হাঁপিয়ে উঠেছে ডিসিসি by অমিতোষ পাল
প্রায় আড়াই বছর আগে মারা যান ঢাকা সিটি করপোরেশনের (ডিসিসি) ১ নম্বর ওয়ার্ডের (উত্তরা এলাকা) কাউন্সিলর ডা. হাফিজুল ইসলাম কুসুম। তাঁর মৃত্যুর পর পার্শ্ববর্তী ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের (কুড়িল এলাকা) কাউন্সিলর কাজী হযরত আলীকে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়। সেই থেকে তিনি একসঙ্গে দুটি ওয়ার্ডের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তাঁকে নানামুখী সমস্যায় পড়তে হচ্ছে বলে জানা যায়। স্থানীয় লোকজনও তাঁর কাছে থেকে প্রয়োজনীয় সেবা পাচ্ছে না।
দায়িত্ব পালনে নানা সমস্যার কথা উল্লেখ করে কালের কণ্ঠকে কাজী হযরত আলী বলেন, নিয়ম অনুযায়ী কোনো কাউন্সিলর মারা গেলে বা দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিলে ৯০ দিনের মধ্যে উপনির্বাচন হওয়ার কথা। সেখানে আড়াই বছরেও এ ওয়ার্ডে নির্বাচন হয়নি। এ রকম অবস্থা আরো অনেক ওয়ার্ডের।
জানা গেছে, ২০০৭ সালের ১৫ মে সাদেক হোসেন খোকার মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালনের পাঁচ বছর পূর্ণ হয়েছে আরো চার বছর তিন মাস আগে। তিনিও অতিরিক্ত সময় পার করছেন। ডিসিসির নির্বাচনেরও কোনো খবর নেই। এতে স্থবির হয়ে পড়েছে নগরীর উন্নয়ন কার্যক্রম। যেসব কাউন্সিলর আগামী দিনে নির্বাচন করতে চান, কেবল তাঁরাই মোটামুটি এলাকাবাসীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। সাবেক মেয়র মোহাম্মদ হানিফকেও পাঁচ বছরের জায়গায় ৯ বছর দায়িত্ব পালন করতে হয়েছিল। এবার এরও বেশি সময় পার হয়ে গেছে।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সভাপতি বদিউল আলম মজুমদার কালের কণ্ঠকে বলেন, ডিসিসির নির্বাচনে জয়-পরাজয়ের প্রশ্ন আছে। এ মুহূর্তে নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগের পরাজিত হওয়ার আশঙ্কা আছে। কাজেই তারা নির্বাচন দিচ্ছে না। বিগত পৌর নির্বাচন ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পর সরকারি দলের মধ্যে এ আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। ফলে নির্বাচনকে ঝুলিয়ে রাখায় দলীয় রাজনীতির কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে ডিসিসি। অথচ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান গঠনের উদ্দেশ্য হলো গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করা।
সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জকে পৌরসভা থেকে সিটি করপোরেশন ঘোষণা করার পর ইতিমধ্যে নির্বাচনের তফসিলও ঘোষণা করা হয়েছে। অথচ ডিসিসির নির্বাচনের কোনো খোঁজ নেই। ফলে স্থবির হয়ে পড়েছে ডিসিসির কার্যক্রম। বর্তমান সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে ডিসিসির আঞ্চলিক কার্যালয়গুলোর কার্যক্রমও ঠিকমতো তদারকি করা হয় না। দু-একজন ছাড়া কাউকেই সকাল ১১টার আগে অফিসে পাওয়া যায় না।
আবার বিকেল ৩টা বাজলেই অফিস খালি হয়ে যায়। অথচ ঠিকমতো অফিস না করায় নির্বাহী প্রকৌশলীর মতো একাধিক কর্মকর্তার সাময়িক বরখাস্ত হওয়ার নজির আছে।
ডিসিসির এক কর্মকর্তা বলেন, আগে মেয়র ঠিকাদারি কাজ বরাদ্দের ব্যাপারেও খোঁজখবর রাখতেন। এখন কয়েকজন এমপি-মন্ত্রীর কথামতো ঠিকাদারি কাজের ভাগবাটোয়ারা হয়। মেয়র সেটার সমন্বয় করে চলছেন।
ডিসিসি আইনের ১৩ ধারায় বলা হয়েছে, যুক্তিযুক্ত কারণ ছাড়া কোনো কাউন্সিলর পর পর তিনটি বৈঠকে অনুপস্থিত থাকলে ও নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধে জড়িত হলে স্বীয় পদ থেকে অপসারণের যোগ্য হবেন। ওই শূন্য আসনে ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন সম্পন্নের বিধান রয়েছে। কিন্তু তিন-চার বছর ধরে ওয়ার্ডগুলো কাউন্সিলরশূন্য থাকলেও নির্বাচন হয়নি। ডিসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ এ প্রসঙ্গে বলেন, 'এটা বিধিবহির্ভূত।' তবে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার প্রসঙ্গকে পাশ কাটিয়ে বলেন, সময়মতো নির্বাচন না হওয়ায় বেশ কিছু সমস্যাও হচ্ছে।
