কবিতা- সাম্প্রতিক সময়ের কিছু কবিতা


তোমার নিমগ্ন অগি্ন
রফিক আজাদ
নিস্তব্ধ প্রহর: তোমার নিমগ্ন অগি্ন
এই শাদা চাদরের প্রান্ত বেয়ে উঠে
আসে, অনায়াসে।
দীর্ঘ প্রতীক্ষার কাল:
আমার বুকের হু-হু বাতাসের সঙ্গে
লতিয়ে উঠছে রাত্রি; মাঝে-মধ্যে খুব
করে অনুভব করি নিজেরই ভিতরে
উনুনের আঁচ- গনগনে কয়লার
লালে স্বভাবের সবটুকু পুড়ে-উড়ে
নিষিদ্ধ সংস্কৃতি!
মানুষ তো ঝুঁকে থাকে
খুব প্রিয় নগ্ন এক সংলগ্ন সত্তায়:
অপর সত্তাটি- ততোধিক প্রিয় আর
আবশ্যিকভাবে মগ্নঃ
নিমগ্ন আঁচল
আর ঐ উঁচুতে সুডৌল মুখের দিকে
উত্তোলিত উচ্চাকাঙ্ক্ষী কাতর দু'হাত
মুগ্ধমূর্তি স্পর্শ করতে বড়ই তৎপর!
তোমার নিমগ্ন অগি্ন আমার দু'চোখেঃ

কে সে যাকে দেখলেই

সাইফুল বারী



তাকে দেখলেই জেগে ওঠে জীবিকার জট

যাকে ভাঙ্গার চেষ্টায় চলে যায় দিন

কোথায় যেনো জমে আছে ভয়ানক গুমোট

স্বপ্নের বিভিন্ন স্তর ক্রমশ হয়ে যায় বিলীন।

যে ভাবেই দেখি ভয়াবহ ত্রুটি অতি সহজে

গিলে খায় সমাজের সব অলিগলি

ক্রমবর্ধমান মানুষের ভীড় যতো আজে-বাজে

স্থানে খুঁটি গাড়ে, দৃষ্টান্ত স্থাপনের পাত্রগুলো খালি।

ধৈর্যকে অনেক কষ্টে ধরে রাখি গোপনে

ভেবে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা গোল বৈঠকে

কিন্তু কোথায় সে ফসল বিশ্বস্ত উঠোনে

যার আত্মার কাছাকাছি বহুদিন নিজেকে

বেঁধে রেখে স্বপ্নের পথ ধরে হেঁটেছি।

কিছু বিরতি থাকবেই সম্পর্কের ইতিহাসে

জানি মেনে নিতে হবে দুর্যোগ যে কোন দুপুরে

মেনে নিতে হবে বিচ্ছিন্ন ঘটনা অনায়াসে

মেনে নিতে হবে অনুপস্থিতি সমস্ত হূদয় জুড়ে।

কিন্তু কে সে যাকে দেখলেই জেগে ওঠে জীবিকার জট?

সে কী কোন প্রেম-প্রীতি-ভালোবাসা নাকি

কোন অসহায় মানুষের পরাজিত দীর্ঘশ্বাস।



পুষ্পলতা

ফজল-এ-খোদা



মুখে লেগে আছে ঠোঁট নোনা স্বাদ

যেন সদ্য চাকভাঙামধু নির্ভেজাল

এমন অনুভব সহসাই জিহ্বায় ধরছে

বৃক্ষে দোলাফল জেসমিনকে মনে পড়ছে



বোঁটা চুষে চুষে মজা হয় বড়

আমরসে মেতে যাই মহানন্দে

দেহে মনে ক্রমান্বয়ে কৈশোর ভরছে

টান টান পুষ্পলতা জেসমিনকে মনে পড়ছে



সরোবরে ঝেপে উথালপাথাল

কিনারা পেয়েও সরবে সাঁতরে যাই

ওপরে ওঠার শেষে ক্লান্ত পাথর করছে

লাজখেলা লজ্জাবতী জেসমিনকে মনে পড়ছে



সেবা পেয়ে স্বস্তি জোটে দিন-রাত

সংসার প্রতিকূল স্রোত রুখে রই

প্রেরণায় এগোবার পথ যতোই গড়ছে

জেসমিন জেসমিন কেবলই মনে পড়ছে





ইতিহাসের নিয়মেই আমি দুর্দমনীয়

মুহম্মদ নূরুল হুদা



একটি বাক্যও মিথ্যা ছিল না

এরকম দাবীর পর,

বিচার বিশেস্নষণে প্রমাণিত হয়

সত্যবান যুধিষ্ঠির সত্য গোপন করেছেন মাত্র

'অশত্থমা হত-ইতি গজ' জাতীয় অর্ধসত্যে

মিথ্যাচারের পাপ আছে বা নেই

এ নিয়ে তর্ক চলতেই থাকে

যদিও প্রবঞ্চনার জ্বালা তাতে একটুও কমে না

এবং গোয়েবলস থিয়োরী যখন

সবচেয়ে চর্চিত, সবচেয়ে বিস্তৃত

নারী তখন প্রান্তিক প্রলেতারিয়েত

তবু ইতিহাস বলে, অনার্যরা অদম্য

ইতিহাসের নিয়মে তাই আমিও দুর্দমনীয়।





মানুষ মেঘের ভেতর

রবিউল হুসাইন



সব স্বপ্ন শেষ হলে একটি স্বপ্ন টিকে থাকে,

গাছের পাতা ঝরে গেলে আবার নতুন পাতা আসে,

পথ কখনো ফুরোয় না, নদীর কাছে শেষ হলে

সে মুখ ডুবিয়ে জলের মধ্যে গিয়ে আবার

ওই পাড়ে ভুঁস্ করে উঠে আসার পরেই

নতুন পথে যাত্রা শুরু করে এবং রাস্তার পাশে

একটু জিরিয়ে নিয়ে চা-টা খেয়ে সামনে চলে,

দুই পাশে ধান ক্ষেত, দূরে ঝুলন্ত দিগন্তরেখা

আকাশ থেকে নেমে দোলনার অদৃশ্য দড়িতে

দোল খায়, মেঘের ভেতর শূন্যে পাখি ওড়ে,

চিল ডাকে, আর মানুষ চিৎকার করে বলে ওঠে

ওপরের দিকে তাকিয়ে, কিন্তু গলা থেকে কোন শব্দ

বের হয় না, সূর্য ডুবে যাচ্ছে, আঁধার চলে আসছে,

মানুষটি সন্ধ্যার হাত ধরে রাস্তায় দাঁড়ায় আর

পথটি কাছে এসে শুধোয়-পথ কেন পথে আসে নেমে,

চিরটাকাল কেন পথ মাটি-সংলগ্ন থাকবে, কেন

মানুষেরাও সবসময় দুঃখ আর কষ্টের ভেতরে রইবে,

সুখ আর আনন্দ একই অস্তিত্বে বিরাজ করে,

বিপরীতে বিষণ্নতা ও বিমর্ষতা মানুষের আদি সত্তা,

স্বস্তিতে বিচ্ছিন্নতা তবুও বোধ হলে বুঝতে হবে-

বর্ষাকাল আসছে এবং খুব বৃষ্টি হবে, সেই বৃষ্টিতে

ভিজে পৃথিবী নরম হয়ে গলে গলে যাবে আর

মানুষ মেঘের ভেতর ডানাহীন পাখিতে রূপ নিয়ে

অন্য কোন পৃথিবীর দিকে ক্লান্তিহীন উড়ে উড়ে যাবে,

কিন্তু কোনোদিন সেখানে পেঁৗছতে পারবে না,

মুখ থুবড়ে আবার এই পৃথিবীর বুকে পড়ে রইবে।





গৃহ ও গৃহী

আল মুজাহিদী



তোমার গৃহের দুঃখগুলো বাইরে নিয়ে যেও না যেন

গৃহী, তোমার সমস্ত দুঃখ-ই অন্তরীণ থাক,

তোমার হূদয়ে চুমকি বসানো পাথর কণাগুলো

জোনাকি ও নক্ষত্র হয়ে জ্বলে ওঠে যেন

আর সহসা মিলিয়ে যাক নিখিল নিভৃতে।







অভিষেক

অসীম সাহা



গভীর সমুদ্র থেকে অবশেষে উঠে এলে মৎস্যকুমারী;

সাত হাজার ছয়শ পঁয়ষট্টি দিন পরে এ তোমার নব্য অভিষেক।

অতল জলের তলে হাঙ্গর ও কুমিরের সাথে যুদ্ধ করে

অনেক দিন ও রাত্রির নির্ঘুম অপেক্ষায় কাটিয়েছো ব্যথিত প্রহর;

আত্মীয়-বান্ধবহীন একা একা অন্ধকারের গুপ্ত জানালায়

যেন তুমি রবীন্দ নাথের এক শিশু হয়ে

ডেকে ফিরছো সেই অলৌকিক দইওয়ালাকে

যে কোনোদিনই জানতে পারেনি

তোমার ভেতরকার সেই গহন অগি্নকে;

