চীনকে দূরে রাখতে প্রতিবেশীদের দিকে নজর মোদির by বার্টিল লিন্টনার
আঞ্চলিক
শক্তি চীন ও ভারতের মধ্যে অবস্থানকারী হিমালয় রাজতান্ত্রিক দেশ ভুটান
শিগগিরই সম্প্রতি নবনির্বাচিত ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির উচ্চ
পর্যায়ের সফলকে স্বাগত জানাবে।
এটি হবে ভারতীয় নেতার ‘প্রতিবেশী প্রথম’ নীতির সর্বশেষ মিশন। নয়া দিল্লির প্রভাববলয় হিসেবে বিবেচিত এই অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব প্রতিরোধের লক্ষ্যে গ্রহণ করা হয়েছে এই পদক্ষেপ।
এই একই নীতি অনুসরণ করে মোদি গত জুনে গিয়েছিলেন মালদ্বীপে। সেটা ছিল মে মাসে পুননির্বাচিত হওয়ার পর তার প্রথম বিদেশ সফর। মালদ্বীপে নতুন ভারতপন্থী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে চীনের ঘনিষ্ঠ হিসেবে বিবেচিত আবদুল্লাহ ইয়ামিনের কাছ থেকে। শ্রীলঙ্কায় বর্তমান প্রেসিডেন্ট মৈত্রিপালা সিরিসেনা ২০১৫ সালে নির্বাচনে চীনাপন্থী প্রেসিডেন্ট মহিন্দা রাজাপাকসাকে হারানোর পর থেকে ভারত ও চীনের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করছে।
তবে ভুটানে প্রভাব বাড়ানো নিয়ে চীন ও ভারত দ্বন্দ্বযুদ্ধে নিয়োজিত রয়েছে। আর এটিই দক্ষিণ এশিয়ার কূটনীতি ও কৌশলগত সম্পর্ককে গড়ে দিচ্ছে।
ভুটান হলো ভারতের দীর্ঘ দিনের ঘনিষ্ঠ মিত্র। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই ছোট্ট তবে কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ দেশটির সাথে কার্যকর সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় চেষ্টা শুরু করেছে। আবার এই দেশটির সাথেই চীনের এখন পর্যন্ত কোনো সরকারি কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই।
ভারতের ‘প্রতিবেশী প্রথম’ নীতির আনুষ্ঠানিক লক্ষ্য সম্ভবত অনেক ধরনের পরিবহণ ব্যবস্থার মাধ্যমে আঞ্চলিক কানেকটিভিটি বিকশিত করা। মোদি নিজেই এমনটা ঘোষণা করেছে।
কিন্তু এখন কোনো সন্দেহ নেই যে, আসলে এর লক্ষ্য হলো ভারতের আঙিনায় চীনা প্রভাব হ্রাস করা। আর সেই লক্ষ্যে ভারত নতুন মিত্র পেয়েছে, সে হলো চীনের কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বী জাপান।
মে মাসে ভারত ও জাপান শ্রীলংকায় চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) প্রতিরোধ করার লক্ষ্যে দ্বীপ দেশটির রাজধানী কলম্বোর প্রধান বন্দরটির সম্প্রসারণ ও উন্নয়নে যৌথ উদ্যোগ গ্রহণ করে।
এই সমঝোতাটি আসে শ্রীলংকা তাদের হামবানতোতা বন্দরটি ঋণ পরিশোধ করতে না পারায় চীনকে দিয়ে দেয়ার প্রেক্ষাপটে।
হামবানতোতা ঘটনা চীনের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ উস্কে দেয় যে দেশটি ঋণ ফাঁদ ফেলে বিআরআই বাস্তবায়ন করার কৌশল গ্রহণ করেছে, তারপর তারা বিশাল এলাকাজুড়ে কৌশলগত অবকাঠামোর নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করবে।
