সেনাবাহিনীর ব্রিফিং: সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোতে ইন্ধন রয়েছে
ইন্তেখাব হায়দার খান বলেন, এসব প্রত্যেকটা ঘটনাকে অন্যান্য ঘটনা থেকে একটু আলাদা করে বিচার করা প্রয়োজন। কারণ এগুলো করছেন ৩ ধরনের ব্যক্তি বা গ্রুপ। একটা হলো যারা চিহ্নিত অপরাধী। তাদের কাজই হচ্ছে বিভিন্ন অপরাধ করা বা এধরনের বিষয়ে কাজ করা। আরেকটা হচ্ছে ইন্ধনদাতা, এদের কিছু হচ্ছে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কাজ করছেন। আরেকটা বড় গ্রুপ আছে, তারা দেশের সাধারণ জনগণ। যেমন-ছাত্রদের আন্দোলন, গার্মেন্টস সেক্টরের আন্দোলনকারী শ্রমিকরা এরা কিন্তু সাধারণ জনগণ। ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করছে, এরা কিন্তু আমাদের মতো সাধারণ জনগণ। আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকাটা থাকবে মূলত আমি প্রথম যেই দুটো গ্রুপ বললাম- যারা অপরাধী ও যারা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কাজ করছে বা ইন্ধনদাতা তাদের বিরুদ্ধে। আর সাধারণ মানুষের বিপক্ষে যখন আমাদের দাঁড়াতে হয় তখন আমাদের একটু চিন্তা করে কাজ করতে হয়। কারণ এই ছাত্ররাই কিন্তু আন্দোলন করে আমাদের দেশকে বর্তমান পরিস্থিতিতে এনেছে। আমরা সবাই আশা করছি দেশটা ভালোর দিকে যাবে। সেই ছাত্ররাই যখন কারোর ইন্ধনে পরিস্থিতি না বুঝে সাময়িকভাবে একটু লাইনচ্যুত হয়ে যাচ্ছে, তখন তাদের বিপক্ষে যদি আমরা শক্তি প্রয়োগের কথা ভাবি তখন আমাদের একটু চিন্তা করে কাজটা করতে হয়। আমরা আশা করি ছাত্ররা, শ্রমজীবী, কর্মজীবী, সাধারণ মানুষ আছে তারা প্রত্যেকেই তার নিজ নিজ জায়গায় থেকে আমরা দেশটাকে কোথায় দেখতে চাই এবং সেখানে আমার নিজের কী দায়িত্ব সেটা বুঝবেন। প্রথমত, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হোক আর যেই মাধ্যমেই হোক এই ধরনের ইন্ধন জাতীয় কোনো বিষয় দেখবেন তখন আগে সেটার যাচাই-বাছাই করবেন, যে সেটা সঠিক কিনা। দ্বিতীয়ত, যদি ঘটনা সত্যিও হয় তাহলেও ওই ঘটনার প্রতিবাদ অনেক শান্তিপূর্ণভাবেও করা যায়। কারণ আমরা সকলেই শান্তি চাই দেশে। তাই আমরা সকলে যদি নিজে থেকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করি তাহলে এমন অনেক ঘটনা আমরা এভয়েড করতে পারি। তখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য এসব উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপরাধীদের বিরুদ্ধে কাজ করতে পারে। আমাদের কাজটাও সহজ হয়। তিনি বলেন, আমাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারেও আরও সচেতন হতে হবে। কারণ এই ইন্ধনদাতারা সংখ্যায় কম হলেও তারা যা পোস্ট করেন তাদের ওই পোস্ট অনেক সাধারণ মানুষও কপি করে পোস্ট করে। এখানে সবাই কিন্তু ইন্ধনদাতা থাকেন না। তবে না বুঝে এমন পোস্টের কারণে ঝামেলাগুলো হয়। আমরা সেসব ইন্ধনদাতাদের চিহ্নিত করার কাজ করছি, যারা আসলেই উদ্দেশ্যমূলকভাবে এই কাজগুলো করছেন এবং তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেয়া হচ্ছে। ইন্টেলিজেন্স, পুলিশ সকলের সঙ্গে সম্মিলিতভাবেই আমরা সেসব কাজ করছি।
গত চার মাসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পালন নিয়ে এই সেনা কর্মকর্তা বলেন, গত ১৭ই সেপ্টেম্বর দায়িত্ব পালনের সুবিধার্থে সশস্ত্র বাহিনীর ক্যাপ্টেন ও তদূর্ধ্ব পদবির অফিসারদের সরকার কর্তৃক যে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা প্রদান করা হয়, তা গত ১৫ই নভেম্বর পুনরায় ৬০ দিনের জন্য বর্ধিত করা হয়েছে। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতার সুষ্ঠু এবং নিয়মতান্ত্রিক প্রয়োগ নিশ্চিত করতে সেনাবাহিনীর সব পর্যায়ের সদস্যরা সচেষ্ট রয়েছে। গত ২০শে জুলাই থেকে এখন পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পালনকালে সেনাবাহিনীর মোট ১২৩ জন সদস্য হতাহত হয়েছেন। এর মধ্যে একজন অফিসার শাহাদতবরণ করেছেন এবং ৯ জন অফিসারসহ মোট ১২২ জন সেনাসদস্য বিভিন্ন মাত্রায় আহত হয়েছেন।
