দুজন বিহনে ফাঁকা রাজনীতির মাঠ by এ কে এম শাহনাওয়াজ
এ প্রশ্নে কারো দ্বিমত নেই যে বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য বাঁধা পড়ে আছে আওয়ামী লীগ আর বিএনপির কাছে। আওয়ামী লীগকে কর্মভূমিকার কারণে আজ যতই ফ্যাকাসে বা পাণ্ডুর দেখাক না কেন, গরিমা করার মতো ঐতিহ্য আছে দলটির। এ কারণে হয়তো টেনেটুনে কাল অতিক্রম করতে পারে। হয়তো সততা ও দৃঢ়চিত্ততায় নতুন প্রত্যয়ী নেতৃত্বের অধিকারী হতে আবার নতুনভাবে ঘুরেও দাঁড়াতে পারে। ঐতিহ্যপ্রিয় দেশপ্রেমিক মানুষের কাছ থেকে নতুন করে বরণমালা পেতেও পারে। এদিক থেকে জন্ম-ঐতিহ্যের অনুজ্জ্বল্য এবং পাঁচমিশালি আদর্শের ধোঁয়াটে অবস্থায় দোদুল্যমানতার কারণে বিএনপির কোনো কাঠামো নির্দিষ্ট হয়নি এখনো। তবুও আওয়ামী লীগ এমন একটি দলকে অন্যতম বৃহৎ দলে পরিণত করতে সাহায্য করেছে। পাকিস্তান আমলজুড়ে রাজনীতির মাঠে দীপ্ত পদচারণ ছিল আওয়ামী লীগের। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনার বাস্তব অভিজ্ঞতা হয়নি দলটির।
মুক্তিযুদ্ধে সফল নেতৃত্ব দিয়েছে, কিন্তু স্বাধীন দেশে নানা প্রতিকূলতায় সুদক্ষ প্রশাসন পরিচালনার অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারেনি। মেঠো রাজনীতির অভিজ্ঞতা খুব সহায়তা করতে পারেনি রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র ও কূটনীতির কাছে বিপর্যস্ত হতে হয়েছে। বিভিন্ন বিরতিতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেও প্রশাসনিক দক্ষতার ঘাটতি পূরণ করতে পারেনি কখনো। আমলাতন্ত্রের হাতেই বন্দি থাকতে হয়েছে। নষ্ট-রাজনীতির দাপটে সুশাসন প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা কখনো তৈরি হয়নি। যে কারণে আওয়ামী লীগ নেত্রী মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে অত্যন্ত সারল্য নিয়ে বলতে হয়, 'মানুষ যত ভালো থাকে, আরো ভালো চায়। কিন্তু পেছনে ফিরে তাকায় না।' অর্থাৎ সরকার পরিচালকদের ভাষায় যা দিয়েছেন ঢের দিয়েছেন। না-শুকুর প্রজাদের তাতেই সন্তুষ্ট থাকা উচিত। অবশ্য এ দেশের সর্বংসহা মানুষ মনকে শাসন করে হলেও শেষ পর্যন্ত সন্তুষ্ট থাকার চেষ্টা করে।
কিন্তু বিএনপিকে নিয়ে সম্প্রতি সচেতন মানুষের আশঙ্কা অনেক বেড়ে গেছে। মানুষ তো মেনেই নিয়েছে রাষ্ট্রক্ষমতার আবর্তনের খেলায় আজ না হয় কাল বিএনপি আবার ক্ষমতার মসনদে বসবে। যদি না তৃতীয় কোনো রাজনৈতিক শক্তি প্রবল প্রতাপে সামনে এগিয়ে আসে। এ পর্যন্ত পড়ে কোনো সম্মানিত পাঠক, বিশেষ করে বিএনপি-অন্তপ্রাণ পাঠক মনে করতে পারেন, এমন মন্তব্য তো আগের প্যারাতে করিনি। তাহলে কি আমি আওয়ামী লীগের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করেছি! আমি বিনয়ের সঙ্গে বলব, বিষয়টি মোটেও তেমন নয়। বিএনপির রাজনৈতিক দৈন্যের প্রকাশ এমন মন্তব্য করার পথ তৈরি করে দিয়েছে।
