বিচ্ছিন্ন কাশ্মীরে কী ঘটছে? by জাহিদুর রহমান
ভারতীয়
সংবিধানে কাশ্মীরকে দেয়া বিশেষ মর্যাদা বাতিল করে দেয়া হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভারতীয় জনতা পার্টি নেতৃত্বাধীন সরকার সোমবার
এক ঘোষণায় এ মর্যাদা কেড়ে নেয়। ভারত সরকারের এ ঘোষণায় বিশ্বজুড়ে, বিশেষ
করে এশিয়ার রাজনৈতিক মহলে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। জম্মু ও কাশ্মীরকে
ভেঙে গঠন করা হয়েছে আলাদা দু’টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল বা ইউনিয়ন টেরিটোরি।
সরকারের এমন সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে বিরোধী দল, পাকিস্তান ও
মানবাধিকার সংগঠনগুলো। ভারত, পাকিস্তান ও চীনের মধ্যে বিভক্ত কাশ্মীরকে
ঘিরে ফের উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে। পাকিস্তানের সেনাপ্রধান বলেছেন,
কাশ্মীরের জন্য যেকোনো পদক্ষেপ গ্রহণে তৈরি পাক সেনাবাহিনী। এদিকে, ঘোষণার
দিন থেকেই বাইরের বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে কাশ্মীরের।
দ্বিতীয় দিনেও ফেরেনি কোনো ইন্টারনেট, মোবাইল সেবা।
গ্রেপ্তার করা হয়েছে রাজ্যের একাধিক শীর্ষ নেতাকে। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছিলেন, বিশেষ মর্যাদা বাতিলের ঘোষণার পরপরই সেখানে তীব্র বিক্ষোভ শুরু হবে। তবে বর্তমানে মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ অঙ্গরাজ্যটির অভ্যন্তরীণ অবস্থা কী সে বিষয়ে জানার কোনো উপায় নেই।
যেভাবে বিশেষ মর্যাদা হারালো কাশ্মীর: সোমবার পার্লামেন্টের এক অধিবেশনে ভারতীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং এক ঘোষণায় জানান, কাশ্মীরকে দেয়া বিশেষ মর্যাদা কেড়ে নেয়া হবে। ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ ধারার অধীনে কাশ্মীরকে বেশ খানিকটা স্বায়ত্তশাসনের অধিকার দেয়া হয়েছিল। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রণীত আইন না মেনে নিজস্ব সংবিধান মেনে চলার অধিকার ছিল কাশ্মীরের। তবে বিজেপি সরকারের সুপারিশে এক নির্দেশনামার মাধ্যমে সংবিধানের ওই ধারা বাতিল করে দেন দেশটির প্রেসিডেন্ট রাম নাথ কোভিন্দ। এতে বিরোধীরা প্রতিবাদ জানালেও তা অগ্রাহ্য করেছে মোদি সরকার। ৩৭০ ধারা বাতিল করায় ধারাটির অন্তর্গত ৩৫-এ ধারাও বাতিল হয়ে গেছে। এই ধারা অনুসারে, বিশেষ সুবিধা পেতেন কাশ্মীরিরা। স্থায়ী বাসিন্দা ছাড়া, বাইরের কেউ সেখানে চাকরির আবেদন করতে পারতেন না, জমিজমা কিনতে পারতেন না। স্থায়ী বাসিন্দা কারা হবেন তা ঠিক করার অধিকার ছিল কেবল রাজ্যসভার। কিন্তু এখন থেকে যেকোনো ভারতীয়ই সেখানে জমি কিনে বাস করতে পারবেন।
ঘোষণার পর সেখানে বিক্ষোভ হতে পারে এমন আশঙ্কায় আগ থেকেই প্রস্তুতি নিয়েছিল ভারত সরকার। ‘জঙ্গি হামলা হতে পারে’- এমনটা দাবি করে সেখানে মোতায়েন করা হয়েছে ৩৮ হাজারের বেশি সামরিক সেনা, বাতিল করে দেয়া হয়েছে অমরনাথ যাত্রা, পর্যটকদের চলে যেতে বলা হয়েছে রাজ্য ছেড়ে। কিন্তু বর্তমানে সেখানে কী হচ্ছে সে বিষয়ে নেই কোনো খবর।
