বাংলাদেশ-ভারত রূপরেখা চুক্তিঃ দিল্লির মনোভাব বদলের ইঙ্গিত by মেহেদী হাসান
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারত বরাবরই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ও সহযোগিতায় বিশ্বাস করে এসেছে। অন্য কোনো রাষ্ট্রের সঙ্গে যেকোনো ইস্যুতে দেশটি দৃশ্যত দ্বিপক্ষীয়ভাবে সহযোগিতার কথা বলে। অন্যদিকে বাংলাদেশ বিশ্বাস করে বহুপক্ষীয় সহযোগিতায়। বাংলাদেশ মনে করে, দ্বিপক্ষীয়র চেয়ে বহুপক্ষীয় ফোরামের মাধ্যমে স্বার্থ রক্ষা ও ন্যায্য দাবি আদায় করা সম্ভব। গত ৬ সেপ্টেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় বাংলাদেশের সঙ্গে স্বাক্ষরিত রূপরেখা চুক্তিতে নয়াদিল্লি দ্বিপক্ষীয়র পাশাপাশি উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতাকে গুরুত্ব দিয়েছে। এমনকি ভবিষ্যতে আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক পরিধি আরো সম্প্রসারণের সুযোগও রাখা হয়েছে এ চুক্তিতে।
ঢাকার কূটনৈতিক সূত্রগুলো একে দিল্লির গতানুগতিক অবস্থান থেকে মনোভাব কিছুটা বদলের ইঙ্গিত হিসেবে দেখছেন। এর ফলে বাংলাদেশের জন্য আঞ্চলিক বা উপ-আঞ্চলিক সুবিধা পাওয়ার সুযোগ আরো জোরালো হলো। তাঁরা আরো বলেছেন, এ চুক্তি আগামী দিনগুলোতে বাংলাদেশ ও ভারতের সম্ভাব্য চুক্তি ও সমঝোতার কাঠামো (গাইডলাইন)। আর এতে খাতওয়ারি সহযোগিতার কথা বলা হয়েছে, যা বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশ লাভবান হবে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের পক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের পক্ষে প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং রূপরেখা চুক্তি (উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সহযোগিতার কাঠামো চুক্তি) স্বাক্ষর করেন।
ভারতের সঙ্গে স্বাক্ষরিত রূপরেখা চুক্তির বিশেষত্ব সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকায় নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কূটনীতিক কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এ চুক্তিতে কেবল বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতাই নয়, উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার কথাও বলা হয়েছে।' তিনি একে অনেকটা বিরল বিষয় আখ্যায়িত করে বলেন, 'এটি বাংলাদেশের সাফল্য যে, উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার অংশ হিসেবে এ দেশ নেপাল ও ভুটানকেও সঙ্গে নিতে পেরেছে।'
ওই কূটনীতিক বলেন, 'ভারত নেপালের সঙ্গে বিভিন্ন ইস্যুতে দ্বিপক্ষীয়ভাবে কাজ করছে। ভুটানের সঙ্গে ভারতের দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার সম্পর্ক রয়েছে। এর ফলে ভারত ওই দেশগুলোর বাড়তি বিদ্যুৎ পাওয়ার ব্যাপারে ইতিবাচক পথে চলতে পারছে। বিষয়গুলো হয়েছে দ্বিপক্ষীয়ভাবে। কিন্তু রূপরেখা চুক্তির মাধ্যমে উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার কথা বলায় বাংলাদেশেরও সেখানে প্রত্যাশা জানানোর সুযোগ থাকছে।'
তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশ দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থার (সার্ক) এবং বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টি সেক্টরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশনের (বিমসটেক) আওতায় নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে বিভিন্ন খাতে সহযোগিতার পরিকল্পনা করছে। উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার সুযোগ সৃষ্টি হলে তা ওই পরিকল্পনাগুলোতে বাড়তি মাত্রা যোগ করবে।
