অনুমতি ছাড়াই মামলার ক্ষমতা পাচ্ছে দুদক by আহমেদ দীপু
প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা করার জন্য সরকারের আর আগাম অনুমোদনের প্রয়োজন হবে না। তদন্তে দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হলে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সরাসরি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বা কর্মচারীর বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দিতে পারবে। নতুন এই বিধান সংযোজন করে দুদক আইন চূড়ান্ত করা হচ্ছে। আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি আগামী সপ্তাহে আইনটি চূড়ান্ত করার কাজে হাত দেবে।
এদিকে দুর্নীতি দমন কমিশন আইনে নতুন এ বিধান চূড়ান্ত করা নিয়ে জনপ্রশাসনে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। কর্মকর্তাদের মতে, এ ধরনের আইন করা হলে সরকারি কাজের গতি আরো কমবে। বিশেষ করে উন্নয়ন প্রকল্পের গতি ভীষণভাবে ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
দুদক আইন প্রসঙ্গে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হলে মামলা দায়েরের জন্য প্রধানমন্ত্রীর আগাম অনুমোদনের প্রয়োজন হবে না। দুদক সরাসরি অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করতে পারবে। তবে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির অভিযোগে কারো বিরুদ্ধে মামলা করতে হলে প্রধানমন্ত্রীর আগাম অনুমোদন নিতে হবে। মন্ত্রী বলেন, 'এই বিধান যুক্ত করে আইনটি সংশোধনের বিষয়ে আমরা প্রাথমিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি। সংসদীয় কমিটি এ বিষয়ে কাজ করে যাচ্ছে। দুদকের সচিব নিয়োগসহ অন্যান্য বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি চূড়ান্ত করবে।' তবে এ জন্য আইনটি ফের অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিসভায় উপস্থাপনের প্রয়োজন নেই বলে তিনি উল্লেখ করেন।
আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত কালের কণ্ঠকে বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশন (সংশোধন) আইন-২০১১ চূড়ান্ত করার জন্য আগামী ১৩ অক্টোবর সংসদীয় কমিটি বৈঠকে বসবে। ওই দিন থেকে বিলটি চূড়ান্ত করার কাজ শুরু হবে। বিলে কোনো পরিবর্তন আনা হবে
কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, পরিবর্তন তো হবেই। তবে কী ধরনের পরিবর্তন আনা হবে তা এখনই বলা সম্ভব নয়। বিলের একটি ধারা নিয়ে সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে_এ বিষয়ে কমিটির অবস্থান সম্পর্কে তিনি বলেন, ক্ষোভ রয়েছে বলেই বিলটি নিয়ে এত আলোচনা হচ্ছে। শুধু ক্ষোভের বিষয় নয়, দুদককে একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড় করানোর জন্য যেটা প্রয়োজন, সেটাই করা হবে।
চলতি বছরের প্রথম দিকে সরকার দুর্নীতি দমন কমিশন আইন সংশোধনের জন্য একটি খসড়া মন্ত্রিসভায় উপস্থাপন করে। বৈঠকে খসড়াটি অনুমোদনও দেওয়া হয়। ওই অনুমোদিত সংশোধিত আইনের খসড়া অনুযায়ী সরকারের ''পূর্বানুমোদন ছাড়া সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, জজ ও ম্যাজিস্ট্রেটের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কোনো মামলা করতে পারবে না। সরকারি কর্মচারী, জজ ও ম্যাজিস্ট্রেটের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে 'ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা ১৯৭-এর বিধান আবশ্যিকভাবে প্রতিপালন করতে হবে।' ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯৭ ধারায় বলা রয়েছে, সরকারের পূর্বানুমতি ছাড়া কোনো আদালত সরকারি কর্মচারী, জজ ও ম্যাজিস্ট্রেটের বিরুদ্ধে কোনো অপরাধ বিচারের জন্য আমলে নিতে পারবেন না।'' আইনের এ ধারাগুলো সংশোধন করা হচ্ছে।
