প্রতিদিনই ডেঙ্গু আক্রান্তের রেকর্ড: এমপিরা নীরব by মসিউর রহমান খান
মশাবাহিত
রোগ ডেঙ্গু নিয়ে দেশজুড়ে আতঙ্ক ছড়ালেও এমপিদের তৎপরতা চোখে পড়ছে না। তিন
দিনের দলীয় কর্মসূচির বাইরে সরকারি দলের বেশির ভাগ এমপিই নীরব। সিটি
করপোরেশন এলাকার এমপিরা পার পেতে চাইছেন মেয়রদের ঘাড়ে দায় চাপিয়ে। অন্যান্য
আসনের এমপিরাও দায় চাপাচ্ছেন স্থানীয় সরকারের কাঁধে। তবে বিশ্নেষকরা
বলছেন, এ ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশন কিংবা স্থানীয় সরকারের ভূমিকা প্রধান হলেও
এমপিরা দায়মুক্ত থাকতে পারেন না। কারণ, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের সব
কাজেই এমপিদের ভূমিকা, এমনকি হস্তক্ষেপও থাকে।
সংসদে প্রতিনিধিত্বশীল রাজনৈতিক দলগুলোর অনেকেই বলছেন, পুরো দেশে ছড়িয়ে পড়া ডেঙ্গু জাতীয় দুর্যোগে রূপ নিয়েছে। বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড় বা ভূমিকম্প- কোনো দুর্যোগেই একই সঙ্গে দেশের এত বিস্তীর্ণ এলাকা আক্রান্ত হয়নি বা হয় না। তাদের আশঙ্কা, ঈদের ছুটিতে শহরের মানুষ গ্রামে গেলে ডেঙ্গু মফস্বলে আরও প্রকট আকার ধারণ করতে পারে।
বিশ্নেষকদের মতে, এ পরিস্থিতিতে শুধু স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠান সিটি করপোরেশন, পৌরসভা বা ইউনিয়ন পরিষদের দিকে তাকিয়ে থাকলে চলবে না। এমপিরা অনেক আগেই এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে পারতেন। সংসদের বিশেষ অধিবেশন আহ্বান করাও উচিত ছিল। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি জরুরি বৈঠক ডেকে স্থানীয় সরকারকে জবাবদিহি করতে পারত।
জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত আসনসহ মোট এমপি রয়েছেন ৩৫০ জন। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের দলীয় কর্মসূচির বাইরে সর্বোচ্চ ১৫-২০ এমপি নিজস্ব উদ্যোগে তাদের নির্বাচনী এলাকায় ডেঙ্গুবিরোধী কোনো না কোনো কার্যক্রমে অংশ নেন। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী গতকাল সোমবার চিফ হুইপ ও হুইপদের সঙ্গে নিয়ে জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায় ডেঙ্গুবিরোধী পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালান।
চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী দাবি করেছেন, দলের সব সংসদ সদস্যকে তিনি এরই মধ্যে মোবাইলে মেসেজ পাঠিয়েছেন, যাতে ঈদের ছুটিতে নিজ এলাকায় এমপিরা ডেঙ্গু, বন্যা ও নদীভাঙন বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেন। সংসদের অধিবেশন আহ্বান-সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৮ আগস্ট দেশে ফিরবেন। এর আগে এ বিষয়ে কিছুই বলা যাচ্ছে না।
বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ মসিউর রহমান রাঙ্গাঁ বলেন, সংসদের বিশেষ অধিবেশন ডাকা অনেক পরের বিষয়, সরকার তো এটিকে সংকট বলে স্বীকারই করছে না। তিনি বলেন, জুনে বাজেট পেশ করার সময় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার কারণে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল নিজে বাজেট পেশ করতে পারেননি। সে সময় ডেঙ্গুর আক্রমণ শুরু হলেও কোনো প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। উল্টো দক্ষিণ সিটির