এ কথা তো মানতে হবে, অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে নো-ম্যানসল্যান্ডের মতো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছরের পর বিপুল জনসমর্থন নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট বিএনপির প্রতি একটি শক্ত চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে সরকার গঠন করে। যদিও সরকার পরিচালনার শুরু থেকেই আওয়ামী লীগ সম্ভাবনার দরজাগুলো খুলে দিতে তেমন সফল হয়নি। এখনো সঠিক ছন্দ খুঁজে পায়নি বলে বলা যায়, ভবিষ্যৎ নির্মাণের সুযোগগুলোরও অপচয় করছে। তার পরও এসব সুবিধা কাজে লাগাতে পারছে না বিএনপি। এর কারণ খুব অস্পষ্ট নয়। একটি আদর্শিক জায়গায় দাঁড়াতে না পারলে নানা মত-পথের সুবিধাবাদী মানুষের ক্লাব বড় কোনো ঐক্য গড়ে তুলতে পারে না। আদর্শিক রাজনীতির পরিবেশে বেড়ে ওঠা দল রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে দীর্ঘদিন থাকলেও হতাশাগ্রস্ততায় খণ্ডিত হয়ে যায় না। রাজনীতির ময়দানেই নিজের শক্তি সংহত করে। কিন্তু বিএনপি নেতা-নেত্রীদের সে সুবিধা কম। হাজার বিতর্কের মধ্য দিয়ে জিয়াউর রহমানের উত্থান হলেও তিনি বিএনপি গড়েছিলেন বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের মতো একটি আদর্শের জন্ম দিয়ে। হয়তো এ ধরনের জাতীয়তাবাদী আদর্শ নিয়ে তাত্তি্বক বিতর্ক থাকতে পারে। কিন্তু সে সময়ের বাস্তবতায় উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষ আকৃষ্ট হয়েছিল। তবে দূরদর্শিতা নিয়ে বাংলাদেশের বাস্তবতা যদি অনুধাবন করতেন এবং জামায়াতে ইসলামীর মতো মৌলবাদী সংগঠনগুলোর সংশ্লিষ্টতা এড়িয়ে বিএনপির সাংগঠনিক ভিত শক্ত করতে চাইতেন, তবে দলের জন্য তা কল্যাণের হতো। লক্ষণীয় যে জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুকে খাটো করে এবং মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বের আসনে বঙ্গবন্ধুকে ধোঁয়াচ্ছন্ন করে ইতিহাসকে অস্বীকার করতে চাননি। স্বকপোলকল্পিত ইতিহাসও রচনা করতে চাননি। কিন্তু দুর্ভাগ্য বিএনপির, দলটি জিয়াউর রহমানকে হারাল কঠিন এক সময়ে। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বের নতুন বিএনপি কার্যত আদর্শচ্যুত হলো। বেঁচে থাকা ও এগিয়ে যাওয়ার জন্য বিভ্রান্ত পথ বেছে নিল। এ সময় সুবিধাবাদী ক্ষমতালিপ্সু নেতাদের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব একক ক্ষমতাধর করে দিল খালেদা জিয়াকে। ঐতিহ্যের শূন্যতা থেকে এবং সংস্কৃতিবোধের বাইরে থেকে রাজনীতির ময়দানে কোনো পরিবার নিয়ন্ত্রিত দল মহীরুহ হয়ে উঠতে পারে না। এতে বরং পরিবারের বাইরের দলের সিনিয়র নেতারা দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে যান। দলছুট 'প্রাজ্ঞ' নেতারাও এভাবে একসময় দলের প্রধান ক্ষমতাসীন নেতা বা নেত্রীর কৃপাপ্রার্থী হয়ে পড়েন। এ অবস্থা দলের ভিত্তিকে নড়বড়ে করে দেয়। এমন দল তুলনামূলক ভালো থাকে শুধু রাষ্ট্রক্ষমতার জীয়নকাঠি হাতে থাকলে। তবে প্রধান নেতা-নেত্রীর কৃপার দিকেই তাকিয়ে থাকতে হয় খুচরা নেতাদের। যে কারণে এসব নেতার চোখের সামনে একজন কিশোর তারেক রহমানের বেড়ে ওঠা, যৌবনে পদার্পণ, শিক্ষা-দীক্ষা, সংস্কৃতিবোধ, রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ও অনুশীলন_সব কাছে থেকে দেখার পরও অদ্ভুত গণতন্ত্রের দেশে ২০-৩০-৫০ বছর রাজনীতি করা নেতারা দলীয় নেত্রীর আদেশে অবলীলায় ঘাড় নিচু করে দিলেন। আর সেসব ঘাড় ডিঙিয়ে তারেক রহমান দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব হয়ে গেলেন (এখন তো দ্বিতীয় প্রধান)। সবাই ঘাড় উঁচু করে মারহাবা বললেন আর হাততালি দিলেন। তার পর থেকে এই কৃপাপ্রার্থীদের দায়িত্ব হলো, রাজনীতির মাঠে হঠাৎ আবির্ভূত তারেক রহমান যে একজন বিদগ্ধ মহান নেতা, তা অহরাত্রি প্রচার করে বেড়ানো। ছাত্রদলের তরুণ নেতা-কর্মীদের শেখানো হলো, পদে পদে সব বক্তৃতায় যেন 'তারুণ্যের অহংকার আগামীর রাষ্ট্রনায়ক' বিশেষণগুলো যুক্ত করে তারেকের নাম উচ্চারিত হয়। এভাবে গোষ্ঠীতন্ত্রের বদলে পারিবারিক দল হিসেবে নিশ্চিত রূপ পেয়ে যায় বিএনপি।
জোট সরকারের গত আমলটিতে ভুক্তভোগীর আর্তনাদ আর জনশ্রুতিতে বিএনপির দলান্ধ ও কৃপাপ্রার্থী নেতা-কর্মী ছাড়া মোটামুটি দেশবাসী সবার কাছে তারেক রহমানের নামের সঙ্গে আরো অনেক উপাধি যুক্ত হয়ে গিয়েছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এর সরব প্রকাশ আইনের চোখে কতটা প্রামাণ্য, কতটা প্রামাণ্য নয়_তা আইন বিচার করলেও সাধারণ মানুষ বিশ্বাসের জায়গা থেকে অনেকটাই বাদ দিতে পারেনি। এ বাস্তবতায় দলীয় স্বার্থে বিএনপির রাষ্ট্রক্ষমতায় আসা জরুরি ছিল। কিন্তু নিয়তির বজ্রাঘাতে তা সম্ভব হলো না।
তাই হতাশ বিএনপির নেতারা নিজ রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় দল বাঁচানো আর এগিয়ে নেওয়ার আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেললেন বা তেমন পরিবেশ খুঁজে পেলেন না। ফলে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে ঘিরে পারিবারিক দলেরই পৃষ্ঠপোষক হলেন সবাই। এতকালে যে ঐতিহ্য গড়েছে বিএনপি, তাতে ক্ষমতাহীন থেকে মানুষের কাছে পেঁৗছার জন্য বক্তৃতার মঞ্চ আর টিভি ক্যামেরার সামনে অনেক বেশি মুখর থাকা ছাড়া কোনো উপায় যেন নেই দলটির একান্ত বাধ্যগত নেতাদের। ক্যামেরার সামনে প্রতিদিনের কথা বলা পারফরম্যান্স দেখে তো স্বাভাবিকভাবেই মনে হতে পারে, ভারপ্রাপ্ত বা ভারমুক্ত সব