শুধু বাতাসের বিহ্বল চিৎকারে

তোমার বুকের মধ্যে ঘুরে মরেছে দীর্ঘ হাহাকার।

সমুদ্রের জল জানি স্ফটিকস্বচ্ছ নয়, জাফলংয়ের ঝর্নার মতো নয়।

ঘোলা আবেগের মতো ঢেউয়ের সুউচ্চ পাহাড় ভেঙে

তোমাকে আসতে হলো এই পোড়া দেশে।

নির্বাসন কাম্য ছিলো না, তবু পরবাসী এ জীবন চিরস্থায়ী হবে ভেবে

আর্তনাদে, হাহাকারে তুমি ছিলে সমুদ্র-ভেনাস।

জলের ভেতর থেকে অবশেষে জন্ম নিলে মৎস্যকুমারী।

বহুদিন পরে আজ অশ্রুজল তোমাকে মানায়।

রক্তভেজা এই মাটি, এই ঘাস, এই রাঙা পাখিদের কোলাহল

তোমার বুকের মধ্যে কলরোল তোলে।

এখানে সমুদ্র নেই

তুমি আর মৎস্যকুমারী নও।

সাত হাজার ছয়শ পঁয়ষট্টি দিন পরে তুমি আজ

হও মাতা, হও কন্যা, হও বধূ, সুন্দরী-রূপসী।

মনে রেখো, তোমাকে হাঁটতে হবে বহু পথ

এখানেও হাঙ্গর ও কুমিরের নগ্ন ডানার ধার

তোমাকে রক্তাক্ত করে ফেলে দেবে অন্ধকার জলে।

তোমার শরীর থেকে তুমি তাই পেখম খুলো না

মৎস্যকুমারী হয়ে পিচ্ছিল শরীর তুমি

করে তোলো স্পর্শের অতীত।

এইভাবে তোমাকেই যেতে হবে হাজার বছর ধরে

বাংলার সর্বশেষ সীমান্ত অবধি।





তোমার কাছেই

জিয়া হায়দার



আমি ডাকলেই তোমার সময় হয়না

হঠাৎ ব্যস্ততা তোমাকে ঘিরে রাখে



আমাকে মনের মধ্যে ফেলে রেখে

অজানা অচেনা

কারো আকুল নিমন্ত্রণ

তোমার আনন্দিত সময়।

সেদিন আমাকে ডেকেছিলে

আমার সময় হয়নি

সময় নিয়ে খেলা

তোমার কাছেই শিখেছি।





বলেছি

দাউদ হায়দার



সমবেদনা ছাড়াই দিনগুলি চলে গেল, দ্যাখে

ভীরু মাধুরীর আসঙ্গে রাত্রি।

আমার করতলে রুদ্রের সঞ্চয় ছিলো

বজে বাজেনি বাঁশি।

'ছায়াদীঘি কেন আবরণে ঢাকা

বলেছি-?

পাষাণদুয়ার বিকশিত হলো

রক্তের ধুলিবাসে।





নদী আর তুমি

শহীদ আশরাফী



নদীর হূদয় তুষারের মাঝে রয় জমা

কেবল সে তুষারের ভংগুর কণা

উষ্ণতা পেলেই হারায় বুঝি তার সীমা

নদী সাজায় ঢেউয়ের মত্ত ফণা।

এই যেমন তোমার হূদয় উষ্ণতায় ভরা

আলিঙ্গন কাম্য সদাই, যদিও বাঁধন হারা।

হিমালয় থেকে উষ্ণ গলা নদী

সাগর পানে বয়ে চলে নিরবধি

কখনও ভয়ংকর উন্মত্ত ঢেউয়ের দলে

ছদ্মবেশী সে-তীরের আলিঙ্গন নেবার ছলে।

তুমি যদি হও নদী বয়ে যাও নিরবধি

তোমারই সখা হতে সদা আমি চাই যদি

তীর হয়ে মিশে রব তোমার স্রোতে

দু'য়ের ভালবাসা বন্ধনে বিনিদ্র রাতে।







কবির ছায়া

মাকিদ হায়দার



বলতে পারো

পালিয়ে এলাম

পা পিছলে

পড়লে যখন

ঝরনাতলায়

তখন আমি ভেবেছিলেম

তুলবো তোমায়

দু'হাত ধরে।

বাড়িয়েছিলেন হাত দু'খানি

ফিরিয়ে দিলে

আমার দু'হাত।

ভেবেছিলেম ডাকবে তুমি,

ডাকলো কাছে মেঘ বালিকা।

এগিয়ে গিয়ে

হাত বাড়ালাম

তাহার দিকে

তিনিও দেখি তোমার মতো

এড়িয়ে গেলো

কবির ছায়া,

ভালোই হলো

দুঃখ নিয়ে ফিরে এলাম

ঝরনাতলায়।

তাকিয়ে দেখি জোসনা রোদে

ভেসে গেছে সুমুর চোখের

বৃষ্টিকণা।





চাকা

জাহিদ হায়দার



তারপর চাকা তৈরি হলো।

ঐ তারপরের আগের মানুষেরা

পরের পৃথিবীকে,

পরের মানুষেরা আগের পৃথিবীকে

অনুপুংখ দেখবে বলে,



চাকায় করে সামনের দিকে এগিয়ে গেলো

পেছনের দিকে এগিয়ে গেলো।



একটি চাকার আবিষ্কার হলো বলে

দুটো মানুষ অচেনা দূরত্বে

চলে গেলো।







অবহেলা

সানাউল হক খান



মানান-সই উচ্চারণে দেখেছি

হাসি আর ভার-মুখে, স্থির ঠোঁটে,

কথা বলে দেখেছি খুঁটে-খুঁটেঃ



কেউ নেয়নি কোনোভাবেই

কারও করুণা-দাক্ষিণ্য নয়

আমারই দু'হাত দশ-আঙ্গুল

দু'টি পা সমেত বিশটি আঙ্গুল

নখের ব্যাকুল মুকুল গুলো

কী ভাবে শুদ্ধ, কীভাবে ভুল

দৃষ্টিতে দীপ্তিমান বর্তমানের কথা

বাষ্পাতুর হূদয়ের অনুবাদ করা ভাষা

এবং ভালোবাসার কথাগুলো

খুলে-খুলে বলেছি:

শ্রমলব্ধ ভাতের থালায় হাতের উৎপাত

তুলে ধরেছি নুনসত্য, নুনমিথ্যে



কেউ নেয়নি আমার সমীপেষু-চিত্ত

কেউ নেয়নি আকুলতা



দুঃসময় ছাড়া কোনো সুসময়

আমাকে 'সময়' দেয় না

শুধু অবহেলাগুলো ওৎ পেতে থাকেঃ





হূদয় সম্বল শুধু তুমি চির একা

মিনার মনসুর



যদি ফোটে যৌবনের অদম্য বকুল

সহসা প্রাণের নদী উথলিয়া উঠে

সমুদ্র মন্থন করে তুলে নেয় ঠোঁটে

অমৃতের ভাণ্ড ভেবে বিষময় হূল।

বেধে যায় হূলস্থূল_ হা হা রব ওঠে

জগৎ সভায়_ আতঙ্কে বিদীর্ণ হয়

জীর্ণ পৃথিবীর প্রাণ; পুঁতিগন্ধময়

নর্দমার জলে হূদ মরে মাথা কুটে।।



তোমার কী আসে যায় তাতে! নদী তুমি

বয়ে যাও, পাখি তুমি গেয়ে যাও গান।

বসন্ত অনন্ত নয়_ অনন্য এ ধান_

ইরির খামার নয় হূদয়ের ভূমি!

হূদয় সম্বল শুধু তুমি চির একা

সজোরে অাঁকড়ে ধরো যদি মেলে দেখা ।।







প্রত্যাঘাতে , খোলাচুলে

হাসান হাফিজ



ক.

সামান্য ফুৎকারে তুমি উড়ে যাবে

এমন সম্ভব নয়,

ভালোবাসা তুমি

পাথরেরও চেয়ে ভারী

পাহাড়েরও অধিক নিষ্ঠুর

আকাশের অধিক উদার

খ.

নতুন দুঃখ আর কি-ই বা দেবে

যা দেবার দিয়েই ফেলেছো

দিতে দিতে নিঃস্ব দীন দেউলিয়া

প্রত্যাঘাত করার সময়

এসে গেছে

এখন আমার

গ.

ফুল নয় ভুলও নয়

ভালোবাসা খোলোচুল তুমি

আমার মৃতু্যই লেখা

সঙ্গোপনে লুকোনো চুরোনো

ওই খোলা চুলে

ঘ.

ঘৃণা আর বিস্মরণ দিয়ে ভাবলে তুমি

উজাড় উপুড় করা

ভালোবাসা বিনিময়ে পাবে!





