আর্থিক প্রতিষ্ঠানে লুটপাট: বিএফআইইউ’র ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন

দুর্নীতি, অনিয়ম আর অপরাধের মাধ্যমে গত ১৫ বছরে দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। ক্ষমতার সঙ্গে সরাসরি জড়িত প্রভাবশালীরাই অর্থ পাচার করেছেন বিদেশে। এসব খবর নিয়মিতভাবে প্রকাশিত হলেও দেশের আর্থিক গোয়েন্দা বিভাগ দৃশ্যত কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। বরং বরাবরই রহস্যজনক কারণে নীরব ছিল বাংলাদেশের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ)। তবে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সক্রিয় হয়ে উঠেছে সংস্থাটি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রায় প্রতিদিনই সংস্থাটি সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করছে, আটকে দিচ্ছে ব্যাংকে থাকা লকার আর তলব করছে ব্যাংক লেনদেনের তথ্য। কিন্তু ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও নেটিজেনরা। তাদের মতে, এসব অ্যাকাউন্টে কি বড় অঙ্কের টাকা ছিল? অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা সরানোর পর জব্দ করলে তো কোনো লাভ হবে না? এ নিয়ে সামাজিক সাইটেও বেশ আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে।

উল্লেখ্য, বিগত সরকারের সময় ফুলেফেঁপে ওঠা অনেকের বিদেশে সম্পদের তথ্য সংগ্রহের জন্য যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে চিঠি দেয়া হয়েছে। পাচার করা অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সহায়তা চেয়েছে সরকার। পাচার করা অর্থ ফেরত আনতে এরই মধ্যে নতুন করে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে।

সূত্র জানায়, জব্দ করা অ্যাকাউন্টগুলো যাদের নামে, তাদের বড় অংশই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। আছেন শেখ হাসিনা পরিবারের সদস্য, খেলোয়াড়, প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ও পুলিশ কর্মকর্তাও। এসব ব্যাংক হিসাবে থাকা অর্থের উৎস ও আয়ের নথি খতিয়ে দেখছে বিএফআইইউ। বিভিন্ন ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়ে পাচারের সুনির্দিষ্ট তথ্য রয়েছে সমালোচিত ব্যবসায়ী গ্রুপ এস আলমের বিরুদ্ধে। গত সাত বছরে এস আলম গ্রুপ শুধু ইসলামী ব্যাংকিং সিস্টেম থেকেই নামে-বেনামে লুট করেছে ২ লাখ কোটি টাকার উপরে, যার বেশির ভাগ অংশই সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে পাচার করেছে।

বিএফআইইউ’র কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, গত কয়েক বছরে দেশ থেকে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার করেছে এস আলম গ্রুপ। তার অর্থ পাচারের সুনির্দিষ্ট তথ্য সংস্থাটির কাছে আছে। এস আলমসহ অন্য অনেকের তথ্য রয়েছে। এরপরও অদৃশ্য কারণে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না।
বিএফআইইউ’র সাবেক প্রধান দুদকের জালে: বিএফআইইউ’র সাবেক প্রধান মাসুদ বিশ্বাসের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারসহ দুর্নীতির বিভিন্ন অভিযোগের অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদকের এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানা গেছে। দুদকে জমা দেয়া অভিযোগে বলা হয়, বিএফআইইউ’র পদত্যাগ করা মাসুদ বিশ্বাস বিভিন্ন সময়ে শীর্ষ দুর্নীতিবাজদের থেকে ঘুষের মাধ্যমে অনিয়মে সহায়তা করেছেন। বিগত দিনে হলমার্ক, বিসমিল্লাহ সহ ২৪টি বড় ঘটনায় ৯২ হাজার কোটি টাকার আর্থিক কেলেঙ্কারির মাধ্যমে অর্থ পাচারে নীরব ভূমিকা পালন করেছিল মাসুদ বিশ্বাসের বিএফআইইউ।

যেসব দেশে পাচার হয়েছে: বিএফআইইউ গত বছরের জানুয়ারিতে উচ্চ আদালতে অর্থ পাচার, উদ্ধার প্রক্রিয়াসহ বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরে ৪৯ পৃষ্ঠার একটি রিপোর্ট দাখিল করে। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার করে নেয়া বিশেষ গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, সিঙ্গাপুর ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। এ ছাড়া সামপ্রতিক সময়ে অনেকেই মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোম প্রকল্পে বিনিয়োগ করেছেন। এর বাইরে অস্ট্রেলিয়া, জাপান, হংকং, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, ভারত, শ্রীলঙ্কা, কুয়েত, বেলজিয়াম, তাঞ্জানিয়ায় পাচারের তথ্য রয়েছে। এসব দেশে পাচারের সুনির্দিষ্ট অভিযোগে সব মিলিয়ে ৫৯টি মামলার চার্জশিট হয়েছে।