মেয়র বেফাঁস মন্তব্য করায় জনগণের ক্ষোভ চরম আকার ধারণ করেছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, এপ্রিলে ডেঙ্গুর প্রকোপ শুরু হয়। জুনে আক্রান্তের সংখ্যা এক হাজার ৮৬৩ জনে উন্নীত হয়। তখন সংসদের বাজেট অধিবেশন চলছিল। অধিবেশন শেষ হয় ১১ জুলাই। সে সময় সংসদে বিষয়টি আলোচনা হয়নি। এমনকি প্রতি মাসে নূ্যনতম একটি সভা আহ্বানের নিয়ম থাকলেও এর পর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠক হয়নি। আজ ৬ আগস্ট সভা হওয়ার কথা রয়েছে। অন্যদিকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত কমিটি গত রোববার বৈঠক করলেও এর কার্যসূচিতে ডেঙ্গুবিষয়ক কোনো আলোচনা ছিল না। তবে বিবিধ আলোচনা পর্বে এ বিষয়ে উত্তর সিটির প্রধান নির্বাহী জানিয়েছেন, তাদের ওষুধ আসতে আরও এক সপ্তাহ সময় লাগবে। অন্যদিকে দক্ষিণ সিটির কর্মকর্তারা ওষুধ কবে এসে পৌঁছাবে, তা সুনির্দিষ্টভাবে জানাতে পারেননি।
দেশের ১২টি সিটি করপোরেশন এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হাতেগোনা কয়েকজন সংসদ সদস্য ব্যক্তিগত উদ্যোগে ডেঙ্গু প্রতিরোধে জনগণকে সচেতন করতে কিছু কর্মসূচি পালন করলেও তা তেমন দৃশ্যমান ছিল না। ৩০ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের বৈঠকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযানে নামার নির্দেশ দেন। এর পর ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে দলীয় কর্মসূচিতে এমপিদের অংশ নিতে দেখা যায়। এর আগে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে নেওয়া কর্মসূচিতে অতিথি হিসেবে অংশ নিয়েই দায় এড়িয়েছেন এমপিরা।
ঢাকার বাইরে নড়াইল-২ আসনের এমপি এবং বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা তার ব্যক্তিগত অর্থায়নে ডেঙ্গু রোগ শনাক্তকরণের ছয়শ' এনএস-১ কিট তার নিজ জেলা নড়াইলে পাঠিয়েছেন। বাগেরহাট-২ আসনের এমপি শেখ তন্ময় তার নির্বাচনী এলাকার ডেঙ্গু রোগীদের খরচ বহনের ঘোষণা দিয়েছেন। ঢাকা-৯ আসনের এমপি সাবের হোসেন চৌধুরী ২৭ জুলাই ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, সচিব, প্রধান প্রকৌশলীসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। এ অনুষ্ঠানে কাউন্সিলররাও উপস্থিত ছিলেন। এলাকায় তিনি একটি হটলাইন নম্বরও চালু করেন।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মধ্যে চার এমপি ডা. আফছারুল আমীন, আবদুল লতিফ, মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল ও মইনউদ্দীন খান বাদল শুরু থেকেই সক্রিয় ছিলেন। তারা ব্যক্তিগত উদ্যোগে স্কুল-কলেজে লিফলেট বিতরণ, মসজিদ-মাদ্রাসার মাইক ব্যবহার করে প্রচার চালানোসহ বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছেন। তবে গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, রাজশাহী, সিলেট, বরিশালসহ অন্য সিটির এমপিদের পক্ষ থেকে কোনো কর্মসূচি ছিল না।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, জাতীয়ভাবে এত বড় একটা সংকটে এমপিরা দায় এড়াতে পারেন না। কারণ, তারা শুধু আইন প্রণয়নে নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখেন না। সব ধরনের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডেই তারা সম্পৃক্ত থাকেন। তিনি বলেন, জুন মাসের শুরু থেকেই ডেঙ্গুর প্রকোপ চলছে। তখন অধিবেশন চলমান ছিল। এর পর সংসদীয় কমিটিগুলোর জরুরি বৈঠকে বসার সুযোগ ছিল। সে ক্ষেত্রেও তাদের কোনো ভূমিকা দেখা যায়নি। এমনকি মাঠ পর্যায়েও এমপিদের ভূমিকা হয়ে উঠেছে প্রশ্নবিদ্ধ।