এই কূটনীতিক জানান, পাঁচ পৃষ্ঠার চুক্তির প্রথম পৃষ্ঠায়ই বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ও ভারত সরকার দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে দ্বিপক্ষীয়, উপ-আঞ্চলিক ও আঞ্চলিক পর্যায়ে সহযোগিতা উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করবে এবং শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ দক্ষিণ এশিয়া গঠনের অভিন্ন লক্ষ্য, অংশীদারত্বের ভাগ্য ও প্রত্যাশিত উন্নয়ন অর্জনে সক্ষমতা জোগাবে। চুক্তির প্রথম অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, দ্বিপক্ষীয় ও উপ-আঞ্চলিক পর্যায়ে ব্যবহারের জন্য উভয় দেশ যথার্থ অবকাঠামোর উন্নয়ন, সমুদ্রবন্দর, বিভিন্ন ধরনের পরিবহন ও পরিবহন ব্যবস্থার মানোন্নয়নে উৎসাহিত করবে। ওই কূটনীতিক এর ব্যাখ্যায় বলেন, এখানে সুস্পষ্টভাবে দ্বিপক্ষীয়র পাশাপাশি উপ-আঞ্চলিক পর্যায়ে ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশও এ সুবিধা কাজে লাগাতে পারবে।
চুক্তির সপ্তম অনুচ্ছেদের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, পারস্পরিক স্বার্থে জুতসই উন্নয়ন, পরিবেশ, ভৌত যোগাযোগ, পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা ও বিদ্যুৎ খাতে উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা সুবিধা কাজে লাগাতে যৌথ উদ্যোগে উন্নয়ন ও অর্থায়ন প্রকল্প নেওয়ার কথা এতে রয়েছে।
তিনি আরো বলেন, ভবিষ্যতে আরো বড় পরিসরে আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক পর্যায়ে এ সহযোগিতার সুযোগ রয়েছে। রূপরেখা চুক্তির ১১তম অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, আঞ্চলিক/উপ-আঞ্চলিক পরিধি সম্প্রসারণসহ সহযোগিতা আরো জোরদার ও সম্প্রসারিত করতে পারস্পরিক (বাংলাদেশ ও ভারত) সম্মতির ভিত্তিতে এ চুক্তি সংশোধন করা যেতে পারে।
'এ চুক্তি দেশের স্বার্থবিরোধী নয়' : রূপরেখা চুক্তির খসড়া প্রণয়ন থেকে শুরু করে স্বাক্ষর হওয়া পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তার কাছে চুক্তি নিয়ে বিভিন্ন মহলের সমালোচনার যৌক্তিকতা জানতে চাইলে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, চুক্তিটি গোপন নয়। ইতিমধ্যে তা প্রকাশ করা হয়েছে। আর এতে দেশের স্বার্থবিরোধী কিছুই হয়নি।
ওই কর্মকর্তা বলেন, চুক্তিতে খাতওয়ারি সহযোগিতার রূপরেখার কথা বলা হয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য, অভিন্ন নদ-নদীর পানিবণ্টন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বিদ্যুৎ, বিজ্ঞান, শিক্ষা ও সংস্কৃতি, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন, পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা, জাতীয় স্বার্থে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখা ও নিরাপত্তা খাতে সহযোগিতার ধরন কী হবে, তার দিকনির্দেশনা রয়েছে ওই চুক্তিতে।
রূপরেখা চুক্তিতে বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা বিষয়ে বলা হয়েছে, এ সহযোগিতা হতে হবে এমন যা দুই দেশের জন্য সুষম, জুতসই ও সম্বৃদ্ধিতে সহায়ক। উভয় পক্ষ বাণিজ্য বৈষম্য কমাতে, পর্যায়ক্রমে শুল্ক ও অশুল্ক বাধা দূর করতে এবং রেল, সড়ক, অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন নৌপথ, আকাশ ও জাহাজযোগে বাণিজ্য সুবিধা দিতে উদ্যোগ নেবে। এ ছাড়া উভয় দেশ দ্বিপক্ষীয়র পাশাপাশি উপ-আঞ্চলিক পর্যায়ে ব্যবহারের জন্য যথার্থ অবকাঠামো উন্নয়ন, সমুদ্রবন্দর, বিভিন্ন পথের পরিবহন ও পরিবহন ব্যবস্থার মানোন্নয়নে উৎসাহিত করবে।