মহাসচিবের যোগ্যতা প্রমাণের এটিই প্রধান মাধ্যম। এ কারণে সব কিছু ছাপিয়ে পরিবারতন্ত্রই প্রকাশ্য হয়। সরকারের আচরণের সমালোচনা করতে গিয়ে এঁরা নিজ দল এবং এর নেতা-কর্মী সবাইকে গৌণ করে দিয়ে দমে দমে 'জিয়া পরিবার ধ্বংসের ষড়যন্ত্র' টাইপের বক্তৃতা বেশি দিতে থাকেন। কিন্তু দলের নীতিনির্ধারকরা একবারও ভাবেন না, এ দেশের গণতন্ত্র-পছন্দ মানুষ দলের বৃহত্তর আঙ্গিক রেখে পরিবারতন্ত্রের একচ্ছত্র দাপটকে মানসিকভাবে স্বাগত জানাবে না। আর এমন ঘরানা তৈরি হওয়ায় বিএনপি নেতারা দিন দিন রাজনীতির মাঠে নিজেদের অযোগ্য করে ফেলছেন।
সাম্প্রতিক একটি প্রামাণ্যভাষ্য এর স্পষ্টতা দেবে। ১৩ সেপ্টেম্বর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এক মানববন্ধন আয়োজনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য প্রবীণ নেতা নজরুল ইসলাম খান বলেন, 'খালেদা ও তারেককে রাজনীতির বাইরে রেখে সরকার ফাঁকা মাঠে গোল দিতে চায়।' এটি আঁতকে যাওয়ার মতো কথা। বিএনপির মতো একটি বড় দলের কি তাহলে এখন এই দশা যে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের অনুপস্থিতিতে বিএনপির রাজনীতির মাঠ পুরোটাই ফাঁকা হয়ে যায়! তাহলে এতসব হেভিওয়েট নেতার দলে থাকা কেন! গোলপোস্ট আগলে রাখার মতো কোনো যোগ্যতাই কি তাঁদের নেই? এমন বক্তব্যে আওয়ামী লীগ কতটা খুশি হয়েছে জানি না, তবে দলের প্রতি ভালোবাসা আছে বিএনপির এমন অসংখ্য নেতা-কর্মী হতাশ হয়েছেন। এসব নেতার অকর্মণ্যতায় ক্ষুব্ধও হয়েছেন অনেকে। এবার ক্ষুব্ধ-হতাশ কর্মীবাহিনী যদি জার্সি খুলে নেন তখন কী দশা হবে? দুই মহাজনের বিহনে সব নেতা নিজেদের হরিজন মেনে নেবেন_এটি কারো কাম্য হতে পারে না।
সরকারবিরোধী আন্দোলনে নামার ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি। এখন এর বিকল্পও তাদের কাছে নেই। এই সময় দলীয় নেতৃত্বের এহেন আত্মবিশ্বাসের ক্ষরণ দলের জন্য অশনিসংকেত। দলীয় নেত্রী খালেদা জিয়াকেই প্রথম এই সত্য মানতে হবে। রাজনীতির অভিজ্ঞতা ও ঐতিহ্যের দৃষ্টিতে জিয়া পরিবার মতিলাল নেহরুর পরিবার নয়। আবার বাংলাদেশের মানুষ অতটা নির্বোধ এবং গাড়লও নয়। তাদের রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামের দীর্ঘ অতীত আছে। তাই কিছুসংখ্যক অন্ধ আর পোষ্য নেতা-কর্মীর হর্ষধ্বনি ও করতালিতে আবিষ্ট হলে চলবে না। কঠিন বাস্তব মানতে হবে। খালেদা জিয়া যদি পরিবারতন্ত্রের কূপমণ্ডূকতা থেকে দলকে মুক্তি না দেন এবং বিএনপির নীতিনির্ধারক নেতারা যদি স্বাধীন হতে না পারেন, তবে বিশাল দল পরিচালনা করার যোগ্য সহিস খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। হতাশা আঁকড়ে ধরবে। 'তারেক জিয়া জিগির' এ সময় বিএনপির জন্য কতটা পরিবেশবান্ধব, তা ভাবতে হবে। মানতে হবে, সব ঘোড়াই রেসে জেতে না।