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ আসনের এমপি হারুনুর রশীদ বলেন, বর্তমান সরকার যেমন অনির্বাচিত, তেমনি স্থানীয় সরকারের প্রতিটি স্তরে অনির্বাচিতরা বসে আছেন। তাই এমন পরিস্থিতিতেও তারা বিদেশে গেছেন। ডেঙ্গুর প্রকোপ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। তাই জাতীয় দুর্যোগ ঘোষণার কোনো বিকল্প নেই। তিনি অবিলম্বে সংসদের অধিবেশন ডেকে এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় সব দলকে নিয়ে আলোচনার আহ্বান জানান।
ঢাকা-৮ আসনের এমপি রাশেদ খান মেনন বলেন, ঈদের ছুটির পরপরই সংসদের বৈঠক বসবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সতর্কতার পরও সিটি করপোরেশন আগাম ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছে। ওষুধ কেনার জন্য ৫০ কোটি টাকা পানিতে- গণমাধ্যমে এমন খবর প্রকাশিত হচ্ছে। এটা সিটি করপোরেশনের পুরোপুরি দুর্নীতি ও অদক্ষতা। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, তার নির্বাচনী এলাকার স্কুল-কলেজে তিনি একাধিক ডেঙ্গু সচেতনতামূলক সভা করেছেন, তবে তা খুব বেশি প্রচার পায়নি।
ঢাকা-৬ আসনের এমপি ও জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, ঢাকার এমপিদের আরও বেশি দৃশ্যমান হওয়া উচিত। কিন্তু আমরা অসহায়। এমপিদের নিজস্ব লোকবল নেই। সিটি করপোরেশনের এক-চতুর্থাংশ কর্মচারী কাজ করে না। তাদের এত লোক, তারা কোথায়? তিনি বলেন, পরিস্থিতি মহামারি আকার ধারণ করেছে। এমপিরা রাস্তায় নেমে ফটোসেশন করে কী লাভ হবে?
রাজধানীর সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গুপ্রবণ এলাকা গুলশান, বনানী ও বারিধারা পড়েছে ঢাকা-১৭ ও ঢাকা-১১ আসনের মধ্যে। ঢাকা-১৭ আসনের এমপি আকবর হোসেন পাঠান (চিত্রনায়ক ফারুক) ও ঢাকা-১১ আসনের এমপি এ কে এম রহমত উল্লাহ। তারা কোনো কর্মসূচি নিয়েছেন কি-না, এলাকাবাসীর জানা নেই। উত্তর সিটি করপোরেশনের এই এলাকার সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর (ওয়ার্ড-৭) খালেদা বাহার বিউটি জানালেন, তার নির্বাচনী এলাকায় দু'জন এমপি রয়েছেন। এমপি চিত্রনায়ক ফারুক (ঢাকা-১৭) ও এ কে এম রহমত উল্লাহ (ঢাকা-১১) সিটি করপোরেশন আয়োজিত বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন। কিন্তু ব্যক্তিগত উদ্যোগে কোনো কর্মসূচি নিয়েছেন বলে জানা নেই তার।
সংরক্ষিত ওয়ার্ড-৮ পড়েছে ঢাকা-১১ ও ঢাকা-১২ আসনের মধ্যে। ঢাকা-১২ আসনের এমপি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। এ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আমেনা বেগম জানান, তার এলাকায় প্রতিদিনই সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। এগুলোর কোনো কোনোটিতে এমপিরাও এসেছেন। তবে এমপিদের পক্ষ থেকে আয়োজিত কোনো কর্মসূচির কথা তিনি জানেন না।