১৪ ওয়ার্ড কাউন্সিলরশূন্য, সুবিধাবঞ্চিত সোয়া কোটি মানুষ : বর্তমানে ডিসিসির ১৪টি ওয়ার্ড কাউন্সিলরশূন্য। এসব ওয়ার্ডের দায়িত্ব পার্শ্ববর্তী ওয়ার্ডের কাউন্সিলরকে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৫৬ ও ৫৩ নম্বর ওয়ার্ডের দায়িত্ব কাউকেই দেওয়া হয়নি। ৫৬ নম্বর ওয়ার্ডের চৌধুরী আলম নিখোঁজ হওয়ার পর ও ২১ আগস্টের গ্রেনেড হত্যা মামলায় কারাগারে যাওয়ার পর থেকে স্থানীয় লোকজন কাউন্সিলর সনদ পাচ্ছে না। আর যেসব কাউন্সিলর অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন, তাঁরাও অন্য ওয়ার্ডের ব্যাপারে থাকছেন উদাসীন।
জানা গেছে, ৯ বছর ধরে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কাজের আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন কাউন্সিলররা। এ ছাড়া প্রতিটি ওয়ার্ডেই সরকারি দল ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীদের দৌরাত্ম্য বেড়েছে। কাউন্সিলররা কিছু বলতে গেলে প্রতিরোধের মুখে পড়েন। সরকারের অনুগত কর্মকর্তাদের দাপট বেড়েছে নগর ভবনে। সব মিলিয়ে একটি গুবলেট অবস্থায় চলছে ডিসিসির কার্যক্রম।
মেয়র সাদেক হোসেন খোকা বলেন, নির্বাচন না হওয়ায় কিছু সমস্যা তো হচ্ছেই। একই ব্যক্তিকে দুটি ওয়ার্ডের দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। এতে নাগরিক সনদ বা জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন সনদ পেতেও সমস্যা হচ্ছে। কিন্তু কোনো বিকল্প নেই। অবশ্য ডিসিসির নৈমিত্তিক কার্যক্রম যেমন_পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও রাস্তার বাতি লাগানো, সড়ক উন্নয়ন। এগুলো তো চলছে।
নির্বাচন অনিশ্চিত : বর্তমান সরকারের আমলে ডিসিসিকে দুই বা চার ভাগ করে নির্বাচন আয়োজনের একটি আলোচনা হয়েছিল। সে ব্যাপারেও এখন পর্যন্ত কোনো অগ্রগতি নেই। ফলে ডিসিসির নির্বাচন কবে হবে_এটা কেউ বলতে পারে না। এ প্রসঙ্গে ডিসিসির তদারককারী প্রতিষ্ঠান স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের সচিব আবু আলম মোহাম্মদ শহীদ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'ডিসিসিকে ভাগ করার বিষয়টি আমিও পত্রিকায় দেখেছিলাম। আমাদের অফিশিয়ালি কিছু বলা হয়নি। নির্বাচন কবে হবে, সেটাও বলতে পারছি না। তবে এটা বুঝতে পারছি যে নির্বাচন না হওয়ার কারণে নগরবাসীর নাগরিক সুবিধা পেতে সমস্যা হচ্ছে।'
কার দায়িত্ব কে পালন করে : জানা গেছে, ২০০৭ সালের অক্টোবরে মারা যান ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের (মিরপুরের পীরেরবাগ এলাকা) কাউন্সিলর হাজি আবদুস সাত্তার। ওই ওয়ার্ডের কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয় পার্শ্ববর্তী ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হাজি আবদুল কাদেরকে। প্রায় চার বছর ধরে নিজের কার্যালয়ে বসে তিনি কোনোমতে দুটি ওয়ার্ডের দায়িত্ব পালন করছেন। আগামী দিনে আর কাউন্সিলর পদে নির্বাচন করার ইচ্ছা না থাকায় তিনি অনেকটাই নিষ্ক্রিয়। এলাকার দিকেও তাঁর নজরদারি কম। এর ওপর বার্ধক্য ভর করায় মাঝেমধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। ফলে এলাকাবাসীও তাঁর কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সেবা পাচ্ছে না। অবশ্য তাঁর সচিব মো. হাশেম বলেন, 'দুটি ওয়ার্ডে দায়িত্ব পালন করা বাবদ স্যারকে অতিরিক্ত কোনো ভাতা দেওয়া হয় না। এর পরও লোকজনের যাতে সমস্যা না হয়, সে জন্য স্যার আগেই নাগরিক সনদে স্বাক্ষর দিয়ে যান। সার্টিফিকেট নিতে আসা লোকজনের নাম-ঠিকানা লিখে আমিই সার্টিফিকেট দিয়ে দিই।'
