চীন+১: দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া কেন ভারতকে পেছনে ফেলে প্রথম পছন্দ হয়ে উঠেছে? by সুব্রত মজুমদার
ঘটনাচক্রে, বাণিজ্যমন্ত্রীর দাবির বাস্তবতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে । কারণ চীন+১ কৌশলের আবির্ভাবের মাধ্যমে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য আরও আকর্ষণীয় গন্তব্য হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ইউরেশিয়া রিভিউ-তে নয়া দিল্লির ‘জাপান এক্সটার্নাল ট্রেড অর্গানাইজেশন (জেট্রো)-এর একজন প্রাক্তন উপদেষ্টা সুব্রত মজুমদার লিখছেন, চীন থেকে বড় মাপের বিনিয়োগের সাথে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় (আসিয়ান ১০) বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে। বিপরীতে ভারতে বিদেশি বিনিয়োগ হ্রাস পেয়েছে। ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ আকর্ষণ হারিয়েছে। যার ফলে উৎপাদন বৃদ্ধি অত্যন্ত নিম্নস্তরে পৌঁছেছে। আসিয়ান-এর রপ্তানি যখন দ্বিগুণ অঙ্কে বৃদ্ধি পেয়েছে, তখন ভারতের রপ্তানি একটি অনিয়মিত প্রবণতার দিকে ইঙ্গিত করে। ভারত বেকারত্বের শীর্ষে রয়েছে, যখন আসিয়ান বেকারত্ব কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা জারি রেখেছে।
চীন+১ হল একটি সাপ্লাই চেইন কৌশল। এটি ২০১৪ ও ২০১৫-এর মধ্যে বিশ্বব্যাপী মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। চীনে শ্রমের পেছনে ক্রমবর্ধমান ব্যয়ের কারণে সাপ্লাই চেইনের ওপর নির্ভরতা হ্রাসের পাশাপাশি বিকল্প হিসেবে অন্যান্য এশিয়ান দেশগুলোর চাহিদা বাড়ছে। ফলে সরবরাহ শৃঙ্খলে বৈচিত্র্য বাড়ছে। লক্ষ্য সোর্সিং ও ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের জন্য একক দেশের উপর অতিরিক্ত নির্ভরতার ঝুঁকি হ্রাস করা। আর তাই ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা এবং কোভিড-১৯ এর পর ‘চীন +১’ বিশ্বের নজর কেড়েছে। ‘চীন +১’ মানে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা চীনে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার ছাড়পত্র পাবার পাশাপাশি একাধিক দেশে তাদের ব্যবসা ছড়িয়ে দেবে, যেগুলোকে ‘প্লাস ওয়ান’ হিসাবে বিবেচনা করা হয়।
দুঃখজনকভাবে মেক ইন ইন্ডিয়ার সাফল্যের গল্প ব্যর্থ হয়েছে। এটি তার লক্ষ্য হারিয়েছে। মেক ইন ইন্ডিয়ার মূল লক্ষ্য ছিল জিডিপিতে উৎপাদনের অংশ ২০১৪ সালে ১৭-১৮ শতাংশ থেকে ২০২২ সালে ২২ শতাংশে উন্নীত করা। তবে এটি ২০১৫-১৬ সালে ১৮.২ শতাংশ থেকে ২০২৩-২৪ সালে ১৭.৩ শতাংশে পৌঁছেছে। ভারতে বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে। ২০২১ থেকে ২০২৩ তিন বছরের মধ্যে বিদেশি বিনিয়োগ ১৯.৫ শতাংশ কমেছে। ফলস্বরূপ বেকারত্ব আকাশচুম্বী। দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বেকারত্বের শীর্ষে ভারত। এটি ২০১৬-১৭ থেকে ২০২৩-২৪ এর মধ্যে প্রায় ৭-৮ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছেছে, যে সময়টিতে মেক ইন ইন্ডিয়ার সাফল্য ঘোষণা করা হয়েছিল। এর বিপরীতে আসিয়ানের বেকারত্বের হার ক্ষীণ বৃদ্ধি পেয়েছে, যেখানে থাইল্যান্ডে ০.৯৮ শতাংশ, ভিয়েতনামে ১.৬ শতাংশ ও চীনে ৫.২শতাংশ।
২০২৪ সালে ভারতের সাধারণ নির্বাচনে বেকারত্ব মূল সমস্যা হিসেবে প্রতিভাত হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ক্যারিশমা হারানো এবং লোকসভায় বিজেপির সংখ্যাগরিষ্ঠতা কমার ক্ষেত্রে এটি অন্যতম প্রধান ইস্যু হিসেবে সামনে আসে। এটি বর্তমান সরকারের অর্থনৈতিক সাফল্যের পাশাপাশি মেক ইন ইন্ডিয়ার সাফল্যের বিষয়ে উদ্বেগ বাড়িয়েছে। অবশেষে সরকার ২০২৪-২৫ সালের আর্থিক বাজেটে চাকরি সৃষ্টিতে প্রণোদনা দেওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে। কর্মসংস্থানের সুযোগ সম্প্রসারণের জন্য নিয়োগকর্তাদের এই প্রণোদনা দেওয়া হবে। যুক্তি দেওয়া হয়েছে, যে কীভাবে একজন নিয়োগকর্তা উৎপাদনের সম্প্রসারণ ছাড়াই কর্মসংস্থান বাড়াতে পারেন। কার্যত, ভারতই হবে বিশ্বের প্রথম দেশ যারা চাকরি সৃষ্টির ক্ষেত্রে প্রণোদনা চালু করবে।