রূপরেখা চুক্তিতে অভিন্ন নদ-নদীর পানিবণ্টনে সহযোগিতা জোরদার প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, উভয় পক্ষ পরস্পরের স্বার্থে অভিন্ন নদ-নদীগুলোর অববাহিকা ব্যবস্থাপনার সম্ভাবনা যাচাই করবে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও বন্যা পূর্বাভাসের ক্ষেত্রে উভয় দেশ পরস্পরকে সহযোগিতা করবে। এ ছাড়া নৌপথ ও বন্দর এলাকায় নাব্যতা ও অভিগম্যতা জোরদারে উভয় দেশ পরস্পরকে সহযোগিতা ও প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করবে।
রূপরেখা চুক্তিতে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা খাতে সহযোগিতা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, উভয় দেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষেত্রে কারিগরি সহযোগিতা ও আগাম তথ্যবিনিময়ের কাঠামো ঠিক করবে। দুর্যোগ মোকাবিলা প্রক্রিয়া আধুনিকায়নের লক্ষ্যে দুই দেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নিয়োজিত কর্তৃপক্ষের মধ্যে সহযোগিতা ছাড়াও দক্ষতা বৃদ্ধি ও প্রশিক্ষণকে উৎসাহিত করার কথাও বলা হয়েছে রূপরেখা চুক্তিতে।
নবায়নযোগ্যসহ অন্যান্য খাতের বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণ খাতে সহযোগিতা জোরদারে ব্যবস্থা চালুর কথা রূপরেখা চুক্তিতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া পারস্পরিক অর্থনৈতিক সুবিধার জন্য বিদ্যুৎ বিনিময়কে উৎসাহিত করতে বিদ্যুৎ গ্রিড সংযোগ ব্যবহারে উভয় দেশের সম্মতির কথাও চুক্তিতে উল্লেখ রয়েছে।
দুই দেশের বিজ্ঞান, শিক্ষা, সংস্কৃতি, মানুষে মানুষে যোগাযোগ ও সহযোগিতা জোরদারে কৃষি, শিক্ষা, সংস্কৃতি, স্বাস্থ্য, পর্যটন, ক্রীড়া, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিসহ উভয় দেশের সম্মতিতে বাছাই করা অন্য খাতগুলোতে যৌথ উদ্যোগে কর্মসূচি বাস্তবায়নের কথা রূপরেখা চুক্তিতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া বৈজ্ঞানিক জ্ঞান, তথ্য-উপাত্ত, গবেষণা, প্রশিক্ষণ বিনিময়, অভিন্ন কর্মসূচি পালনসহ উভয় দেশের সম্মতিতে বাছাই করা উপায়ে সহযোগিতার কথা চুক্তিতে বলা হয়েছে।
অভিযোজনের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা ও পরিবেশ সংরক্ষণে কর্মসূচি নির্ধারণ ও বাস্তবায়নের কথা রূপরেখা চুক্তিতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া অভিন্ন পরিবেশ-প্রতিবেশ ব্যবস্থা (ইকোসিস্টেম) রক্ষায় পারস্পরিক স্বার্থে ও সহযোগিতায় প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা রূপরেখা চুক্তিতে বলা হয়েছে।
পারস্পরিক স্বার্থে জুতসই উন্নয়ন, পরিবেশ, ভৌত যোগাযোগ, পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা ও বিদ্যুৎ খাতে উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা সুবিধা কাজে লাগাতে যৌথ উদ্যোগে উন্নয়ন ও অর্থায়ন প্রকল্প নেওয়া হবে বলে রূপরেখা চুক্তিতে উল্লেখ রয়েছে।
জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোতে দুই দেশের নিবিড় সহযোগিতার কথা রূপরেখা চুক্তিতে উল্লেখ রয়েছে। এতে আরো বলা হয়েছে, অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও উন্নয়নে সহায়ক শান্তিপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টিতে বাংলাদেশ ও ভারত একযোগে কাজ করবে।