এখন এ আলামত একটু একটু দৃশ্যমান হচ্ছে। বিএনপির দলীয় ও পেশাজীবী সংগঠনগুলোর অন্তর্দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য হচ্ছে। বাস্তবতা মেনে বিএনপি নেতাদের বলতে হচ্ছে, সরকার বিএনপিকে ভাঙার চেষ্টা করছে। রাজনীতির স্বার্থে কূটকৌশল তো থাকবেই। সেসব মোকাবিলা করাই হচ্ছে সাফল্য। আজকে বিএনপি নেতাদের এই বিপন্ন বক্তব্য হতাশারই প্রকাশ।
আমরা আশা করব, দলের সংহতি ও শক্তি ফিরিয়ে আনার জন্য দলকে পরিবারতান্ত্রিক ধারণা থেকে মুক্ত করতে সচেষ্ট হবেন বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। এ জন্য অবশ্য বিএনপিকে ভালোবাসেন এমন কর্মী-সমর্থকদের সোচ্চার হতে হবে। পারস্পরিক অবিশ্বাস আর হতাশার মধ্যে যেকোনো আকৃতির দলই নিজের অখণ্ডতা ধরে রাখতে পারে না। সরকারবিরোধী আন্দোলন শাণানোর আগে খালেদা জিয়া, তারেক রহমানসহ দলীয় নেতা-নেত্রীদের এ সত্যকে সর্বাধিক গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে।
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
কিন্তু বিএনপিকে নিয়ে সম্প্রতি সচেতন মানুষের আশঙ্কা অনেক বেড়ে গেছে। মানুষ তো মেনেই নিয়েছে রাষ্ট্রক্ষমতার আবর্তনের খেলায় আজ না হয় কাল বিএনপি আবার ক্ষমতার মসনদে বসবে। যদি না তৃতীয় কোনো রাজনৈতিক শক্তি প্রবল প্রতাপে সামনে এগিয়ে আসে। এ পর্যন্ত পড়ে কোনো সম্মানিত পাঠক, বিশেষ করে বিএনপি-অন্তপ্রাণ পাঠক মনে করতে পারেন, এমন মন্তব্য তো আগের প্যারাতে করিনি। তাহলে কি আমি আওয়ামী লীগের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করেছি! আমি বিনয়ের সঙ্গে বলব, বিষয়টি মোটেও তেমন নয়। বিএনপির রাজনৈতিক দৈন্যের প্রকাশ এমন মন্তব্য করার পথ তৈরি করে দিয়েছে।
এ কথা তো মানতে হবে, অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে নো-ম্যানসল্যান্ডের মতো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছরের পর বিপুল জনসমর্থন নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট বিএনপির প্রতি একটি শক্ত চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে সরকার গঠন করে। যদিও সরকার পরিচালনার শুরু থেকেই আওয়ামী লীগ সম্ভাবনার দরজাগুলো খুলে দিতে তেমন সফল হয়নি। এখনো সঠিক ছন্দ খুঁজে পায়নি বলে বলা যায়, ভবিষ্যৎ নির্মাণের সুযোগগুলোরও অপচয় করছে। তার পরও এসব সুবিধা কাজে লাগাতে পারছে না বিএনপি। এর কারণ খুব অস্পষ্ট নয়। একটি আদর্শিক জায়গায় দাঁড়াতে না পারলে নানা মত-পথের সুবিধাবাদী মানুষের ক্লাব বড় কোনো ঐক্য গড়ে তুলতে পারে না। আদর্শিক রাজনীতির পরিবেশে বেড়ে ওঠা দল রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে দীর্ঘদিন থাকলেও হতাশাগ্রস্ততায় খণ্ডিত হয়ে