ভারত ও চীনের মধ্যে থাকা ভুটান ছোট দেশ হলেও বেইজিং সেখানেও প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে। অবশ্য এখানে তার কৌশল বিআরআই ঋণ বা মঞ্জুরি নয়, বরং ‘সফট কূটনীতি’।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনা সার্কাস শিল্পী, অ্যাক্রোব্যাট, ফুটবলাররা স্থানীয় লোকদের আনন্দ দিতে সারা ভুটান ঘুরে ফিরছে। আবার বিপুলসংখ্যক ভুটানি ছাত্র স্কলারশিপ নিয়ে চীন যাচ্ছে। চীনা পর্যটনও সম্প্রসারিত হচ্ছে।
চীন ও ভুটান একে অপরের দেশে দূতাবাস প্রতিষ্ঠা না করলেও তারা তাদের মধ্যকার অভিন্ন ও বিরোধপূর্ণ সীমান্ত নিয়ে কয়েক দফা আলোচনা করেছে।
দুই দেশের মধ্যে ১৯৮৪ সাল থেকে ২৪ দফা আলোচনা হয়েছে। এর ফলে দুই দেশের কূটনীতিকরা পারস্পরিক স্বার্থ নিয়ে আলোচনার সুযোগ পাচ্ছে।
ভারত বেশ উদ্বেগের সাথে এসব ঘটনা লক্ষ্য করে ২০১৪ সাল থেকে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছে। মোদির আসন্ন সফর এমনই একটি।
ওই বছরের জুলাই মাসে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মোদি প্রথম বিদেশ সফর করেছিলেন ভুটানে। ভারতীয় নেতার এজেন্ডায় চীনের দূতাবাস বা অন্য কোনো ধরনের প্রতিনিধিত্ব করার বিষয়টি ছিল গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু।
চীন ও ভারতের মধ্যে থাকা ভুটানের গুরুত্ব প্রবলভাবে ফুটে ওঠে ২০১৭ সালের জুলাই মাসে। এ সময় দোকলাম দিয়ে রাস্তা বানানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করে চীন। এই স্থানটি ভুটান ও চীন উভয় দেশই দাবি করে থাকে। ভারত সেখানে সৈন্য পাঠিয়ে চীনা উদ্যোগ ভণ্ডুল করার চেষ্টা চালায়। এ নিয়ে চীন ও ভারতের মধ্যে বেশ কিছু দিন উত্তেজনা থাকে। ভুটান যে কঠিন অবস্থানে আছে, তা এই ঘটনায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
আবার ভুটানের কাছেও স্পষ্ট হয়ে যায় যে তারা দুই শক্তিশালী প্রতিবেশীর মধ্যকার সঙ্ঘাতে প্রক্সি হতে চায় না।
ভুটানের স্থানীয় একটি ওয়েবসাইট ২০১৭ সালের ৫ আগস্ট জানায়, ভুটান চায় না যে ভারত ও চীন যুদ্ধে মাতুক। ইতোমধ্যেই উত্তপ্ত হয়ে ওঠো পরিস্থিতি আর উত্তপ্ত হতে দিতে চায় না ভুটান।
এখনো ভুটানে ভারতের যে প্রভাব আছে, তা নস্যাৎ করার মতো অবস্থানে নেই চীন। সেই ১৮৬৫ সাণ থেকে ভুটানের সাথে ভারতের বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। ওই সম্পর্কের সূচনা হয়েছিল ভুটানের শাসক ও ব্রিটিশ ভারতের উপনিবেশিক প্রভুদের মাধ্যমে।
ভুটান ও ব্রিটিশ ভারত ১৯১০ সালে একটি চুক্তিতে সই করে। এতে ব্রিটিশ রাজ ভুটানের অভ্যন্তরীণ সার্বভৌমত্বকে স্বীকৃতি দেয়, আর এর পররাষ্ট্র সম্পর্কের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। ভুটান ও স্বাধীন ভারত ১৯৪৯ সালে একই ধরনের চুক্তিতে সই করে।