এ বিষয়ে ঢাকা-১১ আসনের এমপি ও মহানগর উত্তর শাখা আওয়ামী লীগ সভাপতি এ কে এম রহমত উল্লাহ বলেন, বাড্ডা, ভাটারা ও রামপুরা নিয়ে তার নির্বাচনী এলাকা। এখানে মাত্র চারজন ডেঙ্গু রোগী রয়েছেন। জনগণকে সচেতন করতে নিয়মিত তার নির্বাচনী এলাকায় বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি চলছে। এর মধ্যে সিটি করপোরেশন ও আওয়ামী লীগদলীয় কর্মসূচির বাইরে তিনি নিজেও তিনটি কর্মসূচি পালন করেছেন। এসব কর্মসূচি কী এবং তা কখন, কোথায় হয়েছে- জানতে চাইলে তিনি সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারেননি।
উত্তর সিটির ১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আফছার উদ্দিন খান জানান, তার এলাকার এমপি ঢাকা-১৮ আসনের সাহারা খাতুন। নেতাকর্মীদের মধ্যে সমন্বয় ঘটিয়ে আফছার উদ্দিন সিটি করপোরেশন ও দলীয় কর্মসূচি পালন করে থাকেন। তবে এমপির উদ্যোগে কোনো কর্মসূচির কথা তার জানা নেই। এ নিয়ে তিনি এমপির সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।
উত্তর সিটির ২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. সাজ্জাদ হোসেন জানান, তাদের এমপি ঢাকা-১৬ আসনের ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহর কোনো কর্মসূচি আছে কি-না, সেটা তিনি জানেন না। তবে দলীয় কর্মসূচিতে এমপিকে দেখা গেছে বলে তিনি জানান।
উত্তর সিটির ৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. মোবাশ্বের চৌধুরী জানান, মধ্যবিত্ত অধ্যুষিত মিরপুর এলাকায় ডেঙ্গুর আতঙ্ক কিছুটা কম। তিনি জানান, মিরপুরের ওয়ার্ডগুলোর প্রায় ৮০ ভাগই স্যুয়ারেজ পাইপলাইনে প্রবাহিত। ড্রেনের লাইন খুবই কম এলাকায়। তাই মশার বিস্তারও বেশি নয়। তাদের এমপি ঢাকা-১৪ আসনের আসলামুল হক আসলামের নিজস্ব কোনো কর্মসূচির কথা তার জানা নেই।
তবে আসলামুল হক জানিয়েছেন, এ বিষয়ে তিনি সক্রিয় রয়েছেন। ফেসবুকে 'মুক্তির গান' নামে একটি পেজ রয়েছে। সেখানে তার ডেঙ্গুবিরোধী কার্যক্রমের বিবরণ পাওয়া যাবে। এ ছাড়া ৭ আগস্ট তিনি মাজার রোডে র্যালির কর্মসূচি দিয়েছেন। এদিকে 'মুক্তির গান' পেজে গিয়ে দেখা গেছে, সেখানে 'ডেঙ্গু হলে কী করতে হবে', 'ডেঙ্গুর চারশত বছরের ইতিহাস' এমন সব পোস্ট রয়েছে। কিন্তু নিজের নির্বাচনী এলাকায় তিনি কী ধরনের তৎপরতা চালিয়েছেন, তেমন কোনো তথ্য সেখানে নেই।
সংসদে প্রতিনিধিত্বশীল রাজনৈতিক দলগুলোর অনেকেই বলছেন, পুরো দেশে ছড়িয়ে পড়া ডেঙ্গু জাতীয় দুর্যোগে রূপ নিয়েছে। বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড় বা ভূমিকম্প- কোনো দুর্যোগেই একই সঙ্গে দেশের এত বিস্তীর্ণ এলাকা আক্রান্ত হয়নি বা হয় না। তাদের আশঙ্কা, ঈদের ছুটিতে শহরের মানুষ গ্রামে গেলে ডেঙ্গু মফস্বলে আরও প্রকট আকার ধারণ করতে পারে।
বিশ্নেষকদের মতে, এ পরিস্থিতিতে শুধু স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠান সিটি করপোরেশন, পৌরসভা বা ইউনিয়ন পরিষদের দিকে তাকিয়ে থাকলে চলবে না। এমপিরা অনেক আগেই এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে পারতেন। সংসদের বিশেষ অধিবেশন আহ্বান করাও উচিত ছিল। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি জরুরি বৈঠক ডেকে স্থানীয় সরকারকে জবাবদিহি করতে পারত।
জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত আসনসহ মোট এমপি রয়েছেন ৩৫০ জন। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের দলীয় কর্মসূচির বাইরে সর্বোচ্চ ১৫-২০ এমপি নিজস্ব উদ্যোগে তাদের নির্বাচনী এলাকায় ডেঙ্গুবিরোধী কোনো না কোনো কার্যক্রমে অংশ নেন। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী গতকাল সোমবার চিফ হুইপ ও হুইপদের সঙ্গে নিয়ে জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায় ডেঙ্গুবিরোধী পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালান।
চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী দাবি করেছেন, দলের সব সংসদ সদস্যকে তিনি এরই মধ্যে মোবাইলে মেসেজ পাঠিয়েছেন, যাতে ঈদের ছুটিতে নিজ এলাকায় এমপিরা ডেঙ্গু, বন্যা ও নদীভাঙন বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেন। সংসদের অধিবেশন আহ্বান-সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৮ আগস্ট দেশে ফিরবেন। এর আগে এ বিষয়ে কিছুই বলা যাচ্ছে না।
বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ মসিউর রহমান রাঙ্গাঁ বলেন, সংসদের বিশেষ অধিবেশন ডাকা অনেক পরের বিষয়, সরকার তো এটিকে সংকট বলে স্বীকারই করছে না। তিনি বলেন, জুনে বাজেট পেশ করার সময় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার কারণে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল নিজে বাজেট পেশ করতে পারেননি। সে সময় ডেঙ্গুর আক্রমণ শুরু হলেও কোনো প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। উল্টো দক্ষিণ সিটির মেয়র বেফাঁস মন্তব্য করায় জনগণের ক্ষোভ চরম আকার ধারণ করেছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, এপ্রিলে ডেঙ্গুর প্রকোপ শুরু হয়। জুনে আক্রান্তের সংখ্যা এক হাজার ৮৬৩ জনে উন্নীত হয়। তখন সংসদের বাজেট অধিবেশন চলছিল। অধিবেশন শেষ হয় ১১ জুলাই। সে সময় সংসদে বিষয়টি আলোচনা হয়নি। এমনকি প্রতি মাসে নূ্যনতম একটি সভা আহ্বানের নিয়ম থাকলেও এর পর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠক হয়নি। আজ ৬ আগস্ট সভা হওয়ার কথা রয়েছে। অন্যদিকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত কমিটি গত রোববার বৈঠক করলেও এর কার্যসূচিতে ডেঙ্গুবিষয়ক কোনো আলোচনা ছিল না। তবে বিবিধ আলোচনা পর্বে এ বিষয়ে উত্তর সিটির প্রধান নির্বাহী জানিয়েছেন, তাদের ওষুধ আসতে আরও এক সপ্তাহ সময় লাগবে। অন্যদিকে দক্ষিণ সিটির কর্মকর্তারা ওষুধ কবে এসে পৌঁছাবে, তা সুনির্দিষ্টভাবে জানাতে পারেননি।
দেশের ১২টি সিটি করপোরেশন এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হাতেগোনা কয়েকজন সংসদ সদস্য ব্যক্তিগত উদ্যোগে ডেঙ্গু প্রতিরোধে জনগণকে সচেতন করতে কিছু কর্মসূচি পালন করলেও তা তেমন দৃশ্যমান ছিল না। ৩০ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের বৈঠকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযানে নামার নির্দেশ দেন। এর পর ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে দলীয় কর্মসূচিতে এমপিদের অংশ নিতে দেখা যায়। এর আগে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে নেওয়া কর্মসূচিতে অতিথি হিসেবে অংশ নিয়েই দায় এড়িয়েছেন এমপিরা।