ঘোষণার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন: ৩৭০ ধারা অনুসারে, কাশ্মীর সরকারের অনুমোদন ছাড়া ধারাটি বাতিলের অধিকার ছিল না ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের। কিন্তু গত এক বছর ধরে সেখানে কার্যত কোনো রাজ্য সরকার নেই। গত বছরের জুনে রাজ্যটির তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতির সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারালে সেখানে রাজ্যপালের শাসন চালু করে কেন্দ্রীয় সরকার। অর্থাৎ, বিজেপি সরকারের জন্য কেবল তাদের নিয়োগকৃত রাজ্যপালের অনুমতি নেয়াই যথেষ্ট ছিল। বিজেপি সরকারের দাবি, এটা তাদের অধিকারের মধ্যে পড়ে। তবে তাদের দাবি নিয়ে বিভক্ত আইন বিশেষজ্ঞদের মতামত। একজন আইন বিশেষজ্ঞ শুভাষ কেশ্যপ বলেছেন, সরকারের সিদ্ধান্ত সংবিধান মেনেই নেয়া হয়েছে। এতে ভুল নেই। কিন্তু অপর এক বিশেষজ্ঞ এজি নুরানি বলেন, এটা একটি অবৈধ সিদ্ধান্ত, জালিয়াতি করে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টে এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মামলা করা সম্ভব। ধারণা করা হচ্ছে, শিগগিরই সিদ্ধান্তটি নিয়ে আইনি লড়াই শুরু হবে।
নতুন ফিলিস্তিন হতে যাচ্ছে কাশ্মীর: অনেক সমালোচকের দাবি, কাশ্মীরের বিশেষ সুবিধা কেড়ে নিয়ে এশিয়ায় নতুন ফিলিস্তিনের সৃষ্টি করতে যাচ্ছে ভারত। ইসরাইল যেভাবে ফিলিস্তিনে জোরপূর্বকভাবে বসতি স্থাপন করছে, সেভাবে ভারতীয়রাও এখন থেকে কাশ্মীরে জোরপূর্বকভাবে বসতি স্থাপন করবে। সংবিধানের ৩৫-এ ধারা বিলুপ্ত করে এই সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে বিজেপি সরকার। এই ধারা অনুসারে, বাইরের কেউ কাশ্মীরে জমিজমা কিনতে পারতো না। বিজেপি সরকারের দাবি, এই ধারার কারণে রাজ্যটি পিছিয়ে পড়ছে। সেখানে উন্নয়ন হচ্ছে না। বিনিয়োগ করতে পারছে না বাইরের কেউ। তাই রাজ্যের উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের চর্চা করতেই ধারাটি বাতিল করা হয়েছে। তবে সমালোচকরা বলছেন, শাসক দল অনেকদিন ধরেই ৩৫ (এ) ধারাকে বৈষম্যমূলক আখ্যা দিয়ে আসছে। গত মাসে একজন জ্যেষ্ঠ বিজেপি নেতা ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে, ওই অঞ্চলে হিন্দু জনসংখ্যা বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে সরকার।
বহু আগ থেকেই ৩৭০ ও ৩৫ (এ) ধারা বাতিলের অঙ্গীকার ছিল বিজেপির। কাশ্মীরিদের আশঙ্কা, এর ফলে এই অঞ্চলের জনতাত্ত্বিক চিত্র একেবারেই পাল্টে যাবে। মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ থেকে সংখ্যালঘু হয়ে পড়বে। সরকার জানিয়েছে, রাজ্যটিকে মোট তিনভাবে ভাগ করা হবে, হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ জম্মু, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মীর ও বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ লাদাখ। এর মধ্যে জম্মু ও কাশ্মীর হবে একটি অঞ্চল ও লাদাখ হবে আলাদা একটি অঞ্চল।
বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন, সেনাদের নজরে বন্দি কাশ্মীর: বিশেষ মর্যাদা কেড়ে নেয়ার পর টানা দ্বিতীয় দিনও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রয়েছে কাশ্মীর। আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, রোববার থেকে বন্ধ রয়েছে টেলিফোন নেটওয়ার্ক, ইন্টারনেট সেবা, রাস্তায় টহল দিয়ে বেড়াচ্ছিল সেনারা। আগ থেকেই ব্যাপক বিক্ষোভের আশঙ্কা ছিল। তবে বর্তমান পরিস্থিতি সমপর্কে জানা যায়নি কোনো তথ্য। এর মধ্যে দুই সাবেক মুখ্যমন্ত্রী সহ স্থানীয় নেতাদের গৃহবন্দি ও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিবিসি’র শ্রীনগর প্রতিবেদক আমির পীরজাদা তার দিল্লির সহকর্মীদের সঙ্গে আলাপ করে জানান, কেউ জানে না কী হচ্ছে সেখানে। সামনে কী হবে তাও জানে না কেউ। এদিকে, ভারতের অন্যান্য অংশে বাসকারী কাশ্মীরিরা জানিয়েছেন, পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না তারা। এমন কী সেখানকার পুলিশ স্টেশনে ফোন করেও পাওয়া যাচ্ছে না কোনো তথ্য। কখন যোগাযোগ ফিরবে সে বিষয়েও কোনো ঘোষণা দেয়নি সরকার। বিবিসি’র সংবাদদাতা আরো জানান, আগ থেকে কিছু না জানিয়ে সেনা মোতায়েন, স্কুল-কলেজ বন্ধ করায় আতঙ্কিত ছিল স্থানীয়রা। সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে কয়েক মাসের খাবার মজুত করে রাখেন অনেকে। এদিকে, যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়া হলেও, পুলিশ কর্মকর্তাদের জন্য স্যাটেলাইট ফোন বরাদ্দ করা হয়।
বিভক্ত বিরোধী দল: সোমবার অমিত শাহ কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহারের ঘোষণা দিলে পার্লামেন্টে বিরোধী দলের মধ্যে হট্টগোল শুরু হয়। কিছুক্ষণের জন্য মুলতবি রাখা হয় অধিবেশন। তবে সোমবার রাজ্যসভায় কাশ্মীর রাজ্য পুনর্গঠন বিল নিয়ে ভোটাভুটিতে দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র। রাজ্যসভায় বিলের পক্ষে ভোট দিয়েছেন ১২৫ জন। বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছেন মাত্র ৬১ জন। ভোটাভুটিতে দেখা গেছে, বিলের পক্ষে এনডিএ’র দলগুলো বিলের পক্ষে সমর্থন দিয়েছে আম আদমি পার্টি, বিজু জনতা দল, বহুজন সমাজ পার্টির মতো বিজেপি বিরোধী দলগুলো। এ ছাড়াও সমর্থন জানিয়ে ভোট দিয়েছে ওয়াইএসআর কংগ্রেস, তেলেঙ্গানা রাষ্ট্র সমিতি ও এআইডিএমকে। অন্যদিকে বিপক্ষে ভোট দিয়েছে কংগ্রেস, ডিএমকে, সমাজবাদী পার্টি, সিপিআই, সিপিআইএম, মুসলিম লীগ, কেরালা কংগ্রেস ও এমডিএমকে। কাশ্মীরের দুই পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টির সদস্যকে সংবিধান ছেঁড়া এবং বিশৃঙ্খল আচরণের জন্য কক্ষ থেকে বের করে দেয়ায় তারা ভোট দিতে পারেন নি। ভোটাভুটির এই অবস্থা ছাড়াও এদিন ৩৭০ ধারার প্রশ্ন কংগ্রেসের মধ্যকার দ্বন্দ্বও প্রকাশ্যে এসেছে। জনার্ধন দ্বিবেদীর মতো প্রবীণ নেতা থেকে শুরু করে দীপেন্দ্র হুডার মতো কংগ্রেসের নবীন নেতারা সোস্যাল মিডিয়ায় ৩৭০ ধারা বাতিলের সমর্থন করেছেন। কংগ্রেসের প্রবীণ নেতা ভুবনেশ্বর কলিতা রাজ্যসভার সাংসদ পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছেন ৩৭০ ধারা নিয়ে দলের অবস্থান মানতে না পারায়।