দেশব্যাপী আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সার্বিকভাবে যেসব দায়িত্ব পালন করছে সেগুলো হলো- অনাকাঙ্ক্ষিত অরাজকতা প্রতিরোধ করা; দেশে সামপ্রদায়িক সমপ্রীতি বজায় রাখা; বিদেশি কূটনীতিক ব্যক্তি ও দূতাবাসগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, দেশের গুরুত্বপূর্ণ শিল্পাঞ্চলগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং কলকারখানাগুলোকে সচল রাখা, রাষ্ট্রের কেপিআই এবং গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ও বেসরকারি স্থাপনাগুলোকে রক্ষা করা, মূল সড়কগুলোকে বাধামুক্ত রাখা, অবৈধ অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করা, অবৈধ মাদকদ্রব্য উদ্ধার, মাদক কারবারি ও মাদকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করা, বিভিন্ন চিহ্নিত অপরাধী ও নাশকতামূলক কাজের ইন্ধনদাতা ও পরিকল্পনাকারীদের গ্রেপ্তার করা, পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখা, কক্সবাজার জেলায় এফডিএমএন ক্যাম্প এলাকার নিরাপত্তা বিধান করা এবং সার্বিকভাবে দেশের অন্তর্বর্তী সরকার যাতে তাদের দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে পারে, সেজন্য স্থিতিশীল পরিবেশ বজায় রাখা।
১৩ই নভেম্বর থেকে আজ পর্যন্ত সেনাবাহিনীর বিভিন্ন কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পরিসংখ্যান তুলে ধরে কর্নেল ইন্তেখাব হায়দার খান বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনী মোট ২৪টি অবৈধ অস্ত্র এবং ৩৬৫ রাউন্ড গোলাবারুদ উদ্ধার করেছে। দেশের বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে ৪০টি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি এবং ১৮টি সড়ক অবরোধ নিয়ন্ত্রণে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে এবং কারখানাগুলোকে চালু রাখার জন্য মালিকপক্ষ, শ্রমিকপক্ষ, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিজিএমইএসহ সংশ্লিষ্ট সবার সমন্বয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এ ছাড়াও শিল্পাঞ্চল ছাড়াও ৬৩টি বিভিন্ন ধরনের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে, যার মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সংক্রান্ত ঘটনা ছিল ১৬টি, সরকারি সংস্থা/অফিস সংক্রান্ত ১টি, রাজনৈতিক কোন্দল ৬টি এবং অন্যান্য বিভিন্ন ধরনের ঘটনা ৪০টি।
যৌথ অভিযানের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, যৌথ অভিযানে ২২৮ জন মাদক কারবারি অথবা মাদকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং বিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্য উদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত মোট ১ হাজার ৩২৮ জন ব্যক্তিকে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, সারা দেশে সদ্য সমাপ্ত বৌদ্ধদের দেশব্যাপী কঠিন চীবরদান উৎসব যেন নিরাপদে পালিত হতে পারে, সেজন্য সেনাবাহিনী অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং সংশ্লিষ্ট বৌদ্ধ সংগঠন ও ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে দায়িত্ব পালন করেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশব্যাপী মোট ৪৪৪টি বৌদ্ধ বিহারে কোনো দুর্ঘটনা ছাড়াই কঠিন চীবরদান উৎসব পালিত হয়েছে।