ফোনে যোগাযোগ করলে হাজি আবদুল কাদের বলেন, 'নির্বাচিত হওয়ার পর প্রথম চার-পাঁচ বছর এলাকাবাসীর জন্য গাধার খাটুনি খেটেছি; কিন্তু কোনো ফল পাইনি। ঠিক সময়ে নির্বাচন না হওয়ার কারণে অনেক সমস্যা হচ্ছে।' এক-দেড় বছর ধরে কাউন্সিলরদের ত্রৈমাসিক মিটিং হয় না। দ্রুত এসবের সুরাহা হওয়া দরকার বলে মনে করেন তিনি।
জানা গেছে, গত কয়েক বছরের ব্যবধানে পাঁচজন কাউন্সিলর মারা গেছেন। দুজন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব থেকে ইস্তফা দিয়েছেন। এ ছাড়া পাঁচজন কাউন্সিলর পলাতক। একজনকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ধরে নিয়ে গুম করে দিয়েছে বলে তাঁর পরিবারের অভিযোগ। আরেকজন ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় কারাগারে।
২০০৭ সালের শুরুতে এক-এগারোর পরই নিখোঁজ হয়ে যান ৬০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোশাররফ হোসেন খোকন। গত চার বছরে তাঁর খোঁজ মেলেনি। তাঁর অবর্তমানে ৬৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোহাম্মদ আজিজ উল্লাহ দায়িত্ব পালন করছেন। ৬০ নম্বর ওয়ার্ডের (লালবাগ শহীদনগর) বাসিন্দাদের অভিযোগ, ভারপ্রাপ্ত কাউন্সিলরকে তাঁর কার্যালয়ে পাওয়া যায় না। বিচার-সালিসের প্রয়োজন হলে যেতে হয় ৬৭ নম্বর কার্যালয়ে অথবা বেগমবাজার তাঁর বাড়িতে। ২০০৮ সালের মে মাসে মারা যান ১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ডা. হাফিজুল ইসলাম কুসুম। ওই ওয়ার্ডের দায়িত্ব পালন করছেন ১৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাজি হযরত আলী। ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোহাম্মদ কাইয়ুম খান মারা যান ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে। সেখানে দায়িত্ব পালন করছেন ৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাজি রফিকুল ইসলাম। ৩৪ নম্বর ওয়ার্ডের মির্জা খোকনকে এক-এগারোর পর আর দেখা যায়নি। ডিসিসির কাছে তাঁর ব্যাপারে কোনো তথ্যও নেই। তিনি বিদেশে পলাতক বলে কথিত। তাঁর দায়িত্ব পালন করছেন ৩৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর সাজ্জাদ জহির। ২০০৭ সালের মার্চ থেকে ৫২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোতাহার হোসেন জাহাঙ্গীরের কোনো হদিস নেই। সেখানে দায়িত্ব পালন করছেন সংরক্ষিত ১২ আসনের কাউন্সিলর বেগম শিরিন জাহান। ৭১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আলহাজ মোহাম্মদ হোসেন মোল্লার ২০০৭ সালের মার্চ থেকে খোঁজ নেই। শূন্যপদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ৬৮ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোহাম্মদ রফিককে। এক-এগারোর পর থেকে ৮৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর সাইদুর রহমান শহীদের কোনো খোঁজ নেই। ২০০৭ সালের মার্চ থেকে তাঁর দায়িত্ব পালন করছেন ৮১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাজি মোহাম্মদ লিয়াকত আলী। সন্ত্রাসীদের হাতে নির্মমভাবে খুন হওয়া ৭০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাজি আহম্মদ হোসেনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ৬৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোহাম্মদ মোহনকে। এ ছাড়া সংরক্ষিত ৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর শাহিদা তারেক দিপ্তী বিগত সংসদ নির্বাচনের পর সংরক্ষিত আসনের মহিলা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। ৩০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর সানজিদা খানম নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে কাউন্সিলর পদ থেকে ইস্তফা দেন। এ ছাড়া সম্প্রতি মারা গেছেন সংরক্ষিত ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মাহমুদা ইসলাম মর্জিনা। ৫৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আরিফুল ইসলাম ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা মামলায় কারাগারে যাওয়ার পর থেকে তাঁর ওয়ার্ডটি পুরোপুরিই শূন্য।