বিপরীতে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া চীন+১ কৌশলের মাধ্যমে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য আরও আকর্ষণীয় গন্তব্য হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ২০২১ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে আসিয়ানে বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) ১০.৭ শতাংশ বেড়েছে। এফডিআই-এর ট্রিগার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপক বিনিয়োগ পরিবর্তনের কারণে হয়েছিল। এটি ২০২১ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে ১২৫.৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। আসিয়ানে মার্কিন বিনিয়োগের মেগা শেয়ার চীন+১ কৌশলের অধীনে বিনিয়োগে বৈচিত্র্য এনেছে।
অবশেষে, কোভিড ১৯ সত্ত্বেও আসিয়ানে বিশ্বব্যাপী রপ্তানি বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে আসিয়ান রপ্তানি ১৪.৯ শতাংশ বেড়েছে। এখানেও সবচেয়ে বড় রপ্তানি গন্তব্য হয়ে উঠেছে যুক্তরাষ্ট্র। তারপরে রয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি ১৩.৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, তারপরে ইইউতে রপ্তানি হয়েছে। যা একই সময়ের মধ্যে ১৫ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে।
তাহলে, ভারত কেন চীন+১ কৌশলের সুফল পেতে ব্যর্থ হয়েছে? গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো ছিল দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার প্রতিযোগিতায় ভারতের ব্যর্থ হওয়া এবং চীনা বিনিয়োগের উপর নিষেধাজ্ঞা। দশ বছর মেয়াদে সাপ্লাই চেইন প্রধান বৈশ্বিক উৎপাদনের মূল ফ্যাক্টর হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এটি বিশ্ব বাণিজ্যের ৪০ শতাংশের জন্য দায়ী। কোভিড-১৯ এর কারণে সাপ্লাই চেইনে ব্যাঘাত বিশ্বব্যাপী উৎপাদনে একটি বড় বাধা সৃষ্টি করেছে।
চীন সাপ্লাই চেইন উৎপাদনের মূল কারিগর এবং বিশ্ব বাণিজ্যের কেন্দ্র। কোভিড ১৯ মহামারি চীনের ম্যানুফ্যাকচারিং সেক্টরকে আঘাত করেছে , যার ফলে বিশ্ব প্রবৃদ্ধি ধাক্কা খেয়েছে। বিশ্ব জিডিপি প্রবৃদ্ধি ২০২২ সালে ৩.২ শতাংশে নেমে এসেছে, যা ২০২১ সালে ছিল ৬ শতাংশ। কোভিড-১৯ পর্যন্ত, ভারত মেক ইন ইন্ডিয়ার দিকে মনোনিবেশ করেছিল। কিন্তু বৈশ্বিক প্রবণতার সাথে সামঞ্জস্য রেখে সরবরাহ চেইন উৎপাদনের অগ্রাধিকারকে উপেক্ষা করে এসেছে। কিন্তু চীন সাপ্লাই চেইন ম্যানুফ্যাকচারিং এবং গ্লোবাল ইন্টিগ্রেশনের উদ্যোগকে গুরুত্ব দিয়ে এসেছে।
এছাড়া চীনা বিনিয়োগের উপর নিষেধাজ্ঞা চীন থেকে ভারতে বিদেশি বিনিয়োগের বহুমুখীকরণে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই কারণে ভারতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগের আকস্মিক পতন ঘটেছে। চীনের ইউএসএ এমএনসি ভারতে স্থানান্তর করতে অনিচ্ছুক ছিল যেহেতু তাদের চীনা সরবরাহ শৃঙ্খল নির্মাতাদের ভারতে প্রবেশে বাধা দেওয়া হয়েছিল, যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমারা ভারতকে চীনের চেয়ে উৎপাদনের জন্য একটি ভালো গন্তব্য হিসেবে দেখে এসেছে। যদিও ভারত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান তৈরিতে চীনের চেয়ে পিছিয়ে রয়েছে, তবুও তারা দীর্ঘমেয়াদি সুবিধার জন্য ভারতকে পছন্দ করে।
এই লক্ষ্যে, চীনা বিনিয়োগের প্রতি ভারতের আগ্রহ বিদেশি বিনিয়োগের গন্তব্যের ক্ষেত্রে ভারতের পুনরুত্থানের আশা জাগিয়েছে। ভারতের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২৩-২৪-এ ভারতে চীনা বিনিয়োগের উপর ফোকাস করার জন্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টার পরামর্শকে সমর্থন করেছিলেন ।ভারতের ইলেকট্রনিক এবং অটোমোবাইল শিল্প বৃদ্ধির মুখ দেখেছে। তবে প্রবৃদ্ধি নির্ভরশীল চীন থেকে আমদানির উপর। ভারতে চীনা বিনিয়োগ সহজ হওয়ায় আমদানির উপর কম নির্ভরতাসহ ভারত এই শিল্পগুলো বিদেশি বিনিয়োগের জন্য আরও আকর্ষণীয় গন্তব্য হতে পারে।
তবে সবশেষে একটি প্রশ্ন ওঠে, নিরাপত্তা উদ্বেগের যুক্তিকে সরিয়ে রেখে চীনা বিনিয়োগকে উৎসাহিত করতে ভারতের কি এক ধাপ এগোনো উচিত?
লেখক: সুব্রত মজুমদার; জাপান এক্সটার্নাল ট্রেড অর্গানাইজেশন (জেট্রো), নয়া দিল্লি’র একজন প্রাক্তন উপদেষ্টা। ভারতীয় মিডিয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন বিদেশি মিডিয়া যেমন, এশিয়া টাইমস অনলাইন ও ইউরেশিয়া রিভিউতে নিবন্ধের লেখক।
No comments