রূপরেখা চুক্তিতে পরস্পরের সার্বভৌমত্বকে সম্মান দেখিয়ে নিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোতে সহযোগিতার কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া উভয় পক্ষ নিজের ভূখণ্ডকে অন্যের ক্ষতিকর কাজে ব্যবহার হতে না দেওয়ার কথাও বলেছে। উল্লেখ্য, গত বছরের জানুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় ঘোষিত যৌথ ইশতেহারে উভয় দেশ তাদের ভূখণ্ড পরস্পরের ক্ষতিকর কাজে ব্যবহার হতে না দেওয়ার অঙ্গীকার করেছিল।
বিশেষজ্ঞরা যা বলেন : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ভারতের মনোভাবে যে পরিবর্তন আসছে, তার প্রমাণ রূপরেখা চুক্তিতে রয়েছে। যদিও এ ধরনের চুক্তি আবশ্যিক কিছু নয়, এর পরও তা বর্তমান বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে দুই দেশের সম্পর্ককে আরো সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টা।
ড. দেলোয়ার হোসেন বলেন, বাংলাদেশ সব সময় মনে করে দ্বিপক্ষীয়র বদলে বহুপক্ষীয় ফোরামের মাধ্যমেই ন্যায্য দাবি, অধিকার, স্বার্থ অর্জন করা সম্ভব। বাংলাদেশ ২০-২৫ বছর ধরে নেপাল ও ভুটানকে এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত করার চেষ্টা চালিয়ে আসছে। আঞ্চলিক বা উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার বিষয়টি বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশ নিঃসন্দেহে লাভবান হবে।
সাবেক পররাষ্ট্রসচিব এম আর ওসমানী কালের কণ্ঠকে বলেন, 'রূপরেখায় ভালো ভালো কথা বলা আছে। কিন্তু তার সুফল পেতে হলে বাস্তবায়ন করতে হবে। তবে গত ৪০ বছরে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের যে ইতিহাস, তাতে আমি খুব একটা আশাবাদী হওয়ার কারণ দেখি না। ভারত এখনো মুজিব-ইন্দিরা চুক্তিই বাস্তবায়ন করেনি।'
উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার ফলে বাংলাদেশ লাভবান হবে কি না, সে বিষয়ে জানতে চাইলে এম আর ওসমানী বলেন, 'রূপরেখাকে সাধুবাদ জানানো যায়। এটি হলে অবশ্যই বাংলাদেশ লাভবান হবে। কিন্তু সমস্যা হলো এখানে উপ-আঞ্চলিক কোনো ফোরাম নেই। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারত, নেপাল ও ভুটানের চার দেশীয় কোনো চুক্তি নেই। তাই শেষ পর্যন্ত এটি কিভাবে বাস্তবায়িত হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। আর তা বাস্তবায়িত না হলে শেষ পর্যন্ত তা বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বিষয় হয়ে যাবে।'
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের পক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের পক্ষে প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং রূপরেখা চুক্তি (উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সহযোগিতার কাঠামো চুক্তি) স্বাক্ষর করেন।
ভারতের সঙ্গে স্বাক্ষরিত রূপরেখা চুক্তির বিশেষত্ব সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকায় নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কূটনীতিক কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এ চুক্তিতে কেবল বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতাই নয়, উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার কথাও বলা হয়েছে।' তিনি একে অনেকটা বিরল বিষয় আখ্যায়িত করে বলেন, 'এটি বাংলাদেশের সাফল্য যে, উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার অংশ হিসেবে এ দেশ নেপাল ও ভুটানকেও সঙ্গে নিতে পেরেছে।'