জানা গেছে, ২০০৭ সালের ১৫ মে সাদেক হোসেন খোকার মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালনের পাঁচ বছর পূর্ণ হয়েছে আরো চার বছর তিন মাস আগে। তিনিও অতিরিক্ত সময় পার করছেন। ডিসিসির নির্বাচনেরও কোনো খবর নেই। এতে স্থবির হয়ে পড়েছে নগরীর উন্নয়ন কার্যক্রম। যেসব কাউন্সিলর আগামী দিনে নির্বাচন করতে চান, কেবল তাঁরাই মোটামুটি এলাকাবাসীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। সাবেক মেয়র মোহাম্মদ হানিফকেও পাঁচ বছরের জায়গায় ৯ বছর দায়িত্ব পালন করতে হয়েছিল। এবার এরও বেশি সময় পার হয়ে গেছে।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সভাপতি বদিউল আলম মজুমদার কালের কণ্ঠকে বলেন, ডিসিসির নির্বাচনে জয়-পরাজয়ের প্রশ্ন আছে। এ মুহূর্তে নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগের পরাজিত হওয়ার আশঙ্কা আছে। কাজেই তারা নির্বাচন দিচ্ছে না। বিগত পৌর নির্বাচন ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পর সরকারি দলের মধ্যে এ আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। ফলে নির্বাচনকে ঝুলিয়ে রাখায় দলীয় রাজনীতির কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে ডিসিসি। অথচ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান গঠনের উদ্দেশ্য হলো গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করা।
সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জকে পৌরসভা থেকে সিটি করপোরেশন ঘোষণা করার পর ইতিমধ্যে নির্বাচনের তফসিলও ঘোষণা করা হয়েছে। অথচ ডিসিসির নির্বাচনের কোনো খোঁজ নেই। ফলে স্থবির হয়ে পড়েছে ডিসিসির কার্যক্রম। বর্তমান সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে ডিসিসির আঞ্চলিক কার্যালয়গুলোর কার্যক্রমও ঠিকমতো তদারকি করা হয় না। দু-একজন ছাড়া কাউকেই সকাল ১১টার আগে অফিসে পাওয়া যায় না।
আবার বিকেল ৩টা বাজলেই অফিস খালি হয়ে যায়। অথচ ঠিকমতো অফিস না করায় নির্বাহী প্রকৌশলীর মতো একাধিক কর্মকর্তার সাময়িক বরখাস্ত হওয়ার নজির আছে।
ডিসিসির এক কর্মকর্তা বলেন, আগে মেয়র ঠিকাদারি কাজ বরাদ্দের ব্যাপারেও খোঁজখবর রাখতেন। এখন কয়েকজন এমপি-মন্ত্রীর কথামতো ঠিকাদারি কাজের ভাগবাটোয়ারা হয়। মেয়র সেটার সমন্বয় করে চলছেন।
ডিসিসি আইনের ১৩ ধারায় বলা হয়েছে, যুক্তিযুক্ত কারণ ছাড়া কোনো কাউন্সিলর পর পর তিনটি বৈঠকে অনুপস্থিত থাকলে ও নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধে জড়িত হলে স্বীয় পদ থেকে অপসারণের যোগ্য হবেন। ওই শূন্য আসনে ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন সম্পন্নের বিধান রয়েছে। কিন্তু তিন-চার বছর ধরে ওয়ার্ডগুলো কাউন্সিলরশূন্য থাকলেও নির্বাচন হয়নি। ডিসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ এ প্রসঙ্গে বলেন, 'এটা বিধিবহির্ভূত।' তবে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার প্রসঙ্গকে পাশ কাটিয়ে বলেন, সময়মতো নির্বাচন না হওয়ায় বেশ কিছু সমস্যাও হচ্ছে।