আরো কিছুকাল

জামাল আহমেদ



ফেললেই যদি লোনাজলে হাত পা

মুখ ভিজিয়ে নিতে যদি দিতে,

এতে কোনো জলের নদী

বিদীর্ণ হতো কি?

শাপলা জলে কোনো মায়াবি আর্শি-

দৃষ্টিছলে ডাকেনি

সমুদ্রের নোনতা স্বাদ জলের ভেতর

চেটে নিতে যদি দিতে

না। অন্তরে ডোবাজল আজলাভরে নিতে

কেউ তো আসেনি,

বাউরি বাতাসে বুকের চাতাল

আরো কিছুকাল চড়-ই সকাল

অপত্যকাঙ্গাল একাকী রাত

বিলি কাটতে যদি দিতে।







মেঘ বালিকার গল্প

আলমগীর রেজা চৌধুরী



হাউজিং আকাশ জুড়ে এরোপেস্নন ওড়ে,

শরতের মেঘ ছুঁয়ে যায় গৃহবধূর স্বপ্নজাল

হাত দিয়ে ধরতে ধরতে জানালার পর্দায় খেলা করে

রৌদ্রস্নাত ভোরের সকাল। চিলতে বারান্দা জুড়ে সাদা

মেঘ বালিকার কলরব। ক্যাসেটে প্রিসলির রক এণ্ড রোলের

তুমুল সিম্ফনি। টবে এইমাত্র ফুটেছে নাইনোক্লক।

ওর নাম সুস্মিতা। ও ইডেনে সাহিত্য পড়ে। চন্দ্রাবতীর নায়িকা-

করুণ বেহাগে গেয়ে ওঠে, এভরি নাইট ইজ মাই ড্রিমঃ

রিসার্চ স্কলার যৌবন পুরুষ ইলিনার ডরমেটরিতে ক্যাথির

কোমর জড়িয়ে ট্রাভোল্টার মুদ্রায় মদালস প্রহর কাঁপিয়ে তোলে

সুস্মিতা, মাই ড্রিম-

স্বপ্ন সঙ্গমে সময় বাড়ে। আহারে, মধ্যবিত্ত জীবন!

হরিসাধন

হরিসাধন, হরিসাধন-ডাক দেয়। বনভূমির সন্তান।

হামাগুড়ি দিয়ে গজারির মাথায় ঝুলে থাকে পঞ্চমীর

চাঁদ। জল কলকল কে গায় কষ্টশ্রাব। বংশাই,

মধুপুর, সাগরদীঘি, বৃন্দাবনের তমাল চূড়ায়

রাধা-গীতিকায় মাতম করে কৃষ্ণভক্ত ভরত দম্পতি।

মহাকালের কিন্নর-কিন্নরী। ওই তো অশ্বারোহী,

ধাবমান পর্যটক বতুতা। রাজ্যলোভী ঈগল রক্তাক্ত

করে শ্যামলভূমি। তুমি সম্মুখে এসো না। কাস্তে

হাতে দাঁড়িয়ে আছে দীপ্ত বঙ্গ সন্তান।









আর্টক্যাম্প

মারুফ রায়হান



রঙের প্রাচুর্য ঢের- ক্যানভাস প্রসন্ন প্রস্তুত

তুলনারহিত তুলি উদগ্রীব উৎকণ্ঠ উৎসুক

কোথায় গেলেন শিল্পী! দেখা যায় মানব আদল

নিঃসঙ্গ আসনে উদাসীন- শিল্পে মন নেই তার

আছে কি প্রেরণা? কমপক্ষে ইচ্ছা, সহজাত যাচ্ঞা?

উদ্যম অনুপস্থিত অবেলায়- অকাল বার্ধক্য!

অথবা ক্ষমতা নেই সঙ্গমের সৃষ্টিশীলতার

রেখার আহ্বান মিছে, প্রায় লুপ্ত রঙের রহস্য

ব্যর্থ হলো জন্ম নিতে চিত্রকর্ম- শিল্পের সংরাগ

অথচ সম্ভব ছিল- সম্ভাবনা ছিল সকাতর

শুধু স্রষ্টা আর ছিলেন না স্রষ্টা- শিল্পী আর শিল্পী

লক্ষ কোটি মানুষের মাঝে শিল্পী কোথায় থাকেন!

সাধনার কোন্ গুপ্ত ঘরে নিবিড় নিমগ্ন তিনি

মানুষের অবয়বে বিরাজিত ভিন্ন কোনো জন?







একাকি ঈশ্বরী

রবীন্দ্র গোপ



এমন কেউ নেই যার কাছে বলি দুঃখ কথা

জলকণার কাছে বার বার ফিরে ফিরে যায় রবিরশ্মি

সে যে আমার স্বপ্নসাথি জেনে গেছে, তাই।

বার বার বাউল মাছের মত টোকা মেরে মেরে

আঁধারের টোপ ছড়িয়ে জ্বালিয়ে জ্বালিয়ে,

যায় জলের ভিতর আগুনের গনগনে চিতা।

জেনে যাওয়ার পর থেকেই আমিও

বড় বেশী মনোযোগী উন্মনা উরুতে যোনির রুদ্ধদ্বারে

স্তনের নাচন দেখে কে পারে যৌবনের

দরজায় খিল সেঁটে বসে থাকবে একাকী নীরবে।

আগুনের চিতায় ঢালি জলের শরীর স্বপ্নঘোর ভালবাসায়

নিভে না আগুন স্বপ্ন খাওয়া আগুন শুধুই লাফায়

জলকণা শিয়রে বসে হাসে, হেসে ওঠে।

ওর যেন কোনই আবেদন আকাঙ্ক্ষা নেই- সবশেষ করে

নির্বিকারে বড়বেশী নিষ্ক্রান্ত ভ্রমর সন্ন্যাস জীবন তার

বসবে না আর কোনদিন ফুলের জলসায় একাকী ঈশ্বরী।





কলম

রেজাউদ্দিন স্টালিন



কবিতার ভয়ে কলম লুকিয়ে ফ্যালে কালি তার গর্ভে,

আর বিশাল অন্ধকারে হারিয়ে যায় তার দৃষ্টি,

সে চেয়েছিলো জীবিকা নির্বাহী এক নির্বিঘ্ন লেখনী

কোনো কেরানির হাতে ছক বাঁধা সময়ের ঘড়ি।

কিন্তু পেলো এক অবাধ্য অঙ্কুরোদগম,

প্রতিহিংসাপরায়ণ শ্বাপদের জিঘাংসু জৃম্ভণ,

স্পর্ধিত রক্তস্রোত অক্ষয় কালির।

একদা কলম ছিল ধরিত্রী সর্বংসহা,

আজ তার বক্ষময় বিচরণশীল কবিতা-কৌরব।

ডেমোক্রিটাস উদ্যানে লেলিহান স্বপ্নদিন,

নিজের দু'চোখ উপড়ে ফেলা হিংস হাতের উলস্নাস,

আবদেরা নগরের পথে পথে দীর্ঘ করাঘাত।

কোন লানতের লগ্নে জন্ম তার,

কার ভবিষ্যদ্বাণীর বিবরে বড় হয় দিনরাত্রি।

আকাশ নুইয়ে রাখে অভিশপ্ত নীল তার মাথার উপরে,

খরা ও মন্বন্তর খেয়ে ফ্যালে কালি তার গর্ভ থেকে;

আর সে অদৃষ্টের পাশে

তীক্ষ্ন খঞ্জর হাতে বসে থাকে মুগ্ধ ইদিপাস।

কলমতো জানে,

আত্মার-অন্ধত্ব ভাল দৃষ্টিমানের চেয়ে;