ওই কূটনীতিক বলেন, 'ভারত নেপালের সঙ্গে বিভিন্ন ইস্যুতে দ্বিপক্ষীয়ভাবে কাজ করছে। ভুটানের সঙ্গে ভারতের দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার সম্পর্ক রয়েছে। এর ফলে ভারত ওই দেশগুলোর বাড়তি বিদ্যুৎ পাওয়ার ব্যাপারে ইতিবাচক পথে চলতে পারছে। বিষয়গুলো হয়েছে দ্বিপক্ষীয়ভাবে। কিন্তু রূপরেখা চুক্তির মাধ্যমে উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার কথা বলায় বাংলাদেশেরও সেখানে প্রত্যাশা জানানোর সুযোগ থাকছে।'
তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশ দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থার (সার্ক) এবং বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টি সেক্টরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশনের (বিমসটেক) আওতায় নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে বিভিন্ন খাতে সহযোগিতার পরিকল্পনা করছে। উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার সুযোগ সৃষ্টি হলে তা ওই পরিকল্পনাগুলোতে বাড়তি মাত্রা যোগ করবে।
এই কূটনীতিক জানান, পাঁচ পৃষ্ঠার চুক্তির প্রথম পৃষ্ঠায়ই বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ও ভারত সরকার দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে দ্বিপক্ষীয়, উপ-আঞ্চলিক ও আঞ্চলিক পর্যায়ে সহযোগিতা উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করবে এবং শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ দক্ষিণ এশিয়া গঠনের অভিন্ন লক্ষ্য, অংশীদারত্বের ভাগ্য ও প্রত্যাশিত উন্নয়ন অর্জনে সক্ষমতা জোগাবে। চুক্তির প্রথম অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, দ্বিপক্ষীয় ও উপ-আঞ্চলিক পর্যায়ে ব্যবহারের জন্য উভয় দেশ যথার্থ অবকাঠামোর উন্নয়ন, সমুদ্রবন্দর, বিভিন্ন ধরনের পরিবহন ও পরিবহন ব্যবস্থার মানোন্নয়নে উৎসাহিত করবে। ওই কূটনীতিক এর ব্যাখ্যায় বলেন, এখানে সুস্পষ্টভাবে দ্বিপক্ষীয়র পাশাপাশি উপ-আঞ্চলিক পর্যায়ে ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশও এ সুবিধা কাজে লাগাতে পারবে।
চুক্তির সপ্তম অনুচ্ছেদের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, পারস্পরিক স্বার্থে জুতসই উন্নয়ন, পরিবেশ, ভৌত যোগাযোগ, পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা ও বিদ্যুৎ খাতে উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা সুবিধা কাজে লাগাতে যৌথ উদ্যোগে উন্নয়ন ও অর্থায়ন প্রকল্প নেওয়ার কথা এতে রয়েছে।
তিনি আরো বলেন, ভবিষ্যতে আরো বড় পরিসরে আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক পর্যায়ে এ সহযোগিতার সুযোগ রয়েছে। রূপরেখা চুক্তির ১১তম অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, আঞ্চলিক/উপ-আঞ্চলিক পরিধি সম্প্রসারণসহ সহযোগিতা আরো জোরদার ও সম্প্রসারিত করতে পারস্পরিক (বাংলাদেশ ও ভারত) সম্মতির ভিত্তিতে এ চুক্তি সংশোধন করা যেতে পারে।
'এ চুক্তি দেশের স্বার্থবিরোধী নয়' : রূপরেখা চুক্তির খসড়া প্রণয়ন থেকে শুরু করে স্বাক্ষর হওয়া পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তার কাছে চুক্তি নিয়ে বিভিন্ন মহলের সমালোচনার যৌক্তিকতা জানতে চাইলে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, চুক্তিটি গোপন নয়। ইতিমধ্যে তা প্রকাশ করা হয়েছে। আর এতে দেশের স্বার্থবিরোধী কিছুই হয়নি।