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া: কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা কেড়ে নেয়ার ঘোষণা চমকে দিয়েছে পুরো বিশ্বকেই। কাশ্মীরের অপর এক অংশের দাবিদার পাকিস্তান থেকেই এসেছে সবচেয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া। দেশটির বিরোধী নেতারা যৌথ অধিবেশনের আহ্বান জানিয়েছেন। যদিও মঙ্গলবার অধিবেশন শুরুর কিছুক্ষণের মধ্যেই তীব্র হট্টগোল শুরু হলে তা মুলতবি করা হয়। তবে পাকিস্তান পিপলস পার্টি, পিএমএল-এন সহ প্রায় সকল প্রধান বিরোধী দলই জানিয়েছে, কাশ্মীর ইস্যুতে তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়তে ইচ্ছুক। দেশটির সেনাপ্রধান জানিয়েছেন, কাশ্মীর ইস্যুতে যেকোনো মাত্রায় যেতে প্রস্তুত সেনাবাহিনী। ঘোষণার পরপরই ইসলামাবাদে নিয়োজিত ভারতীয় হাইকমিশনারকে তলব করে পাকিস্তান।
এদিকে, মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জানিয়েছে, এই ঘোষণায় কাশ্মীরে সহিংসতা বাড়তে পারে। সর্ব ভারতীয় অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রধান আকর পাটেল বলেন, গত কয়েক দিন ধরে কাশ্মীর হাজার হাজার সেনা মোতায়েন, টেলিফোন ও ইন্টারনেট সুবিধা বন্ধ, শান্তিপূর্ণ সমাবেশে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যক্ষ করছে। সর্বশেষ, এই ঘোষণা জম্মু কাশ্মীরের মানুষদের খাদের কিনারায় ঠেলে দিয়েছে।
জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্থনিও গুতেরাঁর এক মুখপাত্র জানিয়েছেন, আমরা ওই অঞ্চলের উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন। সব পক্ষের প্রতি সংযম সাধনের আহ্বান জানাই। জাতিসংঘ মহাসচিব কাশ্মীর সংকটে কোনো ভূমিকা রাখবেন কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা ক্রমবর্ধমান উত্তেজনায় অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। এ নিয়ে মহাসচিব হিসেবে তিনি মত দিয়েছেন এবং এখনো তার অবস্থান সেই একই।
আমরা ওই অঞ্চলের উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন। সব পক্ষের প্রতি সংযম সাধনের আহ্বান জানাই। জাতিসংঘ মহাসচিব কাশ্মীর সংকটে কোনো ভূমিকা রাখবেন কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা ক্রমবর্ধমান উত্তেজনায় অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। এ নিয়ে মহাসচিব হিসেবে তিনি মত দিয়েছেন এবং এখনো তার অবস্থান সেই একই।