যায় না। রাজনীতির ময়দানেই নিজের শক্তি সংহত করে। কিন্তু বিএনপি নেতা-নেত্রীদের সে সুবিধা কম। হাজার বিতর্কের মধ্য দিয়ে জিয়াউর রহমানের উত্থান হলেও তিনি বিএনপি গড়েছিলেন বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের মতো একটি আদর্শের জন্ম দিয়ে। হয়তো এ ধরনের জাতীয়তাবাদী আদর্শ নিয়ে তাত্তি্বক বিতর্ক থাকতে পারে। কিন্তু সে সময়ের বাস্তবতায় উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষ আকৃষ্ট হয়েছিল। তবে দূরদর্শিতা নিয়ে বাংলাদেশের বাস্তবতা যদি অনুধাবন করতেন এবং জামায়াতে ইসলামীর মতো মৌলবাদী সংগঠনগুলোর সংশ্লিষ্টতা এড়িয়ে বিএনপির সাংগঠনিক ভিত শক্ত করতে চাইতেন, তবে দলের জন্য তা কল্যাণের হতো। লক্ষণীয় যে জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুকে খাটো করে এবং মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বের আসনে বঙ্গবন্ধুকে ধোঁয়াচ্ছন্ন করে ইতিহাসকে অস্বীকার করতে চাননি। স্বকপোলকল্পিত ইতিহাসও রচনা করতে চাননি। কিন্তু দুর্ভাগ্য বিএনপির, দলটি জিয়াউর রহমানকে হারাল কঠিন এক সময়ে। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বের নতুন বিএনপি কার্যত আদর্শচ্যুত হলো। বেঁচে থাকা ও এগিয়ে যাওয়ার জন্য বিভ্রান্ত পথ বেছে নিল। এ সময় সুবিধাবাদী ক্ষমতালিপ্সু নেতাদের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব একক ক্ষমতাধর করে দিল খালেদা জিয়াকে। ঐতিহ্যের শূন্যতা থেকে এবং সংস্কৃতিবোধের বাইরে থেকে রাজনীতির ময়দানে কোনো পরিবার নিয়ন্ত্রিত দল মহীরুহ হয়ে উঠতে পারে না। এতে বরং পরিবারের বাইরের দলের সিনিয়র নেতারা দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে যান। দলছুট 'প্রাজ্ঞ' নেতারাও এভাবে একসময় দলের প্রধান ক্ষমতাসীন নেতা বা নেত্রীর কৃপাপ্রার্থী হয়ে পড়েন। এ অবস্থা দলের ভিত্তিকে নড়বড়ে করে দেয়। এমন দল তুলনামূলক ভালো থাকে শুধু রাষ্ট্রক্ষমতার জীয়নকাঠি হাতে থাকলে। তবে প্রধান নেতা-নেত্রীর কৃপার দিকেই তাকিয়ে থাকতে হয় খুচরা নেতাদের। যে কারণে এসব নেতার চোখের সামনে একজন কিশোর তারেক রহমানের বেড়ে ওঠা, যৌবনে পদার্পণ, শিক্ষা-দীক্ষা, সংস্কৃতিবোধ, রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ও অনুশীলন_সব কাছে থেকে দেখার পরও অদ্ভুত গণতন্ত্রের দেশে ২০-৩০-৫০ বছর রাজনীতি করা নেতারা দলীয় নেত্রীর আদেশে অবলীলায় ঘাড় নিচু করে দিলেন। আর সেসব ঘাড় ডিঙিয়ে তারেক রহমান দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব হয়ে গেলেন (এখন তো দ্বিতীয় প্রধান)। সবাই ঘাড় উঁচু করে মারহাবা বললেন আর হাততালি দিলেন। তার পর থেকে এই কৃপাপ্রার্থীদের দায়িত্ব হলো, রাজনীতির মাঠে হঠাৎ আবির্ভূত তারেক রহমান যে একজন বিদগ্ধ মহান নেতা, তা অহরাত্রি প্রচার করে বেড়ানো। ছাত্রদলের তরুণ নেতা-কর্মীদের শেখানো হলো, পদে পদে সব বক্তৃতায় যেন 'তারুণ্যের অহংকার আগামীর রাষ্ট্রনায়ক' বিশেষণগুলো যুক্ত করে তারেকের নাম উচ্চারিত হয়। এভাবে গোষ্ঠীতন্ত্রের বদলে পারিবারিক দল হিসেবে নিশ্চিত রূপ পেয়ে যায় বিএনপি।
