মেঘনায় বালু লুটে প্রভাবশালীরা
ভোলার
তজুমদ্দিন উপজেলার ভাঙনকবলিত এলাকার কাছে মেঘনায় অবৈধভাবে খননযন্ত্রের
(ড্রেজার) সাহায্যে বালু তোলা হচ্ছে। এতে ভাঙন আরও তীব্র আকার ধারণ করবে
বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। স্থানীয় প্রভাবশালীরা বালু উত্তোলন করছেন বলে অভিযোগ
রয়েছে। উপজেলার স্লুইস ও চৌমহনী লঞ্চঘাট এলাকায় ১৫ ডিসেম্বর দেখা যায়, তীর
সংরক্ষণকাজের প্রস্তুতি চলছে। বালু-পাথর আসছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের
(পাউবো) মতে, চৌমহনী থেকে কেয়ামুল্যাহ পর্যন্ত সাড়ে ৬ কিলোমিটার মেঘনার তীর
ও স্লপ (বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধের ঢাল) সংরক্ষণকাজ করা হচ্ছে। এখানে প্রায় ৪০
লাখ সিসি ব্লক ফেলা হবে। এতে ব্যয় হবে প্রায় ৪৪৯ কোটি টাকা। কাজটি ২০১৬-১৭
অর্থবছরে শুরু হলেও কাজের তেমন অগ্রগতি দেখা যায়নি। বড়জোর ৮-১০ শতাংশ কাজ
শেষ হয়েছে। আরও দেখা যায়, উপজেলার গুড়িন্দা থেকে লঞ্চঘাট হয়ে দক্ষিণ দিকে
প্রায় ১৫ কিলোমিটার এলাকা ভাঙনের মুখে রয়েছে। স্লুইস ও চৌমহনী লঞ্চঘাট
বিলীন হয়ে গেছে। নতুন স্থানে লঞ্চঘাট (পন্টুন) বসানো হলেও ভাঙনের কারণে
পন্টুনটি কাত হয়ে আছে। যাত্রীরা ঝুঁকি নিয়ে ঢাকার লঞ্চে ওঠানামা করছেন।
বালু তোলা অবস্থায় ড্রেজার মালিক নুরু মিয়া ও দুলাল বলেন, তাঁদের উপজেলা
ভাইস চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন পোদ্দার বালু তোলার জন্য মুন্সিগঞ্জ থেকে ভাড়া
এনেছেন। শতাধিক তজুমদ্দিনবাসীর অভিযোগ, বালু উত্তোলনের কারণে উপজেলার ভাঙন
তীব্র হচ্ছে। বর্ষায় বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে
তজুমদ্দিনবাসী বর্ষার জোয়ারে প্লাবিত হয়ে চরম ভোগান্তির শিকার হয়েছেন।
ভাঙনকবলিত পাঁচ-ছয়জন বলেন, ভাঙন এলাকার পাশে মেঘনা থেকে আবদুস সালাম ওরফে
বালু সালাম নামের এক প্রভাবশালী ব্যবসায়ী বছর ধরে বালু তুলছেন। মানুষ সেই
বালু দিয়ে পুকুর, জলাভূমি ও কৃষিজমি ভরাট করছেন। ঠিকাদার মেঘনার চিকন দানার
বালু সিলেট-মুন্সিগঞ্জের মোটা দানার বালুর সঙ্গে মিশিয়ে উন্নয়নকাজ করছেন।
এতে মেঘনার ভাঙন তীব্র ও নিম্নমানের উন্নয়ন হচ্ছে। এলাকাবাসী সূত্র জানায়,
প্রতিদিন তজুমদ্দিন উপজেলায় মেঘনা থেকে অপরিকল্পিত ২০-২৫টি কার্গো জাহাজ
বালু তোলা হচ্ছে। বিগত সময়ে মুন্সিগঞ্জ, চাঁদপুর, নারায়ণগঞ্জের খননযন্ত্র
ভাড়া এলেও বর্তমানে ভোলার মালিকদের নিজস্ব খননযন্ত্র আছে।
বর্তমানে বালু
তোলার কাজে জড়িত আছেন উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন পোদ্দার, উপজেলা
ছাত্রলীগের সভাপতি আমিন মহাজনসহ রুবেল মহাজন, আবদুল খালেক, দুলাল বণিক,
হারুন গাজী ও মো. সবুজ। মো. সবুজ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, মেঘনা থেকে
চিকন দানার ভিটি বালু তোলা হয়, তিনি মুন্সিগঞ্জের টোকের (বড় দানা) বালুর
ব্যবসা করেন। আবদুস সালাম বালু তোলার সঙ্গে জড়িত। তবে আবদুস সালামের ছেলে
নুরে আলম বলেন, শুধু তাঁরা নন, আবদুল খালেক, আমিন মহাজন ও রুবেল মহাজন
যৌথভাবে মেঘনা নদী থেকে চার-পাঁচটি খননযন্ত্র দিয়ে বালু তুলছেন। উপজেলা
ভাইস চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন পোদ্দার বলেন, উন্নয়নের স্বার্থে ও নদীর তীর
সংরক্ষণকাজে মাঠ ভরাটের জন্য বালু তোলা হচ্ছে। তবে তীরের কাছ থেকে নয়,
মাঝনদী থেকে। একই ধরনের কথা বলেন ছাত্রলীগ সভাপতি আমিন মহাজন। তিনি বলেন,
‘এলাকার উন্নয়নও হচ্ছে, আমার ফুটপ্রতি চার আনা লাভও হচ্ছে।’ বিআইডব্লিউটিএর
নৌ-নিরাপত্তা বিভাগের পরিদর্শক নাসিম আহমেদ বলেন, ভাঙনের কারণে মেঘনার সব
কটি ঘাট বিকল হয়ে পড়ছে। বিআইডব্লিউটিএর ড্রেজার বিভাগের উপসহকারী প্রকৌশলী
মাসুদ রানা বলেন, অবৈধ বালু উত্তোলনকারীরা সাধারণত যেখানে-সেখানে
অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলন করেন। এ কারণে ভাঙন বৃদ্ধি পেয়ে থাকতে পারে।
ভোলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো-২) নির্বাহী প্রকৌশলী কাইসার আহমেদ বলেন,
মেঘনা নদী এমনিতেই ভাঙনপ্রবণ। ভাঙনের আশপাশ দিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন
করলে ভাঙন আরও বৃদ্ধি পাবে। তবে দূর থেকে তুললে সমস্যা নেই। প্রকৌশলী আরও
বলেন, মেঘনা নদীর মাঝে অনেক ডুবোচর আছে, যা নদীর নাব্যতা হ্রাস করছে। নদীর
নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে ও ভাঙন প্রতিরোধ করতে তীর সংরক্ষণ প্রকল্পের সঙ্গে নদী
খনন ধরা আছে। তাই ডুবোচর কেটে বালু উত্তোলন করলে ক্ষতি নেই। ভোলা জেলা
প্রশাসক মোহাং সেলিম উদ্দিন বলেন, অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলনে ভাঙন
বৃদ্ধি ছাড়াও অনেক ক্ষতি করছে। তা ছাড়া ভোলার মেঘনা-তেঁতুলিয়া নদীতে বালু
উত্তোলন সম্পূর্ণ অবৈধ। এখানে ‘উন্নয়নের স্বার্থ’ বলে কোনো কথা নেই।
No comments