এমপি বাহারের বাহারি রাজত্ব by হায়দার আলী
'সবার মুখের আহার কাইড়া নিচ্ছে মুনসেফ বাড়ির বাহার'-কুমিল্লার রাজনৈতিক মহলে এজাতীয় কথা আজকাল শোনা যায়। এই বাহার হচ্ছেন কুমিল্লা সদর উপজেলার নির্বাচিত সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার। ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা তো বটেই, বাহারকে নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন আওয়ামী লীগের অন্য ছয় সংসদ সদস্য। তাঁরা বলছেন, বাহারের দমন-পীড়ন, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজির কারণে সরকার ও দল-দুয়েরই ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে।
'কুমিল্লা সদরের কোথাও কোনো অনুষ্ঠান করতে পারি না সদরের এমপি বাহাউদ্দিন বাহারের কারণে। গত বছর একটি অনুষ্ঠানে আমাকে এবং সংসদ সদস্য মুজিবুল হককে অতিথি করা হয়। গিয়ে দেখি আমাদের চেয়ারগুলো মঞ্চ থেকে নিচে নামিয়ে রাখা হয়েছে। পরে সেখানে বসেই অনুষ্ঠান শেষ করে আসি। ইচ্ছা থাকলেও কোনো অনুষ্ঠান করতে পারছেন না কুমিল্লার অন্য পাঁচ এমপি।' বলছিলেন কুমিল্লার সংসদ সদস্য নাছিমুল আলম চৌধুরী। আরেক সংসদ সদস্য ও জাতীয় সংসদের হুইপ মো. মুজিবুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বাহারের বিরুদ্ধে আমার কিছু বলার নাই, এলাকায় খোঁজ নিলেই সব জানতে পারবেন।' নাছিমুল আলম এমপি আরো বলেন, 'জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির মিটিংয়ে বাহারের চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করেছিলাম। এমনকি সংসদ সদস্য সুবিদ আলী ভঁূইয়া প্রধানমন্ত্রীর কাছে সংসদ সদস্য বাহারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন। তাঁর কারণে কুমিল্লায় আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি চরমভাবে নষ্ট হচ্ছে।'
অভিযোগ উঠেছে, কুমিল্লা সদরে রাজনৈতিক কিংবা অরাজনৈতিক, ছোট কিংবা বড় যেকোনো অনুষ্ঠান করতে হলে বাহারকে প্রধান অতিথি করতে হবে, নইলে সদরে কোনো অনুষ্ঠানই করতে পারেন না কেউ। অন্য আসনের এমপিদের কোনো অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি করা হলে সেই অনুষ্ঠান পণ্ড করে দেয় বাহারের লোকজন।
সূত্র মতে, এমপি বাহারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া সংসদ সদস্যরা হলেন কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক ও কুমিল্লা-১০ (নাঙ্গলকোট ও সদর দক্ষিণের একাংশ) আসনের সংসদ সদস্য আ হ ম মোস্তফা কামাল (লোটাস কামাল), কুমিল্লা-১১ (চৌদ্দগ্রাম) আসনের এমপি জাতীয় সংসদের হুইপ মো. মুজিবুল হক, কুমিল্লা-৯ (লাকসাম ও মনোহরগঞ্জ) আসনের মো. তাজুল ইসলাম, কুমিল্লা-৮ (বরুড়া ও সদর দক্ষিণের একাংশ) আসনের নাছিমুল আলম চৌধুরী, কুমিল্লা-৫ (বুড়িচং ও ব্রাহ্মণপাড়া) আসনের আবদুল মতিন খসরু ও সংরক্ষিত আসনের নারী সংসদ সদস্য জোবেদা খাতুন পারুল।
ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আনিসুর রহমান মিঠু বলেন, 'নির্বাচনে আওয়ামী লীগের টিকিটে নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই কুমিল্লার মুকুটবিহীন সম্রাটে পরিণত হয়েছেন এমপি আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার। ওনার লোকজন ছাড়া ঠিকাদারি কাজের কথা কেউ চিন্তাও করতে পারে না। অন্য উপজেলার এমপির লোকজনকে কাজ পেতে হলেও সদরের সংসদ সদস্যকে শতকরা পাঁচ ভাগ কমিশন আগে দিতে হয়।' কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের একজন নেতা কালের কণ্ঠের এ প্রতিবেদককে বলেন, 'আমার নাম পত্রিকায় দিবেন না, হাজি বাহার জানলে আমার বাড়িঘরে আগুন জ্বালাইয়া দিব, কুমিল্লার কোনো সাংবাদিক তাঁর বিরুদ্ধে লেখে না, আপনারা একটু লেখেন।'