জোট সরকারের গত আমলটিতে ভুক্তভোগীর আর্তনাদ আর জনশ্রুতিতে বিএনপির দলান্ধ ও কৃপাপ্রার্থী নেতা-কর্মী ছাড়া মোটামুটি দেশবাসী সবার কাছে তারেক রহমানের নামের সঙ্গে আরো অনেক উপাধি যুক্ত হয়ে গিয়েছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এর সরব প্রকাশ আইনের চোখে কতটা প্রামাণ্য, কতটা প্রামাণ্য নয়_তা আইন বিচার করলেও সাধারণ মানুষ বিশ্বাসের জায়গা থেকে অনেকটাই বাদ দিতে পারেনি। এ বাস্তবতায় দলীয় স্বার্থে বিএনপির রাষ্ট্রক্ষমতায় আসা জরুরি ছিল। কিন্তু নিয়তির বজ্রাঘাতে তা সম্ভব হলো না।
তাই হতাশ বিএনপির নেতারা নিজ রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় দল বাঁচানো আর এগিয়ে নেওয়ার আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেললেন বা তেমন পরিবেশ খুঁজে পেলেন না। ফলে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে ঘিরে পারিবারিক দলেরই পৃষ্ঠপোষক হলেন সবাই। এতকালে যে ঐতিহ্য গড়েছে বিএনপি, তাতে ক্ষমতাহীন থেকে মানুষের কাছে পেঁৗছার জন্য বক্তৃতার মঞ্চ আর টিভি ক্যামেরার সামনে অনেক বেশি মুখর থাকা ছাড়া কোনো উপায় যেন নেই দলটির একান্ত বাধ্যগত নেতাদের। ক্যামেরার সামনে প্রতিদিনের কথা বলা পারফরম্যান্স দেখে তো স্বাভাবিকভাবেই মনে হতে পারে, ভারপ্রাপ্ত বা ভারমুক্ত সব মহাসচিবের যোগ্যতা প্রমাণের এটিই প্রধান মাধ্যম। এ কারণে সব কিছু ছাপিয়ে পরিবারতন্ত্রই প্রকাশ্য হয়। সরকারের আচরণের সমালোচনা করতে গিয়ে এঁরা নিজ দল এবং এর নেতা-কর্মী সবাইকে গৌণ করে দিয়ে দমে দমে 'জিয়া পরিবার ধ্বংসের ষড়যন্ত্র' টাইপের বক্তৃতা বেশি দিতে থাকেন। কিন্তু দলের নীতিনির্ধারকরা একবারও ভাবেন না, এ দেশের গণতন্ত্র-পছন্দ মানুষ দলের বৃহত্তর আঙ্গিক রেখে পরিবারতন্ত্রের একচ্ছত্র দাপটকে মানসিকভাবে স্বাগত জানাবে না। আর এমন ঘরানা তৈরি হওয়ায় বিএনপি নেতারা দিন দিন রাজনীতির মাঠে নিজেদের অযোগ্য করে ফেলছেন।
সাম্প্রতিক একটি প্রামাণ্যভাষ্য এর স্পষ্টতা দেবে। ১৩ সেপ্টেম্বর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এক মানববন্ধন আয়োজনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য প্রবীণ নেতা নজরুল ইসলাম খান বলেন, 'খালেদা ও তারেককে রাজনীতির বাইরে রেখে সরকার ফাঁকা মাঠে গোল দিতে চায়।' এটি আঁতকে যাওয়ার মতো কথা। বিএনপির মতো একটি বড় দলের কি তাহলে এখন এই দশা যে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের অনুপস্থিতিতে বিএনপির রাজনীতির মাঠ পুরোটাই ফাঁকা হয়ে যায়! তাহলে এতসব হেভিওয়েট নেতার দলে থাকা কেন! গোলপোস্ট আগলে রাখার মতো কোনো যোগ্যতাই কি তাঁদের নেই? এমন বক্তব্যে আওয়ামী লীগ কতটা খুশি হয়েছে জানি না, তবে দলের প্রতি ভালোবাসা আছে বিএনপির এমন অসংখ্য নেতা-কর্মী হতাশ হয়েছেন। এসব নেতার অকর্মণ্যতায় ক্ষুব্ধও হয়েছেন অনেকে। এবার ক্ষুব্ধ-হতাশ কর্মীবাহিনী যদি জার্সি খুলে নেন তখন কী দশা হবে? দুই মহাজনের বিহনে সব নেতা নিজেদের হরিজন মেনে নেবেন_এটি কারো কাম্য হতে পারে না।
সরকারবিরোধী আন্দোলনে নামার ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি। এখন এর বিকল্পও তাদের কাছে নেই। এই সময় দলীয় নেতৃত্বের এহেন আত্মবিশ্বাসের ক্ষরণ দলের জন্য অশনিসংকেত। দলীয় নেত্রী খালেদা জিয়াকেই প্রথম এই সত্য মানতে হবে। রাজনীতির অভিজ্ঞতা ও ঐতিহ্যের দৃষ্টিতে জিয়া পরিবার মতিলাল নেহরুর পরিবার নয়। আবার বাংলাদেশের মানুষ অতটা নির্বোধ এবং গাড়লও নয়। তাদের রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামের দীর্ঘ অতীত আছে। তাই কিছুসংখ্যক অন্ধ আর পোষ্য নেতা-কর্মীর হর্ষধ্বনি ও করতালিতে আবিষ্ট হলে চলবে না। কঠিন বাস্তব মানতে হবে। খালেদা জিয়া যদি পরিবারতন্ত্রের কূপমণ্ডূকতা থেকে দলকে মুক্তি না দেন এবং বিএনপির নীতিনির্ধারক নেতারা যদি স্বাধীন হতে না পারেন, তবে বিশাল দল পরিচালনা করার যোগ্য সহিস খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। হতাশা আঁকড়ে ধরবে। 'তারেক জিয়া জিগির' এ সময় বিএনপির জন্য কতটা পরিবেশবান্ধব, তা ভাবতে হবে। মানতে হবে, সব ঘোড়াই রেসে জেতে না।
এখন এ আলামত একটু একটু দৃশ্যমান হচ্ছে। বিএনপির দলীয় ও পেশাজীবী সংগঠনগুলোর অন্তর্দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য হচ্ছে। বাস্তবতা মেনে বিএনপি নেতাদের বলতে হচ্ছে, সরকার বিএনপিকে ভাঙার চেষ্টা করছে। রাজনীতির স্বার্থে কূটকৌশল তো থাকবেই। সেসব মোকাবিলা করাই হচ্ছে সাফল্য। আজকে বিএনপি নেতাদের এই বিপন্ন বক্তব্য হতাশারই প্রকাশ।
আমরা আশা করব, দলের সংহতি ও শক্তি ফিরিয়ে আনার জন্য দলকে পরিবারতান্ত্রিক ধারণা থেকে মুক্ত করতে সচেষ্ট হবেন বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। এ জন্য অবশ্য বিএনপিকে ভালোবাসেন এমন কর্মী-সমর্থকদের সোচ্চার হতে হবে। পারস্পরিক অবিশ্বাস আর হতাশার মধ্যে যেকোনো আকৃতির দলই নিজের অখণ্ডতা ধরে রাখতে পারে না। সরকারবিরোধী আন্দোলন শাণানোর আগে খালেদা জিয়া, তারেক রহমানসহ দলীয় নেতা-নেত্রীদের এ সত্যকে সর্বাধিক গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে।
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
No comments