পুরো জম্মু ও কাশ্মীর হলো একীভূত ভারতের অখণ্ড অংশ: এদিকে, কেবল নিজেদের অংশটুকু নিয়েই সন্তুষ্ট নয় বিজেপি সরকার। কাশ্মীরের বাকি অংশও নিজেদের দাবি করে সেগুলো একীভূত করার অঙ্গীকার করেছেন দলটির সভাপতি ও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। মঙ্গলবার তিনি পার্লামেন্টে বলেন, কাশ্মীর হলো ভারতের অখণ্ড অংশ। আমি নিরেটভাবে পরিষ্কার করতে চাই যে, প্রতিবার যখনই আমি জম্মু ও কাশ্মীর নিয়ে কথা বলেছি, তার মধ্যে ছিল পাকিস্তান দখলীকৃত কাশ্মীর (গিলগিট-বাল্টিস্তানসহ) এবং অক্ষয় চীন। এ নিয়ে কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়। পুরো জম্মু ও কাশ্মীর হলো একীভূত ভারতের অখণ্ড অংশ। এ সময় কংগ্রেস সদস্যরা তাকে লক্ষ্য করে হট্টগোল করতে থাকেন।
গ্রেপ্তার করা হয়েছে রাজ্যের একাধিক শীর্ষ নেতাকে। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছিলেন, বিশেষ মর্যাদা বাতিলের ঘোষণার পরপরই সেখানে তীব্র বিক্ষোভ শুরু হবে। তবে বর্তমানে মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ অঙ্গরাজ্যটির অভ্যন্তরীণ অবস্থা কী সে বিষয়ে জানার কোনো উপায় নেই।
যেভাবে বিশেষ মর্যাদা হারালো কাশ্মীর: সোমবার পার্লামেন্টের এক অধিবেশনে ভারতীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং এক ঘোষণায় জানান, কাশ্মীরকে দেয়া বিশেষ মর্যাদা কেড়ে নেয়া হবে। ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ ধারার অধীনে কাশ্মীরকে বেশ খানিকটা স্বায়ত্তশাসনের অধিকার দেয়া হয়েছিল। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রণীত আইন না মেনে নিজস্ব সংবিধান মেনে চলার অধিকার ছিল কাশ্মীরের। তবে বিজেপি সরকারের সুপারিশে এক নির্দেশনামার মাধ্যমে সংবিধানের ওই ধারা বাতিল করে দেন দেশটির প্রেসিডেন্ট রাম নাথ কোভিন্দ। এতে বিরোধীরা প্রতিবাদ জানালেও তা অগ্রাহ্য করেছে মোদি সরকার। ৩৭০ ধারা বাতিল করায় ধারাটির অন্তর্গত ৩৫-এ ধারাও বাতিল হয়ে গেছে। এই ধারা অনুসারে, বিশেষ সুবিধা পেতেন কাশ্মীরিরা। স্থায়ী বাসিন্দা ছাড়া, বাইরের কেউ সেখানে চাকরির আবেদন করতে পারতেন না, জমিজমা কিনতে পারতেন না। স্থায়ী বাসিন্দা কারা হবেন তা ঠিক করার অধিকার ছিল কেবল রাজ্যসভার। কিন্তু এখন থেকে যেকোনো ভারতীয়ই সেখানে জমি কিনে বাস করতে পারবেন।
ঘোষণার পর সেখানে বিক্ষোভ হতে পারে এমন আশঙ্কায় আগ থেকেই প্রস্তুতি নিয়েছিল ভারত সরকার। ‘জঙ্গি হামলা হতে পারে’- এমনটা দাবি করে সেখানে মোতায়েন করা হয়েছে ৩৮ হাজারের বেশি সামরিক সেনা, বাতিল করে দেয়া হয়েছে অমরনাথ যাত্রা, পর্যটকদের চলে যেতে বলা হয়েছে রাজ্য ছেড়ে। কিন্তু বর্তমানে সেখানে কী হচ্ছে সে বিষয়ে নেই কোনো খবর।
ঘোষণার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন: ৩৭০ ধারা অনুসারে, কাশ্মীর সরকারের অনুমোদন ছাড়া ধারাটি বাতিলের অধিকার ছিল না ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের। কিন্তু গত এক বছর ধরে সেখানে কার্যত কোনো রাজ্য সরকার নেই। গত বছরের জুনে রাজ্যটির তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতির সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারালে সেখানে