বাহারের লোকজন : এলাকাবাসীর অভিযোগ ও কালের কণ্ঠের অনুসন্ধানে জানা গেছে, বাহার নির্বাচিত হওয়ার পর তাঁর ভাই, ভাতিজা ও মুষ্টিমেয় কিছু লোক ঠিকাদারিসহ বিভিন্ন কাজ নিয়ন্ত্রণ করছে। অভিযোগ মতে, এমপি বাহারের হয়ে পুরো জেলার 'কাজ' নিয়ন্ত্রণ করছেন তাঁর ফুফাতো ভাই দক্ষিণ জেলা যুবলীগের সহসভাপতি আরফানুল হক রিফাত। এই রিফাতের নিয়ন্ত্রণে কুমিল্লার পাঁচটি বালুমহাল, যেখান থেকে প্রতিদিন পাঁচ থেকে ১০ লাখ টাকা আসে। রিফাতের প্রভাব কুমিল্লা সদরের থানা প্রশাসনেও; যেখানে থানায় মামলা নেওয়া না-নেওয়া থেকে শুরু সব কিছুই রিফাত নিয়ন্ত্রণ করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, বিবির বাজার বালুমহাল থেকে সারিবদ্ধভাবে শতাধিক শ্রমিক বালু তুলছিলেন। পাশের চায়ের দোকানে বসা আলাউদ্দিন, রমজান আলী ও আছরউদ্দিন নামের তিন এলাকাবাসী। বালুমহাল থেকে এখন কারা বালু উত্তোলন করছে-এমন প্রশ্নের জবাবে একজন বলেন, 'আপনি এলাকায় নতুন আইছেন, এমপির লোকজন ছাড়া এইখানে বালু উডাইব-কার বুকে এত সাহস?' এলাকাবাসী জানায়, শুধু বিবির বাজার নয়, কুমিল্লার সব বালুমহাল থেকেই বালু উত্তোলন নিয়ন্ত্রণ করছেন এমপি বাহারের ভাই রিফাত। কুমিল্লার জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অফিসেও রিফাতের একচ্ছত্র প্রভাব থাকার কথা জানা যায়। অভিযোগ উঠেছে, কুমিল্লার সুজানগরের পুরাতন এবং ঐতিহ্যবাহী লস্করদিঘিসহ একাধিক দিঘি অবৈধভাবে ভরাট করে ফেলছে এমপির লোকজন।
কুমিল্লার পাঁচটি বালুমহাল থেকে প্রতিদিন যে বালু তোলা হয় এর মূল্য ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা হবে বলে মনে করা হচ্ছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বিনা টেন্ডারে চলছে বালু উত্তোলনের উৎসব। সদর উপজেলার বালুমহাল থেকে প্রতিদিনই ২৪ ঘণ্টা বালু তোলা হচ্ছে। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার আগে প্রতিবছরের পহেলা বৈশাখ পাঁচটি বালুমহালের টেন্ডার হতো। কিন্তু এখন জেলা প্রশাসনের খাস কালেকশনের মাধ্যমে বালু উত্তোলনের টাকা আদায় হচ্ছে। বছরে নামমাত্র ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা পাচ্ছে সরকার। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেলা প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, 'দরপত্রের মাধ্যমে বালুমহাল থেকে বালু উত্তোলন করা হলে সরকার প্রতিবছর সাত থেকে আট কোটি টাকা রাজস্ব পেত। জেলা প্রশাসন লাখ লাখ টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হলেও এমপি বাহারের পকেট নিয়মিত ভরছে।'
এদিকে কুমিল্লা এলজিইডির যত কাজ আছে এর সবই নিয়ন্ত্রণ করেন এমপি বাহারের আরেক ভাতিজা নাইমুর রহমান তুহিন। শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের কুমিল্লা অফিস নিয়ন্ত্রণ করেন কুমিল্লা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের সাবেক ভিপি জহিরুল ইসলাম মিন্টু। মিন্টু এমপি বাহারের খুবই ঘনিষ্ঠ লোক হিসেবে পরিচিত। জেলার ১৩ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেঙ্ ও জেলা সদরে দুটি হাসপাতালের