নির্বাচন কমিশনঃ কিছু অসমাপ্ত দায়িত্ব by তোফায়েল আহমেদ
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে গঠিত বর্তমান নির্বাচন কমিশনের প্রধানসহ অপর দুই কমিশনার আগামী পাঁচ মাসের মধ্যে তাঁদের কার্যকাল শেষ করতে যাচ্ছেন। বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনারের ইতিহাসে এত নির্বিঘ্নে ও সম্মানজনকভাবে কেউই তাঁদের কার্যকাল শেষ করতে পারেননি। এই কমিশনের বিরুদ্ধেও অভিযোগ বা কিছু কাজকর্ম নিয়ে একেবারে বিতর্ক নেই, একথা কেউ বলবে না। তবে সামগ্রিক বিচারে কমিশনের কার্যকালে সফলভাবে সমাপ্ত কার্যতালিকা বেশ দীর্ঘই বলতে হবে। তাঁদের সমাপ্ত কাজের মধ্যে কিছু কাজ যুগান্তকারী।
বিশেষত ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা, অন্তত ৯৯ শতাংশ শুদ্ধ ভোটার তালিকা নিশ্চিতকরণ, ছবিসহ ভোটার আইডি কার্ড (যা ন্যাশনাল আইডি কার্ড হিসেবে জনপ্রিয়তা পেয়েছে), রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন, নিবন্ধনের শর্ত অনুযায়ী বার্ষিক হিসাব পেশ ও গ্রহণ, জনপ্রতিনিধিত্ব আইন সংশোধনে সরকারকে সহায়তা প্রদান এবং শেষ পর্যন্ত একটি গ্রহণযোগ্য সংশোধনী পাস হওয়া, নির্বাচন কমিশনের দেশব্যাপী নতুন সাংগঠনিক ও ভৌত অবকাঠামো সৃষ্টি, কমিশনের নিজস্ব সমর্থতা বৃদ্ধি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য সফলতার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। তা ছাড়া সত্যিকারের বড় সাফল্য হচ্ছে ২০০৮-এর সফল নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন, ২০০৯-এর উপজেলা পরিষদ নির্বাচন এবং ২০১০-এর চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা নির্বাচন।
এসবের মধ্যে কমিশনের উজ্জ্বল ভাবমূর্তি কিছুটা ম্লান করেছে একটি বা দুটি জাতীয় সাংসদের উপনির্বাচন এবং কিছুসংখ্যক পৌরসভা নির্বাচন। সম্প্রতি সমাপ্ত ইউপি নির্বাচনে কিছু বিচ্যুতি লক্ষ করা যায়। তাই যে মাত্রার সফলতা জাতীয় সংসদ, উপজেলা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দেখা গেছে, সে তুলনায় পরের নির্বাচনগুলোর সাফল্য কিছুটা ম্লান—তা স্বীকার করতে দ্বিধা নেই। তবে এ ক্ষেত্রে আমাদের এটিও মনে রাখা উচিত, নির্বাচন ব্যবস্থাপনায় বা একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য শুধু কমিশনের একার উদ্যোগ যথেষ্ট নয়, এটি বহু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের একটি মিলিত উদ্যোগ। এখানে সবার দায়দায়িত্ব থাকে। অন্য সবাই দায়িত্ব-বিচ্যুত হলে এককভাবে কমিশনকে দায়ী করা যাবে, কিন্তু অবস্থার উন্নয়ন ঘটানো পুরোপুরি সম্ভব নয়। তবে যেটি একটি নিরপেক্ষ কমিশনের কাছ থেকে কাম্য, তা হচ্ছে তাদের অবস্থানের স্পষ্ট ব্যাখ্যা। অনিয়মের বিরুদ্ধে দৃঢ় পদক্ষেপ। এসব আইনি পদক্ষেপের রাজনৈতিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া এবং ফলাফল নিয়ে কমিশনের স্বাভাবিক নিয়মে মাথা ঘামানোর কথা নয়। তবে তাঁরা দেশের রাজনীতির রূঢ় বাস্তবতার সঙ্গে মাঝেমধ্যে যে কৌশলগত আপস করেছেন, তা খুব একটা লুকাতে পারেননি। তবে জনসাধারণের সাধারণ চোখে ব্যক্তি হিসেবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্য দুই কমিশনারের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়নি।
