সরিষা ফুলের মধু সংগ্রহে ব্যস্ত মৌচাষীরা
সরিষা
ক্ষেতের পাশে মৌবাক্স স্থাপন করে কৃত্রিম পদ্ধতিতে ভ্রাম্যমাণ মধু সংগ্রহ
হচ্ছে। এ কাজ ব্যস্ত সময় পার করেছেন নওগাঁর মান্দা উপজেলার বেকার শিক্ষিত
যুবকরা। সচেতনতা বৃদ্ধি, উপযুক্ত প্রশিক্ষণ এবং ঋণের সুবিধা দিলে আগামীতে
বাণিজ্যিকভাবে মধু সংগ্রহ সম্ভব বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। কৃষি সম্প্রসারণ
অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, এ বছর জেলায় ২৭ হাজার হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ
করা হয়েছে। মান্দা ও সাপাহার উপজেলায় প্রায় ২ হাজার ২০০টি মৌবাক্স স্থাপন
করা হয়েছে। গত বছর জেলায় ২৩ হাজার কেজি মধু আহরণ করা হয়েছিল। চলতি মৌসুমে
এখন পর্যন্ত প্রায় ২ হাজার কেজি মধু আহরণ করা হয়েছে। মান্দা উপজেলার ভারশো,
বাঁকাপুর, কৈইকুড়িসহ বেশ কয়েকটি গ্রামের ফসলের মাঠে সরিষা ফুল থেকে
কৃত্রিম পদ্ধতিতে মধু সংগ্রহ করছেন মৌচাষীরা। তবে স্থানীয়ভাবে মধু সংগ্রহ
না হলেও রাজশাহী জেলার মোহনপুর উপজেলার দর্শনপাড়া থেকে এসে মধু সংগ্রহ
করছেন দুই মৌচাষী। সরিষা ক্ষেত এলাকায় অভিনব পন্থায় ইউরোপিয়ান মেলিফেরা
জাতের মৌমাছি দিয়ে মধু সংগ্রহে ব্যস্ত দেখা যায় তাদের। ক্ষেতের পাশে ৬০টি
মধুবাক্স স্থাপন করা হয়েছে। প্রতিটি বক্সে ৮টি করে ফ্রেম সাজানো আছে।
সপ্তাহ পর পর ফ্রেম থেকে সংগ্রহ করা হয় মধু। গত ২০ দিনে প্রায় ১০ মণ মধু
সংগ্রহ হয়েছে। সরিষা ক্ষেতে মৌমাছি বসায় ফসলের ক্ষতি হচ্ছে এমন ভ্রান্ত
ধারণা আছে কৃষকদের মাঝে। ফলে অনেক স্থানে মৌচাষীদের বসতে দেয়া হয়নি। এছাড়া
সরিষা ক্ষেতে কীটনাশক স্প্রে করা হয়। ফুলে মৌমাছি বসায় মৌমাছি মারা যাওয়ার
ঘটনা ঘটে। উপজেলার দোডাঙ্গী গ্রামের কৃষক আলমগীর হোসেন বলেন, এ বছর তিন
বিঘা জমিতে সরিষার আবাদ করেছেন। বিগত বছরগুলোতে সরিষা ক্ষেতে কীটনাশক
স্প্রে করতে হতো। গত বছর থেকে আমাদের মাঠে মৌচাষীরা ফসলের ক্ষেতের পাশে
মৌবাক্স স্থাপন করে মধু সংগ্রহ শুরু করে। ক্ষেতে মৌমাছির বিচরণ হওয়ায়
পরাগায়ন হয়। কীটনাশক স্প্রে করতে হয়নি। রোগবালাই তেমন নেই। ফলে সরিষার
আবাদও ভালো হয়েছিল। এ বছর ফলন ভালো হবে বলে আশা করছেন। গত এক মাস আগে
উপজেলার কৈইকুড়ি গ্রামের মাঠে মৌবাক্স স্থাপন করে মধু সংগ্রহ করছেন মৌচাষী
আরিফ হাসান। তিনি বলেন, রাজশাহী নিউ ডিগ্রি কলেজে অনার্স শেষ বর্ষে পড়াশোনা
করছেন। ২০১৩ সালে মৌচাষের ওপর বিসিক থেকে এক মাসের প্রশিক্ষণ নেন।
এরপর
৭০০ টাকা করে ৩৫টি ফ্রেম কিনে আনুষঙ্গিক প্রায় ৩৫ হাজার টাকা খরচ করে মৌচাষ
শুরু করেন। খামারের নাম দিয়েছেন ‘বরেন্দ্র মৌখামার’। ২০১৬ সালে কয়েকটি
জেলায় প্রায় ৫২ মণ মধু সংগ্রহ করে প্রায় ৪ লাখ টাকার মতো বিক্রি করেছিলেন।
আর খরচ হয়েছিল প্রায় ৮০-৯০ হাজার টাকা। এছাড়া মৌমাছি বিক্রি করেছিলেন ৭০-৮০
হাজার টাকা। এ বছর প্রায় ৫ লাখ টাকার মতো মধু বিক্রি করবেন বলে জানান
তিনি। মৌচাষী রুস্তম আলী বলেন, রাজশাহী, দিনাজপুর, পাবনা, নাটোর ও নওগাঁ
জেলায় প্রায় ৭ মাস মধু সংগ্রহ করেন। বাকি সময় মৌমাছিকে রয়েল জেলি খাওয়াইয়ে
পুষতে হয়। নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত সরিষা ফুল থেকে মধু সংগ্রহ
হয়। মূলত সরিষা, কালাই জিরা ও লিচু ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করেন। সরিষা ও
লিচুর মধু পাইকারি ২৫০ টাকা ও খুরচা ৩০০ টাকা কেজি এবং কালাই জিরা মধু
পাইকারি ৪০০ টাকা ও খুরচা ৫০০ টাকা কেজিতে বিক্রি করেন। বেঙ্গল কোম্পানিসহ
বিভিন্ন প্রসাধনী তৈরি কোম্পানির কাছে পাইকারি করেন। আমাদের মতো ক্ষুদ্র
যারা খামারি আছেন তাদের উন্নত প্রশিক্ষণ এবং স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করা
হলে আগামী বাণিজ্যিকভাবে মধু সংগ্রহ সম্ভব বলে মনে করেন তিনি। নওগাঁ কৃষি
সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মনোজিত কুমার মল্লিক বলেন, কৃষকদের মধ্যে
একটি ভুল ধারণা আছে। সেটা হচ্ছে মৌমাছি ফুলে বসলে হয়তো ফসলের ক্ষতি হয়।
মৌচাষীদের কৃষকরা ক্ষেতের পাশে মৌবাক্স স্থাপনে নিষেধ করেন। কিন্তু বাস্তবে
তা নয়। মৌমাছি ফুল থেকে রেণু সংগ্রহ করে। এতে ফুলের পরাগায়ন হয়। ফসলের
জন্য এটি খুবই উপকারী এবং ফলন বৃদ্ধি করে। আগামীতে নওগাঁ জেলাকে মধু
উৎপাদনকারী জেলা হিসেবে পরিচিত পাবে।
No comments