রাজ্যপালের শাসন চালু করে কেন্দ্রীয় সরকার। অর্থাৎ, বিজেপি সরকারের জন্য কেবল তাদের নিয়োগকৃত রাজ্যপালের অনুমতি নেয়াই যথেষ্ট ছিল। বিজেপি সরকারের দাবি, এটা তাদের অধিকারের মধ্যে পড়ে। তবে তাদের দাবি নিয়ে বিভক্ত আইন বিশেষজ্ঞদের মতামত। একজন আইন বিশেষজ্ঞ শুভাষ কেশ্যপ বলেছেন, সরকারের সিদ্ধান্ত সংবিধান মেনেই নেয়া হয়েছে। এতে ভুল নেই। কিন্তু অপর এক বিশেষজ্ঞ এজি নুরানি বলেন, এটা একটি অবৈধ সিদ্ধান্ত, জালিয়াতি করে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টে এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মামলা করা সম্ভব। ধারণা করা হচ্ছে, শিগগিরই সিদ্ধান্তটি নিয়ে আইনি লড়াই শুরু হবে।
নতুন ফিলিস্তিন হতে যাচ্ছে কাশ্মীর: অনেক সমালোচকের দাবি, কাশ্মীরের বিশেষ সুবিধা কেড়ে নিয়ে এশিয়ায় নতুন ফিলিস্তিনের সৃষ্টি করতে যাচ্ছে ভারত। ইসরাইল যেভাবে ফিলিস্তিনে জোরপূর্বকভাবে বসতি স্থাপন করছে, সেভাবে ভারতীয়রাও এখন থেকে কাশ্মীরে জোরপূর্বকভাবে বসতি স্থাপন করবে। সংবিধানের ৩৫-এ ধারা বিলুপ্ত করে এই সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে বিজেপি সরকার। এই ধারা অনুসারে, বাইরের কেউ কাশ্মীরে জমিজমা কিনতে পারতো না। বিজেপি সরকারের দাবি, এই ধারার কারণে রাজ্যটি পিছিয়ে পড়ছে। সেখানে উন্নয়ন হচ্ছে না। বিনিয়োগ করতে পারছে না বাইরের কেউ। তাই রাজ্যের উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের চর্চা করতেই ধারাটি বাতিল করা হয়েছে। তবে সমালোচকরা বলছেন, শাসক দল অনেকদিন ধরেই ৩৫ (এ) ধারাকে বৈষম্যমূলক আখ্যা দিয়ে আসছে। গত মাসে একজন জ্যেষ্ঠ বিজেপি নেতা ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে, ওই অঞ্চলে হিন্দু জনসংখ্যা বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে সরকার।
বহু আগ থেকেই ৩৭০ ও ৩৫ (এ) ধারা বাতিলের অঙ্গীকার ছিল বিজেপির। কাশ্মীরিদের আশঙ্কা, এর ফলে এই অঞ্চলের জনতাত্ত্বিক চিত্র একেবারেই পাল্টে যাবে। মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ থেকে সংখ্যালঘু হয়ে পড়বে। সরকার জানিয়েছে, রাজ্যটিকে মোট তিনভাবে ভাগ করা হবে, হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ জম্মু, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মীর ও বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ লাদাখ। এর মধ্যে জম্মু ও কাশ্মীর হবে একটি অঞ্চল ও লাদাখ হবে আলাদা একটি অঞ্চল।
বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন, সেনাদের নজরে বন্দি কাশ্মীর: বিশেষ মর্যাদা কেড়ে নেয়ার পর টানা দ্বিতীয় দিনও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রয়েছে কাশ্মীর। আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, রোববার থেকে বন্ধ রয়েছে টেলিফোন নেটওয়ার্ক, ইন্টারনেট সেবা, রাস্তায় টহল দিয়ে বেড়াচ্ছিল সেনারা। আগ থেকেই ব্যাপক বিক্ষোভের আশঙ্কা ছিল। তবে বর্তমান