বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ
বাংলাদেশ
প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করা
হয়েছে। গতকাল বুয়েটের কেন্দ্রীয় মিলনায়তনে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে
বৈঠককালে ভিসি অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম এ ঘোষণা দেন। এ ছাড়া আবরার হত্যা
ঘটনায় এজাহারভুক্ত ১৯ আসামিকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা
হয়েছে বলেও জানান ভিসি। ইতোপূর্বে ঘটা র্যাগিংয়ের ঘটনাও তদন্ত করবে বুয়েট
প্রশাসন। আবরার ফাহাদ হত্যার ঘটনায় বুয়েটের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে
প্রকাশ্যে আলোচনা বসার দাবি অনুযায়ী গতকাল বিকাল ৫টায় বুয়েট অডিটোরিয়ামে
আলোচনায় বসেন ভিসি অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম। এসময় তিনি শিক্ষার্থীদের দশ
দফা নিয়ে পৃথকভাবে বুয়েট প্রশাসনের পদক্ষেপের কথা জানান। তবে এতে
শিক্ষার্থীরা সন্তুষ্ট কিনা রাতে সংবাদ সম্মেলন করে জানানো হবে বলে জানান
আন্দোলনকারীরা। রাত সাড়ে ৮টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বিক্ষোভ করছেন।
পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী বিকাল পাঁচটায় ভিসির বৈঠক শুরু হওয়ার কথা থাকলেও আধঘণ্টা বিলম্বে শুরু হয় আলোচনা। ভিসি ছাড়াও বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন ছাত্রকল্যাণ পরিচালক অধ্যাপক মিজানুর রহমানসহ আরও ৭ শিক্ষক। বৈঠকে বিপুল সংখ্যক সাধারণ শিক্ষার্থী ও সংবাদকর্র্মীদের উপস্থিতি ছিল। কানায় কানায় পূর্ণ ছিল মিলনায়তন। মিলনায়তনের বাইরেও অপেক্ষা করতে দেখা গেছে আনুমানিক ৫ শতাধিক শিক্ষার্থীকে।
বৈঠকের শুরুতে নিহত আবরার ফাহাদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ উপস্থিত সকলে। এসময় ভিসি অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম আবরার হত্যাকান্ডের ঘটনায় নিজের ভূমিকার জন্য ক্ষমা চান। তিনি শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলেন, আমার কিছুটা ভুল হয়েছে, আমি তোমাদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। আমার ভুল আমি স্বীকার করছি। তোমরা আমাকে ক্ষমা করে দাও। তিনি বলেন, আবরার আমার সন্তানের মতো ছিল। তোমাদের যেমন কষ্ট লাগছে তার মৃত্যুতে আমারও অনেক খারাপ লেগেছে। এটি আমি মেনে নিতে পারিনি। তার মৃত্যুতে দুঃখ তোমরা পেয়েছ, আমিও পেয়েছি। আমরা সকলেই মর্মাহত। এসময় শিক্ষার্থীদের দশ দফা নিয়ে পৃথকভাবে বুয়েট প্রশাসনের নেয়া ব্যবস্থার কথা জানান ভিসি। প্রথম দফা ছিল- আবরার ফাহাদের খুনিদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। সিসিটিভি ফুটেজ ও জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্য অনুসারে শনাক্ত খুনিদের প্রত্যেকের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এ বিষয়ে ভিসি বলেন, আমরা সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদানে একমত। আমরা সরকারের সাথেও কথা বলেছি। তারাও সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে। দ্বিতীয় দফা ছিল- সিসিটিভি ফুটেজ থেকে জড়িতদের শনাক্ত করে শুক্রবার বিকাল ৫টার মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আজীবন বহিষ্কার করতে হবে। এ ব্যাপারে ভিসি বলেন, এ ব্যাপারে তদন্ত কমিটি কাজ করছে। সবকিছু নিয়মের মধ্যে হচ্ছে। যদি তাড়াহুড়া করে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় তাহলে আমরা যদি কোর্টে হেরে যাই তাহলে সমস্যা। তাই এজাহারভুক্ত ১৯ জনকে সাময়িক বহিষ্কার করা হলো।