জানা গেছে, ৫ই আগস্ট স্বৈরাচার সরকারের পতনের পর বিভিন্ন দুর্নীতির ফাইল টেবিলের ড্রয়ারে আটকে রেখে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাধারণ কর্মকর্তারা। বিক্ষুব্ধ কর্মকর্তাদের চাপের মুখে পদত্যাগে বাধ্য হন বিএফআইইউ প্রধান মো. মাসুদ বিশ্বাস। পাশাপাশি বিএফআইইউকেও ঢেলে সাজানোর কাজ শুরু হয়। এজন্য দীর্ঘ দিনে এ সংস্থায় কাজ করা ও বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ ওঠা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদেরও বদলি করা হয়। কিন্তু এখনো বহাল তবিয়তে রয়েছেন বিএফআইইউ ডেপুটি হেড রফিকুল ইসলাম। তিনি একসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ করতেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সরকার পতনের পর থেকে ধারাবাহিকভাবে সাবেক মন্ত্রী, এমপি, রাজনীতিবিদ, পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ একাধিক প্রভাবশালী ব্যক্তির অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করেছে বিএফআইইউ। কিন্তু রহস্যজনক কারণে টাকা পাচারের তথ্য উদ্ঘাটনের জন্য সরকারের অন্য সংস্থাগুলো যে গতিতে কাজ করছে, তার ধারে কাছেও নেই বিএফআইইউ। তাদের মতে, যেখানে অনিয়মের অভিযোগ উঠায় বিএফআইইউ প্রধান পদত্যাগ করেছে, সেখানে ডেপুটি হেড কীভাবে এখনো বহাল তবিয়তে রয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিভিন্ন ব্যাংক থেকে অর্থপাচারে মূল অভিযুক্তদের কারও বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বিশেষ করে এস আলমের ক্ষেত্রে একেবারেই রহস্যজনক ভূমিকা পালন করছে বিএফআইইউ।

এদিকে এসব বিষয় নিয়ে খোদ সংশ্লিষ্ট সংস্থার কর্মকর্তারাও প্রশ্ন তুলেছেন। গত ২১শে আগস্ট বিএফআইইউতে অনুষ্ঠিত এক সভায় অর্থপাচারকারীদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না; তা নিয়ে একাধিক কর্মকর্তা প্রশ্ন তুলেন।

সূত্র জানিয়েছে, ওইদিন বিএফআইইউ’র ডেপুটি হেড রফিকুল ইসলামের সভাপতিত্বে সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে একাধিক কর্মকর্তা প্রশ্ন করেন, এস আলম গ্রুপ, সামিট, নাসা গ্রুপ, ব্যাংক খাতের সমালোচিত চৌধুরী নাফিজ সরাফতসহ অনেকের অর্থপাচারের সুনির্দিষ্ট তথ্য বিএফআইইউতে আছে। বিভিন্ন সময়ে এদের অনিয়ম নিয়ে সংবাদপত্রে রিপোর্ট হয়েছে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। একাধিক কর্মকর্তা ক্ষোভ প্রকাশ করে জানিয়েছেন, এতদিন বলা হতো চাপের কারণে কিছু করা যাচ্ছে না। কিন্তু এখন তো আর সেই চাপ নেই। কিন্তু এখন কেন দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাচ্ছে না।

এস আলম ও তার পরিবারের সদস্যদের কোনো ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট নাই? এমন প্রশ্ন তুললে বিএফআইইউ’র উপপ্রধান রফিকুল ইসলাম বলেন, তাদের ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে বেশি টাকা নাই। এস আলম গ্রুপ সব করেছে বেনামী অ্যাকাউন্টে। আমরা এখন তাদের বেনামী অ্যাকান্টগুলো খুঁজে বের করছি।
বিএফআইইউ’র একজন কর্মকর্তা বলেন, পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধারের জন্য প্রথমে দেশের আদালতে প্রমাণ করতে হবে। এরপর সংশ্লিষ্ট দেশ থেকে অর্থ ফেরত আনতে তৎপরতা চালাতে হবে। আবার দেশের বাইরেও আইনি প্রতিষ্ঠান নিয়োগসহ লেগে থাকতে হয়। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে এসব নিয়ে দাবি তুলতে হয়। তবে যখন যে সরকার ক্ষমতায় আসে, এ ক্ষেত্রে তাদের আন্তরিকতার ঘাটতি দেখা যায়। যে কারণে অর্থ উদ্ধার কার্যকর হয় না। এখন একটি অরাজনৈতিক সরকার রয়েছে। ফলে তারা চাইলে উন্নতি সম্ভব।

বিএফআইইউ’র সাবেক প্রধান আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান বলেন, আইনে বিএফআইইউকে কাজের স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। তবে পরিবেশ অনুকূলে না থাকা, ঝুঁকি না নেয়া এবং ওপর থেকে বাধা আসায় এটি কাজ করতে পারেনি। বিএফআইইউ সক্রিয় থাকলে অনেক আর্থিক অপরাধ ঘটতো না বা রোধ করা যেতো।

নয়ন নামের একজন ফেসবুকে লিখেছেন, ব্যাংক থেকে সব টাকা তোলার পর অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হচ্ছে। বাহ! বাহ! বিষয়টা খুবই সুন্দর। তার মতো আরও অনেকেই বিএফআইইউ’র কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.