ভাল বিবেকের চেয়ে বোধের অঙ্কুর।

যে অন্ধ সে অতৃপ্ত

আর যে তৃপ্ত সে মৃত।







আমার মায়ের ছবি

নূহ্ উল-আলম লেনিন



তোমার একটা ছবি অাঁকবো ভেবে রঙ তুলি

নিয়ে ইজেল সাজাতেই আকাশ জুড়ে বর্ষা

আমার সব রং তুলি ভাসিয়ে নিল।

আমার মনটাও গেলো ভিজে এবং মনের ভেতরে

তোমার ছবিটাও।



অবাক বিস্ময়ে অনুভব করলাম আমি শৈশবে

ফিরে গেছি। বৃষ্টিভেজা দুপুরে দুই দুরন্ত কিশোর-কিশোরী

মেজদি ও আমি, ইলশেগুড়ি বৃষ্টি। হঠাৎ সূর্যালোকের উদ্ভাস।

খেঁকশিয়ালের বিয়ে হবে। ও পাড়ায় শারদীয় ঢাকের শব্দ।

মায়ের সাথে খুনসুটি। কলা চুরি করেছি আমি; আর মারটা খেলো মেজদি।

আহা! সেদিন মেজদিটার জন্য আমার বড্ডো মায়া লেগেছিল।

মেজদি ও আমি, মায়ের ন্যাওটা, কিন্তু এঁড়েবাছুরের মতোই দুরন্ত,

কখনো অবাধ্য কখনো একান্ত সহায়।



ভাবলাম আজ মাকে নিয়ে কয়েকটি পংক্তি রচনা করবো।

কলমটা খুঁজে পেতে ঘরে ঢুকতেই দেয়ালে মায়ের প্রসন্ন মুখ,

বললেন, খোকা তোর কলমে কালি নেই, তুই অযথাই পংক্তি

মেলাতে যাসনে। এইতো আমি আছি, তুই বরং একবার পদ্মায়

ডুব দিয়ে আয়। অনেক-দিন তোকে ছুঁতে পারি না।



পদ্মার ভাঙনে আমাদের গ্রাম পতনের পর মানুষের

স্থায়ী আসন কবর থেকে আমার মায়ের মমির মতো লাশটাকে

বড়দা পদ্মায় ভাসিয়ে দিয়েছিলেন। সেই থেকে

আমার মা পদ্মার জলে মিশে আছেন। পদ্মা আমার

মা। ওই জলে আমার জীবন জুড়ায়।





অন্য আলো ছায়া

সোহরাব পাশা



ক্রমশই বেড়ে উঠবার কথা ছিলো

কিন্তু ছোটো হচ্ছে প্রতিদিন

বৃক্ষরাও ছোটো হয়ে হঠাৎ উধাও

ছায়া ভেঙে ছায়া হচ্ছে মেঘের ভেতর,

ফোটার মুহূর্ত রেখে বর্ষার কদম

ঝরে পড়ে

ধূলিচিত্র মুছে যায় বেভুল হাওয়ায়

ভিড় করে অন্য আলো ছায়া;

অন্যদের স্বপ্ন পাঠে শূন্যতার ভারে

গাঢ় ক্লান্তি নেমে আসে

চোখে-চোখের পাতায়

সন্ধ্যে ছোঁয় রাত্রিদের ডানা

রোদের পঙক্তি লেখে অন্য এক ভোর।







ওহে শকুন্তলে

মুহাম্মদ সামাদ



হাত-পা গুটিয়ে বসে গেছো হূদয়ের পাশে

প্রেমের পাহাড় হয়ে দাঁড়িয়েছো

সামনে পেছনে কিম্বা মস্তিষ্কের কোষে-কোষে;

আমার হূদয় কাঁপে- তুমি যে বলো না কথা

ভালোবেসে অথবা কিছুটা মনস্তাপে!

পাহাড়ের পর পাহাড়-ঝরণা কতো- যে সবুজ ঝোপঝাড়

এই অবুঝ আমরা পেরিয়ে গিয়েছি চেরাপুঞ্জির বৃষ্টিতে

ধূলোবালি আর কাঁদামাটি মেখেছি চাঁদের শুভ দৃষ্টিতে

শিলং পাহাড়ে মেঘের মেয়েকে বুকে জড়িয়েছি

আধখানা চাঁদের সীমান্তে আমি পরিয়েছি সিঁদুরের ফোঁটা

আমাদের প্রিয় ঠোঁটে পরস্পরে ঢেলেছি অমৃতসুধা

কামরাঙ্গা এই লাল দেহ যখন মজেছে স্বর্গসুখে

তুমি কি তখন ঘুমিয়ে পড়োনি এ হূদয় ভরা বুকে

তবু তুমি চুপ করে থাকো- আমি কী বুঝি না

এতো চুপ করে থাকা জ্ঞানী কিম্বা ধ্যানীকে মানায়

আমি অবোধ প্রেমিক- আমার কী আসে যায়?

সবি কি আমার দোষ?

তোমার প্রশ্রয় আমি পাইনি কখনো?

বুকে হাত রেখে- চোখে চোখ রেখে স্থির হয়ে পারবে দাঁড়াতে?

তবে এতো অভিমান কেনো- বেশী ভালোবাসি বলে চলে যাবে!

তোমার মুখের মতো কোন সুখ আমি আর খুঁজতে যাইনি

তোমার বুকের মতো কোন বসুন্ধরা আমি তো পাইনি

তোমার চোখের মতো গভীর সমুদ্রস্নান কোথায় তাপসী

তুমি তপস্যা আমার আমি- প্রেমের প্রসাদ নিয়ে বসে আছি

দেবী, তুমি চোখ তুলে তাঁকাও আমার দিকে

ওহে শকুন্তলে, এই ঘনকৃষ্ণ তপোবনে

তোমাকেই চাই আমি সর্বদেহে মনে।





বৃক্ষরা সবুজ, তুমিও

মঈনুদ্দিন কাজল



লোকটার বুক লাল, হিংসায় ভরা

মৃতু্যর চেয়ে অন্ধকার,ঘৃণা

হিংস প্রাণী রাজাকার অক্টোপাস

বৃক্ষরা সবুজ, তুমিও।

বাঘ, কুমির সিংহের হিংস তা

তার কাছে হার মেনে অলিম্পিক দৌড়

নুয়ে পড়ে সবুজ ধান আততায়ীর ভয়ে

প্রতিদিন প্রতিরাত চিরছায়া ভূমিও।

ফুল পাখি অহিংস নিত্য জাগরণ

ফুরফুরে বাতাস, সবুজে তাকাও

বুকের ভিতর ঘাতকাতঙ্ক

জঙ্গিবাদ নিপাত যাক।





মরীচিকা

কাজী রোজী



জলের একটা প্রজ্বলন থাকতেই পারে

জলের আগুনে সেটা পোড়ে না

মানুষের ঋজু সহিষ্ণুতার মতো

নিবিষ্ট জল-বাঁধ তবু ভাঙ্গে না।

আমার নিত্য সহচর আছে যারা

ছায়ার আবেষ্টনে কাঁটাতার তারা

মুগ্ধ পথিক চায় সে দেয়াল টপকাতে

দুঃখ-আগুনে আমি ভস্ম হই না।

ছায়াটা আমার মতো ভাঙ্গে না তবু

মেঘ ভাঙ্গা রোদ এসে মেঘ পড়ে না

জলের দাবির কাছে বৃষ্টি ঝরায় শুধু

আকাশের উল্কারা কথা কয় না।

কি জানি আগামীদিন মরীচিকা মনে হয়

নাগালের ছোঁয়া দিয়ে নিত্য পালিয়ে যায়।





















এলিজি স্বপ্নের জন্য

আসাদ মান্নান



স্বপ্ন ছিলো সূর্যটাকে ন্যাংটো করে নিয়ে যাবো নদীর কিনারে,

তারপর নাড়ার আগুনে তার মুখটাকে পুড়ে দেবো,আর

রাখাল রাজার মতো বাঁশি হাতে উড়ে যাবো পাহাড়ের কাঁধে;

বাঘের থাবার মুখে অন্ধকারে ঢেলে দেবো জলের প্রবাহ।

কুয়াশা নদীর জলে মুখ ধুয়ে অভিমান করে শুয়ে আছে

হেমন্তের কাশবনে;রুপোর হাঁসুলী গলে মস্নানমুখো সন্ধ্যা



একাকী দাঁড়িয়ে থাকে শহীদের লাশ নিয়ে কবরখানায় :

অশ্বহীন আস্তাবলে জোনাকির মতো ওড়ে জীবনের পোকা।

বাসনা বাঁশির মতো বাঁশবনে কেন বাজে ? পূর্ণিমার টানে

আমার চোখের নিচে জলহীন নদী এসে লুকিয়ে রয়েছে;

শেস্নটের লেখার মতো স্মৃতি থেকে মুছে যাচ্ছে প্রিয় মুখগুলো :

একজন আফ্রিকায়, অন্যজন চলে গেছে মার্কিন মুলস্নুকে;

সেলাই মেশিনে বসে একজন স্বপ্ন নিয়ে সুঁই-সুতো খেলে-

পরিত্যক্ত পিদিমের হাহাকার ছাড়া আর কোনও স্বপ্ন নেই;