কমিশন সূত্রে জানা গেছে, সংশোধনের নামে আইনটি দুর্বল করে ফেলা হয়েছে। এতে স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশনের ক্ষমতাও খর্ব করা হয়েছে। বিশেষ করে সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো ক্ষমতাই সরাসরি কমিশনের হাতে রাখা হয়নি। কর্মকর্তা, বিচারক, ম্যাজিস্ট্রেটদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে আগাম অনুমোদন নিতে হবে।
এ খসড়ায় অনুমোদন দেওয়ার পর থেকেই মূলত সরকার চাপের মধ্যে আছে। কমিশনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য উন্নয়ন সহযোগীসহ স্থানীয় সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরাও নানাভাবে চাপ সৃষ্টি করে চলেছেন। উন্নয়ন সহযোগীদের জোট হিসেবে পরিচিত লোকাল কনসালটেটিভ গ্রুপ (এলসিজি) গত মার্চ মাসে সরকারকে দেওয়া একটি চিঠিতে দুদকের ক্ষমতা হ্রাসের বিষয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করে। তাদের মতে, দুর্নীতি দমন কমিশনের ক্ষমতা কমে গেলে দুর্নীতি প্রতিরোধের কার্যক্রমে ভাটা পড়ে যাবে। বাংলাদেশের উন্নয়নের স্বার্থেই দুর্নীতি রোধের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা প্রয়োজন। এ জন্য কমিশনকে শক্তিশালী করার পক্ষে তারা মত দেয়। উল্লেখ্য, অর্থসচিব, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব এবং ঢাকাভিত্তিক দ্বিপক্ষীয় উন্নয়ন সহযোগী, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ও জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থাসহ ৩৯টি সংস্থা নিয়ে এলসিজি গঠিত।
এ ছাড়া ঢাকায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত স্টিফেন ফ্রোয়েন গত মে মাসে ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে দুদকের ক্ষমতা খর্ব করার বিষয়ে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন। তিনি বলেন, দুদককে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত একটি নিরপেক্ষ সংস্থা হতে হবে। উন্নয়ন সহযোগীদের পাশাপাশি দেশের সুশীল সমাজও দুর্নীতি দমন কমিশনকে স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষমতা দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে আসছে। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত দুদক আইনের খসড়াটি সংসদে পাস না করে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠায়। পাশাপাশি দুদককে কার্যকর করার জন্য এ-সংক্রান্ত আইনে আর কী কী বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা যায় সে বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য অর্থমন্ত্রী ও আইনমন্ত্রীকে দায়িত্ব দেন খোদ প্রধানমন্ত্রী। অর্থমন্ত্রী ও আইনমন্ত্রী সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করে নতুন সংশোধনীটি সংসদীয় কমিটির কাছে পেশ করেন। কমিটি এখন সেই সংশোধনীর আলোকে কাজ করছে বলে জানা গেছে।
নতুন সংশোধনী অনুযায়ী, তদন্তে দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হলে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের বিরুদ্ধে সরাসরি মামলা করা যাবে_এই খবরে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়েছে জনপ্রশাসনে। এর আগে দুদক আইনের খসড়া কর্মকর্তারাই তৈরি করেছিলেন। তাতে দুর্নীতি থেকে নিজেদের ধরাছোঁয়ার বাইরে রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছিল। এ জন্য ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা ১৯৭-এর বিধান প্রতিপালনের বিষয়ে আইনে বাধ্যবাধকতাও আরোপ করা হয়েছিল। কিন্তু নতুন সংশোধনীতে সেই সুরক্ষা উঠে যাওয়ায় কর্মকর্তারা অসন্তুষ্ট।
এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন সচিব কালের কণ্ঠকে বলেন, 'শুধু একজন কর্মকর্তা নন, দেশের একজন নাগরিক হিসেবে সরকার যে আইন করবে, তা মেনে চলতে আমরা বাধ্য। কিন্তু নতুনভাবে সংশোধিত আইনটি কার্যকর হলে সরকারের কাজে গতি থাকবে না। কর্মকর্তারা কাজ করতে ভয় পাবেন। গুরুত্বপূর্ণ ফাইলে সহজে সিদ্ধান্ত দিতে চাইবেন না। এতে কাজের গতি কমে যাবে।' তিনি বলেন, এ আইনে কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত এবং প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি দুই ভাবে দেখানো হয়েছে। এভাবে দুর্নীতি চিহ্নিত করা নিয়েও সমস্যা দেখা দেবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
যুগ্ম সচিব পর্যায়ের আরেক কর্মকর্তা বলেন, 'আমরা সরকারি চাকরি করি। আমাদের সব কাজ সরকারের উদ্দেশ্যেই করা। এখানে ব্যক্তিগত কাজ এবং প্রাতিষ্ঠানিক কাজের কথা উল্লেখ করে সরকার কাদের বিরুদ্ধে কী করতে যাচ্ছে, সে বিষয়টিও বিবেচনায় নেওয়া উচিত।'
উল্লেখ্য, কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত দুর্নীতি বলতে ছোটোখাট ক্রয়, কাজ না করে উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থ আত্মসাৎ, কাজ শেষ হওয়ার আগে অথবা শেষ হওয়ার পর কাজের মান বিবেচনা না করে ঠিকাদারদের অর্থ পরিশোধ করাকে কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত দুর্নীতি হিসেবে দেখানো হয়েছে। আর বড় বড় চুক্তি, অন্য কোনো দেশের সঙ্গে চুক্তি, বিদেশি কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি বা তাদের কাছ থেকে কোনো কিছু কেনা বা কেনার অনুমোদনসহ সংশ্লিষ্ট কাজের ক্ষেত্রে অনিয়ম হয়ে থাকলে তাকে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি হিসেবে দেখানো হয়েছে বলে জানা গেছে।
প্রস্তাবিত আইনে মিথ্যা তথ্য প্রদানের জন্য শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। দুদক আইনের ২৮ (গ) ধারায় সংশোধনী এনে বলা হয়েছে, মিথ্যা তথ্যপ্রদানকারীকে কমপক্ষে দুই বছর, অনধিক পাঁচ বছর সশ্রম কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড দেওয়া যাবে। দুদকের বা সরকারি কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী যদি মিথ্যা তথ্য প্রদান করেন, তাঁর বিরুদ্ধেও বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের প্রস্তাব করা হয়েছে।
খসড়ায় দুদকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে দুদক আইনের অধীন অপরাধ তদন্তের ক্ষেত্রেও সংশোধনী আনা হয়েছে। এতে উল্লেখ করা হয়েছে, কমিশন নিজে তাঁদের অপরাধ তদন্ত করতে পারবে না। দুদক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অপরাধ তদন্তের দায়িত্ব পুলিশ বা অন্য কোনো সংস্থাকে দিতে হবে। দুদক সরকারি গেজেট প্রজ্ঞাপন দিয়ে পুলিশ বা অন্য কোনো সংস্থাকে ক্ষমতা অর্পণ করতে পারবে।
তদন্তের সময়সীমা সম্পর্কে প্রস্তাবিত বিলে বলা হয়েছে, ক্ষমতাপ্রাপ্তির তারিখ থেকে অনধিক ১২০ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্তকারী কর্মকর্তাকে এই আইন ও তফসিলের উলি্লখিত তদন্ত কাজ সম্পন্ন করতে হবে। তবে ১২০ দিনের মধ্যে তদন্ত শেষ করা সম্ভব না হলে তদন্তকারী কর্মকর্তা সময়সীমা বৃদ্ধির জন্য কমিশনের কাছে আবেদন করতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে কমিশন আরো অনধিক ৬০ কর্মদিবস সময় বাড়াতে পারবে। বর্ধিত সময়ের মধ্যেও যৌক্তিক কারণ ছাড়া তদন্ত শেষ করতে ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণের বিধান রাখা হয়েছে। তদন্ত চলাকালে সরকার বা সরকারের অধীনস্থ কোনো কর্তৃপক্ষ বা সংস্থা থেকে যেকোনো প্রতিবেদন বা তথ্য তদন্তকারী কর্মকর্তা চাইতে পারবেন। বিশেষজ্ঞদেরও সহায়তা চাইতে পারবেন তিনি। তথ্য না দিলেও দুদক কর্মকর্তা নিজ উদ্যোগে সংশ্লিষ্ট অভিযোগের অনুসন্ধান বা তদন্ত সম্পন্ন করতে পারবেন। তথ্যপ্রদানকারীর পরিচয় গোপন রাখা হবে।