তা অবিলম্বে কার্যকর করা হবে। এতে কোন গাফিলতি করা হবে না। তৃতীয় দাবি হচ্ছে, মামলার সব খরচ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে নিতে হবে এবং আবরারের পরিবারের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। শুক্রবার বিকাল ৫টার মধ্যে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক নোটিশ জারি করতে হবে। এ দাবির প্রেক্ষিতে ভিসি বলেন, তাদের পরিবারকে সকল প্রকার ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে। আমরা সিদ্ধান্ত নেব কি ধরনের ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে। আমরা এই ব্যাপারে নোটিশে জানিয়ে দিব। চতুর্থ দাবি ছিল- দ্রুত বিচার ট্রাইবুনালে স্বল্পতম সময়ে আবরার হত্যা মামলার নিষ্পত্তি করার জন্য বুয়েট প্রশাসনকে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। বুয়েট প্রশাসনকে সক্রিয় থেকে সমস্ত প্রক্রিয়া নিয়ামত পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং নিয়মিত ছাত্রদের তথ্য দিতে হবে। এ দাবির প্রেক্ষিতে ভিসি বলেন, আমরাও এই বিষয়েও একমত। সরকারের সাথে আমাদের কথা হয়েছে। সরকার আমাদের আশ্বস্ত করছেন। এ ব্যাপারে কোন গাফিলতি করা হবে না। পঞ্চম দাবি ছিল- আবরার হত্যা মামলার অভিযোগপত্রের কপি অবিলম্বে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করতে হবে। এ দাবি প্রসঙ্গে ভিসি বলেন, এটাও প্রকাশ করা হবে। এ ব্যাপারে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। আমরা এ ব্যাপারে সরকারকে লিখিত দেব। আজ শুক্রবার হওয়ায় লিখিত দিতে পারিনি। এই মামলার সকল আপডেট ভিসি অফিস থেকে নোটিশ আকারে জানানো হবে। ষষ্ঠ দাবি ছিল- হত্যা মামলার চার্জশিট প্রকাশ করতে হবে। এ বিষয়ে ভিসি বলেন, চার্জশিটের জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। আমরা এ ব্যাপারে সরকারকে জোর করতে পারব না। তাদের নিজস্ব গতিতে কাজ করছে। চার্জশিট হাতে পেলে আমরা নোটিশে জানিয়ে দিব। সপ্তম দাবি ছিল-বুয়েটে ‘সাংগঠনিক ছাত্র রাজনীতি’ নিষিদ্ধ করতে হবে।
এ দাবি প্রসঙ্গে বুয়েট ভিসি সাইফুল ইসলাম বলেন, ভিসির ক্ষমতা বলে আজ থেকে বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা হলো। সাথে শিক্ষক রাজনীতিও। আজ থেকে পলিটিক্যাল কোন প্রোগ্রামে শিক্ষক যাবে না। তবে যদি কেউ গোপনে রাজনীতি করে তাহলে আমরা তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব। অষ্টম দফা ছিল- বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি কেন ৩০ ঘণ্টা অতিবাহিত হওয়ার পরও ঘটনাস্থলে যাননি এবং ৩৮ ঘণ্টা পরে উপস্থিত হয়ে কেন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বিরূপ আচরণ করেছেন? এমন জবাবাদিহিতায় সাইফুল ইসলাম বলেন, আমার শরীর ভালো না থাকার কারণে সময় উপযোগী সিদ্বান্ত নিতে পারিনি। এজন্য আমি দুঃখ প্রকাশ করছি ক্ষমা প্রার্থনা করছি। নবম দফা ছিল- আবাসিক হলগুলোতে র্যাগের নামে এবং ভিন্ন মতাবলম্বীদের ওপর সকল প্রকার শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতন বন্ধ করতে হবে এবং এ ধরনের সন্ত্রাসে জড়িত সকলের ছাত্রত্ব প্রশাসনকে বাতিল করতে হবে। একই সাথে আহসানউল্লাহ হল এবং সোহরাওয়ার্দী হলের পূর্বের ঘটনাগুলোতে জড়িত সকলের ছাত্রত্ব বাতিল করতে হবে ১১ অক্টোবর বিকাল ৫টার মধ্যে। এ দাবির প্রেক্ষিতে ভিসি বলেন, এই ব্যাপারেও ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে। এছাড়াও একটি ওয়েবসাইট করা হবে সেখানে সবাই অভিযোগ প্রকাশ করতে পারবে। এই সাইটের মধ্যে কি কি থাকতে হবে তা তোমাদের সাথে আলোচনা করে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এই প্রোগ্রামের জন্য এক সপ্তাহ সময় লাগবে। নিরাপত্তার স্বার্থে সবগুলো হলের প্রত্যেক ফ্লোরের সবগুলা উইংয়ের দুই পাশে সিসিটিভি ক্যামেরার ব্যবস্থা করার বিষয়ে ভিসি