খাদ্য, ওষুধ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার কাজ, ভবন নির্মাণসহ বিভিন্ন ধরনের কাজ নিয়ন্ত্রণ করেন এমপি বাহারের আরেক ভাতিজা মো. সাদি মোহাম্মদ। কুমিল্লা সড়ক ও জনপথ নিয়ন্ত্রণ করেন জহিরুল কামাল জহির ও আহামেদ ইরান। তাঁরা দুজনই এমপি বাহারের ব্যবসায়িক সহযোগী। ওয়াপদার কাজ নিয়ন্ত্রণ করেন এমপির ঘনিষ্ঠ সহযোগী কালা ফারুক ও তোফায়েল আহামেদ। পিডাবি্লউডির কাজ নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন এমপি বাহারের বড় ভাই মো. কুতুবউদ্দিন আহামেদ। এদিকে কুমিল্লা জেলখানার ঠিকাদারি কাজসহ বিভিন্ন কাজ নিয়ন্ত্রণ করছে কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের নবনির্বাচিত সাংগঠনিক সম্পাদক গোলাম সারোয়ার শিপন। জেলা পরিষদ ও কুমিল্লা সিটি করপোরেশনে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে আছেন সাবেক ছাত্রনেতা সরকার মাহমুদ জাবেদ। অন্যদিকে কুমিল্লায় ভারতীয় সীমান্ত হয়ে চোরাকারবারি পণ্যের সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করছেন এমপির খুব কাছের লোক চিকা শহিদ।
সন্ত্রাসী বাহিনীকে মদদ : অভিযোগ রয়েছে, এমপি বাহারের আছে একটি সন্ত্রাসী বাহিনী। এর নেতৃত্ব দেন জহিরুল ইসলাম রিন্টু। সঙ্গে আছে জুয়েল, শাওন, সোহাগ, রাসেলসহ ২০ থেকে ২৫ জনের একটি সন্ত্রাসী গ্রুপ। বাহারের বিরুদ্ধে কেউ কথা বললেই নেমে আসে অমানুষিক নির্যাতন। রিন্টু বাহিনীর নির্যাতনের শিকার হয়ে এখন পঙ্গু কুমিল্লা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের সাবেক ভিপি খলিলুর রহমান রিপন। রিন্টু ও তার বাহিনী শহরের ধর্মসাগর পাড়ের বাড়িতে ঢুকে রিপনের দুই পায়ের এবং হাতের রগ কেটে দেয় এবং শরীরের বিভিন্ন স্থানে ছুরিকাঘাত করে ফেলে রেখে যায়। জেলা যুবলীগের সমাজকল্যাণ সম্পাদক কবির হোসেন ভূইয়াকে কুপিয়ে হাত-পায়ের রগ কেটে চিরতরে পঙ্গু করে দেয় একই বাহিনী। রিন্টু বাহিনী একই কায়দায় সদর উপজেলা ছাত্রলীগের নেতা আহাম্মেদ হোসেনেরও হাত-পায়ের রগ কেটে দেয়। এ ছাড়া বরুড়া থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মিহির মজুমদারকে কুমিল্লা শহরের রামঘাট জেলা আওয়ামী লীগ অফিসের সামনে হাত-পায়ের রগ কেটে দেওয়া হয়। গত ৫ জুলাই শহরের কান্দিরপাড় এলাকায় ছাত্রলীগের সমাবেশে কুমিল্লা অজিতগুহ কলেজ ছাত্রলীগ নেতা নাজমুল হাসান মজুমদারকে ছুরিকাঘাত করে গুরুতর আহত করে রিন্টু বাহিনী। গত ২৫ জুলাই দুপুর ১২টায় কুমিল্লা সরকারি কলেজের সামনে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে যুবলীগ নেতা নুরুল ইসলাম আপেলকে। এ ঘটনায় রিন্টু গ্রুপের রাসেলসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়।
যোগাযোগ করা হলে নির্যাতিত কবির হোসেন ভূইয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, 'ভাই আমি সন্তানদের নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই, আমার কপালে যা লেখা ছিল, তাই হয়েছে। ওই বিষয় নিয়ে আমি কিছু বলতে চাই না।' যুবলীগ নেতা নুরুল ইসলাম আপেলের একজন আত্মীয় বলেন, হত্যাকারীরা সরাসরি এমপি বাহারের ছত্রছায়ায় থাকে, এ জন্য পুলিশ ঘাতকদের গ্রেপ্তার করছে না।