সাধুর করঃ ১০

আমিনুর রহমান সুলতান



লাজুক শরীর অাঁকড়ে ধরে

ঝুলে পড়েছো বাঁচার লোভে

মাটির অচেনা পড়শিঃ

শান্তির নিঃশ্বাস বুকে নিয়ে নিদ্রা যাও

আরও জড়িয়ে ধরবার নেশায় বিহ্বলাঃ

ভেতরে রসালো হতে হতে

নিষ্কলঙ্ক বাঁচতে চাও একা

বৃক্ষখেকোঃ

পিপড়ার যে খিদে অল্পতে মিটানো যায়

তাকে পোষা যায়

যায় না তোমাকে

পুষবো বলে তো কখনও জড়াইনি গায়ে

চিকন সাপের মতো বাড়ে তোমার শরীর

ওই শরীরেই লুকিয়ে রয়েছে দুটি মৃতু্য

প্রতি আলিঙ্গনে

শেকড়ে জলের মাটি

থাকছে না রসালো

জলে ভেজাঃ

















তোমারেই সঙ্গে নেবো

দুখু বাঙাল



তোমার নিজের চেয়ে কতোটা বিশাল ছিল স্বপ্ন যে তোমার।

যেমন জোনাকি এসে ঘরময় দুই হাতে ছড়ালে আগুন

দেহ মনে সবখানে ছোঁয়ালে আপন মনে অচেনা ফাগুন

জীবনের উপকূলে কানায় কানায় শুধু অদম্য জোয়ার।



হূদয় তো চিরকাল অভিসারী যা আছে তা যায় চলে যাক

তোমার বুকের তলে নেচে চলে পাহাড় সমান সব লোভ

সারাক্ষণ খাই খাই তারপর কি যে খাই এই যত ক্ষোভ

দু'জন দু'পথে চলা মাঝখানে আকাশ মৃত্তিকা শুধু ফাঁক।



বুকের গভীরে বসে থেকে থেকে কয় নির্ঘুম রাত

বিশ্বাসের পর্বতে দিলে ছাই হাত রেখে অনাহূত ঘাসে

হূদয়জোড়া পূর্ণিমার চাঁদ সেও একদিন ক্ষীণ হয়ে আসে

বল্লে- ফের দেখা হলে তোমারেই সঙ্গে নেবো নেবো নির্ঘাত।







ভিখিরি উপাখ্যান

নজরুল হায়াত



ভিখিরির শরীরটা ডুবে আছে কাতর কান্নায়

ক্লান্ত ভিখিরি, পৌষের হিম মেঘে রাত্রিভর

একাকী বিষণ্ন 'হে দয়ালু' বলে

হূদয়ের তস্য দাস এক অমানুষ বের করে

সারাদিন তার পথে পথে ক্ষুব্ধ খঞ্জ, নু্যব্জ মানুষেরা

ভিড় করে এসেছিলো: পথিকের চোখে ঘৃণা

সামান্য করুণা, কখনো রুদ্র কৃপাণের মতো চোখ

এইসব অবিশ্রান্ত অভিজ্ঞতা জগতের হূদ্ধ পরিক্রমা

অবশেষে এই রাত্রে সে চিত্ত মেলে ধরে 'করুণাময়

অপার তোমার দয়া, মানুষের বুক খুলে দাও'

বলে রৌদ্রময় জোছনায় ভিজে ভিজে খোলা মাঠে

দগ্ধ হূদয় মেলে চিৎ হয়ে পড়ে থাকে।





যা ফুরিয়ে যাবার নয়

রহমান শেলী



আচ্ছা বলোতো কতোটা অপরাধ হলো আমার তোমাকে দেখে দেখে

তোমাকে ভেবে ভেবে দেখে দেখে আমি কী অশুদ্ধ করেছি তোমাকে?

ভেবে ভেবে আমি কতোটা দুশ্চিন্তায় রেখেছি তোমাকে

কতোটা সময় তোমার আটকে রেখেছি চোখের পলকে

এক সেকেন্ড, এক মিনিট, এক ঘন্টা

এভাবে একটি বছর নাকি লক্ষ বছর সমান!

কতো কোটি বছর হলে সময় হবে আমাকে দেবার?

বিনিময়ে কি চাই তোমার? বিশাল অরণ্য, আকাশ চুম্বি পাহাড়?

তুমি অরণ্যে হেঁটে বেড়াও, ফুল তোলো সবুজ ঘাসে শিশির কুড়াও

আমি শুধু দেখি, আমি শুধু ভাবি।



সেদিন আমি

সুলতান আকন



হঠাৎ এক গোধূলি বেলায়

তুমি জানালায় এসে দাঁড়ালে

আমার দৃষ্টি থমকে গেলো

তোমার দুইটি চোখে।

তারপর কতটা সময়

পার হয়ে গেছে আমার

জীবনে এসেছে কত সুসময় দুঃসময়

কতবার হয়েছে জীবনের ঠিকানা বদল,

কিন্তু কি আলো

সেদিন আমি

বুকে ধারণ করে এনেছিলাম

সেই স্বপ্ন সেই আলো

কী করে আমি ভুলে যাবো!







ফিলিস্তিনি কবিতা

সামিহ আল কাসিম

অনুবাদ: নুরুল করিম নাসিম



সামিহ আল কাসিমের জন্ম ১৯৩৯ সালে জর্ডানের জারকা অঞ্চলে। ইসরাইলি কমিউনিষ্ট পার্টির সদস্য। হাইফাতে তিনি সাংবাদিকতা পেশায় জড়িত। সেখানে আরাবেস্ক প্রেস এবং প্যালেস্টিনিয়ান লোকশিল্প কেন্দ্র পরিচালনা করেন। ২৫টি কবিতার বই প্রকাশ পেয়েছে এই দীর্ঘ সময়ে। তিনি একটি আত্মজৈবনিক উপন্যাস, একটি নাটক ও ডাইরি লিখে বিদগ্ধ পাঠকদের মাঝে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। তিনি তার কবিতায় একটি ভিন্ন ধারা নির্মাণে প্রয়াসী। বর্তমানে তার বয়স ৭১, কিন্তু এখনও তিনি কর্মঠ ও তৎপর।

পরিত্যাগ

আমি তাকে দেখলাম

আমি তাকে সড়ক চত্বরে দেখলাম

রক্তাক্ত পড়েছিল

আমি তাকে বিহ্বলভাবে হাঁটতে দেখেছি

আমি তাকে হত্যা হতে দেখেছি

আমি তাকে দেখেছি

আমি তাকে দেখেছি

যখন সে চিৎকার করলো

কে ছিল তার অভিভাবক?