এই কমিশন তাদের মেয়াদের শেষ বর্ষে আরও কিছু সাহসী ও অতি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল। প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্যান্য কমিশনার নিয়োগবিষয়ক আইন, জাতীয় নির্বাচনে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে নির্বাচনী তহবিল সহায়তা এবং আরপিওর আরও সংশোধনী। তা ছাড়া ‘ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন’-এর ব্যবহার সম্পর্কেও তাঁরা নীতিমালার খসড়া তৈরি করেছেন। কিন্তু এসব পদক্ষেপের বাস্তবায়নে সরকারের দিক থেকে এখনো ইতিবাচক কোনো সাড়া সম্ভবত পাওয়া যায়নি।
অক্টোবর ২০১১-এর মধ্যে নবগঠিত নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, এ নির্বাচনটি কমিশনের সামনে তাদের সাফল্যের ধারাবাহিকতায় আরেকটি বৃহৎ চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দেবে। নারায়ণগঞ্জ সব সময় রাজনৈতিকভাবে উত্তপ্ত একটি শহর। খুন-খারাবি, দুর্বৃত্তায়ন ও সন্ত্রাসের দীর্ঘ ধারাবাহিকতা এখানে ছিল। তা ছাড়া একটি সরকারের তৃতীয় বর্ষের শেষ প্রান্তে এ নির্বাচন। তাই এর রাজনৈতিক গুরুত্ব উত্তাপ-উত্তেজনার সঙ্গে নির্বাচনী আইনকে মানিয়ে নির্বাচন সম্পন্ন করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ বটে। আশা করি, কমিশন পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে পরিপূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে তফসিল ঘোষণা করেছে। নারায়ণগঞ্জ ছাড়া কুমিল্লা, গাজীপুর, টঙ্গী, রংপুর প্রভৃতি সিটি করপোরেশনেরও নির্বাচনের সময় এ কমিশনের মেয়াদের মধ্যে এসে পড়বে। তবে বর্তমান কমিশন এ নির্বাচনগুলো শেষ করার ব্যাপারে কতটুকু প্রস্তুত, জানা যায়নি। দেশের মানুষ চাইবে, বর্তমান কমিশন এ নির্বাচনগুলো সমাপ্ত করেই বিদায় নিক।
ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়াদোত্তীর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন সক্রিয় কোনো ভূমিকা পালন করেনি। তারা সরকারের ওপর দায়ভার চাপিয়ে নিজেদের কাঁধ হালকা রেখেছে। কোনো কোনো সময় এমনও শোনা গেছে, ‘তামাদি হয়ে যাওয়া’ নির্বাচনের ক্ষেত্রে কমিশনের কিছু করার নেই। তারা নতুন নির্বাচন এবং মেয়াদ শেষ হওয়ার অব্যবহিত পরের নির্বাচনগুলোই শুধু করতে পারে।
কথাটি বাজারে চালু হলেও সত্য এবং সংগত নয়। নির্বাচন তামাদি হতে পারে না এবং হয় না। নির্বাচন মেয়াদোত্তীর্ণ হতে পারে। যেমন হয়েছে ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভা নির্বাচন। একইভাবে বিলম্বিত ছিল নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। তাই ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের ব্যর্থতা এই নির্বাচন কমিশনকে বহন করতে হবে। এ দায় পুরোপুরি অস্বীকার করা যাবে না।