আফজলের পর বাহার পর্ব : কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের নেতা আফজল খান এবং এমপি বাহারের গ্রুপের মধ্যে বিরোধ দীর্ঘদিনের। এ নিয়ে বিগত আওয়ামী সরকারের শেষ সময়ে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল হক দুলাল ও জেলা শেখ রাসেল স্মৃতি সংসদের সভাপতি হাজিদুর রহমান ভূইয়া বাবুকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। দুটি হত্যা মামলায় আসামি করা হয় আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারসহ তাঁর ক্যাডার বাহিনীর সদস্যদের। ওই ঘটনার পর দলীয় সভানেত্রীর নির্দেশে বাহারকে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়। তবে ২০০৮ সালের ১৭ নভেম্বর কুমিল্লা জেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক আ হ ম মোস্তফা কামাল বিরোধ মীমাংসার উদ্যোগ নেন। তাঁর মধ্যস্থতায় ঐক্যবদ্ধ হন আফজল খান এবং বাহার। ফলে সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হন বাহার। তবে এমপি হওয়ার পর থেকে আবারও আফজল খানের সঙ্গে এমপি বাহারের দূরত্ব বাড়তে থাকে।
কুমিল্লা জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আনিসুর রহমান মিঠু বলেন, 'কুমিল্লার মানুষের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে, তারা এই অবস্থা থেকে মুক্তি চায়।'
এলাকাবাসীর অভিযোগ, এক সময় কুমিল্লা এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করতেন কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক আফজল খান। তাঁর সন্ত্রাসী বাহিনীর কাছে পুরো কুমিল্লার মানুষ জিম্মি ছিল। মুক্তির আশায় মানুষ ভোট দিয়েছিলেন বাহারকে। কিন্তু হয়নি মুক্তি লাভ। কুমিল্লা শহর এখন যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি মাদকপ্রবণ এলাকায় পরিণত হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে আফজল খান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বাহারের সঙ্গে যাঁরা আছেন, তাঁরা আওয়ামী লীগ করেন না, করেন বাহার লীগ। এই অবস্থা চলতে থাকলে আগামী নির্বাচনে কুমিল্লা সদর আসন আওয়ামী লীগের হাতছাড়া হয়ে যাবে। বাহারের অপকর্মের প্রভাব অন্য আসনেও পড়ছে'-মন্তব্য করেন আফজল খান।
কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের নবনির্বাচিত সভাপতি আ ফ ম আহসানউদ্দিন টুটুল বলেন, 'সদরের সংসদ সদস্যের একমুখী নীতির কারণে কুমিল্লায় আওয়ামী লীগের রাজনীতি আজ ধ্বংসের পথে। কুমিল্লার সব এমপি এক দিকে আর সদরের এমপি আরেক দিকে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এই বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করলে আরো ভয়াবহ সমস্যা দেখা দিবে।'
কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক শফিকুল ইসলাম কবির বলেন, সদরের এমপির সঙ্গে জেলার অন্য এমপিদের দূরত্ব এখন আকাশ সমান। আরেক যুগ্ম আহ্বায়ক বলেন, 'বাহার তো আওয়ামী লীগ করেন না, করেন বাহার লীগ।' জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা আনসার আহামেদ বলেন, 'সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজি ও ঠিকাদারি ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে স্থানীয় এমপি। এমপি বাহার ছাড়া কারো কথাই এখানে কাজ হয় না।'
কুমিল্লা বরুড়ার এমপি নাসিমুল হক নজরুল বলেন, সদরের এমপি ঠিকাদারি ও চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করছেন। বাহারের লোকজন মাদক ব্যবসা থেকে শুরু করে সব কিছুতেই জড়িয়ে পড়ছে। নাসিমুল হক বলেন, 'চাঁদাবাজি ও ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে আমিই প্রথম জেলা আইনশৃঙ্খলা মিটিংয়ে প্রতিবাদ করেছিলাম, সেই ঘটনার পর থেকে আমাকে বিভিন্নভাবে অপদস্থ করা চেষ্টা করে। অন্য উপজেলার কোনো কাজ পেতে হলেও কমিশন দিয়ে কাজ পেতে হয়।'
