ফিরে দেখা-একাত্তরের বর্বরতা এবং পাকিস্তানের নতুন প্রজন্ম by সুভাষ সাহা
সে সময় পাকিস্তানের সাংবাদিকরা কী করেছিলেন_ এ প্রশ্ন তুলেছেন একজন। অপর একজন বলেছেন, পাকিস্তানের এ জন্য লজ্জিত হওয়া উচিত; বাঙালিদের কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত এবং ক্ষতিপূরণ দেওয়া উচিত একাত্তরে পাকিস্তান সেনাবাহিনী কীভাবে সিস্টেমেটিক হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, নির্যাতন ও ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর মাধ্যমে বাঙালি জাতির
স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে দমন করতে চেয়েছিল, তার লোমহর্ষক বিবরণ সে সময় পূর্ব পাকিস্তানে দায়িত্বে থাকা এক পাকিস্তানি জেনারেলের জবানীতেই প্রকাশ পেয়েছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চতুর্দশ ডিভিশনের কমান্ডার মেজর জেনারেল (অব.) খাদিম হুসাইন রাজার 'আ স্ট্রেঞ্জার ইন মাই ওন কান্ট্রি ইস্ট পাকিস্তান, ১৯৬৯-১৯৭১' নামক সদ্য প্রকাশিত বইটি একজন মর্মযাতনারত সেনা কর্মকর্তার সত্য ঘটনা প্রকাশের নিখাদ চেষ্টা। পাকিস্তানি জেনারেলদের এহেন জঘন্য চরিত্র উন্মোচিত হওয়ার পর দেশটির ইন্টারনেট প্রজন্ম লজ্জিত। দ্য এক্সপ্রেস ট্রিবিউনে বইটির ওপর খালেদ আহমদের পর্যালোচনা প্রকাশের পর তার ওপর মন্তব্য করতে গিয়ে প্রায় পাকিস্তানির মধ্যেই এক ধরনের অপরাধবোধ লক্ষ্য করা গেছে। এখনও পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের দেশে বিভিন্ন এলাকায়, বিশেষ করে বেলুচিস্তান ও অন্য পাহাড়ি এলাকায় অভিযান পরিচালনা করতে গিয়ে কী ধরনের নির্যাতন, হত্যা ও ধর্ষণের মতো অপরাধ সংঘটিত করছে, তারও উল্লেখ করেছেন কেউ কেউ।
আমরা জানি যে, বিভিন্ন সময়ে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী এবং এলিট শ্রেণী কীভাবে বাঙালিদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামকে স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছে। '৭০ সালে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হওয়ার পর বাঙালি জাতির অকুণ্ঠ সমর্থনপুষ্ট দল আওয়ামী লীগকে সরকার গঠন করতে না দেওয়ার কাহিনীও পুরনো। এমনকি একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলার সময় বাঙালিদের ওপর ইতিহাসের যে নিষ্ঠুরতম হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসযজ্ঞ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল_ সেটা আজ ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ। আমাদের মা-বোনদের ওপর নির্বিচারে ধর্ষণ ও হত্যার বিবরণ মসিলিপ্ত ইতিহাসে সংযোজিত। তবে, এ সবের জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কমান্ডিং অফিসারদের কার দায় কতখানি ছিল, তা নিয়ে বিতর্ক এখনও চলছে এবং আরও অনেক দিন ধরেই চলবে। পূর্ব পাকিস্তানে সে সময়ে দায়িত্বে থাকা পাকিস্তানি কোনো কমান্ডারের স্মৃতিকথা যখন প্রকাশ পায়, তখন স্বভাবতই অনুসন্ধিৎসু মন ব্যগ্র হয়ে ওঠে তা থেকে নতুন