ভুটানের একচ্ছত্র রক্ষক হিসেবে ভারতের আবির্ভাব ঘটে ১৯৬৩ সালের চুক্তি অনুযায়ী। এই চুক্তিতে স্বীকার করে নেয়া হয় যে ভুটান উপনিবেশ-পূর্ব ভারতের রাজন্যশাসিত রাজ্য নয়, বরং স্বাধীন রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র।
ভারতের সমর্থন নিয়ে ১৯৭১ সালে জাতিসংঘের সদস্য হয় ভুটান। তবে ১৯৪৯ সালের চুক্তি অনুযায়ী, ভারতই দেশটির পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিয়ে থাকে।
এরপর ২০০৭ সালে সই হওয়া চুক্তিতে বলা হয়, আন্তর্জাতিক স্বার্থে দুই পক্ষ ঘনিষ্ঠভাবে সহযোগিতা করবে। দুই দেশের কেউই অপরের স্বার্থের হানি হয়, এমন কোনো ক্ষতিকর কাজ করবে না।
এই স্বার্থ পরিভাষাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ দিয়ে আসলে চীনকে প্রতিরোধের কথাই বোঝানো হয়েছে। আর এ কারণেই ভুটানবিষয়ক কূটনৈতিক গুরুত্ব এত বেশি আরোপ করেছেন মোদি।
প্রতিবেশী প্রথম কৌশলের মাধ্যমে ভারত নতুন নতুন অবকাঠামো প্রকল্প দিয়ে ভুটানকে আরো কাছে টানার পরিকল্পনা করছে। ভারত এখন স্থল ও নদী রুট দিয়ে এই অঞ্চলের নতুন নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে চাচ্ছে।
এ ধরনের একটি উদ্যোগ হিসেবে সম্প্রতি ১০০০ টন ভুটানি পাথর ট্রাকে করে ভুটান থেকে ধুবরিতে পাঠানো হয়। এই পাথর এরপর জাহাজে করে ব্রহ্মপুত্র নদী দিয়ে বাংলাদেশে রফতানি করা হয়।
এই উদ্যোগটি চীনের বিআরআইয়ের মতো তত সমৃদ্ধ ও জাঁকালো না হলেও এর তাৎপর্যও কম নয়। স্থল-নদী রুটটি ব্যবহারের ফলে ভুটান থেকে বাংলাদেশে পণ্য পাঠাতে ৮-১০ দিন সময় কমবে, পরিবহন ব্যয়ও হ্রাস পাবে ৩০ ভাগ।
ভুটানে সাহায্যের হাত সম্প্রসারণ করছে জাপানও। এর মধ্যে রয়েছে ভূমিধস ও পল্লী উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে দুর্যোগ ত্রাণ।
আরো প্রতীকী ব্যবস্থা হিসেবে জাপানের সম্রাটের ছোট ভাই সম্রাট নারুহিতো আগস্টে তার পরিবার নিয়ে ভুটান যাবেন বলে আশা করা হচ্ছে। জাপানি রাজপরিবার প্রায়ই ভুটান সফর করে। ১৯৯৭ সালে ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে নারুহিতো সফর করেছিলেন ভুটান।
ভুটান, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশকেন্দ্রিক মোদির প্রতিবেশী প্রথম নীতিটি জাপানের স্বার্থের সাথেও প্রাসঙ্গিক।
একইসাথে এই নীতি একে অপরের প্রতি এশিয়ার দুই জায়ন্ট যে পারস্পরিক সন্দেহ পোষণ করে, তা আরো গভীর করতে পারে।
অন্যদিকে ভুটান ও মালদ্বীপের মতো প্রত্যন্ত দেশগুলো আঞ্চলিক শক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে পড়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলতে পারে।
একদিকে ক্রমবর্ধমান শক্তি বৃদ্ধিকারী চীন ও অপরদিকে ভারত ও জাপানসহ শিথিলভাবে জোটবদ্ধ জোটের মধ্যকার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সৃষ্ট একটি নতুন স্নায়ুযুদ্ধের মতো অবস্থা বিরাজ করা বিশ্বের এই অংশের জন্য শুভ ইঙ্গিত হবে না।