ওই কর্মকর্তা বলেন, চুক্তিতে খাতওয়ারি সহযোগিতার রূপরেখার কথা বলা হয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য, অভিন্ন নদ-নদীর পানিবণ্টন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বিদ্যুৎ, বিজ্ঞান, শিক্ষা ও সংস্কৃতি, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন, পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা, জাতীয় স্বার্থে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখা ও নিরাপত্তা খাতে সহযোগিতার ধরন কী হবে, তার দিকনির্দেশনা রয়েছে ওই চুক্তিতে।
রূপরেখা চুক্তিতে বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা বিষয়ে বলা হয়েছে, এ সহযোগিতা হতে হবে এমন যা দুই দেশের জন্য সুষম, জুতসই ও সম্বৃদ্ধিতে সহায়ক। উভয় পক্ষ বাণিজ্য বৈষম্য কমাতে, পর্যায়ক্রমে শুল্ক ও অশুল্ক বাধা দূর করতে এবং রেল, সড়ক, অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন নৌপথ, আকাশ ও জাহাজযোগে বাণিজ্য সুবিধা দিতে উদ্যোগ নেবে। এ ছাড়া উভয় দেশ দ্বিপক্ষীয়র পাশাপাশি উপ-আঞ্চলিক পর্যায়ে ব্যবহারের জন্য যথার্থ অবকাঠামো উন্নয়ন, সমুদ্রবন্দর, বিভিন্ন পথের পরিবহন ও পরিবহন ব্যবস্থার মানোন্নয়নে উৎসাহিত করবে।
রূপরেখা চুক্তিতে অভিন্ন নদ-নদীর পানিবণ্টনে সহযোগিতা জোরদার প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, উভয় পক্ষ পরস্পরের স্বার্থে অভিন্ন নদ-নদীগুলোর অববাহিকা ব্যবস্থাপনার সম্ভাবনা যাচাই করবে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও বন্যা পূর্বাভাসের ক্ষেত্রে উভয় দেশ পরস্পরকে সহযোগিতা করবে। এ ছাড়া নৌপথ ও বন্দর এলাকায় নাব্যতা ও অভিগম্যতা জোরদারে উভয় দেশ পরস্পরকে সহযোগিতা ও প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করবে।
রূপরেখা চুক্তিতে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা খাতে সহযোগিতা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, উভয় দেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষেত্রে কারিগরি সহযোগিতা ও আগাম তথ্যবিনিময়ের কাঠামো ঠিক করবে। দুর্যোগ মোকাবিলা প্রক্রিয়া আধুনিকায়নের লক্ষ্যে দুই দেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নিয়োজিত কর্তৃপক্ষের মধ্যে সহযোগিতা ছাড়াও দক্ষতা বৃদ্ধি ও প্রশিক্ষণকে উৎসাহিত করার কথাও বলা হয়েছে রূপরেখা চুক্তিতে।
নবায়নযোগ্যসহ অন্যান্য খাতের বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণ খাতে সহযোগিতা জোরদারে ব্যবস্থা চালুর কথা রূপরেখা চুক্তিতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া পারস্পরিক অর্থনৈতিক সুবিধার জন্য বিদ্যুৎ বিনিময়কে উৎসাহিত করতে বিদ্যুৎ গ্রিড সংযোগ ব্যবহারে উভয় দেশের সম্মতির কথাও চুক্তিতে উল্লেখ রয়েছে।
দুই দেশের বিজ্ঞান, শিক্ষা, সংস্কৃতি, মানুষে মানুষে যোগাযোগ ও সহযোগিতা জোরদারে কৃষি, শিক্ষা, সংস্কৃতি, স্বাস্থ্য, পর্যটন, ক্রীড়া, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিসহ উভয় দেশের সম্মতিতে বাছাই করা অন্য খাতগুলোতে যৌথ উদ্যোগে কর্মসূচি বাস্তবায়নের কথা রূপরেখা চুক্তিতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া বৈজ্ঞানিক জ্ঞান, তথ্য-উপাত্ত, গবেষণা, প্রশিক্ষণ বিনিময়, অভিন্ন কর্মসূচি পালনসহ উভয় দেশের সম্মতিতে বাছাই করা উপায়ে সহযোগিতার কথা চুক্তিতে বলা হয়েছে।