১৪ ওয়ার্ড কাউন্সিলরশূন্য, সুবিধাবঞ্চিত সোয়া কোটি মানুষ : বর্তমানে ডিসিসির ১৪টি ওয়ার্ড কাউন্সিলরশূন্য। এসব ওয়ার্ডের দায়িত্ব পার্শ্ববর্তী ওয়ার্ডের কাউন্সিলরকে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৫৬ ও ৫৩ নম্বর ওয়ার্ডের দায়িত্ব কাউকেই দেওয়া হয়নি। ৫৬ নম্বর ওয়ার্ডের চৌধুরী আলম নিখোঁজ হওয়ার পর ও ২১ আগস্টের গ্রেনেড হত্যা মামলায় কারাগারে যাওয়ার পর থেকে স্থানীয় লোকজন কাউন্সিলর সনদ পাচ্ছে না। আর যেসব কাউন্সিলর অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন, তাঁরাও অন্য ওয়ার্ডের ব্যাপারে থাকছেন উদাসীন।
জানা গেছে, ৯ বছর ধরে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কাজের আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন কাউন্সিলররা। এ ছাড়া প্রতিটি ওয়ার্ডেই সরকারি দল ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীদের দৌরাত্ম্য বেড়েছে। কাউন্সিলররা কিছু বলতে গেলে প্রতিরোধের মুখে পড়েন। সরকারের অনুগত কর্মকর্তাদের দাপট বেড়েছে নগর ভবনে। সব মিলিয়ে একটি গুবলেট অবস্থায় চলছে ডিসিসির কার্যক্রম।
মেয়র সাদেক হোসেন খোকা বলেন, নির্বাচন না হওয়ায় কিছু সমস্যা তো হচ্ছেই। একই ব্যক্তিকে দুটি ওয়ার্ডের দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। এতে নাগরিক সনদ বা জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন সনদ পেতেও সমস্যা হচ্ছে। কিন্তু কোনো বিকল্প নেই। অবশ্য ডিসিসির নৈমিত্তিক কার্যক্রম যেমন_পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও রাস্তার বাতি লাগানো, সড়ক উন্নয়ন। এগুলো তো চলছে।
নির্বাচন অনিশ্চিত : বর্তমান সরকারের আমলে ডিসিসিকে দুই বা চার ভাগ করে নির্বাচন আয়োজনের একটি আলোচনা হয়েছিল। সে ব্যাপারেও এখন পর্যন্ত কোনো অগ্রগতি নেই। ফলে ডিসিসির নির্বাচন কবে হবে_এটা কেউ বলতে পারে না। এ প্রসঙ্গে ডিসিসির তদারককারী প্রতিষ্ঠান স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের সচিব আবু আলম মোহাম্মদ শহীদ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'ডিসিসিকে ভাগ করার বিষয়টি আমিও পত্রিকায় দেখেছিলাম। আমাদের অফিশিয়ালি কিছু বলা হয়নি। নির্বাচন কবে হবে, সেটাও বলতে পারছি না। তবে এটা বুঝতে পারছি যে নির্বাচন না হওয়ার কারণে নগরবাসীর নাগরিক সুবিধা পেতে সমস্যা হচ্ছে।'
কার দায়িত্ব কে পালন করে : জানা গেছে, ২০০৭ সালের অক্টোবরে মারা যান ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের (মিরপুরের পীরেরবাগ এলাকা) কাউন্সিলর হাজি আবদুস সাত্তার। ওই ওয়ার্ডের কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয় পার্শ্ববর্তী ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হাজি আবদুল কাদেরকে। প্রায় চার বছর ধরে নিজের কার্যালয়ে বসে তিনি কোনোমতে দুটি ওয়ার্ডের দায়িত্ব পালন করছেন। আগামী দিনে আর কাউন্সিলর পদে নির্বাচন করার ইচ্ছা না থাকায় তিনি অনেকটাই নিষ্ক্রিয়। এলাকার দিকেও তাঁর নজরদারি কম। এর ওপর বার্ধক্য ভর করায় মাঝেমধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। ফলে এলাকাবাসীও তাঁর কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সেবা পাচ্ছে না। অবশ্য তাঁর সচিব মো. হাশেম বলেন, 'দুটি ওয়ার্ডে দায়িত্ব পালন করা বাবদ স্যারকে অতিরিক্ত কোনো ভাতা দেওয়া হয় না। এর পরও লোকজনের যাতে সমস্যা না হয়, সে জন্য স্যার আগেই নাগরিক সনদে স্বাক্ষর দিয়ে যান। সার্টিফিকেট নিতে আসা লোকজনের নাম-ঠিকানা লিখে আমিই সার্টিফিকেট দিয়ে দিই।'
ফোনে যোগাযোগ করলে হাজি আবদুল কাদের বলেন, 'নির্বাচিত হওয়ার পর প্রথম চার-পাঁচ বছর এলাকাবাসীর জন্য গাধার খাটুনি খেটেছি; কিন্তু কোনো ফল পাইনি। ঠিক সময়ে নির্বাচন না হওয়ার কারণে অনেক সমস্যা হচ্ছে।' এক-দেড় বছর ধরে কাউন্সিলরদের ত্রৈমাসিক মিটিং হয় না। দ্রুত এসবের সুরাহা হওয়া দরকার বলে মনে করেন তিনি।
