কুরোসাওয়ার জাপানে by হানিফ সিদ্দিকী

আবার জাপানে আসা। জাপানের তোইয়োহাশি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি অধ্যয়নের পাট চুকিয়েছি বছর আড়াই আগে। গবেষণার বিষয়বস্তু ওয়েব সিম্যান্টিকস; কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে কম্পিউটার যেন ইন্টারনেটের তথ্য বুঝতে পারে। কাজটা করেছি অধ্যাপক এম অয়োনোর অধীনে।


এরপর জাপান থেকে ফিরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা। আবারও জাপানের ডাকে পাড়ি জমানো।
কিছুদিন আগেই ঘটে গেছে প্রলয়। তীব্র ভূমিকম্প, সুনামি। মুষড়ে পড়া বিদ্যুতের পারমাণবিক চুলি্ল। ত্রিমুখী-প্রলয়-দেবতার তছনছ করা জাপান। শুনেছি কিছু জায়গায় তেজস্ক্রিয়তা দেখা দিয়েছে। তাই জাপানের মধুর কিছু পূর্বস্মৃতি আর কিছুটা দ্বিধা এবং ভয় নিয়েই দেশত্যাগ করেছি।
এয়ারপোর্টের নিরাপত্তা দরজা পার হয়ে এলাম। আমার ছাত্ররা দাঁড়ানো। সঙ্গে আরও একজন। বুঝতে দেরি হলো না 'জাপানি'। হাস্যরসে কথা চলছে। অল্প ইংরেজি আর অল্প জাপানি ভাষায়। আগের বারে সাড়ে পাঁচ বছর থাকার সুবাদে অল্পবিস্তর জাপানি ভাষা শিখে নিয়েছিলাম। অল্পবয়সী অধ্যাপকের সঙ্গে এক তরুণ জাপানির ভাঙা ভাঙা কথাবার্তা। মাঝে মধ্যে হাস্যরস। কোথা থেকে এসেছি। কেন এসেছি। তারপর জানলাম, সে এয়ারপোর্ট পুলিশ। ভাবতে অবাক লাগল, এতক্ষণ যার সঙ্গে কথা বললাম সে পুলিশ! ঘোর কাটতে না কাটতে বলল, 'সাবধানে যাবেন।' ঘোর কাটিয়ে ছোট করে ধন্যবাদ দিয়ে পা বাড়ালাম।
আড়াই বছর আগের কথা মনে পড়ল। কাজের চাপে সোমবার থেকে শুক্রবার পর্যন্ত ব্যস্ত থাকতে হয়। তাই প্রতিটি শনি-রোববার আমাদের কাছে উৎসবের মতো। হইহুল্লোড় আর বাঙালি আড্ডা। এ রকম এক শনিবারে আড্ডা দিয়ে বাসায় ফিরছি। রাত ১২টা পার হয়েছে। পরদিন আমরা কিছু বাঙালি কমলার বাগানে কমলা তুলতে যাব। খেতে পারব যত খুশি। আবার নির্দিষ্ট একটা ঝুড়ি ভর্তি করে তুলেও আনতে পারব। এটাকে জাপানিতে 'মিকানগারি' বলে। তাই তাড়াতাড়ি ঘুমাতে হবে। আমার জন্য নির্ধারিত জায়গায় গাড়ি পার্ক করতে যাব। পাশে স্ত্রী। তার নজরে পড়ল, কী যেন একটা পড়ে আছে। একটা পার্স, মেয়েদের। আমরা চিন্তায় পড়লাম। ব্যাগে হাতের ছাপ। এখন আবার ফেলে গেলে বিপদ। যদি কিছু খোয়া যায়। পুলিশের কাছে যেতে ভয়। আমাদের অভিজ্ঞতা সায় দেয় না। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে সিদ্ধান্ত নিলাম, পুলিশের কাছেই যাব।
রাত ১টা। দু-তিন কিলোমিটারের মধ্যেই পুলিশ ফাঁড়ি। গিয়ে ভাঙা ভাঙা জাপানিতে বোঝালাম। কথা প্রসঙ্গে বললাম, আমাদের তাড়া আছে। আগামী দিন মিকানগারিতে যাব। আমাদের বসতে বলে ভেতর থেকে একটা ফরম নিয়ে এলো আর এক ঝুড়ি কমলা। কাগজের লেখা শেষ করে আমাদের বুঝিয়ে বলতে লাগল। এক জায়গায় গিয়ে আঁতকে উঠলাম। টাকার প্রসঙ্গ। ভাবলাম, এবার বুঝি আমাকে টাকা দিতে হবে। আমি আর আমার স্ত্রী মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলাম। দুরু দুরু বুকে জিজ্ঞেস করলাম, আমাকে কি কোনো টাকা দিতে হবে? এবার সে হেসে উঠল। বলল, পার্সে যত টাকা বা টাকার সমতুল্য জিনিস আছে তার একটা নির্দিষ্ট শতাংশ পার্সওয়ালী আমাদের দেবে। আমরা যতই লাগবে না বলছি, ততই বোঝানোর চেষ্টা করছে যে এটা নিয়ম।