ঢাকার বাইরে নড়াইল-২ আসনের এমপি এবং বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা তার ব্যক্তিগত অর্থায়নে ডেঙ্গু রোগ শনাক্তকরণের ছয়শ' এনএস-১ কিট তার নিজ জেলা নড়াইলে পাঠিয়েছেন। বাগেরহাট-২ আসনের এমপি শেখ তন্ময় তার নির্বাচনী এলাকার ডেঙ্গু রোগীদের খরচ বহনের ঘোষণা দিয়েছেন। ঢাকা-৯ আসনের এমপি সাবের হোসেন চৌধুরী ২৭ জুলাই ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, সচিব, প্রধান প্রকৌশলীসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। এ অনুষ্ঠানে কাউন্সিলররাও উপস্থিত ছিলেন। এলাকায় তিনি একটি হটলাইন নম্বরও চালু করেন।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মধ্যে চার এমপি ডা. আফছারুল আমীন, আবদুল লতিফ, মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল ও মইনউদ্দীন খান বাদল শুরু থেকেই সক্রিয় ছিলেন। তারা ব্যক্তিগত উদ্যোগে স্কুল-কলেজে লিফলেট বিতরণ, মসজিদ-মাদ্রাসার মাইক ব্যবহার করে প্রচার চালানোসহ বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছেন। তবে গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, রাজশাহী, সিলেট, বরিশালসহ অন্য সিটির এমপিদের পক্ষ থেকে কোনো কর্মসূচি ছিল না।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, জাতীয়ভাবে এত বড় একটা সংকটে এমপিরা দায় এড়াতে পারেন না। কারণ, তারা শুধু আইন প্রণয়নে নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখেন না। সব ধরনের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডেই তারা সম্পৃক্ত থাকেন। তিনি বলেন, জুন মাসের শুরু থেকেই ডেঙ্গুর প্রকোপ চলছে। তখন অধিবেশন চলমান ছিল। এর পর সংসদীয় কমিটিগুলোর জরুরি বৈঠকে বসার সুযোগ ছিল। সে ক্ষেত্রেও তাদের কোনো ভূমিকা দেখা যায়নি। এমনকি মাঠ পর্যায়েও এমপিদের ভূমিকা হয়ে উঠেছে প্রশ্নবিদ্ধ।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ আসনের এমপি হারুনুর রশীদ বলেন, বর্তমান সরকার যেমন অনির্বাচিত, তেমনি স্থানীয় সরকারের প্রতিটি স্তরে অনির্বাচিতরা বসে আছেন। তাই এমন পরিস্থিতিতেও তারা বিদেশে গেছেন। ডেঙ্গুর প্রকোপ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। তাই জাতীয় দুর্যোগ ঘোষণার কোনো বিকল্প নেই। তিনি অবিলম্বে সংসদের অধিবেশন ডেকে এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় সব দলকে নিয়ে আলোচনার আহ্বান জানান।
ঢাকা-৮ আসনের এমপি রাশেদ খান মেনন বলেন, ঈদের ছুটির পরপরই সংসদের বৈঠক বসবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সতর্কতার পরও সিটি করপোরেশন আগাম ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছে। ওষুধ কেনার জন্য ৫০ কোটি টাকা পানিতে- গণমাধ্যমে এমন খবর প্রকাশিত হচ্ছে। এটা সিটি করপোরেশনের পুরোপুরি দুর্নীতি ও অদক্ষতা। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, তার নির্বাচনী এলাকার স্কুল-কলেজে তিনি একাধিক ডেঙ্গু সচেতনতামূলক সভা করেছেন, তবে তা খুব বেশি প্রচার পায়নি।
ঢাকা-৬ আসনের এমপি ও জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, ঢাকার এমপিদের আরও বেশি দৃশ্যমান হওয়া উচিত। কিন্তু আমরা অসহায়। এমপিদের নিজস্ব লোকবল নেই। সিটি করপোরেশনের এক-চতুর্থাংশ কর্মচারী কাজ করে না। তাদের এত লোক, তারা কোথায়? তিনি বলেন, পরিস্থিতি মহামারি আকার ধারণ করেছে। এমপিরা রাস্তায় নেমে ফটোসেশন করে কী লাভ হবে?