এটি হবে ভারতীয় নেতার ‘প্রতিবেশী প্রথম’ নীতির সর্বশেষ মিশন। নয়া দিল্লির প্রভাববলয় হিসেবে বিবেচিত এই অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব প্রতিরোধের লক্ষ্যে গ্রহণ করা হয়েছে এই পদক্ষেপ।
এই একই নীতি অনুসরণ করে মোদি গত জুনে গিয়েছিলেন মালদ্বীপে। সেটা ছিল মে মাসে পুননির্বাচিত হওয়ার পর তার প্রথম বিদেশ সফর। মালদ্বীপে নতুন ভারতপন্থী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে চীনের ঘনিষ্ঠ হিসেবে বিবেচিত আবদুল্লাহ ইয়ামিনের কাছ থেকে। শ্রীলঙ্কায় বর্তমান প্রেসিডেন্ট মৈত্রিপালা সিরিসেনা ২০১৫ সালে নির্বাচনে চীনাপন্থী প্রেসিডেন্ট মহিন্দা রাজাপাকসাকে হারানোর পর থেকে ভারত ও চীনের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করছে।
তবে ভুটানে প্রভাব বাড়ানো নিয়ে চীন ও ভারত দ্বন্দ্বযুদ্ধে নিয়োজিত রয়েছে। আর এটিই দক্ষিণ এশিয়ার কূটনীতি ও কৌশলগত সম্পর্ককে গড়ে দিচ্ছে।
ভুটান হলো ভারতের দীর্ঘ দিনের ঘনিষ্ঠ মিত্র। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই ছোট্ট তবে কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ দেশটির সাথে কার্যকর সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় চেষ্টা শুরু করেছে। আবার এই দেশটির সাথেই চীনের এখন পর্যন্ত কোনো সরকারি কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই।
ভারতের ‘প্রতিবেশী প্রথম’ নীতির আনুষ্ঠানিক লক্ষ্য সম্ভবত অনেক ধরনের পরিবহণ ব্যবস্থার মাধ্যমে আঞ্চলিক কানেকটিভিটি বিকশিত করা। মোদি নিজেই এমনটা ঘোষণা করেছে।
কিন্তু এখন কোনো সন্দেহ নেই যে, আসলে এর লক্ষ্য হলো ভারতের আঙিনায় চীনা প্রভাব হ্রাস করা। আর সেই লক্ষ্যে ভারত নতুন মিত্র পেয়েছে, সে হলো চীনের কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বী জাপান।
মে মাসে ভারত ও জাপান শ্রীলংকায় চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) প্রতিরোধ করার লক্ষ্যে দ্বীপ দেশটির রাজধানী কলম্বোর প্রধান বন্দরটির সম্প্রসারণ ও উন্নয়নে যৌথ উদ্যোগ গ্রহণ করে।
এই সমঝোতাটি আসে শ্রীলংকা তাদের হামবানতোতা বন্দরটি ঋণ পরিশোধ করতে না পারায় চীনকে দিয়ে দেয়ার প্রেক্ষাপটে।
হামবানতোতা ঘটনা চীনের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ উস্কে দেয় যে দেশটি ঋণ ফাঁদ ফেলে বিআরআই বাস্তবায়ন করার কৌশল গ্রহণ করেছে, তারপর তারা বিশাল এলাকাজুড়ে কৌশলগত অবকাঠামোর নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করবে।