আমি তার পরিচয় অস্বীকার করলাম

আমি সড়ক দ্বীপে একা ফেলে চলে গেলাম

তার রক্তপাত হতে লাগলো

বেঁচে থাকার জন্য তার সেকি আপ্রাণ প্রচেষ্টা

সড়ক দ্বীপে তাকে আমি মরতে দিলাম

আমি তাকে ছেড়ে এলাম

যে মানুষটি নির্বাসনে মারা যাচ্ছে তার উইলপত্র

আলো জ্বেলে দাও যেন আমি

আয়নার ভেতর প্রজ্বলিত শিখা দেখতে পাই

আর দেখতে পাই খামারবাড়ী

সেতু এবং

সোনালি শস্যক্ষেত

আলোটি জ্বালো যেন ধ্বংসযজ্ঞের রাত্রিতে আমি

অশ্রু বিন্দুগুলো দেখতে পাই

যেন আমি তোমার বোনের মৃতদেহ দেখতে পাই

যার হূদয় একটি পাখী যা ভিনদেশী

ভাষা ছিন্নভিন্ন করে ফেলেছে

বিদেশী বাতাসে আলোটি প্রজ্বলিত করো যেন

তোমার বোনের মৃতদেহ দেখতে পাই

যেন আমি জেসমিন দেখতে পাই

চাঁদের আবরণে চিরন্তন অগি্নদাহ

ধ্বংসযজ্ঞের রাত্রিতে

আলোটি প্রজ্বলিত করো যেন

আমি আমার নিজের মৃতু্য দেখতে পাই

আমার যন্ত্রণা তোমার একমাত্র

জেসমিন আমার যন্ত্রণার নীরব সাক্ষি হয়ে থাকবে

চাঁদ সাক্ষি হয়ে থাকবে

আলো প্রজ্বলিত করো যেন

আমি দেখতে পাই আলো প্রজ







শত্রু-মিত্র বিবর্তন

আইনুল হক মুন্না



এতটা ব্যাপ্তি ছিল না আমার বিদ্বেষ

পরাভূত কোন গোঁয়ার সৈনিকের মতো

কেবল বেড়ে উঠে ব্যাকুল ক্রোধ।



মানুষের ভালোবাসায় শেস্নষ ছিলো আমার প্রিয়তম কিছু

প্রিয় ছিল যত্ন-অযত্নের বিন্যাস; ভয়াবহ তাবৎ প্রাণী

এখন এসব কিছু নেই, প্রতিদিন খুঁজি ভিন্ন মানুষ

মানুষের নিষ্পাপ জন্মকে।



কোন প্রতারক বন্ধু এখন সখ্যতা খুঁজলে বুঝি, ভাল

কোন গোপন ঘাতকের আগমন বুঝি, ভাল

কোন আদিম ট্রাক কখনো পিষতে এলেই বুঝি, ভাল

গালাগালে কেউ চৌদ্দ পুরুষ ধুলেই বুঝি, ভাল।



ভালোবাসার ভেতরে জন্ম নিলে ক্ষোভ

ক্ষোভের ভেতরে প্রতিহিংসা

আমি পারি না এখন আর সাবলীল হতে

প্রকৃত অর্থে চেষ্টার কোন প্রচেষ্টাই নেই আমার।



সারাজীবন পৃথিবীকে জানবো শত্রু, শত্রুই যে

এখন পরম মিত্র আমার।







আবর্তন

অনীক মাহমুদ



ঘুরছি ঘুরছি পথ থেকে পথে

নিমীলিত সত্যের দুয়ারে কে দাঁড়ায় বুক বেঁধে

জীবনের রণাঙ্গনে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা

অনীকের বসন্ত বাগান কোকিলের

গানে গানে কতোটা মুখর

রাঙা রাজকন্যে হয়তো হারিয়ে গেছে বৈচির মালিকা নিয়ে

ষড়যন্ত্র অন্ধকূপে হারায় বিবেক প্রগতির কুশীলব

ভড়ং আর রংবাজি মতলবে মহাজন হাসে

বিজয় কুমার নারদের মোসায়েব সেজে

অপমান হতমানে উল্টাপথে হাঁটে

ঘুরছি ঘুরছি পথ থেকে পথে

মিথ্যার জাজিমে বসে রাজাকার খাদকেরা

মুক্তিযোদ্ধা-শৌর্যের ভিটের মালিকানা চায়



বিদুষক, তোমাদের নাকে তেল কানে তুলো

স্বাধীনতা মুক্তপথ হাড্ডিসার ফড়িয়ার কোলে

শুধু_ ঘুরছি ঘুরছিঃ







মাহেন্দ্রক্ষণ

লুৎফর রহমান



মেঘে মেঘে ছেয়ে যায়

ধরিত্রী যখন

মৃত্তিকার আর্তি সেই বর্ষণের

দমকা বাতাসে মেঘ

মিলিয়ে যায়।

হাহাকার বুকে নিয়ে বর্ষণের

আবার প্রতীক্ষা।

রংধনু মিশ্র মেঘের

বুকে আবির ছড়ায়

শিহরিত মন। স্মৃতি

যেন তখন চারণভূমি।

আবার উধাও হয়

মনের অজান্তে কখন।

হাহাকার বেড়ে যায়।

আবারও প্রতীক্ষা

একটি মাহেন্দ্রক্ষণের।



শূন্যতার মুহূর্তগুলো

মফিদা আকবর



শূন্যতার মুহূর্তগুলো কঠিনতম বিশুদ্ধ আত্মপীড়িত

তাই ঈশ্বরের কাছে করুণা মেগে হাত বাড়াই

শক্তি দাও, শক্তি দাও হে ঈশ্বর

মুক্তি দাও, মুক্তি দাও হে ঈশ্বর

আমাকে তোমার ধ্যানে নিমগ্ন কর।

ভুলে যেতে সাহায্য কর জাগতিক জঞ্জালের ছাইপাশ।

আকাশের সীমাহীন উদারতা

আর আমাকে দাও সাগরের গভীর ব্যাকুল বিশালতা।

হে ঈশ্বর, আমাকে প্রবেশ করাও তোমার নিভৃত কুঠুরিতে

বিশ্বাসের শান দিয়ে তীক্ষ্ন মন্ত্রে উজ্জীবিত কর।

প্রতিটি মন্ত্রের আবেশে যেন শুদ্ধ করে দিতে পারি

আমার চারপাশ এবং আমিও যেন ভুলে যেতে পারি

আত্মবিজড়িত হাহাকার করা শূন্যতার মুহূর্তগুলো।

আমি চাই সন্ধ্যা ও রাতের ধুসর সময়ে

সাহসের পবিত্র মহাবীজ অঙ্কুরিত হোক।

আত্মগত অমস্নমধুর ভাবনায় নিমজ্জিত হোক দিগন্ত

আগামী অনাগত নতুন অবিনাশী সৃষ্টি

মৌলিক বিষয়গুলো ভরপুর হয়ে যাক মিঠেকড়া স্বাদে।

নিবিড় নিবিষ্ট সময় আহ্লাদী জিহ্বাকে আরো লকলকে করে তুলুক

শক্তি দাও, শক্তি দাও হে ঈশ্বর

আমাকে মুক্তি দাও, মুক্তি দাও হে ঈশ্বর!

জগৎ সংসারে পঙ্কিল রমণ থেকে আমাকে নিবর্ৃত্ত কর।

আমাকে স্বর্গসুখের অমস্নমধুর রমণের রেসিপি দাও।

আমি বুভুক্ষু- সহজাত তৃষ্ণার্ত।







মানিকে মানিক চিনে সৌরভ চিনে কাকে

সৈয়দ সারোয়ার



মেয়েটিকে বললাম আমার পুষ্পের বাগানে আগুন দিয়ো না

যত খুশি ইচ্ছে জলের ছলছল কলকল নৃত্যে ভরে দাও পুষ্পগুলো

মেয়েটি কথা শুনলো না কিছু নাকি বুঝলো না বুঝতে পারিনি আমি

ফের তাকে বলি এই মেয়ে অমন করে চোখ রাঙিয়ো না, অমন

করে দলিত মথিত করো না পুষ্পের সৌরভের অব্যক্ত গৌরবগুলো।



কাঁচা বাঁশে ঘুণ ধরে কথাটা কি সত্য হলো এই মেয়েটির বেলায়

কোন কথাই শুনেনি আমার সে শুনেছে কেবল তার গোপন ব্যথার

কে কাকে তাড়া করেছে বয়স নাকি মেয়েটির পুষ্পভীতির চাঞ্চল্য!

এই মেয়ে বলো তো তোমার জীবনে কী কী খুইয়ে এসেছ যার একটা

বড় তালিকা হতে পারে, যেমন তালিকা হতে পারে পুষ্পের পতঙ্গের।



এই মেয়ে তুমি অমন কথা কেমন করে বললে বসে এতো মুখোমুখি

লজ্জাটাও খুইয়েছো বুঝি নখরামির আদলে ভাসতে ভাসতে বন্যরূপে

তোমাকে আমার কিছুই বলার নেই তুমি নও সেই প্রার্থিতার মতো

শুধু জানতে চাই, মানিকে মানিক চিনে সৌরভ চিনে কাকে?



















একতা এক্সপ্রেস ও একটি পাখি

আসাদ উলস্নাহ



নিউমোনিয়া বুকের গড়গড়ের মতো

করুণ আর্তনাদে ধাবমান নামেই একতা এক্সপ্রেস

আসন ভাগ্য সকলের থাকে না

কেউ কেউ দরজা হেলান নিরীহ নিঃসঙ্গ যাত্রী

পাতাঝরা চৈত্রের বিষণ্ন উড়াউড়ি



ট্রেন যাবে হাট-গঞ্জ না হয় পুর

এখানে সেখানে রেখে স্বজন কোলে স্বজন।

সারাদিন হাঁকছাড়া ক্লান্ত ফেরিওয়ালা

অন্ধ ভিখারি পঁচু, তার আঙ্গুলধরা উলঙ্গ শিশু

তারাও যাবে দরজা আকুল খোলা-



নিগূঢ় রাতের পেটে পথ থেকে পথে

হায়, একতা এক্সপ্রেস আর পা ছেঁড়া বিপন্ন পাখি

পুড়ে পুড়ে উড়ে।





শাহনাজ নাসরীন

আমার ছোট ভাই



আমার ছোট ভাই, বছরের এপিঠ ওপিঠ জুড়ে

আমাদের জন্ম মাস

একদিন সারা বাড়ি জুড়ে শোকের মাতম

পুকুর জুড়ে ডুব-ঝাপ তোলপাড়

আমার ভাইটি সেদিন ডুবে মারা গেল

সেইদিন থেকে নিঃসঙ্গতা কী তীব্র

সব কিছু একা,

রাতের কোলে মাথা পেতে নিঃশব্দ জেগে থাকা

অচিন ভয়ে পাশের বালিশকে

ভাই ভাই বলে অাঁকড়ে ধরা



মা সব ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছেন বিছানায়

বাবা মুখ ফিরিয়েছেন অক্ষম ঘৃণায়

আরো অনেকেই বললো

আহা মেয়েটি থেকে ছেলেটি গেল

কারো একছিটে উদ্বৃত্ত মমতার আশায়

ঘুরঘুর করি এঘর ওঘর

বাবার মুখোমুখি হলে ভস্ম হই চোখের আগুনে

স্পর্ধার মতো আমার বেঁচে থাকা ক্ষিপ্ত করে তাকে

সম্ভব হলে খর্ব করেন অভিশাপে অভিশাপে



আমি তবু বেঁকে চুরে বড় হতে থাকি

কামারশালার গনগনে লোহা বুকের আড়ালে ঢাকি

আমি বড় আরো বড় হতে থাকি।

খবরে প্রকাশ,

শিশু কন্যার মুখে এসিড দিয়েছে পাষন্ড পিতা

বাবাকে আমার মহৎ মনে হয়।







শতরূপা

চৌধুরী নূরুল হুদা



সে যখন যায় তখন মন কাঁদে

তার থেকে আসার বেলায়ও দুঃখ লাগে

সে ও আমি টানাটানি কেমোন আছি

ভালো আছি, নেই ভালো, তবুও-

শতরূপা সামনে আসে অগোচরে

আমি চাই সে আসুক যখন তখন

তার মধ্যে সমর্পণ ভেসে উঠুক

ফিরে না তাকালে খুব অভিমান হয়

সে জানে আমার বুঝাপড়া

আমিও জানি তার কিসে অভিমান।







জারিত

সুনন্দা কবীর



ভেবেছিলাম চেয়ে নেব

তোমার চোখের সমুদ্র থেকে

দু-এক আঁজলা ভালবাসা

আযৌবন লালিত প্রতীক্ষায়

কেউ বলেনি 'নেবে?'