'মোবাইলে সাক্ষাৎকার দেই না' : অভিযোগ সম্পর্কে কথা বলতে গত সপ্তাহে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে বাহাউদ্দিন বাহার এমপি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগই ভিত্তিহীন। মোবাইলে আপনার সঙ্গে কোনো সাক্ষাৎকার দিব না, আমি দেই না। সরাসরি বসেই সব অভিযোগের বিস্তারিত ব্যাখ্যা আমি দিব।' একাধিকবার ফোন করে অনুরোধ করা হলেও তিনি একইভাবে অপারগতা প্রকাশ করেন।
পিডাবি্লউডিতে কাজ করার অভিযোগ অস্বীকার করে বাহারের বড় ভাই মো. কুতুবউদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমি কোনো ঠিকাদারি ব্যবসার সঙ্গে এখন আর জড়িত নই। তিন বছর আগেই ঠিকাদারি ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছি, এখন একটি মোবাইল ফোন কম্পানির ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। যারা আমার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ দিয়েছে, তারা আমাদের সুনাম নষ্ট করতে চাচ্ছে।' এলজিইডি, সিঅ্যান্ডবি, পাউবো, পিডাবি্লউডির প্রকৌশলীদের উদ্দেশে করে তিনি বলেন, 'সরকারের ওইসব বিভাগের কর্মকর্তারা দুর্নীতি করছে, তাদের বিরুদ্ধে খোঁজখবর না নিয়ে আমাদের পিছনে কেন লেগেছেন? আমি কোনো রাজনীতির সঙ্গেই জড়িত নই, কেউ অভিযোগ দিয়ে থাকলে আমার সামনে এসে বলতে বলুন।'
এলজিইডি নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ অস্বীকার করে এমপি বাহারের ভাতিজা তুহিন বলেন, 'এলজিইডি নিয়ন্ত্রণের কথা যারা বলছে, তারা আমাদের এমপির সুনাম নষ্ট করতে চায়। এলজিইডির বিভিন্ন ওয়ার্ক অর্ডারের কাগজপত্র দেখলেই বিষয়টি পরিষ্কার হতে পারবেন।' ১০ শতাংশ কমিশন দিয়েই নাকি অন্য এমপির লোকজন কাজ পাচ্ছে-এমন অভিযোগও তুহিন অস্বীকার করেন। কুমিল্লার অন্য ছয়জন এমপির সবাই বাহারের বিরুদ্ধে যাওয়া প্রসঙ্গে তুহিন বলেন, 'পলিটিক্যাল কারণে অনেক কিছু হয়। যেমন হুইপ মজিবুর রহমান নিজের এলাকা চৌদ্দগ্রাম ছেড়ে সদরের এমপির এলাকায় রাজনৈতিক অফিস খুলে বসেছেন, এটাতো ঠিক না। আমাদের এমপি অন্য এলাকায় গিয়ে অফিস নিলে সমস্যা কী হতো না? ওইসব কর্মকাণ্ডের বিরোধীতা করতে গিয়ে সব এমপির কাছে বাহার খারাপ হয়েছেন।'
আরফানুল হক রিফাত বলেন, 'আমাদের সময় বিএনপির সমর্থিত ঠিকাদাররাও কাজ পাচ্ছেন।' কুমিল্লার (দক্ষিণ) অপর ছয় এমপি বাহারের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অবস্থান নেওয়া প্রসঙ্গে রিফাত বলেন, 'ছাত্রলীগের কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে তাদের সঙ্গে আমাদের এমপির বিরোধ বেধেছে, তারা ছাত্রলীগের কমিটিতে অছাত্র ও বিবাহিতদের স্থান দিয়েছে।'
জানা যায়, কিছুদিন আগে জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির ওই বৈঠকে ছয় সংসদ সদস্য ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন, কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক আফজল খান ও সফিকুল ইসলাম শিকদার, কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য আফতাবুল ইসলাম এবং কৃষক লীগ, জেলা যুবলীগ, ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগ, মহিলা লীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগসহ সহযোগী ও অঙ্গসংগঠনের একাধিক নেতা-কর্মী।
No comments