ভারত ও চীনের মধ্যে থাকা ভুটান ছোট দেশ হলেও বেইজিং সেখানেও প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে। অবশ্য এখানে তার কৌশল বিআরআই ঋণ বা মঞ্জুরি নয়, বরং ‘সফট কূটনীতি’।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনা সার্কাস শিল্পী, অ্যাক্রোব্যাট, ফুটবলাররা স্থানীয় লোকদের আনন্দ দিতে সারা ভুটান ঘুরে ফিরছে। আবার বিপুলসংখ্যক ভুটানি ছাত্র স্কলারশিপ নিয়ে চীন যাচ্ছে। চীনা পর্যটনও সম্প্রসারিত হচ্ছে।
চীন ও ভুটান একে অপরের দেশে দূতাবাস প্রতিষ্ঠা না করলেও তারা তাদের মধ্যকার অভিন্ন ও বিরোধপূর্ণ সীমান্ত নিয়ে কয়েক দফা আলোচনা করেছে।
দুই দেশের মধ্যে ১৯৮৪ সাল থেকে ২৪ দফা আলোচনা হয়েছে। এর ফলে দুই দেশের কূটনীতিকরা পারস্পরিক স্বার্থ নিয়ে আলোচনার সুযোগ পাচ্ছে।
ভারত বেশ উদ্বেগের সাথে এসব ঘটনা লক্ষ্য করে ২০১৪ সাল থেকে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছে। মোদির আসন্ন সফর এমনই একটি।
ওই বছরের জুলাই মাসে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মোদি প্রথম বিদেশ সফর করেছিলেন ভুটানে। ভারতীয় নেতার এজেন্ডায় চীনের দূতাবাস বা অন্য কোনো ধরনের প্রতিনিধিত্ব করার বিষয়টি ছিল গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু।
চীন ও ভারতের মধ্যে থাকা ভুটানের গুরুত্ব প্রবলভাবে ফুটে ওঠে ২০১৭ সালের জুলাই মাসে। এ সময় দোকলাম দিয়ে রাস্তা বানানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করে চীন। এই স্থানটি ভুটান ও চীন উভয় দেশই দাবি করে থাকে। ভারত সেখানে সৈন্য পাঠিয়ে চীনা উদ্যোগ ভণ্ডুল করার চেষ্টা চালায়। এ নিয়ে চীন ও ভারতের মধ্যে বেশ কিছু দিন উত্তেজনা থাকে। ভুটান যে কঠিন অবস্থানে আছে, তা এই ঘটনায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
আবার ভুটানের কাছেও স্পষ্ট হয়ে যায় যে তারা দুই শক্তিশালী প্রতিবেশীর মধ্যকার সঙ্ঘাতে প্রক্সি হতে চায় না।
ভুটানের স্থানীয় একটি ওয়েবসাইট ২০১৭ সালের ৫ আগস্ট জানায়, ভুটান চায় না যে ভারত ও চীন যুদ্ধে মাতুক। ইতোমধ্যেই উত্তপ্ত হয়ে ওঠো পরিস্থিতি আর উত্তপ্ত হতে দিতে চায় না ভুটান।
এখনো ভুটানে ভারতের যে প্রভাব আছে, তা নস্যাৎ করার মতো অবস্থানে নেই চীন। সেই ১৮৬৫ সাণ থেকে ভুটানের সাথে ভারতের বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। ওই সম্পর্কের সূচনা হয়েছিল ভুটানের শাসক ও ব্রিটিশ ভারতের উপনিবেশিক প্রভুদের মাধ্যমে।
ভুটান ও ব্রিটিশ ভারত ১৯১০ সালে একটি চুক্তিতে সই করে। এতে ব্রিটিশ রাজ ভুটানের অভ্যন্তরীণ সার্বভৌমত্বকে স্বীকৃতি দেয়, আর এর পররাষ্ট্র সম্পর্কের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। ভুটান ও স্বাধীন ভারত ১৯৪৯ সালে একই ধরনের চুক্তিতে সই করে।
ভুটানের একচ্ছত্র রক্ষক হিসেবে ভারতের আবির্ভাব ঘটে ১৯৬৩ সালের চুক্তি অনুযায়ী। এই চুক্তিতে স্বীকার করে নেয়া হয় যে ভুটান উপনিবেশ-পূর্ব ভারতের রাজন্যশাসিত রাজ্য নয়, বরং স্বাধীন রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র।