জানা গেছে, গত কয়েক বছরের ব্যবধানে পাঁচজন কাউন্সিলর মারা গেছেন। দুজন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব থেকে ইস্তফা দিয়েছেন। এ ছাড়া পাঁচজন কাউন্সিলর পলাতক। একজনকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ধরে নিয়ে গুম করে দিয়েছে বলে তাঁর পরিবারের অভিযোগ। আরেকজন ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় কারাগারে।
২০০৭ সালের শুরুতে এক-এগারোর পরই নিখোঁজ হয়ে যান ৬০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোশাররফ হোসেন খোকন। গত চার বছরে তাঁর খোঁজ মেলেনি। তাঁর অবর্তমানে ৬৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোহাম্মদ আজিজ উল্লাহ দায়িত্ব পালন করছেন। ৬০ নম্বর ওয়ার্ডের (লালবাগ শহীদনগর) বাসিন্দাদের অভিযোগ, ভারপ্রাপ্ত কাউন্সিলরকে তাঁর কার্যালয়ে পাওয়া যায় না। বিচার-সালিসের প্রয়োজন হলে যেতে হয় ৬৭ নম্বর কার্যালয়ে অথবা বেগমবাজার তাঁর বাড়িতে। ২০০৮ সালের মে মাসে মারা যান ১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ডা. হাফিজুল ইসলাম কুসুম। ওই ওয়ার্ডের দায়িত্ব পালন করছেন ১৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাজি হযরত আলী। ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোহাম্মদ কাইয়ুম খান মারা যান ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে। সেখানে দায়িত্ব পালন করছেন ৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাজি রফিকুল ইসলাম। ৩৪ নম্বর ওয়ার্ডের মির্জা খোকনকে এক-এগারোর পর আর দেখা যায়নি। ডিসিসির কাছে তাঁর ব্যাপারে কোনো তথ্যও নেই। তিনি বিদেশে পলাতক বলে কথিত। তাঁর দায়িত্ব পালন করছেন ৩৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর সাজ্জাদ জহির। ২০০৭ সালের মার্চ থেকে ৫২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোতাহার হোসেন জাহাঙ্গীরের কোনো হদিস নেই। সেখানে দায়িত্ব পালন করছেন সংরক্ষিত ১২ আসনের কাউন্সিলর বেগম শিরিন জাহান। ৭১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আলহাজ মোহাম্মদ হোসেন মোল্লার ২০০৭ সালের মার্চ থেকে খোঁজ নেই। শূন্যপদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ৬৮ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোহাম্মদ রফিককে। এক-এগারোর পর থেকে ৮৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর সাইদুর রহমান শহীদের কোনো খোঁজ নেই। ২০০৭ সালের মার্চ থেকে তাঁর দায়িত্ব পালন করছেন ৮১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাজি মোহাম্মদ লিয়াকত আলী। সন্ত্রাসীদের হাতে নির্মমভাবে খুন হওয়া ৭০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাজি আহম্মদ হোসেনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ৬৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোহাম্মদ মোহনকে। এ ছাড়া সংরক্ষিত ৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর শাহিদা তারেক দিপ্তী বিগত সংসদ নির্বাচনের পর সংরক্ষিত আসনের মহিলা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। ৩০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর সানজিদা খানম নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে কাউন্সিলর পদ থেকে ইস্তফা দেন। এ ছাড়া সম্প্রতি মারা গেছেন সংরক্ষিত ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মাহমুদা ইসলাম মর্জিনা। ৫৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আরিফুল ইসলাম ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা মামলায় কারাগারে যাওয়ার পর থেকে তাঁর ওয়ার্ডটি পুরোপুরিই শূন্য।
No comments