পরিস্থিতি সমপর্কে জানা যায়নি কোনো তথ্য। এর মধ্যে দুই সাবেক মুখ্যমন্ত্রী সহ স্থানীয় নেতাদের গৃহবন্দি ও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিবিসি’র শ্রীনগর প্রতিবেদক আমির পীরজাদা তার দিল্লির সহকর্মীদের সঙ্গে আলাপ করে জানান, কেউ জানে না কী হচ্ছে সেখানে। সামনে কী হবে তাও জানে না কেউ। এদিকে, ভারতের অন্যান্য অংশে বাসকারী কাশ্মীরিরা জানিয়েছেন, পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না তারা। এমন কী সেখানকার পুলিশ স্টেশনে ফোন করেও পাওয়া যাচ্ছে না কোনো তথ্য। কখন যোগাযোগ ফিরবে সে বিষয়েও কোনো ঘোষণা দেয়নি সরকার। বিবিসি’র সংবাদদাতা আরো জানান, আগ থেকে কিছু না জানিয়ে সেনা মোতায়েন, স্কুল-কলেজ বন্ধ করায় আতঙ্কিত ছিল স্থানীয়রা। সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে কয়েক মাসের খাবার মজুত করে রাখেন অনেকে। এদিকে, যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়া হলেও, পুলিশ কর্মকর্তাদের জন্য স্যাটেলাইট ফোন বরাদ্দ করা হয়।
বিভক্ত বিরোধী দল: সোমবার অমিত শাহ কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহারের ঘোষণা দিলে পার্লামেন্টে বিরোধী দলের মধ্যে হট্টগোল শুরু হয়। কিছুক্ষণের জন্য মুলতবি রাখা হয় অধিবেশন। তবে সোমবার রাজ্যসভায় কাশ্মীর রাজ্য পুনর্গঠন বিল নিয়ে ভোটাভুটিতে দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র। রাজ্যসভায় বিলের পক্ষে ভোট দিয়েছেন ১২৫ জন। বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছেন মাত্র ৬১ জন। ভোটাভুটিতে দেখা গেছে, বিলের পক্ষে এনডিএ’র দলগুলো বিলের পক্ষে সমর্থন দিয়েছে আম আদমি পার্টি, বিজু জনতা দল, বহুজন সমাজ পার্টির মতো বিজেপি বিরোধী দলগুলো। এ ছাড়াও সমর্থন জানিয়ে ভোট দিয়েছে ওয়াইএসআর কংগ্রেস, তেলেঙ্গানা রাষ্ট্র সমিতি ও এআইডিএমকে। অন্যদিকে বিপক্ষে ভোট দিয়েছে কংগ্রেস, ডিএমকে, সমাজবাদী পার্টি, সিপিআই, সিপিআইএম, মুসলিম লীগ, কেরালা কংগ্রেস ও এমডিএমকে। কাশ্মীরের দুই পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টির সদস্যকে সংবিধান ছেঁড়া এবং বিশৃঙ্খল আচরণের জন্য কক্ষ থেকে বের করে দেয়ায় তারা ভোট দিতে পারেন নি। ভোটাভুটির এই অবস্থা ছাড়াও এদিন ৩৭০ ধারার প্রশ্ন কংগ্রেসের মধ্যকার দ্বন্দ্বও প্রকাশ্যে এসেছে। জনার্ধন দ্বিবেদীর মতো প্রবীণ নেতা থেকে শুরু করে দীপেন্দ্র হুডার মতো কংগ্রেসের নবীন নেতারা সোস্যাল মিডিয়ায় ৩৭০ ধারা বাতিলের সমর্থন করেছেন। কংগ্রেসের প্রবীণ নেতা ভুবনেশ্বর কলিতা রাজ্যসভার সাংসদ পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছেন ৩৭০ ধারা নিয়ে দলের অবস্থান মানতে না পারায়।