ভারতের সমর্থন নিয়ে ১৯৭১ সালে জাতিসংঘের সদস্য হয় ভুটান। তবে ১৯৪৯ সালের চুক্তি অনুযায়ী, ভারতই দেশটির পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিয়ে থাকে।
এরপর ২০০৭ সালে সই হওয়া চুক্তিতে বলা হয়, আন্তর্জাতিক স্বার্থে দুই পক্ষ ঘনিষ্ঠভাবে সহযোগিতা করবে। দুই দেশের কেউই অপরের স্বার্থের হানি হয়, এমন কোনো ক্ষতিকর কাজ করবে না।
এই স্বার্থ পরিভাষাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ দিয়ে আসলে চীনকে প্রতিরোধের কথাই বোঝানো হয়েছে। আর এ কারণেই ভুটানবিষয়ক কূটনৈতিক গুরুত্ব এত বেশি আরোপ করেছেন মোদি।
প্রতিবেশী প্রথম কৌশলের মাধ্যমে ভারত নতুন নতুন অবকাঠামো প্রকল্প দিয়ে ভুটানকে আরো কাছে টানার পরিকল্পনা করছে। ভারত এখন স্থল ও নদী রুট দিয়ে এই অঞ্চলের নতুন নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে চাচ্ছে।
এ ধরনের একটি উদ্যোগ হিসেবে সম্প্রতি ১০০০ টন ভুটানি পাথর ট্রাকে করে ভুটান থেকে ধুবরিতে পাঠানো হয়। এই পাথর এরপর জাহাজে করে ব্রহ্মপুত্র নদী দিয়ে বাংলাদেশে রফতানি করা হয়।
এই উদ্যোগটি চীনের বিআরআইয়ের মতো তত সমৃদ্ধ ও জাঁকালো না হলেও এর তাৎপর্যও কম নয়। স্থল-নদী রুটটি ব্যবহারের ফলে ভুটান থেকে বাংলাদেশে পণ্য পাঠাতে ৮-১০ দিন সময় কমবে, পরিবহন ব্যয়ও হ্রাস পাবে ৩০ ভাগ।
ভুটানে সাহায্যের হাত সম্প্রসারণ করছে জাপানও। এর মধ্যে রয়েছে ভূমিধস ও পল্লী উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে দুর্যোগ ত্রাণ।
আরো প্রতীকী ব্যবস্থা হিসেবে জাপানের সম্রাটের ছোট ভাই সম্রাট নারুহিতো আগস্টে তার পরিবার নিয়ে ভুটান যাবেন বলে আশা করা হচ্ছে। জাপানি রাজপরিবার প্রায়ই ভুটান সফর করে। ১৯৯৭ সালে ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে নারুহিতো সফর করেছিলেন ভুটান।
ভুটান, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশকেন্দ্রিক মোদির প্রতিবেশী প্রথম নীতিটি জাপানের স্বার্থের সাথেও প্রাসঙ্গিক।
একইসাথে এই নীতি একে অপরের প্রতি এশিয়ার দুই জায়ন্ট যে পারস্পরিক সন্দেহ পোষণ করে, তা আরো গভীর করতে পারে।
অন্যদিকে ভুটান ও মালদ্বীপের মতো প্রত্যন্ত দেশগুলো আঞ্চলিক শক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে পড়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলতে পারে।
একদিকে ক্রমবর্ধমান শক্তি বৃদ্ধিকারী চীন ও অপরদিকে ভারত ও জাপানসহ শিথিলভাবে জোটবদ্ধ জোটের মধ্যকার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সৃষ্ট একটি নতুন স্নায়ুযুদ্ধের মতো অবস্থা বিরাজ করা বিশ্বের এই অংশের জন্য শুভ ইঙ্গিত হবে না।
ভুটানের রাজা জিগমে খেসার নামগিয়ালের সঙ্গে ভারতের প্রদানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি (ডানে), ছবি: ফেসবুক |
No comments