বলেন, অতিদ্রুত সিসিটিভি ফুটেজের ব্যবস্থা করা হবে। আমি এ ব্যাপারে আইআইসিসি বিভাগের সাথে কথা বলেছি। সবগুলো হলে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করা হবে। আর শেরে বাংলা হলের প্রভোস্টকে প্রত্যাহার করার শেষ দাবি সম্পর্কে ভিসি বলেন, তিনি আগেই পদত্যাগ করেছেন। এর আগে শুক্রবার সকাল থেকে বুয়েট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বিক্ষোভ শুরু করেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। সকাল ১১টায় শহীদ মিনার থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়। মিছিলটি ক্যাম্পাসের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে ফের শহীদ মিনারে এসে বিক্ষোভ সমাবেশে মিলিত হয়। মিছিলের পূর্বে আন্দোলনকারীরা দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করতে সংবাদ সম্মেলন করেন।
সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা বলেন, আজকে আন্দোলনের পঞ্চম দিনে এসে আমরা বলতে চাই, যে ১০ দফা দাবি দিয়েছি, এখনো তার দৃশ্যমান অগ্রগতি আমরা দেখিনি। আরও একটি দুঃখের বিষয় হচ্ছে, আমাদের দাবিগুলো বাস্তবায়নের সদিচ্ছার অভাব দেখতে পাচ্ছি। আল্টিমেটামের সময় বাড়ানোর তথ্য দিয়ে তারা বলেন, যেহেতু ভিসি স্যার বিকেল ৫টায় আমাদের সঙ্গে দেখা করতে রাজি হয়েছেন, সেহেতু আমরা তার সিদ্ধান্তের প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা রেখে আমাদের আল্টিমেটাম তার মিটিং শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত বৃদ্ধি করেছি। তারা জানান, ভিসি তার পিএস ও আরও দু-একজন শিক্ষক নিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সামনে হাজির হন। শিক্ষার্থীরা জানান, ভিসি স্যার আমাদের সঙ্গে একান্তে একটি কক্ষে কথা বলতে চেয়েছিলেন গণমাধ্যমের উপস্থিতি ছাড়া। তখন সাধারণ শিক্ষার্থীরা জানান, যেহেতু আন্দোলন সাধারণ শিক্ষার্থীদের, তাই সাধারণ শিক্ষার্থী ছাড়া প্রতিনিধি দলের সঙ্গে কথা বললে হবে না। এরপর সাধারণ শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নিয়ে ভিসি উন্মুক্ত আলোচনায় রাজি হন। তবে উন্মুক্ত আলোচনায় কিছু নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হবে বলেও জানানো হয় সংবাদ সম্মেলনে। শিক্ষার্থীরা জানান, অডিটোরিয়ামে আলোচনার সময় শিক্ষার্থী ও গণমাধ্যমকর্মীরা থাকবেন। তবে আলোচনার সময় গণমাধ্যম তা সরাসরি সমপ্রচার করতে পারবে না। তবে ভিডিও করা যাবে। আলোচনা শেষে তা ভিডিও আকারে প্রকাশ করতে পারবে। এ সময় গণমাধ্যমকর্মীরা প্রশ্নও করতে পারবেন না। ভিসির অনুরোধে শর্তগুলো মানা হবে বলে জানান শিক্ষার্থীরা।
এর আগে গত বৃহস্পতিবার ভিসি অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলালকে দুপুর ২টার মধ্যে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের দাবির বিষয়ে অবস্থান পরিষ্কার না করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব একাডেমিক ও প্রশাসনিক ভবনে তালা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন শিক্ষার্থীরা। এরপর ওইদিন বিকালে ভিসি অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম আন্দোলনকারীদের সঙ্গে বসার প্রস্তাব দেন। তবে এ আলোচনায় গণমাধ্যমের উপস্থিতি থাকা যাবে না বলে শর্ত দেন ভিসি। কিন্তু শিক্ষার্থীরা গণমাধ্যমের উপস্থিতি ছাড়া ভিসির সঙ্গে কোন আলোচনায় না যাওয়ার ঘোষণা দিলে রাতে প্রথম সারির গণমাধ্যমের উপস্থিতিতে আলোচনায় বসতে রাজি হন ভিসি সাইফুল ইসলাম। উল্লেখ্য, গত রোববার দিবাগত রাতে বুয়েটের শেরে বাংলা হলের ২০১১ নম্বর কক্ষে তড়িৎ ও ইলেক্ট্রনিক প্রকৌশল বিভাগের ১৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করে বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এরপর তার মরদেহ দ্বিতীয় তলার সিঁড়িতে ফেলে রাখে ঘাতকরা। এ ঘটনায় উত্তাল বুয়েট ক্যাম্পাস ও দেশের শিক্ষাঙ্গণ। সকলের একটাই দাবি হত্যাকারী ছাত্রলীগ নেতাদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা। হত্যাকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তিসহ ১০ দফা দাবিতে আন্দোলনে রয়েছেন বুয়েটের শিক্ষার্থীরা। হত্যাকান্ডের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানীসহ বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা।
পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী বিকাল পাঁচটায় ভিসির বৈঠক শুরু হওয়ার কথা থাকলেও আধঘণ্টা বিলম্বে শুরু হয় আলোচনা। ভিসি ছাড়াও বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন ছাত্রকল্যাণ পরিচালক অধ্যাপক মিজানুর রহমানসহ আরও ৭ শিক্ষক। বৈঠকে বিপুল সংখ্যক সাধারণ শিক্ষার্থী ও সংবাদকর্র্মীদের উপস্থিতি ছিল। কানায় কানায় পূর্ণ ছিল মিলনায়তন। মিলনায়তনের বাইরেও অপেক্ষা করতে দেখা গেছে আনুমানিক ৫ শতাধিক শিক্ষার্থীকে।
বৈঠকের শুরুতে নিহত আবরার ফাহাদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ উপস্থিত সকলে। এসময় ভিসি অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম আবরার হত্যাকান্ডের ঘটনায় নিজের ভূমিকার জন্য ক্ষমা চান। তিনি শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলেন, আমার কিছুটা ভুল হয়েছে, আমি তোমাদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। আমার ভুল আমি স্বীকার করছি। তোমরা আমাকে ক্ষমা করে দাও। তিনি বলেন, আবরার আমার সন্তানের মতো ছিল। তোমাদের যেমন কষ্ট লাগছে তার মৃত্যুতে আমারও অনেক খারাপ লেগেছে। এটি আমি মেনে নিতে পারিনি। তার মৃত্যুতে দুঃখ তোমরা পেয়েছ, আমিও পেয়েছি। আমরা সকলেই মর্মাহত। এসময় শিক্ষার্থীদের দশ দফা নিয়ে পৃথকভাবে বুয়েট প্রশাসনের নেয়া ব্যবস্থার কথা জানান ভিসি। প্রথম দফা ছিল- আবরার ফাহাদের খুনিদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। সিসিটিভি ফুটেজ ও জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্য অনুসারে শনাক্ত খুনিদের প্রত্যেকের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এ বিষয়ে ভিসি বলেন, আমরা সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদানে একমত। আমরা সরকারের সাথেও কথা বলেছি। তারাও সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে। দ্বিতীয় দফা ছিল- সিসিটিভি ফুটেজ থেকে জড়িতদের শনাক্ত করে শুক্রবার বিকাল ৫টার মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আজীবন বহিষ্কার করতে হবে। এ ব্যাপারে ভিসি বলেন, এ ব্যাপারে তদন্ত কমিটি কাজ করছে। সবকিছু নিয়মের মধ্যে হচ্ছে। যদি তাড়াহুড়া করে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় তাহলে আমরা যদি কোর্টে হেরে যাই তাহলে সমস্যা। তাই এজাহারভুক্ত ১৯ জনকে সাময়িক বহিষ্কার করা হলো।
তা অবিলম্বে কার্যকর করা হবে। এতে কোন গাফিলতি করা হবে না। তৃতীয় দাবি হচ্ছে, মামলার সব খরচ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে নিতে হবে এবং আবরারের পরিবারের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। শুক্রবার বিকাল ৫টার মধ্যে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক নোটিশ জারি করতে হবে। এ দাবির প্রেক্ষিতে ভিসি বলেন, তাদের পরিবারকে সকল প্রকার ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে। আমরা সিদ্ধান্ত নেব কি ধরনের ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে। আমরা এই ব্যাপারে নোটিশে জানিয়ে দিব। চতুর্থ দাবি ছিল- দ্রুত বিচার ট্রাইবুনালে