অভিযোজনের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা ও পরিবেশ সংরক্ষণে কর্মসূচি নির্ধারণ ও বাস্তবায়নের কথা রূপরেখা চুক্তিতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া অভিন্ন পরিবেশ-প্রতিবেশ ব্যবস্থা (ইকোসিস্টেম) রক্ষায় পারস্পরিক স্বার্থে ও সহযোগিতায় প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা রূপরেখা চুক্তিতে বলা হয়েছে।
পারস্পরিক স্বার্থে জুতসই উন্নয়ন, পরিবেশ, ভৌত যোগাযোগ, পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা ও বিদ্যুৎ খাতে উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা সুবিধা কাজে লাগাতে যৌথ উদ্যোগে উন্নয়ন ও অর্থায়ন প্রকল্প নেওয়া হবে বলে রূপরেখা চুক্তিতে উল্লেখ রয়েছে।
জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোতে দুই দেশের নিবিড় সহযোগিতার কথা রূপরেখা চুক্তিতে উল্লেখ রয়েছে। এতে আরো বলা হয়েছে, অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও উন্নয়নে সহায়ক শান্তিপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টিতে বাংলাদেশ ও ভারত একযোগে কাজ করবে।
রূপরেখা চুক্তিতে পরস্পরের সার্বভৌমত্বকে সম্মান দেখিয়ে নিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোতে সহযোগিতার কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া উভয় পক্ষ নিজের ভূখণ্ডকে অন্যের ক্ষতিকর কাজে ব্যবহার হতে না দেওয়ার কথাও বলেছে। উল্লেখ্য, গত বছরের জানুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় ঘোষিত যৌথ ইশতেহারে উভয় দেশ তাদের ভূখণ্ড পরস্পরের ক্ষতিকর কাজে ব্যবহার হতে না দেওয়ার অঙ্গীকার করেছিল।
বিশেষজ্ঞরা যা বলেন : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ভারতের মনোভাবে যে পরিবর্তন আসছে, তার প্রমাণ রূপরেখা চুক্তিতে রয়েছে। যদিও এ ধরনের চুক্তি আবশ্যিক কিছু নয়, এর পরও তা বর্তমান বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে দুই দেশের সম্পর্ককে আরো সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টা।
ড. দেলোয়ার হোসেন বলেন, বাংলাদেশ সব সময় মনে করে দ্বিপক্ষীয়র বদলে বহুপক্ষীয় ফোরামের মাধ্যমেই ন্যায্য দাবি, অধিকার, স্বার্থ অর্জন করা সম্ভব। বাংলাদেশ ২০-২৫ বছর ধরে নেপাল ও ভুটানকে এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত করার চেষ্টা চালিয়ে আসছে। আঞ্চলিক বা উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার বিষয়টি বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশ নিঃসন্দেহে লাভবান হবে।
সাবেক পররাষ্ট্রসচিব এম আর ওসমানী কালের কণ্ঠকে বলেন, 'রূপরেখায় ভালো ভালো কথা বলা আছে। কিন্তু তার সুফল পেতে হলে বাস্তবায়ন করতে হবে। তবে গত ৪০ বছরে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের যে ইতিহাস, তাতে আমি খুব একটা আশাবাদী হওয়ার কারণ দেখি না। ভারত এখনো মুজিব-ইন্দিরা চুক্তিই বাস্তবায়ন করেনি।'
উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার ফলে বাংলাদেশ লাভবান হবে কি না, সে বিষয়ে জানতে চাইলে এম আর ওসমানী বলেন, 'রূপরেখাকে সাধুবাদ জানানো যায়। এটি হলে অবশ্যই বাংলাদেশ লাভবান হবে। কিন্তু সমস্যা হলো এখানে উপ-আঞ্চলিক কোনো ফোরাম নেই। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারত, নেপাল ও ভুটানের চার দেশীয় কোনো চুক্তি নেই। তাই শেষ পর্যন্ত এটি কিভাবে বাস্তবায়িত হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। আর তা বাস্তবায়িত না হলে শেষ পর্যন্ত তা বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বিষয় হয়ে যাবে।'
No comments