নবম জাতীয় সংসদের সব প্রার্থী ও নির্বাচিত সদস্যের নির্বাচনী ব্যয়, নির্বাচনী ব্যয়ে অসংগতি, মামলায় শাস্তি হওয়া সত্ত্বেও আদালতের অন্তর্বর্তীকালীন আদেশে নির্বাচন অনুষ্ঠানসহ বিবিধ বিষয়, যা কমিশনে এবং আদালতে ঝুলে থাকল—এসব বিষয়ে কমিশন ‘ধীরে চলো নীতি’ নিয়েছে বলে পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা। কমিশনের বাকি সময়ে এ বিষয়গুলো স্বচ্ছ হওয়া প্রয়োজন। তা ছাড়া কোনো কোনো সাংসদ নির্বাচনী আইন লঙ্ঘন করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। যেমন—তথ্য গোপন করে সরকারি প্রতিষ্ঠানের ঠিকাদার হয়ে নির্বাচনে লড়েছেন অথবা নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর ঠিকাদার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন, এখানে নির্বাচন কমিশন পুরোপুরি নীরব। এসব ক্ষেত্রে সক্রিয় হস্তক্ষেপ নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক দায়িত্বের অন্তর্গত। সর্বশেষ কিছু অসমাপ্ত কাজ, যা নির্বাচন কমিশন অনেক আগে করতে পারত। কিন্তু করেনি। এখনো করার কোনো লক্ষণ প্রকাশ পাচ্ছে না, সে রকম কয়েকটি কাজের কথা বলি। উপজেলা পরিষদ নির্বাচন হয় ২০০৯ সালে। এরপর নানা কারণে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানের কিছু পদ শূন্য হয়েছে। ওই শূন্য পদগুলোতে আইন অনুযায়ী ৯০ দিনের মধ্যে উপনির্বাচন করার কথা। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, নির্বাচন কমিশনকে ওই শূন্য পদে উপনির্বাচনের অনুরোধও করা হয়েছে; কিন্তু কমিশন এই উপনির্বাচনগুলোর ব্যাপারে রহস্যজনকভাবে নীরব।
উপজেলা পরিষদের এক-তৃতীয়াংশ সংরক্ষিত আসনের নারী সদস্য নির্বাচনেরও কোনো উদ্যোগ ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভা নির্বাচন শেষ হওয়ার পরও গ্রহণ না করা উদ্বেগজনক। কমিশনের উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তারা এই নির্বাচন এক সপ্তাহের মধ্যেই শেষ করতে পারেন। কমিশনের অবহেলার কারণে উপজেলা পরিষদের সংরক্ষিত নারী আসন পরিষদ গঠনের দুই বছর সাত মাস পরও পূরণ হলো না। তাই কমিশন তাদের বাকি সময়ের মধ্যে উপজেলা পরিষদের শূন্য পদগুলো পূরণের জন্য যেখানে যা প্রযোজ্য, উপনির্বাচন ও সংরক্ষিত আসনের নির্বাচনগুলো শেষ করার ব্যবস্থা নিলে দেশের উপজেলা পরিষদগুলো পরিষদ হিসেবে পূর্ণাঙ্গতা পেতে পারে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজেলা পরিষদ, ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভা নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব হলেও বিদ্যমান আইন অনুযায়ী জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদের নির্বাচনগুলো অনুষ্ঠান করা হলো না। জেলা পরিষদে ২০ বছর ধরে নির্বাচন নেই। আঞ্চলিক পরিষদ গঠনের সময় থেকে এ পর্যন্ত কোনো নির্বাচন হয়নি। সংশ্লিষ্ট আইনগুলো পর্যালোচনা করে এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। এ বিষয়ে অন্তত মেয়াদ শেষ করার আগে একটি পর্যবেক্ষণ ও নির্দেশনা থাকা উচিত। এসব বিষয়ে সরকারি নির্দেশনা পাওয়া না গেলে কমিশন আদালত থেকে নির্দেশনা চাইতে পারে। অসমাপ্ত কাজগুলোর একটি তালিকা তাঁদের পর্যবেক্ষণসহ পরবর্তী কমিশনের জন্য রেখে যেতে পারেন।