বিদায় নিয়ে এসে ঘুমিয়ে পড়েছি। দরজার খটখট শব্দে ঘুম ভাঙল। একজন ত্রিশোর্ধ্ব তরুণী দাঁড়িয়ে। হাতে সুন্দর নকশা করা খাম। অভিবাদন জানিয়ে পরিচয় দিতেই হাঁটু পর্যন্ত মাথা নিচু করে ধন্যবাদ জানিয়ে খামটা হাতে দিতে গেল। বুঝতে বাকি থাকল না। টাকার খাম। অনেক না-না করে হার মানতে হলো। কেননা তাকে পুলিশের কাছে রিপোর্ট করতে হবে। পুরো ব্যাপারটাই একটা সিস্টেম। এসব ভাবতে ভাবতে এয়ারপোর্ট স্টেশনে পেঁৗছে গেলাম।
এয়ারপোর্ট থেকে ট্রেনে উঠে তোইয়োহাশি শহরে রওনা হতে হয় দোতলা থেকে। যেতে যেতে মনে পড়ল আমাদের পণ্ডিত সত্যজিৎ রায়ের প্রিয় ব্যক্তিত্ব আকিরা কুরোসাওয়ার কথা। তার অনবদ্য সৃষ্টি" রাসমন। যার প্রথম পর্বে ধর্মযাজকের মুখ নিঃসৃত কয়েকটি কথা আমাকে আলোড়িত করে। "একজন মারা গিয়েছে... যুদ্ধ, ভূমিকম্প, বাতাস, আগুন, দুর্ভিক্ষ, পেল্গগ... বছরের পর বছর আসছে। সবই দুর্যোগ। পাহাড় থেকে প্রতি রাতে দস্যু নেমে আসে। আমি অনেক মানুষকে পোকার কামড়ে মরতে দেখেছি। ...এই একজনের মৃত্যু কী মর্মান্তিক। আমি শেষ পর্যন্ত মানুষের ওপর থেকে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছি। এটা দস্যুপনা, পেল্গগ, দুর্ভিক্ষ, আগুন এমনকি যুদ্ধের চেয়েও অধিকতর খারাপ। আমি প্রথমবার জাপানে এসেছি আমার এক শিক্ষাগুরুর সুপারিশে। তিনি প্রায়ই বলতেন এবং আমি নিজেও দেখেছি যে এখানে পাবলিক বাস চালায় একজনে আর কমিউটিং ট্রেন চালায় দু'জনে। তিনি বেশ কিছুদিন বাসে ভাড়া না দিয়েই নেমে যেতেন। একদিন এক জাপানিকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা তো ভাড়া না দিয়েই নেমে যেতে পার, কেউ তো কিছু বলবে না। জাপানি তার দিকে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, 'কেন ভাড়া না দিয়ে নামব?' একটি প্রশ্ন। তার পর থেকে কোনোদিন তিনি ভাড়া না দিয়ে নামতেন না। চিন্তা করতে করতে কখন যে তোইয়োহাশি পেঁৗছে গেছি খেয়াল করিনি।
সন্ধ্যায়ই একবার আমার প্রিয় গবেষণাগারে যেতে ইচ্ছা করল। আমার ঘর থেকে পাঁচ মিনিট হাঁটার পথ। ঢোকার পথে স্বয়ংক্রিয় দরজা। সবার জন্য একটা ম্যাগনেটিক কার্ড আছে। সেটা ব্যবহার করে যখন তখন বিল্ডিংয়ে ঢোকা যায়। বিল্ডিংয়ে ঢুকতেই নিঝুমপুরীতে হঠাৎ কে যেন আলো জ্বালিয়ে দিল। আট বছর আগে শুনেছিলাম, কীভাবে সেন্সর ব্যবহার করে বিদ্যুতের অপচয় রোধ করা যায়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা বিদ্যুতের কত অপচয় করি! জনমানবহীন বিল্ডিংগুলোর আলো কেমন করে নিঃসঙ্গ হতে হতে কুয়াশার জল নিয়ে কাঁদতে থাকে। এই সেন্সরগুলো কি আমাদের এক বছরের বিদ্যুতের চেয়ে বেশি দামি? আমার গবেষণাগার পাঁচতলায়। লিফটে উঠতে যাব, গায়ে লেখা, 'বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের জন্য সিঁড়ি ব্যবহার করুন'। আগে তো লেখা ছিল না!
জানতে পারলাম, পারমাণবিক সব চুলি্ল বন্ধ থাকায় গ্রীষ্মকালে তাদের বিদ্যুৎ ঘাটতি শতকরা পাঁচভাগ হতে পারে। যদিও আমি এখন পর্যন্ত এক সেকেন্ডের জন্য বিদ্যুৎ যেতে দেখিনি। কী তাদের এমনভাবে সচেতন করে তোলে?

ড. হানিফ সিদ্দিকী : সহযোগী অধ্যাপক, কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগ, চবি
mhsbd@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.