কোনো তথ্য পাওয়া যায় কি-না তা জানার জন্য। একাত্তরে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে দায়িত্বরত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চতুর্দশ ডিভিশনের মেজর জেনারেল (অব.) খাদিম হুসাইন রাজার অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে অতি সম্প্রতি প্রকাশিত বই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিষ্ঠুরতা, অত্যাচার-নির্যাতন ও বাঙালিদের সম্পর্কে নীচ ধারণা পোষণ করা সম্পর্কে পূর্ব ধারণাকে আরও দৃঢ় করবে। মৃত্যুর পরেই পরিবারের পক্ষ থেকে তার ইচ্ছা অনুযায়ী বইটি প্রকাশ করার ব্যবস্থা করা হয়। কেন তিনি বইটি জীবদ্দশায় প্রকাশ করতে যাননি_ সে সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন ধারণা থাকা স্বাভাবিক। সম্ভবত, সে সময়ে পূর্ব পাকিস্তানে কর্মরত অধিকাংশ সেনা কমান্ডারের জঘন্য ও মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের বিবরণ বইতে লিপিবদ্ধ থাকার কারণে এটি তিনি জীবৎকালে প্রকাশিত হোক_ চাননি। বিশেষ করে তিনি যে বাহিনীতে দীর্ঘ কর্মজীবন কাটিয়েছেন, সেই বাহিনীর কমান্ডাররা কী ধরনের ব্যভিচারী, বুদ্ধিতে খাটো ও অর্বাচীন হতে পারেন_ সে সম্পর্কে পাকিস্তানের নতুন প্রজন্ম জানার পর তাদের প্রতিক্রিয়া এই বাহিনী সম্পর্কে কতটা নেতিবাচক হবে, তা নিয়ে তিনি শঙ্কিত হয়ে থাকতে পারেন।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কোন কমান্ডার সে সময় কোন জেলায় গণহত্যার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং তারা কী ধরনের অপকর্মের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তার বিবরণ প্রকাশ পেয়েছে এ জেনারেলের বইয়ে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গোপনে পাকিস্তানে নিয়ে বন্দি করার পরিবর্তে জেনারেল টিক্কা তাকে ঢাকাতেই প্রকাশ্যে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করার পক্ষপাতী ছিলেন_ জেনারেল রাজার জবানী থেকে এই সত্য আমরা জানতে পারি। জেনারেল আইয়ুবের ক্ষমতা থেকে বিদায় নেওয়া, টিক্কার শাসনামল, জেনারেল ইয়াহিয়া এবং একাত্তরে কীভাবে জেনারেল নিয়াজি বাঙালি মহিলাদের গর্ভে পাকিস্তানি সৈন্যদের জারজ সন্তানের জন্ম দিয়ে বাঙালি জাতির নৃতাত্তি্বক বৈশিষ্ট্যকে পরিবর্তন করার মতো ঔদ্ধত্যপূর্ণ উক্তি করেছিলেন; সেটাও আমরা এই বইয়ে স্পষ্টভাবেই পাই। বাংলাকে বাদ দিয়ে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা আর বাঙালির নৃতাত্তি্ব্বক বৈশিষ্ট্য পরিবর্তনে জেনারেলদের হুঙ্কার একই উদ্দেশ্যতাড়িত নয় কি? তবে, জেনারেল ইয়াকুবের ইয়াহিয়াকে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বন্ধ করার পরিবর্তে অনুষ্ঠানের পরামর্শ আগ্রহোদ্দীপক। ইয়াকুবের মতো প্রেগমেটিভ জেনারেলের উপস্থিতি তখনকার পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর হাইয়ার্কিতে একেবারেই নগণ্য ছিল।
