স্থিতিশীলতার জন্য ভারসাম্য দরকার
পাকিস্তানের
প্রধান বিচারপতি সম্প্রতি আদালতের এক আদেশের ব্যাপারে জনসমক্ষে ব্যাখ্যা
দিলে দেশটির রাজনৈতিক পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়েছে। মোল্লারা রাজধানী
ইসলামাবাদ অবরোধ করলে দেশটির শাসনব্যবস্থায় ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এর
কারণ হচ্ছে, এই অতি উত্তেজনা কেবল রাজনৈতিক দলের মধ্যে সীমিত ছিল না।
বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সংস্থার মধ্যে শুধু বিবাদই হয়নি, তাদের অন্তঃকলহে
রাষ্ট্রের মৌলিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে। ২০১৪ সালে নওয়াজ শরিফ নির্বাচিত
হওয়ায় ইসলামাবাদে যে আগ্রাসী অবস্থান ধর্মঘট হয়েছে, তার পেছনে যেমন
রাষ্ট্রের ভেতরের রাষ্ট্রের প্রভাব ছিল, তেমনি আদালতের এক সন্দেহজনক আদেশের
মাধ্যমে নওয়াজ শরিফকে সরানোর ক্ষেত্রেও তার হাত ছিল। যৌথ তদন্ত দলের
(জেআইটি) যে প্রতিবেদনের ভিত্তিতে এই আদালত এই আদেশ দিয়েছেন, সেই দলটি
সামরিক গোয়েন্দাদের দিয়ে ভর্তি ছিল। নিরাপত্তা বাহিনী উচ্চ আদালতকে ব্যবহার
করে নওয়াজ শরিফকে সরিয়েছে, যিনি দুটি কারণে তাদের বিরাগভাজন হয়েছিলেন।
প্রথমত, তিনি সাবেক সেনাশাসক জেনারেল পারভেজ মোশাররফকে অভিযুক্ত করে বিশেষ
ট্রাইব্যুনালের সামনে দাঁড় করিয়েছিলেন। দ্বিতীয়ত, নওয়াজ শরিফ প্রতিবেশীদের
সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চেয়েছিলেন, বিশেষ করে ভারতের সঙ্গে। ভারতের
সঙ্গে তিনি যে অর্থনৈতিক সহযোগিতার সম্পর্কে যেতে চাইছিলেন, তাতে তিনি
নিরাপত্তা বাহিনীর চক্ষুশূল হন। তবে নওয়াজ শরিফ অযোগ্য ঘোষিত হওয়ার পরও যখন
সেই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধাচরণ করলেন,তখন সরকারের ওপর নতুন চাপ দেওয়া হলো।
তিনি আদালতের আদেশ চ্যালেঞ্জ করে ইসলামাবাদ থেকে নিজ শহর পর্যন্ত এক বড়
মিছিলের নেতৃত্ব দেন, সেই মিছিল লাহোর পর্যন্ত গিয়েছিল। এর জবাবে দাঙ্গা
পুলিশ নামানো হয়েছিল। আর নভেম্বরে ধর্মীয় চরমপন্থীরা যে ইসলামাবাদ ঘেরাও
করল, সেটা ছিল এই মন্থর অভ্যুত্থানের সবচেয়ে নিকৃষ্ট পর্যায়, যার কারণে
সরকার বেশ দুর্বল হয়ে পড়ে। কিন্তু রাষ্ট্রের সঙ্গে এই রাষ্ট্রবিরোধী শক্তির
সংঘাতের সময় নিরাপত্তা বাহিনী যেভাবে নীরব থেকেছে এবং শেষের দিকে তারা
যেভাবে ‘মধ্যস্থতাকারীর’ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, তাতে মানুষের মনে অনেক
প্রশ্নের উদয় হয়েছে। এক ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তা পোশাক পরে এই ধর্মান্ধদের
মধ্যে টাকা বিতরণ করছেন—এই দৃশ্যের ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে আমাদের সবকিছু বোঝা
হয়ে যায়। নিরাপত্তা বাহিনী ও উচ্চ আদালত ক্ষয়ক্ষতি নিয়ন্ত্রণের যে চেষ্টা
করেছেন, তার সম্ভাব্য দুটি কারণ থাকতে পারে। প্রথম কারণ হলো, নির্বাচিত
প্রধানমন্ত্রীকে সরাতে তারা যে ভূমিকা পালন করেছে, তা শোভনতা ও শালীনতার সব
সীমা ছাড়িয়ে গেছে। এসব কারণে তাদের একটু পিছু হটতে হবে। দ্বিতীয়ত,
পিএমএলের(এন) রক্ষণশীল নেতারা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের লক্ষ্যে নওয়াজ
শরিফকে নিরাপত্তা বাহিনীর শর্ত মানতে রাজি করাতে পেরেছেন। প্রধানমন্ত্রীর
পদে শাহবাজ শরিফের মনোনয়ন সেই কথিত চুক্তির সবচেয়ে দৃশ্যমান প্রকাশ।
এসব
সত্ত্বেও সুপ্রিম কোর্ট যে রাজনৈতিক ভারসাম্যের নির্দেশ দিয়েছেন এবং সংসদে
আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণের যে বিল পেশ করা হয়েছে, তাতে আগামী নির্বাচনের
পথ পরিষ্কার হয়েছে। এখনকার মতো সংবিধানাতিরিক্ত পদক্ষেপ যেমন দীর্ঘস্থায়ী
তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের ব্যাপারটা ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু
সাম্প্রতিক সংকটে পাকিস্তানের সব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান টলমল করছে। বিশেষ
করে বেসামরিক সংস্থাগুলোর অবস্থা ভালো নয়। আর ভাবমূর্তির দিক থেকেও উচ্চ
বিচারালয় বেশির ভাগটাই হারিয়েছে। যে রাজনীতিকদের নিরাপত্তা বাহিনী দানব
বানিয়েছে, পাকিস্তানের সর্বোচ্চ আদালত তঁাদের বিচারে জিহাদি জোশ দেখিয়েছেন।
কিন্তু জেনারেলদের বিচার তাঁরা করতে পারেননি, এমনকি অবসরপ্রাপ্ত
জেনারেলেরও। জেনারেল মোশাররফের বিচার করতে না পারাটা সবচেয়ে কুখ্যাত নজির
হয়ে থাকবে। দুর্নীতিবাজ বিচারকদেরও কিছু হয় না, এ ক্ষেত্রে আদালতের অবস্থা
একেবারেই শোচনীয়। সংসদও সংকট কাটিয়ে উঠতে পারেনি। নির্বাচিত সংস্থাগুলো
কয়েক বছর ধরে কোণঠাসা হয়ে আছে। কিন্তু আসন পুনর্বিন্যাসের বিল পাসে বিলম্ব
হওয়ায় বোঝা যায়, সংসদ অগণতান্ত্রিক শক্তির কাছে কতটা অসহায়। নেতারা
ব্যক্তিস্বার্থে বুঁদ হয়ে আছেন। তাঁরা যে ন্যূনতম বিষয়েও একমত হতে পারেন
না, তাতে তাঁদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়নি। সংকট কাটিয়ে ওঠাটা দৃশ্যত সুখবর।
সবাই চাইবে, আগামী নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দল সমান সুযোগ পাক, পরিবেশ
শান্তিপূর্ণ হোক। ভবিষ্যতের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য এটিই একমাত্র পথ।
কিন্তু রাষ্ট্রের এক মৌলিক বিরোধের মীমাংসা না করে এর মসৃণ অগ্রগতি আশা করা
যায় না। এই সংকটের মূলে আছে ভারসাম্যহীন সামরিক-বেসামরিক সম্পর্ক। দেশ
রক্ষায় সেনাবাহিনী অতন্দ্র প্রহরীর মতো কাজ করে—এ নিয়ে কারও দ্বিমত নেই।
নিরাপত্তা ও পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নে তারা যা বলে, সবাই তা একরকম বিনা বাক্যে
মেনে নেয়। এটা স্বাভাবিক। কিন্তু কিছু জেনারেল যখন অন্য সব প্রতিষ্ঠানকে
বাদ দিয়ে নিজেদের ‘রাষ্ট্র’ ভাবতে শুরু করেন, তখনই বিপত্তিটা বাধে।
নির্বাচিত নেতারা যখন সংবিধানের ঊর্ধ্বে উঠে রাজার মতো আচরণ করেন বা
জবাবদিহির আওতায় থাকেন না, তখন তাঁদের চ্যালেঞ্জ জানানোটা আমাদের তরফে
ন্যায্য। শীর্ষ সামরিক ও বেসামরিক আমলারা যখন চাকরির সীমা ছাড়িয়ে নিজেদের
‘প্রকৃত শাসক’ ভাবতে শুরু করেন, তখনো তাঁদের ক্ষেত্রে এ কথা প্রযোজ্য। ঠিক
সেখানেই রাষ্ট্রের ভেতরে রাষ্ট্রের প্রসঙ্গ আসে। এটা শুধু অসাংবিধানিকই নয়,
টেকসইও নয়। রাজনৈতিক দল বিভিন্ন সামাজিক-রাজনৈতিক কর্মসূচিতে মানুষের রায়
পায়। কিন্তু সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্র যখন মানুষের রায়ে ভেটো দেওয়ার
অধিকার আছে বলে মনে করে, তখন গণতন্ত্র অর্থহীন হয়ে পড়ে। পাকিস্তানে
স্থিতিশীল গণতন্ত্র আনার ক্ষেত্রে এটা পূর্বশর্ত। এই প্রশ্ন
অনির্দিষ্টকালের জন্য কার্পেটের নিচে লুকিয়ে রাখা যাবে না।
দ্য নেশন থেকে নেওয়া, অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন।
আফ্রাসিয়াব খটক: পাকিস্তানের আঞ্চলিক রাজনীতি বিশ্লেষক।
দ্য নেশন থেকে নেওয়া, অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন।
আফ্রাসিয়াব খটক: পাকিস্তানের আঞ্চলিক রাজনীতি বিশ্লেষক।
No comments