সিলেটে ওদের ঘিরে যে বিতর্ক by ওয়েছ খছরু

সিলেটকে বলা হয় রাজনৈতিক সম্প্রীতির শহর। স্বাধীনতা-উত্তর সময় থেকে এখানে রাজনীতিতে সোহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বিরাজমান। কিন্তু ৫ই আগস্টের প্রেক্ষাপটের পর রাজনৈতিক সম্প্রীতিতে চিড় ধরেছে। এ নিয়ে বোদ্ধা মহলে তুমুল আলোচনা। কেন এমন হলো পরিস্থিতি- এ প্রশ্নের উত্তর নেই। রাজনীতিবিদদের মতে; এবার সিলেটের রাজনৈতিক সম্প্রীতি নষ্ট করে দিয়েছে ক্যাডার ভিত্তিক রাজনীতিক নেতারা। তাদের কারণেই ৫ই আগস্টের আগে সিলেটে ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করা হয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে ‘গণহারে’ রাজনীতিকরা হয়েছেন মামলার আসামি। বাদ যাননি সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেনও। একদফা দাবিতে সিলেটে ছাত্র-জনতার বিক্ষোভের সময় নগরীতে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের হয়ে ক্যাডাররা সশস্ত্র মহড়া দিয়েছে। শুধু মহড়াই নয়, তারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা গুলিও ছুড়েছে। ‘ওয়ার্মআপ অপারেশন’ নামে ম্যাছাকার চালিয়েছে সম্প্রীতির এ নগরে। ২রা আগস্ট। সিলেটের মদিনা মার্কেট থেকে তেমুখী এলাকায় ছাত্র-জনতা ছিল বিস্ফোরণ্মুখ। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দখলে ছিল গোটা এলাকা। নিয়ন্ত্রণে পুলিশ ও সিআরটি টিম হিমশিম খাচ্ছিলো। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের হল ছেড়ে দিয়েছে ছাত্রলীগ। এই অবস্থায় পুলিশকে ‘ব্যাকআপ’ দিতে নামে যুবলীগ ও ছাত্রলীগ। ওই এলাকা হচ্ছে স্বেচ্ছাসেবক লীগ নগর সভাপতি আপ্তাব হোসেন খানের পার্শ্ববর্তী এলাকা। সাবেক যুবলীগ নেতা আব্দুল হান্নানেরও অবস্থান ওই এলাকায়। যুবলীগ ও ছাত্রলীগের দুর্ধর্ষ ক্যাডারদের নিয়ে আপ্তাব ও হান্নান মাঠে নামেন। ওই সময় তাদের হাতে ছিল আগ্নেয়াস্ত্র। পরিস্থিতি মোকাবিলায় মাঠে থাকা পুলিশ যখন ক্লান্ত তখনই শিক্ষার্থীদের পিছু হটাতে তারা পুলিশের পাশ থেকে করে গুলিবর্ষণ। এতে ভয় পায় আন্দোলনে থাকা শিক্ষার্থীরা। তারা তটস্থ হয়ে পড়ে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা জানিয়েছেন- সশস্ত্র ক্যাডারদের গুলিবর্ষণের মুখে তারা আখালিয়াস্থ সুরমা আবাসিক এলাকার বিভিন্ন বাসা বাড়িতে অবস্থান নেয়। ৩রা আগস্ট একইভাবে তাদের ওপর গুলিবর্ষণ করা হয়। সড়কে আন্দোলনে টিকতে না পেরে শিক্ষার্থীরা বাসা-বাড়িতে অবস্থান নেয়। তবে ওইদিন বিকাল থেকে পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে ওঠে। সশস্ত্র ক্যাডাররা সুরমা আবাসিক এলাকার বাসা বাড়িতেও হানা দিতে শুরু করে। একপর্যায়ে সাধারণ শিক্ষার্থীরাও মেস ও বাসা ছেড়ে নিরাপদে ছুটতে থাকে। সিলেট নগরের বন্দরবাজার, জিন্দাবাজারসহ কয়েকটি এলাকায় আগস্টের প্রথম থেকেই ছাত্র-জনতা তীব্র আন্দোলনে নামে। দিন দিন আন্দোলনের মাত্রা তীব্র হতে থাকে। রাজপথে বেশি সংখ্যক ছাত্র-জনতার উপস্থিতি থাকার কারণে মোকাবিলায় থাকা পুলিশ দল হাঁপিয়ে