স্বভাবতই জেনারেল খাদিম রাজার 'ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট' এই অকপট স্বীকারোক্তি পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষের অস্বস্তির কারণ হয়ে থাকবে। সে কারণেই বইটি প্রকাশনা বন্ধের চেষ্টা থেকে শুরু করে এটি বাজার থেকে তুলে নেওয়া বা নিষিদ্ধ করার চেষ্টা জোরদার হচ্ছে। তবে সত্যকে এতদিন গোপন রাখার দায়ও পাকিস্তান সামরিক বাহিনী ও এলিট শ্রেণীর ঘাড়েই বর্তাচ্ছে।
পাকিস্তানের মানুষের প্রতিক্রিয়া অনেকটা পাকিস্তানের 'দ্য এক্সপ্রেস ট্রিবিউন' পত্রিকায় প্রকাশিত জেনারেলের বইটি সম্পর্কে খালিদ আহমেদের পর্যালোচনামূলক লেখার ওপর করা মন্তব্য থেকে আঁচ করা যায়। বাবলু নামে একজন একাত্তরে পাকিস্তানি বর্বরতাকে উপমহাদেশের দ্বিতীয় গণহত্যা বলে অভিহিত করেছেন। আরেকজন এ ঘটনায় একজন পাকিস্তানি হিসেবে তিনি লজ্জিত বলে উল্লেখ করেছেন। জিম বইটির ওপর সারগর্ভ পর্যালোচনা প্রকাশের জন্য খালেদকে ধন্যবাদ দিয়েছেন। চুদ্ধি নামে একজন বলেছেন, নিয়াজি একজন দুশ্চরিত্রের লোক হিসেবে পরিচিত। তার বাড়াবাড়ি সবার জানা। তবে, বেলুচিস্তানেও নিয়াজির মতো লোক কর্মরত রয়েছেন কিনা, সেটা নিউজ হতে পারে। ফারাজ বলেছেন, নিয়াজির মন্তব্য জঘন্য। বাঙালিরা স্বাধীনতা পাওয়ার যোগ্য। আরেকজনের মত হলো, পাকিস্তানি সেনা কমান্ডাররা তাড়াতাড়ি এর সমাধান চেয়েছিলেন। কিন্তু সমাধান আসলে তাড়াতাড়ি হওয়ার ছিল না। আরেকজন বলেছেন, হামুদুর রহমান কমিশন রিপোর্টেই পাকিস্তানের সেনা কমান্ডারদের অনেক অপকর্মের বিবরণ রয়েছে। আরেক পাকিস্তানির মন্তব্যা_ ৪১ বছর পর দেখা যাচ্ছে, বাঙালিরা আমাদের থেকে অর্থনৈতিকভাবে অনেক এগিয়ে গেছে। এখন আমরাই মনে করতে পারি যে, আমাদের নিজেদেরই মঙ্গলের জন্য জেনেটিক পরিবর্তন দরকার! আরেকজন তার দেশের নামে বাঙালিদের ওপর যে অত্যাচার-নির্র্যাতন চালানো হয়, তা ক্ষমা করে দেওয়ার জন্য বাঙালি ভাই-বোনদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। রিয়াজ খান বইয়ের পর্যালোচনায় পাকিস্তানের আসল কুৎসিত চেহারা তুলে ধরার জন্য লেখককে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, তিনি পাকিস্তানের নাগরিক হিসেবে পরিচয় দিতে লজ্জাবোধ করছেন। আরেকজন বলেছেন, পাকিস্তান এ জন্য ভারতকে দোষারোপ করে, কিন্তু নিজেদের দোষ দেখতে পায় না। এই বই অনেক সত্যকে সামনে নিয়ে এসেছে বলে তিনি মন্তব্য করেন। আরিফ লিখেছেন, এই বই থেকে পাকিস্তানের বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিজেদের অতীত সম্পর্কে অনেক কিছুই জানতে পারবে। আরেকজন বলেছেন, বইটি বাঙালিরা না পড়লেই ভালো। কারণ, তাতে একজন পাকিস্তানি হিসেবে তিনি দ্বিতীয়বার লজ্জিত হবেন। আরেকজনের মতে, উচ্চ পর্যায়ের কিছু লোক যে কোনো জাতির কতটা ক্ষতি করতে পারে_ তার প্রমাণ পাওয়া যায় এতে। খুররম একে বর্ণনা করেছেন লজ্জাজনক ঘটনার বিবরণ হিসেবে। সে সময় পাকিস্তানের সাংবাদিকরা কী করেছিলেন_ এ প্রশ্ন তুলেছেন একজন। অপর একজন বলেছেন, পাকিস্তানের এ জন্য লজ্জিত হওয়া উচিত; বাঙালিদের কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত এবং ক্ষতিপূরণ দেওয়া উচিত।