নভেম্বরের ১৫-১৬ এবং ২০ তারিখে সনাতন ধর্মাবলম্বী মাতুয়া গোষ্ঠীর রাসমেলা ও নবান্ন উৎসব উদ্যাপনের জন্য গোপালগঞ্জ, বাগেরহাট, পিরোজপুর ও পটুয়াখালী জেলায় নিরাপত্তা সহায়তা প্রদান করা হয়েছে এবং উভয় অনুষ্ঠান অত্যন্ত আনন্দ-উদ্দীপনার সঙ্গে পালিত হয়েছে। এ ছাড়াও ১০-১২ নভেম্বর প্রায় ৫০ হাজার দর্শনার্থীর অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত বরিশালের জগদ্ধাত্রী পূঁজাতেও নিরাপত্তা প্রদান করা হয়েছে।
কর্নেল ইন্তেখাব বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষার পাশাপাশি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিভিন্ন সময়ে যারা আহত হয়েছেন, তাদের সুচিকিৎসার জন্য সেনাবাহিনী ৩ হাজার ৪৩০ জনকে দেশের বিভিন্ন সিএমএইচে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে; যার মধ্যে ৩৫ জন এখনো সিএমএইচে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। সিএমএইচে এ পর্যন্ত দেড় হাজারের বেশি বিভিন্ন ধরনের অস্ত্রোপচার করা হয়েছে, যার মধ্যে ১৫৩টি ছিল গুরুত্বপূর্ণ মাত্রার। এ ছাড়া ৪ জন গুরুতর আহত রোগীকে উন্নত সুচিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ডে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছে সেনাবাহিনী।
তিনি বলেন, কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মির (কেএনএ) বিরুদ্ধে পার্বত্য চট্টগ্রামে চলমান অভিযানে বান্দরবানের দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মির হাত থেকে স্থানীয় নিরীহ জনগোষ্ঠীকে রক্ষায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে একটি বিশেষ যৌথ অভিযান গত এপ্রিল থেকে পরিচালিত হয়ে আসছে।
কর্নেল ইন্তেখাব হায়দার খান বলেন, সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে মানবাধিকার রক্ষা করে সুনির্দিষ্ট গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে পরিচালিত এই অভিযানে এখন পর্যন্ত ১৭৯ জন কেএনএ সক্রিয় সদস্য/সহায়তাকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি বলেন, অভিযানে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রসহ মোট ৬টি বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র ও বিপুল পরিমাণে গোলাবারুদ ও সামরিক সরঞ্জামাদি (দূরবিন, ম্যাপ, আইডি সরঞ্জাম, ওয়াকি টকি, ইউনিফর্ম, ল্যাপটপ ইত্যাদি) উদ্ধার করা হয়েছে। সন্ত্রাসী সংগঠনটির পুঁতে রাখা আইইডি বিস্ফোরণ এবং অতর্কিত হামলায় এ পর্যন্ত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৭ জন বীর সেনানী শহীদ হয়েছেন।
দেশের বিরাজমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা, দেশের জনগণের জানমাল এবং রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ ও স্থাপনার নিরাপত্তা প্রদানসহ সার্বিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের দিক-নির্দেশনাকে অনুসরণ করে দেশের ৬২টি জেলায় সেনাসদস্যরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, স্থানীয় প্রশাসন, বিভিন্ন সংস্থা, গণমাধ্যম এবং সাধারণ জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে সার্বক্ষণিক সক্রিয়ভাবে দায়িত্ব পালন করছে। এই সমন্বয় ও পারস্পরিক সহযোগিতা আরও বৃদ্ধি করে কর্মধারা অব্যাহত রাখতে সেনাবাহিনী অঙ্গীকারবদ্ধ।
No comments