কিন্তু আত্মউন্মোচনের আঙ্গিক বড় নিষ্ঠুর

এখন সমস্ত সখ্য বর্জন করে

গাঁইতি দিয়ে খুবলে নিতে গিয়ে দেখি

জীবন আর স্বপ্নমুখী নয়

কখন জারিত হয়ে গেছে শোকগাথায়

বোঝা গেল পঁয়তালিস্নশ বছর ধরে

একটু একটু করে নিজেই খুন করেছি নিজেকে!



ঐশীয় ঔষধি শাহিদার হাতে

কামরুল আলম সিদ্দিকী



স্মৃতিপ্রিয়া লক্ষ্মী বাহু মেলে তার

এই জংধরা বক্ষে আমার বহুদিন পর-

গাবের ছায়ার মতো পরাণের মাঠে

সুশীতল সুখ নামে মৃত্তিকা শিথানে

আমার আত্মার মাঝে বাজে যেন বেণু

হাজার বছর আগে-মায়ামতি হুর

দু্যতিমুতি মালা পরে সোনার পালংকে

হেলানো স্ফটিক নীরে প্রস বণ তীরে বসে

আহা আমারই ভালবাসা নিতে উন্মুখ-সম্মুখ কতো যুগ যুগ ধরে।

আর আমার আত্মায় বেজে উঠে ঘোর

আবারো সেই বাংলোর ওঠোনে

অনন্ত ছন্দে কার পদধ্বনি আমাকে জাগায়

আহা বিনম্র আহ্লাদে চিরচেনা সুরে

তার কনক চরণ চাঁদামাখা ছাপে

আজো সে, সে ভোরে যেন শিশির বালুতে তোলে কোমল বকুল-

বকুলের মালা যেন গো জীয়ন কাঠি

নিয়ে এসেছে পরাতে সে-ই দুঃখের মরিচা সারাতে

অকূল এই চলিস্নশে আমার!

চৌদ্দশ' বছর শেষে আবারো সুখের

ঔষধি দারুণ দয়া পদ্মপাতাঢাকা রূপালি বেলুন হাতে

ঐশীয় মোযেজা আশ্চর্য শাহিদা যেন আয়েশার গূঢ় পিরিতে গভীর

জীবরাঈলের ওহী কলবে আমার বাংলার জমিনে

একী! কী আশ্চর্য নামে!

আমিও কি বেঁচে ওঠি ফের চিরঞ্জীব যুবকের মতো প্রেমে বেহেশতী বাগানে

নৈঃশব্দ্য আকুলতার মোমীয় আলোকে,

আগেকার শাহিদার সাথে কী নিবিড়-

ঠিক আগেকার মতো আবে হায়াতীয়

মন্ময়ী প্রত্নীয়, শুচি কবিরাজ ঘরে!







অগি্নমুগ্ধ মুক্তোবাস

রোকেয়া ইসলাম



বুকের অনিবার্য তৃষ্ণা নিয়ে

অতলান্ত জলে নিপাট বসবাস

মহাজনী রক্ততিলক ছোটে তীক্ষ্ম বর্শায়

যায় জীবন যাক চৈত্র গঙ্গায়

সর্বাঙ্গে নিবাস কালনেমিকাল

জলসে তো কোন ছাড়

মহাজনে বাধা আগত মহাকাল



ধল প্রহরের ঠোঁটজোড়া একটু খুলে

তবুও নিঃশেষে করিনি পান

অাঁজলা ভরে সুধা সঞ্জীবনী।

অন্তরে একটি বিষের কণা

যদি নড়ে যায় ক্ষয়ে যায়

তবে অগি্নমুগ্ধ মুক্তো কি হয়











মা

তাহমিনা কোরাইশী



লাল কাঁকড়ার দল

জলজ পাহাড় সমতল

পায়ে দলে চলে পথ দ্রুত

খোঁজে সমুদ্রের বালিয়াড়ি পথ

বলে- একটু রোষ বাছাঃ

পৃথিবীর আলো হাওয়া জল মেটাবে তৃষা।



অবশেষে মেলে গন্তব্য

মহানন্দে করে খলবল

জলকেলিতে ঢেউ ভাঙ্গে

ভাসে লক্ষ কোটি প্রাণ

উদর উগলে চলে জীবনের শ্বাস

প্রবল ঢেউয়ে আছড়ে পড়ে গর্ভবতী মা

ভেসে যায় কেউ না কেউ বহু দূরে

মায়ের এ জীবনগাথা অমৃত সমান

স্বাচ্ছন্দ্যে পোনারা গুটিপায়ে ভাসমান

কূলে ভিড়ে আকাঙ্ক্ষিত জীবন

লোনা জল কারো কারো অতীব প্রয়োজন

লক্ষ কোটি লাল কাঁকড়ার দল-

জীবনে জীবন দান

ক'জনা পারে দিতে ওদের মতন?







রহস্যমধুর

খালেদ হোসাইন



দিন-রাতের অন্ন জাগাড় করতে করতে

জীবনের প্রায় সবটাই পিছনে ফেলে এসেছি।



এখন আফসোস হচ্ছে। জীবন

অন্য-রকম হতে পারত।

যদিও জানি, তা কখনো হওয়ার ছিল না।

সামান্যও নয়।



এইটুকু পথ পাড়ি দিতে ঝরে পড়ল কত

শিউলি-বকুল-শত্রু ও স্বজন-

তাদের কথা মাঝেমধ্যে মনে পড়ে।

আর যারা বহাল তবিয়তে আছে-

তাদের কথা মনে পড়ে।



এ এক আশ্চর্য কাণ্ড-

পায়ে শিকড় গজায় তো হাত রূপান্তরিত হয় ডানায়।

চোখ মুদলে যদি দুঃস্বপ্ন তো জেগে উঠলেই মিষ্টি রোদ।

হয়তো চোখে ছানি পড়েছে। হয়তো স্নায়ু নিস্তেজ।

তবু একফোঁটা জলকেও অমৃত মনে হয়।



জীবনের প্রায় সবটাই পিছনে ফেলে এসে

সামনের অনিশ্চিত পথটুকু হয়ে উঠেছে রহস্যমধুর।

বড় রহস্যমধুর।





নতুন এ বাংলাদেশ

ফয়সাল শাহ্



পিতৃহত্যার দায়মুক্ত নতুন এ বাংলাদেশ

পশুমুক্ত, কলংকমুক্ত, অভিশাপমুক্ত আজ,

বৃন্তের পাতায়, ভোরের ঘাসে, শস্যকণায়, ফুলের পাপড়িতে

পিতৃহত্যার রক্ষিত ধারায় মিশেছিল যে পাপ,

বাঙালি জাতি হত্যাকারীর বিচার করে

চৌত্রিশ বছর পরে হয়েছে পাপমুক্ত।



এ চৌত্রিশটি বছর ধরে জন্ম নিয়েছিল যে শিশু

বেঁচেছিল যে কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা-

সকলেই বুকের গহীনে জগদ্দল পাথরের মতো

বয়ে বেড়াতে হয়েছিল পিতৃহত্যার কলঙ্ক;

এ বাংলাদেশে সকলে বুক ভরে নেবে নিঃশ্বাস;



নতুন প্রজন্মের ভালবাসায় সিক্ত সোনার বাংলাদেশ

দীর্ঘ রজনী পেরিয়ে, অমানিশার অাঁধার কেটে শত সংগ্রাম শেষে

বাঙালি কলঙ্কমুক্ত করেছে তার মাটি-ফুল-আকাশ-বাতাস।







শ্বাপদসঙ্কুল

কামাল মাহমুদ



এতো কারুকার্য- ঋদ্ধ বসুন্ধরার এতো শ্রীময় শোভায়

এতো উজ্জ্বল রৌদ্রাভা, আলো, পাখির চোখের মতো

ঘাসে জমা জলবিন্দুতে ফুলের উপমা

শিশু পাতার বাঁশিতে বুনো বাতাসে বেজে ওঠা কোমলগান্ধার

কত গৌর-কৃষ্ণ শত অপার্থিব সুন্দর চারদিকেঃ



সাধের সভ্যতা তাতে ছড়িয়ে দিচ্ছে বিষ

ধোঁয়া, শিশা, পোড়া বারুদের মেঘবাম্প-

আণবিক নুনঝাল মেখে, ভিনিগারে চুবিয়ে ডুবিয়ে

মনুষ্যভক্ষণ- কলা শেখাচ্ছে ভূতপ্রেত, রোবট রাক্ষুসী

জলের দানব এসে আছড়ে পড়ছে উপকূলে



প্রকৃতি তোমার পায়ে ভব্যতার বেড়ি

অশনিসঙ্কেত অাঁকা দিগন্তরেখায়

পৃথিবীর শ্বাসে-প্রশ্বাসে মহাজাগতিক বর্জ্যসকল

তার নখে দাঁতে চোখে, স্পর্শেও সন্ত্রাস



শ্বাপদসঙ্কুল এই ঘন জনারণ্যে কে বীণাযন্ত্রী তুমি

মাথা নিচে, দুই হাতে হেঁটে যাও দূর

তোমার কঙ্কাল তোলে জনপদে খটখট ভৌমিক শব্দদূষণ

স্কুলবালিকারা ভয়ে থমকে দাঁড়াবে যে

কেঁপে যাবে ভ্রুণে জাতকের জন্মের প্রস্তুতি!