পাকিস্তানের মানুষের এ ধরনের সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়ার বিষয় আগেই আঁচ করা গিয়েছিল বলেই কি সেখানকার বহুল প্রচারিত পত্রিকাগুলো বইটির ওপর পর্যালোচনা ছাপতে কুণ্ঠিত? নাকি এ ব্যাপারে সামরিক বাহিনী ও এলিট শ্রেণীর কাছ থেকে কোনো চাপ রয়েছে তাদের ওপর? তবে, জেনারেল খাদিম হুসাইন রাজার বই সম্পর্কে বিস্তারিত প্রকাশ করলে পাকিস্তানের মিডিয়া ইতিহাসের দায় থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি পেতে পারে। জেনারেল খাদিমের এই আত্মোপলব্ধি পাকিস্তানের শাসক শ্রেণীর মধ্যে জাগ্রত করা তাদের দেশ ও জাতির স্বার্থেই প্রয়োজন। তবে, বাঙালি জাতি এ বই থেকে অবশ্যই নিজেদের বিশ্বাসে আরও স্থিত হওয়ার প্রেরণা পাবে।
সুভাষ সাহা :সাংবাদিক
আমরা জানি যে, বিভিন্ন সময়ে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী এবং এলিট শ্রেণী কীভাবে বাঙালিদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামকে স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছে। '৭০ সালে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হওয়ার পর বাঙালি জাতির অকুণ্ঠ সমর্থনপুষ্ট দল আওয়ামী লীগকে সরকার গঠন করতে না দেওয়ার কাহিনীও পুরনো। এমনকি একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলার সময় বাঙালিদের ওপর ইতিহাসের যে নিষ্ঠুরতম হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসযজ্ঞ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল_ সেটা আজ ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ। আমাদের মা-বোনদের ওপর নির্বিচারে ধর্ষণ ও হত্যার বিবরণ মসিলিপ্ত ইতিহাসে সংযোজিত। তবে, এ সবের জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কমান্ডিং অফিসারদের কার দায় কতখানি ছিল, তা নিয়ে বিতর্ক এখনও চলছে এবং আরও অনেক দিন ধরেই চলবে। পূর্ব পাকিস্তানে সে সময়ে দায়িত্বে থাকা পাকিস্তানি কোনো কমান্ডারের স্মৃতিকথা যখন প্রকাশ পায়, তখন স্বভাবতই অনুসন্ধিৎসু মন ব্যগ্র হয়ে ওঠে তা থেকে নতুন কোনো তথ্য পাওয়া যায় কি-না তা জানার জন্য। একাত্তরে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে দায়িত্বরত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চতুর্দশ ডিভিশনের মেজর জেনারেল (অব.) খাদিম হুসাইন রাজার অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে অতি সম্প্রতি প্রকাশিত বই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিষ্ঠুরতা, অত্যাচার-নির্যাতন ও বাঙালিদের সম্পর্কে নীচ ধারণা পোষণ করা সম্পর্কে পূর্ব ধারণাকে আরও দৃঢ় করবে। মৃত্যুর পরেই পরিবারের পক্ষ থেকে তার ইচ্ছা অনুযায়ী বইটি প্রকাশ করার ব্যবস্থা করা হয়। কেন তিনি বইটি জীবদ্দশায় প্রকাশ করতে যাননি_ সে সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন ধারণা থাকা স্বাভাবিক। সম্ভবত, সে সময়ে পূর্ব পাকিস্তানে কর্মরত