সেই শিক্ষকরাই নতুন নামে আন্দোলনে-উপাচার্যের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ চার ঘণ্টা অবরোধ by ইমন রহমান

সকাল থেকেই শিক্ষার্থীরা গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি উপেক্ষা করে নির্ধারিত সময়ে যার যার বিভাগে উপস্থিত। কিছু ব্যাচের ক্লাস পরীক্ষা হচ্ছে আবার কিছু ব্যাচের শিক্ষার্থীরা ক্লাসের সময় কোর্স শিক্ষককে খুঁজে পাচ্ছেন না। কারণ ওই সময় শিক্ষকরা ব্যস্ত তাঁদের আন্দোলন নিয়ে। কেউ কেউ ক্লাসে এলেও হাজিরা নিয়েই চলে যাচ্ছেন।


গতকাল শনিবার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগ ঘুরে এমন চিত্রই দেখা গেছে। সাম্প্রতিককালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন চিত্র নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে গেছে বলে অভিযোগ করেছেন শিক্ষার্থীরা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, কখনো শিক্ষক সমাজ, কখনো সম্মিলিত শিক্ষক পরিষদ নামে শিক্ষকদের একটি অংশ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নানামুখী আন্দোলনে সক্রিয়। এর মধ্যে মিলেমিশে রয়েছেন বিএনপি-জামায়াতপন্থী ও আওয়ামী লীগপন্থী শিক্ষকদের একটি অংশ। তাঁরাই এখন আগামী ২০ জুলাইয়ের উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন স্থগিত করার দাবিতে আন্দোলনে নেমেছেন। গতকালও তাঁরা উপাচার্যের কার্যালয় চার ঘণ্টা অবরোধ করে রাখেন। অন্যদিকে তাঁদের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন সদ্য পদত্যাগী উপাচার্য ও প্রশাসনপন্থী শিক্ষকরা। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এখন একাধিক গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, জাতীয় রাজনীতির অংশ হিসেবে বিএনপি-জামায়াত, স্বাধীনতাবিরোধী ও সরকারবিরোধীদের একটি অংশ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ইন্ধন জোগাচ্ছেন এসব আন্দোলনে। বিশ্ববিদ্যালয়কে অস্থিতিশীল করার মধ্য দিয়ে সরকারকে বিব্রত করা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারপ্রক্রিয়া ব্যাহত করাই তাঁদের লক্ষ্য।
এদিকে গতকাল রাতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে সিন্ডিকেটের এক জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। রাত সাড়ে ৯টায় বৈঠক শেষে উপাচার্য ড. আনোয়ার হোসেন সাংবাদিকদের জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একাংশের আন্দোলনে শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ায় সিন্ডিকেট দুঃখ প্রকাশ করেছে। একই সঙ্গে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করার বিষয়টিকে স্বাগত জানানো হয়েছে। উপাচার্য ২০ জুলাইয়ের নির্বাচনের ব্যাপারে তাঁর অনড় মনোভাবের কথা জানিয়েছেন।
চার ঘণ্টা অবরুদ্ধ উপাচার্য : উপাচার্য নির্বাচনের আগে ডিন, সিনেট, সিন্ডিকেট ও জাকসু নির্বাচন দাবি করে সম্মিলিত শিক্ষক পরিষদের শিক্ষকরা গত বৃহস্পতিবার ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী গতকাল সকাল ১০টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত উপাচার্যের কার্যালয়ের সামনে অবরোধ ও সমাবেশ কর্মসূচি পালন করেন। প্রশাসনিক ভবনের প্রধান দুই ফটকে বেঞ্চ বসিয়ে অবরোধ পালন করেন তাঁরা। অবরোধ চলাকালে উপাচার্য অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন একটি সেমিনারে অংশ নিতে প্রশাসনিক ভবনের বাইরে যেতে চাইলে তাঁকে বাধা দেওয়া হয় এবং তাঁর সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন আন্দোলনকারী শিক্ষক অধ্যাপক আনোয়ারুল্লাহ ভুঁইয়া, অধ্যাপক রশিদ হারুন, আবু সাঈদ মো. মোস্তাফিজুর রহমান প্রমুখ। এ সময় উপাচার্যের সঙ্গে থাকা এক শিক্ষককে উপাচার্যের দালালসহ বিভিন্ন অশালীন ভাষায় গালাগাল করেন তাঁরা। বাধার কারণে বাইরে যেতে না পেরে উপাচার্য তাঁর কার্যালয়ে ফিরে যান। আন্দোলনকারীরা গতকাল অবরোধ পালন করলেও তাঁদের কর্মসূচিতে প্রশাসনিক ভবনের সামনে অবস্থান ও সমাবেশের কথা বলা হয়েছিল। এ বিষয়ে অধ্যাপক নাসিম আখতার হোসাইন বলেন, 'অবস্থান কর্মসূচির অর্থই হচ্ছে অবরোধ। উপাচার্য আমাদের গায়ের ওপর দিয়ে তো যেতে পারেন না।' উপাচার্য ড. আনোয়ার হোসেন তাঁর সঙ্গে আন্দোলনকারী কয়েকজন শিক্ষকের এই অসৌজন্যমূলক আচরণে ব্যথিত হয়েছেন বলে রাতে সিন্ডিকেট বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন।
অন্যদিকে নির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী আজ রবিবার ও আগামীকাল প্রশাসনিক ভবন অবরোধ, ১৭ ও ১৮ জুলাই কর্মবিরতিসহ ধর্মঘট এবং ১৯ জুলাই সকাল থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট ও অনশন করবে সম্মিলিত শিক্ষক পরিষদ।
উপাচার্য নির্বাচন ঠেকাতেই এত কিছু : এত দিন যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করেছেন এবং যাঁদের আন্দোলনের মুখে অধ্যাপক ড. শরীফ এনামুল কবিরকে উপাচার্যের পদ থেকে সরিয়ে দিয়েছে সরকার, তাঁরাই এখন উপাচার্য নির্বাচনের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন প্রশাসনপন্থী শিক্ষকরা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ কয়েক মাস ধরে বিএনপি-জামায়াত ও আওয়ামী লীগের একাংশ এবং বামপন্থী শিক্ষকরা সম্মিলিতভাবে আন্দোলন করছেন। অভিযোগ রয়েছে, এই আন্দোলনের নেপথ্যে রয়েছে আওয়ামীপন্থী কিছু শিক্ষকের উপাচার্য হওয়াসহ নানা রকম ক্ষমতার লোভ। এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের পদত্যাগী উপাচার্য অধ্যাপক ড. শরীফ এনামুল কবিরের বিরুদ্ধে শিক্ষক সমাজের ব্যানারে আন্দোলন চলে। শরীফ এনামুল কবিরের পদত্যাগের পর তাঁদের মধ্যে কেউ উপাচার্য হবেন- এমন আশাই ছিল আন্দোলনকারীদের। কিন্তু সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেনকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব দিলে ক্ষুব্ধ হন এই অংশটি। তাৎক্ষণিকভাবে তাঁরা এ নিয়োগ অনভিপ্রেত ও দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেন। এরপর নতুন করে তাঁরা আন্দোলন গড়ে তুলেছেন।
বর্তমানে নবগঠিত সম্মিলিত শিক্ষক পরিষদের ব্যানারে অধ্যাপক ড. এম এ মতিনের নেতৃত্বে চলছে উপাচার্য নির্বাচনবিরোধী আন্দোলন। অধ্যাপক মতিন বলেন, উপাচার্য অন্যান্য মেয়াদোত্তীর্ণ নির্বাচন না দিয়ে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সবার মত না নিয়ে এবং কারো সঙ্গে আলোচনা না করে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সব মতের শিক্ষকরা এ নির্বাচনের তারিখ প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি বলেন, 'আমরাও নির্বাচন চাই। তবে তা অন্যান্য নির্বাচনের পর।'
শিক্ষকদের এই অংশটির এমন দাবি বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ অনুযায়ী অযৌক্তিক বলে জানা গেছে। ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশের ১৯(২) ধারায় স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে, 'সদস্যদের মেয়াদ তিন বছর অথবা পরবর্তী নির্বাচিত সদস্যদের দায়িত্ব গ্রহণ পর্যন্ত।' কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশের কোনো তোয়াক্কা না করে দাবি আদায়ে মাঠে নেমেছে শিক্ষকদের এই অংশটি।
শিক্ষক সমাজই এখন সম্মিলিত শিক্ষক পরিষদ : সাবেক উপাচার্যের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী বিভিন্ন মতাদর্শের শিক্ষকদের সমন্বয়ে অধ্যাপক ড. নাসিম আখতারের নেতৃত্বে গঠিত শিক্ষক সমাজই এখন কেবল নেতৃত্বে পরিবর্তন এনে সম্মিলিত শিক্ষক পরিষদ নামে আত্মপ্রকাশ করেছে। গত ৭ জুলাই অধ্যাপক ড. এম এ মতিনকে আহ্বায়ক করে ২৩ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অন্যান্য সদস্যের মধ্যে রয়েছেন শিক্ষক সমাজের আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. নাসিম আখতার হোসাইন, জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরামের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. শামছুল আলম, অধ্যাপক ড. বদরুল আলম পাটোয়ারী, অধ্যাপক ড. কাঞ্চন চৌধুরী, অধ্যাপক ড. মোস্তফা ফিরোজ, অধ্যাপক ড. অজিত কুমার মজুমদার, অধ্যাপক ড. হারুন-অর-রশিদ, অধ্যাপক ড. মানস চৌধুরী, রায়হান রাইন প্রমুখ।
আন্দোলনের নেপথ্যে : আগামী ২০ জুলাই উপাচার্য নির্বাচন ঠেকাতে আন্দোলনের নেপথ্যে রয়েছে গত ২৯ জুনের সিনেটে তিন ক্যাটাগরির নির্বাচনে হার এবং উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনেও হারের সমূহ আশঙ্কা। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সিনেটর থেকে দুজন সিন্ডিকেট সদস্য, একজন বিশিষ্ট নাগরিক সিন্ডিকেট সদস্য ও একজন অর্থ কমিটির সদস্য- এই তিন ক্যাটাগরির নির্বাচনে বিপুল ব্যবধানে হেরে যায় প্রশাসনবিরোধী অংশ। হারার পর শিক্ষকদের এই অংশটি উপাচার্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে কিছু সিনেটরকে নিয়ে আপত্তি তোলে। উল্লেখ্য, সম্মিলিত শিক্ষক পরিষদের আহ্বায়ক অধ্যাপক এম এ মতিনের সিনেট সদস্যপদে রয়েছেন ১৪ বছর ধরে। ২০০১ সালে দুই শিক্ষক এনামুল্লাহ পারভেজ ও আবদুর রব নিস্তার হাইকোর্টে রিট করার কারণে দীর্ঘ সময় ধরে এ নির্বাচনপ্রক্রিয়া বন্ধ রয়েছে।
এ বিষয়ে প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. অসিত বরণ পাল বলেন, যাঁরা উপাচার্য নির্বাচনে বাধা দিচ্ছেন তাঁরা গত ২৯ জুন সিনেটে তিনটি ক্যাটাগরির নির্বাচনে অংশ নিয়ে হেরেছেন। ওই নির্বাচনের আগে কোনো আপত্তি তোলেননি তাঁরা। বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ মেনেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের গুটিকয়েক শিক্ষকের অযৌক্তিক দাবির মুখে নির্বাচন স্থগিত হতে পারে না।
উপাচার্য অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন বলেন, ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ অনুযায়ী আগামী ২০ জুলাই উপাচার্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কোনো অবস্থাতেই এ নির্বাচন স্থগিত করা হবে না। এ ছাড়া অন্যান্য নির্বাচনও পর্যায়ক্রমে অনুষ্ঠিত হবে। শিক্ষকদের একটি বড় অংশ নির্বাচনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। শিক্ষার্থীরাও নির্বাচন চান।
উপাচার্য বলেন, 'রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আমি দেখা করেছি। তিনি উপাচার্য নির্বাচনের তফসিল ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছেন। শিক্ষকদের যে অংশটি নির্বাচন স্থগিত করার দাবি করছেন, তাঁরাও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মঙ্গল চান। আশা করছি, তাঁরাও নির্বাচনে অংশ নেবেন।',

No comments

Powered by Blogger.