা বিশ্বব্যাংকের সমালোচনায় মুখর ছিলেন তারা কেমন করে আজ বিশ্বব্যাংকের বন্দনায় নেমেছেন অথবা মুখে কুলুপ এঁটে রয়েছেন। নাকি তারা এক ধরনের বৃদ্ধকাল সিনড্রোমে ভুগছেন। আমি একবার এক ব্যাংকে বেশ কিছু অতি সৎ ও সজ্জন ব্যক্তিকে নিয়োগ দিয়েছিলাম। তারা সবাই ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত। আমি এসব সজ্জন ব্যক্তির মাঝেও দুর্নীতি দেখে বিস্মিত হয়েছিলাম। পরে জেনেছি সারাজীবন সৎ থাকায় পরিবারের সদস্যদের খোঁচানিতে তারা জীবনের শেষ সুযোগটি কাজে লাগিয়েছেন। আমার মনে হচ্ছে, এই সিনড্রোম বিশ্বব্যাংকের পক্ষে ওকালতির পক্ষে কাজ করছে।
রাজনীতিবিদদের কথা বলব না। তারা নিজেরাই জানে দলের চেয়ে দেশ বড়, ব্যক্তির চেয়ে সংগঠন বড়। তাই আগামী নির্বাচন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের বিচারের ভার জনগণের হাতে ছেড়ে দিতে পারেন। অন্যান্য দেশের বিরোধী দলের মতো জাতীয় স্বার্থে হিমালয়সদৃশ একতা নিয়ে দাঁড়াতে আমরা সকলকে আহ্বান জানাব। আমরা যেন নিজের নাক কেটে আর পরের যাত্রা ভঙ্গের প্রয়াস না নেই এবং একটি দলের তথাকথিত দুর্নীতির কারণে সারা জাতিকে অহেতুক শূলে তুলে না দেই।
অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী শিক্ষাবিদ ও মুক্তিযোদ্ধা
No comments