অধিকাংশ সেনা কমান্ডারের জঘন্য ও মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের বিবরণ বইতে লিপিবদ্ধ থাকার কারণে এটি তিনি জীবৎকালে প্রকাশিত হোক_ চাননি। বিশেষ করে তিনি যে বাহিনীতে দীর্ঘ কর্মজীবন কাটিয়েছেন, সেই বাহিনীর কমান্ডাররা কী ধরনের ব্যভিচারী, বুদ্ধিতে খাটো ও অর্বাচীন হতে পারেন_ সে সম্পর্কে পাকিস্তানের নতুন প্রজন্ম জানার পর তাদের প্রতিক্রিয়া এই বাহিনী সম্পর্কে কতটা নেতিবাচক হবে, তা নিয়ে তিনি শঙ্কিত হয়ে থাকতে পারেন।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কোন কমান্ডার সে সময় কোন জেলায় গণহত্যার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং তারা কী ধরনের অপকর্মের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তার বিবরণ প্রকাশ পেয়েছে এ জেনারেলের বইয়ে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গোপনে পাকিস্তানে নিয়ে বন্দি করার পরিবর্তে জেনারেল টিক্কা তাকে ঢাকাতেই প্রকাশ্যে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করার পক্ষপাতী ছিলেন_ জেনারেল রাজার জবানী থেকে এই সত্য আমরা জানতে পারি। জেনারেল আইয়ুবের ক্ষমতা থেকে বিদায় নেওয়া, টিক্কার শাসনামল, জেনারেল ইয়াহিয়া এবং একাত্তরে কীভাবে জেনারেল নিয়াজি বাঙালি মহিলাদের গর্ভে পাকিস্তানি সৈন্যদের জারজ সন্তানের জন্ম দিয়ে বাঙালি জাতির নৃতাত্তি্বক বৈশিষ্ট্যকে পরিবর্তন করার মতো ঔদ্ধত্যপূর্ণ উক্তি করেছিলেন; সেটাও আমরা এই বইয়ে স্পষ্টভাবেই পাই। বাংলাকে বাদ দিয়ে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা আর বাঙালির নৃতাত্তি্ব্বক বৈশিষ্ট্য পরিবর্তনে জেনারেলদের হুঙ্কার একই উদ্দেশ্যতাড়িত নয় কি? তবে, জেনারেল ইয়াকুবের ইয়াহিয়াকে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বন্ধ করার পরিবর্তে অনুষ্ঠানের পরামর্শ আগ্রহোদ্দীপক। ইয়াকুবের মতো প্রেগমেটিভ জেনারেলের উপস্থিতি তখনকার পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর হাইয়ার্কিতে একেবারেই নগণ্য ছিল।
স্বভাবতই জেনারেল খাদিম রাজার 'ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট' এই অকপট স্বীকারোক্তি পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষের অস্বস্তির কারণ হয়ে থাকবে। সে কারণেই বইটি প্রকাশনা বন্ধের চেষ্টা থেকে শুরু করে এটি বাজার থেকে তুলে নেওয়া বা নিষিদ্ধ করার চেষ্টা জোরদার হচ্ছে। তবে সত্যকে এতদিন গোপন রাখার দায়ও পাকিস্তান সামরিক বাহিনী ও এলিট শ্রেণীর ঘাড়েই বর্তাচ্ছে।
পাকিস্তানের মানুষের প্রতিক্রিয়া অনেকটা পাকিস্তানের 'দ্য এক্সপ্রেস ট্রিবিউন' পত্রিকায় প্রকাশিত জেনারেলের বইটি সম্পর্কে খালিদ আহমেদের পর্যালোচনামূলক লেখার ওপর করা মন্তব্য থেকে আঁচ করা যায়। বাবলু নামে একজন একাত্তরে পাকিস্তানি বর্বরতাকে উপমহাদেশের দ্বিতীয় গণহত্যা বলে অভিহিত করেছেন। আরেকজন এ ঘটনায় একজন পাকিস্তানি হিসেবে তিনি লজ্জিত বলে উল্লেখ করেছেন। জিম বইটির ওপর সারগর্ভ পর্যালোচনা