উঠেছিলো। দফায় দফায় সংঘর্ষ করলেও বন্দরবাজার এলাকা ছাত্র-জনতা দখলে রাখে। এই অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ছেড়ে নগরের গুরুত্বপূর্ণ এই সড়কগুলো মুক্ত করতে ৪ঠা আগস্ট রাজপথে আওয়ামী লীগের নেতাদের নেতৃত্বে নামে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সশস্ত্র ক্যাডাররা। ওইদিন নগরের কোর্ট পয়েন্টে ছাত্র-জনতা অবস্থানের ঘোষণা দিয়েছিলো। সকাল থেকে সেখানে ছাত্র-জনতার ব্যানারে অবস্থান নেন বিরোধী বলয়ের নেতাকর্মীরা। বেলা ১১টার দিকে পুলিশ অ্যাকশনে নেমে ছাত্র-জনতাকে সরিয়ে দেয়। এর পরপরই কোর্ট পয়েন্ট দখলে নেয় যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। তাদের হাতে হাতে ছিল আগ্নেয়াস্ত্র। অর্ধশতাধিক নেতাকর্মীর হাতে এদিন আগ্নেয়াস্ত্র ছিল। ফ্রন্টলাইনে ছিলেন সিলেটের দুর্ধর্ষ ক্যাডার পীযূষ কান্তি দে ও জেলা যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদক ও কাউন্সিলর জাহাঙ্গীর আলম। তিনি নগরের পূর্ব অংশের আলোচিত নেতা। আর পীযূষ এর আগেও একাধিকবার অস্ত্রবাজির ঘটনায় সিলেটে আলোচনায় এসেছিলো। একপর্যায়ে তাদের সঙ্গে যোগ দেন সাবেক কাউন্সিলর আপ্তাব হোসেন খান, আব্দুল হান্নানের নেতৃত্বে সশস্ত্র ক্যাডাররা। দুপুরের পরপরই তারা নগরের বন্দরবাজার, জিন্দাবাজারসহ আশপাশের এলাকায় অ্যাকশন শুরু করে। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন; সিলেটে রাজপথে এত আগ্নেয়াস্ত্র কখনোই প্রদর্শিত হয়নি। কারও হাতে স্নাইপার, কারও হাতে একে ফোরটি সেভেনের মতো মরণাস্ত্র ছিল। ওইদিন মূলত ছিল সিলেটে টিকে থাকার লড়াই। পুলিশ মাঠে ছিল না। এ কারণে সশস্ত্র অস্ত্রবাজরা রক্তের হুলি খেলায় মেতে ওঠে। আন্দোলনে থাকা কয়েকশ’ ছাত্র-জনতা আহত হয়। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে রোগী ভর্তি জায়গা ছিল না। ৪ঠা আগস্ট রাজপথে অস্ত্রবাজির কথা সিলেটের মানুষের মনে দাগ কেটেছে। আর এই অস্ত্রবাজির নেতৃত্বে ছিলেন ক্যাডারভিত্তিক রাজনীতির আলোচিত চার নেতা। মূলত তাদের শেল্টারে থাকা অস্ত্রবাজরা এদিন সিলেটের সম্প্রীতিকে নষ্ট করে দিয়েছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক নেতারা। ফলে ছাত্র-জনতার বিজয়ের পর সিলেটের এসব নেতাদের বাসায় ক্ষোভের প্রতিফলন ঘটেছে। একবার নয়, একাধিকবার করে তাদের বাসা জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। চলছে যৌথ অভিযান। কিন্তু অস্ত্র উদ্ধার না হওয়ায় সিলেট জুড়ে তীব্র বিতর্ক চলছে। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরব ছাত্র-জনতা। বারবারই ঘুরে ফিরে আলোচিত হচ্ছে তাদের নাম। পুলিশ জানিয়েছে; গত সোমবার যৌথবাহিনীর একটি টিম নগরের পীরমহল্লা এলাকায় আপ্তাব হোসেন খানের বাসায় অভিযান চালিয়েছিলো। সেখানে আগ্নেয়াস্ত্র না পেলে বিপুল পরিমাণ ধারালো অস্ত্র পেয়েছে। অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় আপ্তাব হোসেন খানকে একমাত্র আসামি করে এয়ারপোর্ট থানায় মামলা হয়েছে।
mzamin

No comments

Powered by Blogger.