বর্তমান নির্বাচন কমিশনের গায়ে সাফল্যের অনেক সুবর্ণ পালক শোভা পাচ্ছে। নিঃসন্দেহে জাতি এ তিন কমিশনারের কাছে তাঁদের দক্ষতা, নিরপেক্ষতা ও নিষ্ঠার জন্য কৃতজ্ঞ। তবে ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় কিংবা রূঢ় বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে কিছু কিছু কাজ তাঁরা এড়িয়ে যাচ্ছেন, যা সাহসিকতার সঙ্গে করে গেলে কিংবা করার উদ্যোগ নিলে পরবর্তী কমিশনের জন্য হলেও তা নজির হতে পারত এবং এ কমিশনের বিদায় আরও গৌরবজনক হতে পারত।
অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ: সমাজবিজ্ঞানী ও লেখক। E-mail : ahmedt_dr@yahoo.com
এসবের মধ্যে কমিশনের উজ্জ্বল ভাবমূর্তি কিছুটা ম্লান করেছে একটি বা দুটি জাতীয় সাংসদের উপনির্বাচন এবং কিছুসংখ্যক পৌরসভা নির্বাচন। সম্প্রতি সমাপ্ত ইউপি নির্বাচনে কিছু বিচ্যুতি লক্ষ করা যায়। তাই যে মাত্রার সফলতা জাতীয় সংসদ, উপজেলা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দেখা গেছে, সে তুলনায় পরের নির্বাচনগুলোর সাফল্য কিছুটা ম্লান—তা স্বীকার করতে দ্বিধা নেই। তবে এ ক্ষেত্রে আমাদের এটিও মনে রাখা উচিত, নির্বাচন ব্যবস্থাপনায় বা একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য শুধু কমিশনের একার উদ্যোগ যথেষ্ট নয়, এটি বহু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের একটি মিলিত উদ্যোগ। এখানে সবার দায়দায়িত্ব থাকে। অন্য সবাই দায়িত্ব-বিচ্যুত হলে এককভাবে কমিশনকে দায়ী করা যাবে, কিন্তু অবস্থার উন্নয়ন ঘটানো পুরোপুরি সম্ভব নয়। তবে যেটি একটি নিরপেক্ষ কমিশনের কাছ থেকে কাম্য, তা হচ্ছে তাদের অবস্থানের স্পষ্ট ব্যাখ্যা। অনিয়মের বিরুদ্ধে দৃঢ় পদক্ষেপ। এসব আইনি পদক্ষেপের রাজনৈতিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া এবং ফলাফল নিয়ে কমিশনের স্বাভাবিক নিয়মে মাথা ঘামানোর কথা নয়। তবে তাঁরা দেশের রাজনীতির রূঢ় বাস্তবতার সঙ্গে মাঝেমধ্যে যে কৌশলগত আপস করেছেন, তা খুব একটা লুকাতে পারেননি। তবে জনসাধারণের সাধারণ চোখে ব্যক্তি হিসেবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্য দুই কমিশনারের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়নি।
এই কমিশন তাদের মেয়াদের শেষ বর্ষে আরও কিছু সাহসী ও অতি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল। প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্যান্য কমিশনার নিয়োগবিষয়ক আইন, জাতীয় নির্বাচনে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে নির্বাচনী তহবিল সহায়তা এবং আরপিওর আরও সংশোধনী। তা ছাড়া ‘ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন’-এর ব্যবহার সম্পর্কেও তাঁরা নীতিমালার খসড়া তৈরি করেছেন। কিন্তু এসব পদক্ষেপের বাস্তবায়নে সরকারের দিক থেকে এখনো ইতিবাচক কোনো সাড়া সম্ভবত পাওয়া যায়নি।