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া: কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা কেড়ে নেয়ার ঘোষণা চমকে দিয়েছে পুরো বিশ্বকেই। কাশ্মীরের অপর এক অংশের দাবিদার পাকিস্তান থেকেই এসেছে সবচেয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া। দেশটির বিরোধী নেতারা যৌথ অধিবেশনের আহ্বান জানিয়েছেন। যদিও মঙ্গলবার অধিবেশন শুরুর কিছুক্ষণের মধ্যেই তীব্র হট্টগোল শুরু হলে তা মুলতবি করা হয়। তবে পাকিস্তান পিপলস পার্টি, পিএমএল-এন সহ প্রায় সকল প্রধান বিরোধী দলই জানিয়েছে, কাশ্মীর ইস্যুতে তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়তে ইচ্ছুক। দেশটির সেনাপ্রধান জানিয়েছেন, কাশ্মীর ইস্যুতে যেকোনো মাত্রায় যেতে প্রস্তুত সেনাবাহিনী। ঘোষণার পরপরই ইসলামাবাদে নিয়োজিত ভারতীয় হাইকমিশনারকে তলব করে পাকিস্তান।
এদিকে, মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জানিয়েছে, এই ঘোষণায় কাশ্মীরে সহিংসতা বাড়তে পারে। সর্ব ভারতীয় অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রধান আকর পাটেল বলেন, গত কয়েক দিন ধরে কাশ্মীর হাজার হাজার সেনা মোতায়েন, টেলিফোন ও ইন্টারনেট সুবিধা বন্ধ, শান্তিপূর্ণ সমাবেশে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যক্ষ করছে। সর্বশেষ, এই ঘোষণা জম্মু কাশ্মীরের মানুষদের খাদের কিনারায় ঠেলে দিয়েছে।
জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্থনিও গুতেরাঁর এক মুখপাত্র জানিয়েছেন, আমরা ওই অঞ্চলের উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন। সব পক্ষের প্রতি সংযম সাধনের আহ্বান জানাই। জাতিসংঘ মহাসচিব কাশ্মীর সংকটে কোনো ভূমিকা রাখবেন কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা ক্রমবর্ধমান উত্তেজনায় অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। এ নিয়ে মহাসচিব হিসেবে তিনি মত দিয়েছেন এবং এখনো তার অবস্থান সেই একই।
আমরা ওই অঞ্চলের উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন। সব পক্ষের প্রতি সংযম সাধনের আহ্বান জানাই। জাতিসংঘ মহাসচিব কাশ্মীর সংকটে কোনো ভূমিকা রাখবেন কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা ক্রমবর্ধমান উত্তেজনায় অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। এ নিয়ে মহাসচিব হিসেবে তিনি মত দিয়েছেন এবং এখনো তার অবস্থান সেই একই।
পুরো জম্মু ও কাশ্মীর হলো একীভূত ভারতের অখণ্ড অংশ: এদিকে, কেবল নিজেদের অংশটুকু নিয়েই সন্তুষ্ট নয় বিজেপি সরকার। কাশ্মীরের বাকি অংশও নিজেদের দাবি করে সেগুলো একীভূত করার অঙ্গীকার করেছেন দলটির সভাপতি ও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। মঙ্গলবার তিনি পার্লামেন্টে বলেন, কাশ্মীর হলো ভারতের অখণ্ড অংশ। আমি নিরেটভাবে পরিষ্কার করতে চাই যে, প্রতিবার যখনই আমি জম্মু ও কাশ্মীর নিয়ে কথা বলেছি, তার মধ্যে ছিল পাকিস্তান দখলীকৃত কাশ্মীর (গিলগিট-বাল্টিস্তানসহ) এবং অক্ষয় চীন। এ নিয়ে কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়। পুরো জম্মু ও কাশ্মীর হলো একীভূত ভারতের অখণ্ড অংশ। এ সময় কংগ্রেস সদস্যরা তাকে লক্ষ্য করে হট্টগোল করতে থাকেন।
No comments