স্বল্পতম সময়ে আবরার হত্যা মামলার নিষ্পত্তি করার জন্য বুয়েট প্রশাসনকে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। বুয়েট প্রশাসনকে সক্রিয় থেকে সমস্ত প্রক্রিয়া নিয়ামত পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং নিয়মিত ছাত্রদের তথ্য দিতে হবে। এ দাবির প্রেক্ষিতে ভিসি বলেন, আমরাও এই বিষয়েও একমত। সরকারের সাথে আমাদের কথা হয়েছে। সরকার আমাদের আশ্বস্ত করছেন। এ ব্যাপারে কোন গাফিলতি করা হবে না। পঞ্চম দাবি ছিল- আবরার হত্যা মামলার অভিযোগপত্রের কপি অবিলম্বে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করতে হবে। এ দাবি প্রসঙ্গে ভিসি বলেন, এটাও প্রকাশ করা হবে। এ ব্যাপারে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। আমরা এ ব্যাপারে সরকারকে লিখিত দেব। আজ শুক্রবার হওয়ায় লিখিত দিতে পারিনি। এই মামলার সকল আপডেট ভিসি অফিস থেকে নোটিশ আকারে জানানো হবে। ষষ্ঠ দাবি ছিল- হত্যা মামলার চার্জশিট প্রকাশ করতে হবে। এ বিষয়ে ভিসি বলেন, চার্জশিটের জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। আমরা এ ব্যাপারে সরকারকে জোর করতে পারব না। তাদের নিজস্ব গতিতে কাজ করছে। চার্জশিট হাতে পেলে আমরা নোটিশে জানিয়ে দিব। সপ্তম দাবি ছিল-বুয়েটে ‘সাংগঠনিক ছাত্র রাজনীতি’ নিষিদ্ধ করতে হবে।
এ দাবি প্রসঙ্গে বুয়েট ভিসি সাইফুল ইসলাম বলেন, ভিসির ক্ষমতা বলে আজ থেকে বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা হলো। সাথে শিক্ষক রাজনীতিও। আজ থেকে পলিটিক্যাল কোন প্রোগ্রামে শিক্ষক যাবে না। তবে যদি কেউ গোপনে রাজনীতি করে তাহলে আমরা তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব। অষ্টম দফা ছিল- বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি কেন ৩০ ঘণ্টা অতিবাহিত হওয়ার পরও ঘটনাস্থলে যাননি এবং ৩৮ ঘণ্টা পরে উপস্থিত হয়ে কেন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বিরূপ আচরণ করেছেন? এমন জবাবাদিহিতায় সাইফুল ইসলাম বলেন, আমার শরীর ভালো না থাকার কারণে সময় উপযোগী সিদ্বান্ত নিতে পারিনি। এজন্য আমি দুঃখ প্রকাশ করছি ক্ষমা প্রার্থনা করছি। নবম দফা ছিল- আবাসিক হলগুলোতে র্যাগের নামে এবং ভিন্ন মতাবলম্বীদের ওপর সকল প্রকার শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতন বন্ধ করতে হবে এবং এ ধরনের সন্ত্রাসে জড়িত সকলের ছাত্রত্ব প্রশাসনকে বাতিল করতে হবে। একই সাথে আহসানউল্লাহ হল এবং সোহরাওয়ার্দী হলের পূর্বের ঘটনাগুলোতে জড়িত সকলের ছাত্রত্ব বাতিল করতে হবে ১১ অক্টোবর বিকাল ৫টার মধ্যে। এ দাবির প্রেক্ষিতে ভিসি বলেন, এই ব্যাপারেও ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে। এছাড়াও একটি ওয়েবসাইট করা হবে সেখানে সবাই অভিযোগ প্রকাশ করতে পারবে। এই সাইটের মধ্যে কি কি থাকতে হবে তা তোমাদের সাথে আলোচনা করে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এই প্রোগ্রামের জন্য এক সপ্তাহ সময় লাগবে। নিরাপত্তার স্বার্থে সবগুলো হলের প্রত্যেক ফ্লোরের সবগুলা উইংয়ের দুই পাশে সিসিটিভি ক্যামেরার ব্যবস্থা করার বিষয়ে ভিসি বলেন, অতিদ্রুত সিসিটিভি ফুটেজের ব্যবস্থা করা হবে। আমি এ ব্যাপারে আইআইসিসি বিভাগের সাথে কথা বলেছি। সবগুলো হলে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করা হবে। আর শেরে বাংলা হলের প্রভোস্টকে প্রত্যাহার করার শেষ দাবি সম্পর্কে ভিসি বলেন, তিনি আগেই পদত্যাগ করেছেন। এর আগে শুক্রবার সকাল থেকে বুয়েট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বিক্ষোভ শুরু করেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। সকাল ১১টায় শহীদ মিনার থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়। মিছিলটি ক্যাম্পাসের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে ফের শহীদ মিনারে এসে বিক্ষোভ সমাবেশে মিলিত হয়। মিছিলের পূর্বে আন্দোলনকারীরা দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করতে সংবাদ সম্মেলন করেন।
সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা বলেন, আজকে আন্দোলনের পঞ্চম দিনে এসে আমরা বলতে চাই, যে ১০ দফা দাবি দিয়েছি, এখনো তার দৃশ্যমান অগ্রগতি আমরা দেখিনি। আরও একটি দুঃখের বিষয় হচ্ছে, আমাদের দাবিগুলো বাস্তবায়নের সদিচ্ছার অভাব দেখতে পাচ্ছি। আল্টিমেটামের সময় বাড়ানোর তথ্য দিয়ে তারা বলেন, যেহেতু ভিসি স্যার বিকেল ৫টায় আমাদের সঙ্গে দেখা করতে রাজি হয়েছেন, সেহেতু আমরা তার সিদ্ধান্তের প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা রেখে আমাদের আল্টিমেটাম তার মিটিং শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত বৃদ্ধি করেছি। তারা জানান, ভিসি তার পিএস ও আরও দু-একজন শিক্ষক নিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সামনে হাজির হন। শিক্ষার্থীরা জানান, ভিসি স্যার আমাদের সঙ্গে একান্তে একটি কক্ষে কথা বলতে চেয়েছিলেন গণমাধ্যমের উপস্থিতি ছাড়া। তখন সাধারণ শিক্ষার্থীরা জানান, যেহেতু আন্দোলন সাধারণ শিক্ষার্থীদের, তাই সাধারণ শিক্ষার্থী ছাড়া প্রতিনিধি দলের সঙ্গে কথা বললে হবে না। এরপর সাধারণ শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নিয়ে ভিসি উন্মুক্ত আলোচনায় রাজি হন। তবে উন্মুক্ত আলোচনায় কিছু নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হবে বলেও জানানো হয় সংবাদ সম্মেলনে। শিক্ষার্থীরা জানান, অডিটোরিয়ামে আলোচনার সময় শিক্ষার্থী ও গণমাধ্যমকর্মীরা থাকবেন। তবে আলোচনার সময় গণমাধ্যম তা সরাসরি সমপ্রচার করতে পারবে না। তবে ভিডিও করা যাবে। আলোচনা শেষে তা ভিডিও আকারে প্রকাশ করতে পারবে। এ সময় গণমাধ্যমকর্মীরা প্রশ্নও করতে পারবেন না। ভিসির অনুরোধে শর্তগুলো মানা হবে বলে জানান শিক্ষার্থীরা।
এর আগে গত বৃহস্পতিবার ভিসি অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলালকে দুপুর ২টার মধ্যে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের দাবির বিষয়ে অবস্থান পরিষ্কার না করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব একাডেমিক ও প্রশাসনিক ভবনে তালা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন শিক্ষার্থীরা। এরপর ওইদিন বিকালে ভিসি অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম আন্দোলনকারীদের সঙ্গে বসার প্রস্তাব দেন। তবে এ আলোচনায় গণমাধ্যমের উপস্থিতি থাকা যাবে না বলে শর্ত দেন ভিসি। কিন্তু শিক্ষার্থীরা গণমাধ্যমের উপস্থিতি ছাড়া ভিসির সঙ্গে কোন আলোচনায় না যাওয়ার ঘোষণা দিলে রাতে প্রথম সারির গণমাধ্যমের উপস্থিতিতে আলোচনায় বসতে রাজি হন ভিসি সাইফুল ইসলাম। উল্লেখ্য, গত রোববার দিবাগত রাতে বুয়েটের শেরে বাংলা হলের ২০১১ নম্বর কক্ষে তড়িৎ ও ইলেক্ট্রনিক প্রকৌশল বিভাগের ১৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করে বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এরপর তার মরদেহ দ্বিতীয় তলার সিঁড়িতে ফেলে রাখে ঘাতকরা। এ ঘটনায় উত্তাল বুয়েট ক্যাম্পাস ও দেশের শিক্ষাঙ্গণ। সকলের একটাই দাবি হত্যাকারী ছাত্রলীগ নেতাদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা। হত্যাকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তিসহ ১০ দফা দাবিতে আন্দোলনে রয়েছেন বুয়েটের শিক্ষার্থীরা। হত্যাকান্ডের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানীসহ বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা।
No comments