ফেরত চাওয়া

কাজী মাহমুদুর রহমান



সমু, শুনেছি তোমার বিয়ে। শুনেছি

তুমি ভয় পেয়েছো, অষ্ট প্রহর বক্ষ দুরুদুরু,

যদি তোমার চিঠিগুলো হবু বরকে দিই!

হিসহিসিয়ে ছোবল দিই, বিষের থলি

উগরে দিই কাল কেউটের মতো

বলে দিই তোমার আমার গোপন কথা যতো!



চিঠিগুলো তাই ফেরত চাওয়া, কান্নাকাটি ক্ষমা চাওয়া

ভালোবাসার অনেক দোহাই

আমি নাকি নীলকণ্ঠ তোমার বাঁচন তোমার মরণ।



ভয় পেয়ো না জান্টু সোনা, চিঠিগুলো ফেরত দেব

দেবই দেব যদি তুমি ফেরত দাও

আমার যতো ভালোবাসার

হাজার দিনের হাজার বিকেল

লক্ষ হাজার উমু।

ফেরত দেবে সমু?





দু'টি ছড়া

আনজীর লিটন



ব্রেকিং নিউজ



অঝোর ধারার বৃষ্টি এখন কর্পোরেটের হাতে

স্পনসর দেবে ফোন কোম্পানী চুক্তি মেঘের সাথে

আষাঢ়-শ্রাবণ দুই মাস

বর্ষায় ঘোর বসবাস

বৃষ্টির জলে কনসার্ট হবে উৎসব হবে রাতে।







লাইভ টেলিকাস্ট



টক শো চলছে। দু'জন অতিথি। হাসি হাসি মুখ বটে

লাইভ টেলিকাস্ট। কিন্তু হঠাৎ কেমন কাণ্ড ঘটে!

কথায় তুমুল ঝড় বয়ে যায় সমানে সমান তারা

আচমকা এক প্রশ্নের বাণে একজন দিশেহারা।



'আপনি বলুন গতবার গম চুরিটা করলো কে?'

বলা মাত্রই ফোন কল আসে উপস্থাপক যে,

বললেন হেসে, নামটা বলুন প্রশ্ন করুন তবে

দর্শক ফোনে নামটা বলেই, পাল্টা বলেন, কবে

প্রশ্নকারীও গম মেরেছেন দিন না হিসাব আগে

অতিথি দু'জন নাজেহাল বটে স্টুডিওতে বসে রাগে।

উপস্থাপক বললেন পরে, বিজ্ঞজনের প্রতি

অনুরোধ করি আজকে না হয় সদয় হবেন অতি।



আবারও ফোন। নামটা বলেই একটা প্রশ্ন আসে

'গমের ব্যাপারে ফয়সালা চাই চুরি হলো কোন মাসে?'

উপস্থাপক বললেন পরে, গম প্রসঙ্গ থাক

মূল বিষয়ের দিকেই না হয় দৃষ্টি দেওয়া যাক।

আজকে বিষয়: ঢাকার ট্রাফিক সিসটেম নিয়ে হবে

দু'জন অতিথি রয়েছেন সাথে প্রশ্ন করুন তবে।



'আগের প্রশ্ন খেয়ে ফেলেছেন উত্তর চাই আগে'

আবারও ফোন। বললেন কেউ, দর্শক পেল বাগে

কাটা ঘায়ে যেন লবণের ছিটা দর্শক একী বলে!

দ্বিধায় পড়েন দু'জন অতিথি আলোচনা আর চলে?



উপস্থাপক বললেন পরে, বহে তর্কের ঝড়

সঙ্গে থাকুন আসবো আবার একটা বিরতি পর।





অভূতপূর্ব

ওয়াসিফ-এ-খোদা



পাখি হতে চাই না আমি

বিমান বাহন না-থাক দামি

আকাশে তবু উড়বো, উড়বোঃ

এমন যদি ঘটেই তবে

বলবে মানুষ উচ্চ রবে-

অভূতপূর্ব! অভূতপূর্ব!!



নয় ঘুমে নয় জাগরণে

নয় হেঁটে নয় যানবাহনে

দূর দেশে তাও ঘুরবো, ঘুরবোঃ

এমন যদি ঘটেই তবে

বলবে মানুষ উচ্চ রবে-

অভূতপূর্ব!!! অভূতপূর্ব!!!!



















আমের মুকুল

ফাইজুল ইসলাম



আমের মুকুল আমের মুকুল

আমি বলি ও আমের ফুল

গৌড়ি মেয়ের কি কানের দুল?

চারিপাশে গন্ধ তুমুল।



মৌমাছিরা গায় গুনাগুন

নতুন পাতায় ঝরে আগুন!

সব মুকুল কি ফল হয় বলতে পারো?

বৃষ্টি-খরায় প্রাণ বুঝি যায় তারও

বৈরি বাতাস ঝরে মুকুল আরও।

ছেয়ে গেলে আমের বাগান

বাগান মালিক সে খবর পান?



মৌমাছিরা গায় গুনাগুন

তাই না দেখে হাসতে থাকে

ছেলেমেয়ে, কেউ হেসেই খুন।



আমের মুকুল আমের মুকুল

তুমি বাঁচলে বাঁচবে দু'কুল।
==========================
আলোচনা- 'মোস্লেম ভারত' পত্রিকায় চর্চিত মুসলিম ধর্ম- দর্শনের স্বরূপ  ইতিহাস- 'চারশ' বছরের ঢাকা লোক ঐতিহ্যের দশ-দিগন্ত' by আনিস আহমেদ  গল্পালোচনা- 'মৃত্যুর মুশায়রা' by সেলিনা হোসেন  গল্প- 'বৃষ্টি নেমেছিল' by ইমদাদুল হক মিলন  গল্প- 'সড়ক নভেল' by হাসনাত আবদুল হাই  গল্প- 'জানালার বাইরে' by অরহ্যান পামুক  স্মৃতি ও গল্প- 'কবির অভিষেক' by মহাদেব সাহা  ইতিহাস- 'ভাওয়ালগড়ের ষড়যন্ত্র' by তারিক হাসান  আলোচনা- 'বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা' by বেলাল চৌধুরী  আলোচনা- 'শিল্প সৃষ্টি ও নান্দনিকতা' by আহমদ রফিক  আলোচনা- ''স্বর্ণকণা শোভে শত শত' মদির গন্ধভরা কণ্টকফল by মুহম্মদ সবুর  বিশেষ রচনা :ওমর খৈয়াম by ড. শামসুল আলম সাঈদ  নাটক- 'বিম্বিত স্বপ্নের বুদ্বুদ' by মোজাম্মেল হক নিয়োগী  গল্প- 'জয়া তোমাকে একটি কথা বলবো' by জাহিদুল হক  গল্প- 'নতুন বন্ধু' by আশরাফুল আলম পিনটু  গল্প- 'টপকে গেল টাপ্পু' by ঝর্ণা দাশ পুরকায়স্থ  গল্প- 'নাচে বানু নাচায়রে' by আতা সরকার  গল্প- 'রূপকথার মতো' by নাসির আহমেদ  গল্প- 'বিয়ে' by আর্নল্ড বেনেট  গল্প- 'মাদকাসক্ত' by আলী ইদ্রিস  গল্প- 'বেঁটে খাটো ভালোবাসা' by রেজানুর রহমান  কবর by জসীম উদ্দীন (পল্লীকবি)  গল্প- 'নদীর নাম চিলমারী' by নীলু দাস  গল্প- 'লাউয়ের ডগা' by নূর কামরুন নাহার  গল্প- 'অপূর্ব সৃষ্টি' by পারভীন সুলতানা গল্প- 'ঊনচলিস্নশ বছর আগে' by জামাল উদ্দীন


দৈনিক ইত্তেফাক এর সৌজন্য

এই কবিতা গুলো পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.