অক্টোবর ২০১১-এর মধ্যে নবগঠিত নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, এ নির্বাচনটি কমিশনের সামনে তাদের সাফল্যের ধারাবাহিকতায় আরেকটি বৃহৎ চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দেবে। নারায়ণগঞ্জ সব সময় রাজনৈতিকভাবে উত্তপ্ত একটি শহর। খুন-খারাবি, দুর্বৃত্তায়ন ও সন্ত্রাসের দীর্ঘ ধারাবাহিকতা এখানে ছিল। তা ছাড়া একটি সরকারের তৃতীয় বর্ষের শেষ প্রান্তে এ নির্বাচন। তাই এর রাজনৈতিক গুরুত্ব উত্তাপ-উত্তেজনার সঙ্গে নির্বাচনী আইনকে মানিয়ে নির্বাচন সম্পন্ন করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ বটে। আশা করি, কমিশন পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে পরিপূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে তফসিল ঘোষণা করেছে। নারায়ণগঞ্জ ছাড়া কুমিল্লা, গাজীপুর, টঙ্গী, রংপুর প্রভৃতি সিটি করপোরেশনেরও নির্বাচনের সময় এ কমিশনের মেয়াদের মধ্যে এসে পড়বে। তবে বর্তমান কমিশন এ নির্বাচনগুলো শেষ করার ব্যাপারে কতটুকু প্রস্তুত, জানা যায়নি। দেশের মানুষ চাইবে, বর্তমান কমিশন এ নির্বাচনগুলো সমাপ্ত করেই বিদায় নিক।
ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়াদোত্তীর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন সক্রিয় কোনো ভূমিকা পালন করেনি। তারা সরকারের ওপর দায়ভার চাপিয়ে নিজেদের কাঁধ হালকা রেখেছে। কোনো কোনো সময় এমনও শোনা গেছে, ‘তামাদি হয়ে যাওয়া’ নির্বাচনের ক্ষেত্রে কমিশনের কিছু করার নেই। তারা নতুন নির্বাচন এবং মেয়াদ শেষ হওয়ার অব্যবহিত পরের নির্বাচনগুলোই শুধু করতে পারে।
কথাটি বাজারে চালু হলেও সত্য এবং সংগত নয়। নির্বাচন তামাদি হতে পারে না এবং হয় না। নির্বাচন মেয়াদোত্তীর্ণ হতে পারে। যেমন হয়েছে ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভা নির্বাচন। একইভাবে বিলম্বিত ছিল নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। তাই ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের ব্যর্থতা এই নির্বাচন কমিশনকে বহন করতে হবে। এ দায় পুরোপুরি অস্বীকার করা যাবে না।
নবম জাতীয় সংসদের সব প্রার্থী ও নির্বাচিত সদস্যের নির্বাচনী ব্যয়, নির্বাচনী ব্যয়ে অসংগতি, মামলায় শাস্তি হওয়া সত্ত্বেও আদালতের অন্তর্বর্তীকালীন আদেশে নির্বাচন অনুষ্ঠানসহ বিবিধ বিষয়, যা কমিশনে এবং আদালতে ঝুলে থাকল—এসব বিষয়ে কমিশন ‘ধীরে চলো নীতি’ নিয়েছে বলে পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা। কমিশনের বাকি সময়ে এ বিষয়গুলো স্বচ্ছ হওয়া প্রয়োজন। তা ছাড়া কোনো কোনো সাংসদ নির্বাচনী আইন লঙ্ঘন করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। যেমন—তথ্য গোপন করে সরকারি প্রতিষ্ঠানের ঠিকাদার হয়ে নির্বাচনে লড়েছেন অথবা নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর ঠিকাদার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন, এখানে নির্বাচন কমিশন পুরোপুরি নীরব। এসব ক্ষেত্রে সক্রিয় হস্তক্ষেপ নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক দায়িত্বের অন্তর্গত। সর্বশেষ কিছু অসমাপ্ত কাজ, যা নির্বাচন কমিশন অনেক আগে করতে পারত। কিন্তু করেনি। এখনো করার কোনো লক্ষণ প্রকাশ পাচ্ছে না, সে রকম কয়েকটি কাজের কথা বলি। উপজেলা পরিষদ নির্বাচন হয় ২০০৯ সালে। এরপর নানা কারণে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানের কিছু পদ শূন্য হয়েছে। ওই শূন্য পদগুলোতে আইন অনুযায়ী ৯০ দিনের মধ্যে উপনির্বাচন করার কথা। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, নির্বাচন কমিশনকে ওই শূন্য পদে উপনির্বাচনের অনুরোধও করা হয়েছে; কিন্তু কমিশন এই উপনির্বাচনগুলোর ব্যাপারে রহস্যজনকভাবে নীরব।
উপজেলা পরিষদের এক-তৃতীয়াংশ সংরক্ষিত আসনের নারী সদস্য নির্বাচনেরও কোনো উদ্যোগ ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভা নির্বাচন শেষ হওয়ার পরও গ্রহণ না করা উদ্বেগজনক। কমিশনের উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তারা এই নির্বাচন এক সপ্তাহের মধ্যেই শেষ করতে পারেন। কমিশনের অবহেলার কারণে উপজেলা পরিষদের সংরক্ষিত নারী আসন পরিষদ গঠনের দুই বছর সাত মাস পরও পূরণ হলো না। তাই কমিশন তাদের বাকি সময়ের মধ্যে উপজেলা পরিষদের শূন্য পদগুলো পূরণের জন্য যেখানে যা প্রযোজ্য, উপনির্বাচন ও সংরক্ষিত আসনের নির্বাচনগুলো শেষ করার ব্যবস্থা নিলে দেশের উপজেলা পরিষদগুলো পরিষদ হিসেবে পূর্ণাঙ্গতা পেতে পারে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজেলা পরিষদ, ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভা নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব হলেও বিদ্যমান আইন অনুযায়ী জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদের নির্বাচনগুলো অনুষ্ঠান করা হলো না। জেলা পরিষদে ২০ বছর ধরে নির্বাচন নেই। আঞ্চলিক পরিষদ গঠনের সময় থেকে এ পর্যন্ত কোনো নির্বাচন হয়নি। সংশ্লিষ্ট আইনগুলো পর্যালোচনা করে এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। এ বিষয়ে অন্তত মেয়াদ শেষ করার আগে একটি পর্যবেক্ষণ ও নির্দেশনা থাকা উচিত। এসব বিষয়ে সরকারি নির্দেশনা পাওয়া না গেলে কমিশন আদালত থেকে নির্দেশনা চাইতে পারে। অসমাপ্ত কাজগুলোর একটি তালিকা তাঁদের পর্যবেক্ষণসহ পরবর্তী কমিশনের জন্য রেখে যেতে পারেন।
বর্তমান নির্বাচন কমিশনের গায়ে সাফল্যের অনেক সুবর্ণ পালক শোভা পাচ্ছে। নিঃসন্দেহে জাতি এ তিন কমিশনারের কাছে তাঁদের দক্ষতা, নিরপেক্ষতা ও নিষ্ঠার জন্য কৃতজ্ঞ। তবে ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় কিংবা রূঢ় বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে কিছু কিছু কাজ তাঁরা এড়িয়ে যাচ্ছেন, যা সাহসিকতার সঙ্গে করে গেলে কিংবা করার উদ্যোগ নিলে পরবর্তী কমিশনের জন্য হলেও তা নজির হতে পারত এবং এ কমিশনের বিদায় আরও গৌরবজনক হতে পারত।
অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ: সমাজবিজ্ঞানী ও লেখক। E-mail : ahmedt_dr@yahoo.com
No comments