শিক্ষকদের কাজ শিক্ষকদের করতে দিন
দার্শনিক
প্লেটো গিয়েছিলেন তাঁর ওস্তাদ সক্রেটিসের কাছে। জিজ্ঞাস্য হলো—একটি দেশে
নানান পেশা ও নানান ধরনের লোক থাকে। সবার কাজ আলাদা। তাহলে দেশের কাজ কেমনে
হবে? উত্তরে সক্রেটিস বলেছিলেন, যার যা কাজ, সে যদি সেটিই ঠিকমতো করে,
তাহলেই দেশের কাজ হয়ে যায়। সক্রেটিসের এই কথাটা আমরা সারা দেশে গণিত উৎসবে
বলতে থাকি। সেই সঙ্গে বলি নিজের কাজটা ঠিকমতো করা একটা ইবাদতও বটে। আমাদের
ডাচ্-বাংলা ব্যাংক-প্রথম আলো গণিত উৎসব ২০১৭ শুরু হয়েছে ২১ ডিসেম্বর থেকে।
এই সময়টাতে গণিতের বার্তা নিয়ে শহর থেকে শহরে ঘুরে বেড়ানোই আমার কাজ।
এবারও তা-ই করছি। ঘুরতে ঘুরতে বগুড়া জিলা স্কুলে গিয়ে দেখি রাতের বেলায়
শিক্ষকেরা দরজা বন্ধ করে খাতা দেখছেন। স্কুলে ভর্তি পরীক্ষার খাতা। আর সেটা
তত্ত্বাবধান করছেন জেলা প্রশাসনের লোকজন। পঞ্চগড়ে গিয়ে শুনি, পরদিন সেখানে
ও ঠাকুরগাঁও জেলার সরকারি স্কুলের ভর্তি পরীক্ষা। শিক্ষকেরা বললেন, ভর্তি
পরীক্ষার প্রশ্ন করেন জেলা প্রশাসনের লোকজনই। শিক্ষকেরা নন! আমার চমকানো
দেখে তাঁরা জানালেন, এই নিয়ম নাকি বেশ কয়েক বছর ধরেই চলছে। জেলা শহরগুলোতে
সরকারি স্কুলে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন করার যোগ্যতা আমাদের শিক্ষকদের নেই।
এই প্রশ্ন করেন প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা! স্কুলের শিক্ষকেরা কেবল খাতা
দেখেন। তা-ও আবার কঠিন পাহারার মধ্যে। যত রাতই হোক, পরীক্ষার দিনই নাকি
খাতা দেখা শেষ করতে হয়। আর ফলাফল প্রকাশ করে ওই জেলা প্রশাসন! জেলা
প্রশাসনকে কেন স্কুলের ভর্তি পরীক্ষার দায়িত্ব নিতে হলো, সেটা অবশ্য কেউ
আমাকে বলতে পারলেন না। এক শিক্ষক শুধু বললেন, সম্ভবত স্কুলে শিক্ষকেরা
ভর্তি পরীক্ষাটা ঠিকমতো নিতে পারেন না বলে প্রশাসনের হাত লম্বা করতে হয়েছে!
এক শিক্ষকের কাছে জানতে চাইলাম, কর্তাব্যক্তিরা কি স্কুলে এসে বাচ্চাদের
পড়ান? উনি হেসে বললেন, ‘তা কেন হবে। স্কুলে পড়ানোর কাজটা আমরাই করি।’ তবে
শিক্ষকেরা ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন করতে পারেন না। এবার ঘটেছে একটি চমৎকার
ঘটনা।
খুলনা শহরের দুটি স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির ভর্তি পরীক্ষাসংক্রান্ত একটি
খবর পড়লাম পত্রিকায়। ‘খুলনা জিলা স্কুল ও সরকারি ইকবালনগর মাধ্যমিক বালিকা
বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণির ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে নজিরবিহীন ঘটনা ঘটেছে। ঘোষিত
ফলাফল স্থগিত করে পুনরায় গত শনিবার ভর্তি পরীক্ষার ফল ঘোষণা করার পর
বিক্ষোভে ফেটে পড়ে বাদ পড়া শিক্ষার্থীসহ অভিভাবকেরা। এ সময় বাদ পড়া কোমলমতি
শিশুশিক্ষার্থীরা খুলনা প্রেসক্লাবে এসে কান্নায় ভেঙে পড়ে। এদিকে গতকাল
শনিবার বিকেলে খুলনা প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে বাদ পড়া শিক্ষার্থীদের
অভিভাবকেরা তৃতীয় শ্রেণির পরীক্ষার ফলাফলে অনিয়মের জন্য জেলা প্রশাসক ও
পরীক্ষা কমিটির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ করেছেন। এ সময় অভিভাবকেরা বাদ
পড়া শিক্ষার্থীদের ভর্তি করার দাবিতে গত রোববার জেলা প্রশাসকের কাছে
স্মারকলিপি প্রদান, হাইকোর্টে রিট করাসহ আন্দোলনের হুমকি দেন। এ ব্যাপারে