প্রকাশের জন্য খালেদকে ধন্যবাদ দিয়েছেন। চুদ্ধি নামে একজন বলেছেন, নিয়াজি একজন দুশ্চরিত্রের লোক হিসেবে পরিচিত। তার বাড়াবাড়ি সবার জানা। তবে, বেলুচিস্তানেও নিয়াজির মতো লোক কর্মরত রয়েছেন কিনা, সেটা নিউজ হতে পারে। ফারাজ বলেছেন, নিয়াজির মন্তব্য জঘন্য। বাঙালিরা স্বাধীনতা পাওয়ার যোগ্য। আরেকজনের মত হলো, পাকিস্তানি সেনা কমান্ডাররা তাড়াতাড়ি এর সমাধান চেয়েছিলেন। কিন্তু সমাধান আসলে তাড়াতাড়ি হওয়ার ছিল না। আরেকজন বলেছেন, হামুদুর রহমান কমিশন রিপোর্টেই পাকিস্তানের সেনা কমান্ডারদের অনেক অপকর্মের বিবরণ রয়েছে। আরেক পাকিস্তানির মন্তব্যা_ ৪১ বছর পর দেখা যাচ্ছে, বাঙালিরা আমাদের থেকে অর্থনৈতিকভাবে অনেক এগিয়ে গেছে। এখন আমরাই মনে করতে পারি যে, আমাদের নিজেদেরই মঙ্গলের জন্য জেনেটিক পরিবর্তন দরকার! আরেকজন তার দেশের নামে বাঙালিদের ওপর যে অত্যাচার-নির্র্যাতন চালানো হয়, তা ক্ষমা করে দেওয়ার জন্য বাঙালি ভাই-বোনদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। রিয়াজ খান বইয়ের পর্যালোচনায় পাকিস্তানের আসল কুৎসিত চেহারা তুলে ধরার জন্য লেখককে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, তিনি পাকিস্তানের নাগরিক হিসেবে পরিচয় দিতে লজ্জাবোধ করছেন। আরেকজন বলেছেন, পাকিস্তান এ জন্য ভারতকে দোষারোপ করে, কিন্তু নিজেদের দোষ দেখতে পায় না। এই বই অনেক সত্যকে সামনে নিয়ে এসেছে বলে তিনি মন্তব্য করেন। আরিফ লিখেছেন, এই বই থেকে পাকিস্তানের বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিজেদের অতীত সম্পর্কে অনেক কিছুই জানতে পারবে। আরেকজন বলেছেন, বইটি বাঙালিরা না পড়লেই ভালো। কারণ, তাতে একজন পাকিস্তানি হিসেবে তিনি দ্বিতীয়বার লজ্জিত হবেন। আরেকজনের মতে, উচ্চ পর্যায়ের কিছু লোক যে কোনো জাতির কতটা ক্ষতি করতে পারে_ তার প্রমাণ পাওয়া যায় এতে। খুররম একে বর্ণনা করেছেন লজ্জাজনক ঘটনার বিবরণ হিসেবে। সে সময় পাকিস্তানের সাংবাদিকরা কী করেছিলেন_ এ প্রশ্ন তুলেছেন একজন। অপর একজন বলেছেন, পাকিস্তানের এ জন্য লজ্জিত হওয়া উচিত; বাঙালিদের কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত এবং ক্ষতিপূরণ দেওয়া উচিত।
পাকিস্তানের মানুষের এ ধরনের সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়ার বিষয় আগেই আঁচ করা গিয়েছিল বলেই কি সেখানকার বহুল প্রচারিত পত্রিকাগুলো বইটির ওপর পর্যালোচনা ছাপতে কুণ্ঠিত? নাকি এ ব্যাপারে সামরিক বাহিনী ও এলিট শ্রেণীর কাছ থেকে কোনো চাপ রয়েছে তাদের ওপর? তবে, জেনারেল খাদিম হুসাইন রাজার বই সম্পর্কে বিস্তারিত প্রকাশ করলে পাকিস্তানের মিডিয়া ইতিহাসের দায় থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি পেতে পারে। জেনারেল খাদিমের এই আত্মোপলব্ধি পাকিস্তানের শাসক শ্রেণীর মধ্যে জাগ্রত করা তাদের দেশ ও জাতির স্বার্থেই প্রয়োজন। তবে, বাঙালি জাতি এ বই থেকে অবশ্যই নিজেদের বিশ্বাসে আরও স্থিত হওয়ার প্রেরণা পাবে।
সুভাষ সাহা :সাংবাদিক
No comments