রাজধানীর সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গুপ্রবণ এলাকা গুলশান, বনানী ও বারিধারা পড়েছে ঢাকা-১৭ ও ঢাকা-১১ আসনের মধ্যে। ঢাকা-১৭ আসনের এমপি আকবর হোসেন পাঠান (চিত্রনায়ক ফারুক) ও ঢাকা-১১ আসনের এমপি এ কে এম রহমত উল্লাহ। তারা কোনো কর্মসূচি নিয়েছেন কি-না, এলাকাবাসীর জানা নেই। উত্তর সিটি করপোরেশনের এই এলাকার সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর (ওয়ার্ড-৭) খালেদা বাহার বিউটি জানালেন, তার নির্বাচনী এলাকায় দু'জন এমপি রয়েছেন। এমপি চিত্রনায়ক ফারুক (ঢাকা-১৭) ও এ কে এম রহমত উল্লাহ (ঢাকা-১১) সিটি করপোরেশন আয়োজিত বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন। কিন্তু ব্যক্তিগত উদ্যোগে কোনো কর্মসূচি নিয়েছেন বলে জানা নেই তার।
সংরক্ষিত ওয়ার্ড-৮ পড়েছে ঢাকা-১১ ও ঢাকা-১২ আসনের মধ্যে। ঢাকা-১২ আসনের এমপি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। এ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আমেনা বেগম জানান, তার এলাকায় প্রতিদিনই সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। এগুলোর কোনো কোনোটিতে এমপিরাও এসেছেন। তবে এমপিদের পক্ষ থেকে আয়োজিত কোনো কর্মসূচির কথা তিনি জানেন না।
এ বিষয়ে ঢাকা-১১ আসনের এমপি ও মহানগর উত্তর শাখা আওয়ামী লীগ সভাপতি এ কে এম রহমত উল্লাহ বলেন, বাড্ডা, ভাটারা ও রামপুরা নিয়ে তার নির্বাচনী এলাকা। এখানে মাত্র চারজন ডেঙ্গু রোগী রয়েছেন। জনগণকে সচেতন করতে নিয়মিত তার নির্বাচনী এলাকায় বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি চলছে। এর মধ্যে সিটি করপোরেশন ও আওয়ামী লীগদলীয় কর্মসূচির বাইরে তিনি নিজেও তিনটি কর্মসূচি পালন করেছেন। এসব কর্মসূচি কী এবং তা কখন, কোথায় হয়েছে- জানতে চাইলে তিনি সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারেননি।
উত্তর সিটির ১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আফছার উদ্দিন খান জানান, তার এলাকার এমপি ঢাকা-১৮ আসনের সাহারা খাতুন। নেতাকর্মীদের মধ্যে সমন্বয় ঘটিয়ে আফছার উদ্দিন সিটি করপোরেশন ও দলীয় কর্মসূচি পালন করে থাকেন। তবে এমপির উদ্যোগে কোনো কর্মসূচির কথা তার জানা নেই। এ নিয়ে তিনি এমপির সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।
উত্তর সিটির ২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. সাজ্জাদ হোসেন জানান, তাদের এমপি ঢাকা-১৬ আসনের ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহর কোনো কর্মসূচি আছে কি-না, সেটা তিনি জানেন না। তবে দলীয় কর্মসূচিতে এমপিকে দেখা গেছে বলে তিনি জানান।
উত্তর সিটির ৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. মোবাশ্বের চৌধুরী জানান, মধ্যবিত্ত অধ্যুষিত মিরপুর এলাকায় ডেঙ্গুর আতঙ্ক কিছুটা কম। তিনি জানান, মিরপুরের ওয়ার্ডগুলোর প্রায় ৮০ ভাগই স্যুয়ারেজ পাইপলাইনে প্রবাহিত। ড্রেনের লাইন খুবই কম এলাকায়। তাই মশার বিস্তারও বেশি নয়। তাদের এমপি ঢাকা-১৪ আসনের আসলামুল হক আসলামের নিজস্ব কোনো কর্মসূচির কথা তার জানা নেই।
তবে আসলামুল হক জানিয়েছেন, এ বিষয়ে তিনি সক্রিয় রয়েছেন। ফেসবুকে 'মুক্তির গান' নামে একটি পেজ রয়েছে। সেখানে তার ডেঙ্গুবিরোধী কার্যক্রমের বিবরণ পাওয়া যাবে। এ ছাড়া ৭ আগস্ট তিনি মাজার রোডে র্যালির কর্মসূচি দিয়েছেন। এদিকে 'মুক্তির গান' পেজে গিয়ে দেখা গেছে, সেখানে 'ডেঙ্গু হলে কী করতে হবে', 'ডেঙ্গুর চারশত বছরের ইতিহাস' এমন সব পোস্ট রয়েছে। কিন্তু নিজের নির্বাচনী এলাকায় তিনি কী ধরনের তৎপরতা চালিয়েছেন, তেমন কোনো তথ্য সেখানে নেই।
মিরপুরে ডা. এম আর খান শিশু হাসপাতালে চলছে ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা। সোমবারের ছবি : মাহবুব হোসেন নবীন |
No comments