খুলনা জেলা প্রশাসক মো. অমিন উল আহসান বলেন, কোনো প্রকার দুর্নীতি বা
অনিয়মের প্রশ্নই ওঠে না। টেবুলেশন শিট থেকে ফলাফল কম্পিউটারে আপলোড করার
সময় কারিগরি ত্রুটির কারণে ফলাফল ভুল হয়ে যায়, যে কারণে তা স্থগিত করা হয়।
পরে সঠিকভাবে রেজাল্ট তৈরি করে তা শনিবার প্রকাশ করা হয়’ (দৈনিক ইত্তেফাক,
২৪ ডিসেম্বর ২০১৭)। খুলনার ঘটনা থেকে একটি বিষয় খুবই পরিষ্কার। প্রথমত,
যাঁরা ফল প্রকাশ করেছেন, তাঁরা ফল প্রকাশের আগে সেটি যাচাই-বাছাই করেননি।
সম্ভবত প্রয়োজনও বোধ করেননি। কারণ, ‘এ রকম কাজ ওনারা হরহামেশা করেন’। প্রিয়
পাঠক, আপনারা কেউ কি বলতে পারবেন, স্কুলে বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফল কোনো দিন
দ্বিতীয়বার প্রকাশ করা হয়েছে? না, হয়নি। শিক্ষকেরা জানেন তাঁদের কাজ কী।
সেটা কীভাবে করতে হয়। শিক্ষাদানের কাজটা তাঁরা করেন, মূল্যায়নটাও তাঁরা
করেন। ওটাই তাঁদের কাজ। যে শিক্ষকের কাছে ছেলেমেয়েরা পরবর্তী পাঁচ-সাত বছর
পড়াশোনা করবে, সেই শিক্ষকদের কোনো যোগ্যতাই নেই ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন
করার! এই হচ্ছে আমাদের দেশ। শহরের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাসহ হাজার রকমের কাজ বাদ
দিয়ে জেলা প্রশাসনের এখন একটা বড় কাজ হলো ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া। আর তাদের এই
কাজে যুক্ত করে দিয়েছে খোদ শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ থেকে কী লাভ হচ্ছে, সেটি
শিক্ষামন্ত্রী হয়তো বলতে পারবেন। আমি যা বুঝি তা খুবই সহজ। এভাবে শিক্ষকদের
ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন করা ও ফল প্রকাশের দায়িত্ব থেকে মুক্তি দেওয়ার
কারণে সমাজে এমনটাই বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে যে শিক্ষকেরা এই কাজের যোগ্য নন।
তাই শেষ বিচারে শিক্ষার্থী আর অভিভাবকেরা স্কুলের শিক্ষকের ওপর ভরসা রাখতে
পারেন না। ছেলেমেয়েদের পাঠিয়ে দেন কোচিংয়ে। দেশের হাজার হাজার কোচিং
সেন্টারে এমন লোকজন পড়ানোর দায়িত্ব পালন করেন, যাঁরা কখনো স্কুল-কলেজে
শিক্ষক হতে পারেননি, শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতাও তাঁদের নেই। নিজেদের কোচিং
সেন্টারের নাম বাড়ানোর জন্য তখন তাঁরা প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ নানাবিধ কাজে
যুক্ত হন। স্কুলের শিক্ষককে ঠিকমতো সম্মান বা সম্মানী দুটোর কোনোটিই দেওয়া
হচ্ছে না। এই সফরে এক শিক্ষক জানালেন, ১৩ বছর ধরে তাঁদের টাইম স্কেলের
ফাইলটা কিছুতেই পাস হচ্ছে না। কারণ, ওই ফাইলগুলো তো প্রশাসনের কর্তাদের পাস
করতে হয়। তাঁরা তো ভর্তি পরীক্ষা আর শিক্ষকদের দুর্নীতি ধরতে ব্যস্ত
থাকেন। এই সব ফাইল দেখার সময় কই? চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায়
আমাদের বেশির ভাগ বিনিয়োগ করতে হবে শিক্ষায়। আর সেটার সম্পূরক হলো
শিক্ষকদের যথাযথ মর্যাদা এবং তাঁদের কাজ তাঁদের করতে দেওয়ায়। মনে রাখতে
হবে, শিক্ষককে মর্যাদাহীন করে শিক্ষার উন্নতির আশা করাটা বাতুলতা।
মুনির হাসান: সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি।
মুনির হাসান: সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি।
No comments