দুদক আইন প্রসঙ্গে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হলে মামলা দায়েরের জন্য প্রধানমন্ত্রীর আগাম অনুমোদনের প্রয়োজন হবে না। দুদক সরাসরি অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করতে পারবে। তবে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির অভিযোগে কারো বিরুদ্ধে মামলা করতে হলে প্রধানমন্ত্রীর আগাম অনুমোদন নিতে হবে। মন্ত্রী বলেন, 'এই বিধান যুক্ত করে আইনটি সংশোধনের বিষয়ে আমরা প্রাথমিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি। সংসদীয় কমিটি এ বিষয়ে কাজ করে যাচ্ছে। দুদকের সচিব নিয়োগসহ অন্যান্য বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি চূড়ান্ত করবে।' তবে এ জন্য আইনটি ফের অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিসভায় উপস্থাপনের প্রয়োজন নেই বলে তিনি উল্লেখ করেন।
আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত কালের কণ্ঠকে বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশন (সংশোধন) আইন-২০১১ চূড়ান্ত করার জন্য আগামী ১৩ অক্টোবর সংসদীয় কমিটি বৈঠকে বসবে। ওই দিন থেকে বিলটি চূড়ান্ত করার কাজ শুরু হবে। বিলে কোনো পরিবর্তন আনা হবে
কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, পরিবর্তন তো হবেই। তবে কী ধরনের পরিবর্তন আনা হবে তা এখনই বলা সম্ভব নয়। বিলের একটি ধারা নিয়ে সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে_এ বিষয়ে কমিটির অবস্থান সম্পর্কে তিনি বলেন, ক্ষোভ রয়েছে বলেই বিলটি নিয়ে এত আলোচনা হচ্ছে। শুধু ক্ষোভের বিষয় নয়, দুদককে একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড় করানোর জন্য যেটা প্রয়োজন, সেটাই করা হবে।
চলতি বছরের প্রথম দিকে সরকার দুর্নীতি দমন কমিশন আইন সংশোধনের জন্য একটি খসড়া মন্ত্রিসভায় উপস্থাপন করে। বৈঠকে খসড়াটি অনুমোদনও দেওয়া হয়। ওই অনুমোদিত সংশোধিত আইনের খসড়া অনুযায়ী সরকারের ''পূর্বানুমোদন ছাড়া সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, জজ ও ম্যাজিস্ট্রেটের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কোনো মামলা করতে পারবে না। সরকারি কর্মচারী, জজ ও ম্যাজিস্ট্রেটের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে 'ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা ১৯৭-এর বিধান আবশ্যিকভাবে প্রতিপালন করতে হবে।' ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯৭ ধারায় বলা রয়েছে, সরকারের পূর্বানুমতি ছাড়া কোনো আদালত সরকারি কর্মচারী, জজ ও ম্যাজিস্ট্রেটের বিরুদ্ধে কোনো অপরাধ বিচারের জন্য আমলে নিতে পারবেন না।'' আইনের এ ধারাগুলো সংশোধন করা হচ্ছে।
কমিশন সূত্রে জানা গেছে, সংশোধনের নামে আইনটি দুর্বল করে ফেলা হয়েছে। এতে স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশনের ক্ষমতাও খর্ব করা হয়েছে। বিশেষ করে সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো ক্ষমতাই সরাসরি কমিশনের হাতে রাখা হয়নি। কর্মকর্তা, বিচারক, ম্যাজিস্ট্রেটদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে আগাম অনুমোদন নিতে হবে।
এ খসড়ায় অনুমোদন দেওয়ার পর থেকেই মূলত সরকার চাপের মধ্যে আছে। কমিশনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য উন্নয়ন সহযোগীসহ স্থানীয় সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরাও নানাভাবে চাপ সৃষ্টি করে চলেছেন। উন্নয়ন সহযোগীদের জোট হিসেবে পরিচিত লোকাল কনসালটেটিভ গ্রুপ (এলসিজি) গত মার্চ মাসে সরকারকে দেওয়া একটি চিঠিতে দুদকের ক্ষমতা হ্রাসের বিষয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করে। তাদের মতে, দুর্নীতি দমন কমিশনের ক্ষমতা কমে গেলে দুর্নীতি প্রতিরোধের কার্যক্রমে ভাটা পড়ে যাবে। বাংলাদেশের উন্নয়নের স্বার্থেই দুর্নীতি রোধের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা প্রয়োজন। এ জন্য কমিশনকে শক্তিশালী করার পক্ষে তারা মত দেয়। উল্লেখ্য, অর্থসচিব, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব এবং ঢাকাভিত্তিক দ্বিপক্ষীয় উন্নয়ন সহযোগী, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ও জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থাসহ ৩৯টি সংস্থা নিয়ে এলসিজি গঠিত।
এ ছাড়া ঢাকায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত স্টিফেন ফ্রোয়েন গত মে মাসে ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে দুদকের ক্ষমতা খর্ব করার বিষয়ে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন। তিনি বলেন, দুদককে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত একটি নিরপেক্ষ সংস্থা হতে হবে। উন্নয়ন সহযোগীদের পাশাপাশি দেশের সুশীল সমাজও দুর্নীতি দমন কমিশনকে স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষমতা দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে আসছে। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত দুদক আইনের খসড়াটি সংসদে পাস না করে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠায়। পাশাপাশি দুদককে কার্যকর করার জন্য এ-সংক্রান্ত আইনে আর কী কী বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা যায় সে বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য অর্থমন্ত্রী ও আইনমন্ত্রীকে দায়িত্ব দেন খোদ প্রধানমন্ত্রী। অর্থমন্ত্রী ও আইনমন্ত্রী সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করে নতুন সংশোধনীটি সংসদীয় কমিটির কাছে পেশ করেন। কমিটি এখন সেই সংশোধনীর আলোকে কাজ করছে বলে জানা গেছে।
নতুন সংশোধনী অনুযায়ী, তদন্তে দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হলে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের বিরুদ্ধে সরাসরি মামলা করা যাবে_এই খবরে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়েছে জনপ্রশাসনে। এর আগে দুদক আইনের খসড়া কর্মকর্তারাই তৈরি করেছিলেন। তাতে দুর্নীতি থেকে নিজেদের ধরাছোঁয়ার বাইরে রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছিল। এ জন্য ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা ১৯৭-এর বিধান প্রতিপালনের বিষয়ে আইনে বাধ্যবাধকতাও আরোপ করা হয়েছিল। কিন্তু নতুন সংশোধনীতে সেই সুরক্ষা উঠে যাওয়ায় কর্মকর্তারা অসন্তুষ্ট।
এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন সচিব কালের কণ্ঠকে বলেন, 'শুধু একজন কর্মকর্তা নন, দেশের একজন নাগরিক হিসেবে সরকার যে আইন করবে, তা মেনে চলতে আমরা বাধ্য। কিন্তু নতুনভাবে সংশোধিত আইনটি কার্যকর হলে সরকারের কাজে গতি থাকবে না। কর্মকর্তারা কাজ করতে ভয় পাবেন। গুরুত্বপূর্ণ ফাইলে সহজে সিদ্ধান্ত দিতে চাইবেন না। এতে কাজের গতি কমে যাবে।' তিনি বলেন, এ আইনে কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত এবং প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি দুই ভাবে দেখানো হয়েছে। এভাবে দুর্নীতি চিহ্নিত করা নিয়েও সমস্যা দেখা দেবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
যুগ্ম সচিব পর্যায়ের আরেক কর্মকর্তা বলেন, 'আমরা সরকারি চাকরি করি। আমাদের সব কাজ সরকারের উদ্দেশ্যেই করা। এখানে ব্যক্তিগত কাজ এবং প্রাতিষ্ঠানিক কাজের কথা উল্লেখ করে সরকার কাদের বিরুদ্ধে কী করতে যাচ্ছে, সে বিষয়টিও বিবেচনায় নেওয়া উচিত।'
উল্লেখ্য, কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত দুর্নীতি বলতে ছোটোখাট ক্রয়, কাজ না করে উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থ আত্মসাৎ, কাজ শেষ হওয়ার আগে অথবা শেষ হওয়ার পর কাজের মান বিবেচনা না করে ঠিকাদারদের অর্থ পরিশোধ করাকে কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত দুর্নীতি হিসেবে দেখানো হয়েছে। আর বড় বড় চুক্তি, অন্য কোনো দেশের সঙ্গে চুক্তি, বিদেশি কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি বা তাদের কাছ থেকে কোনো কিছু কেনা বা কেনার অনুমোদনসহ সংশ্লিষ্ট কাজের ক্ষেত্রে অনিয়ম হয়ে থাকলে তাকে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি হিসেবে দেখানো হয়েছে বলে জানা গেছে।
প্রস্তাবিত আইনে মিথ্যা তথ্য প্রদানের জন্য শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। দুদক আইনের ২৮ (গ) ধারায় সংশোধনী এনে বলা হয়েছে, মিথ্যা তথ্যপ্রদানকারীকে কমপক্ষে দুই বছর, অনধিক পাঁচ বছর সশ্রম কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড দেওয়া যাবে। দুদকের বা সরকারি কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী যদি মিথ্যা তথ্য প্রদান করেন, তাঁর বিরুদ্ধেও বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের প্রস্তাব করা হয়েছে।
খসড়ায় দুদকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে দুদক আইনের অধীন অপরাধ তদন্তের ক্ষেত্রেও সংশোধনী আনা হয়েছে। এতে উল্লেখ করা হয়েছে, কমিশন নিজে তাঁদের অপরাধ তদন্ত করতে পারবে না। দুদক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অপরাধ তদন্তের দায়িত্ব পুলিশ বা অন্য কোনো সংস্থাকে দিতে হবে। দুদক সরকারি গেজেট প্রজ্ঞাপন দিয়ে পুলিশ বা অন্য কোনো সংস্থাকে ক্ষমতা অর্পণ করতে পারবে।
তদন্তের সময়সীমা সম্পর্কে প্রস্তাবিত বিলে বলা হয়েছে, ক্ষমতাপ্রাপ্তির তারিখ থেকে অনধিক ১২০ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্তকারী কর্মকর্তাকে এই আইন ও তফসিলের উলি্লখিত তদন্ত কাজ সম্পন্ন করতে হবে। তবে ১২০ দিনের মধ্যে তদন্ত শেষ করা সম্ভব না হলে তদন্তকারী কর্মকর্তা সময়সীমা বৃদ্ধির জন্য কমিশনের কাছে আবেদন করতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে কমিশন আরো অনধিক ৬০ কর্মদিবস সময় বাড়াতে পারবে। বর্ধিত সময়ের মধ্যেও যৌক্তিক কারণ ছাড়া তদন্ত শেষ করতে ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণের বিধান রাখা হয়েছে। তদন্ত চলাকালে সরকার বা সরকারের অধীনস্থ কোনো কর্তৃপক্ষ বা সংস্থা থেকে যেকোনো প্রতিবেদন বা তথ্য তদন্তকারী কর্মকর্তা চাইতে পারবেন। বিশেষজ্ঞদেরও সহায়তা চাইতে পারবেন তিনি। তথ্য না দিলেও দুদক কর্মকর্তা নিজ উদ্যোগে সংশ্লিষ্ট অভিযোগের অনুসন্ধান বা তদন্ত সম্পন্ন করতে পারবেন। তথ্যপ্রদানকারীর পরিচয় গোপন রাখা হবে।
No comments