দুই মিনিটের দূরত্ব পার হতে দেড় ঘণ্টা!
বাস কিংবা ব্যক্তিগত গাড়িতে কুড়িল চৌরাস্তা থেকে নতুনবাজার পর্যন্ত যেতে সময় লাগে বড়জোর দুই মিনিট। অথচ এখন এ দূরত্ব পাড়ি দিতে ঘণ্টা পার হয়ে যাচ্ছে। এ নিয়ে ভুক্তভোগী যাত্রীসাধারণের ক্ষোভ-অসন্তোষের শেষ নেই। কারণ রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি। ড্রেন কেটে দিনের পর দিন ফেলে রাখা হয়েছে। রাস্তার ওপর ইট-বালুর স্তূপ। এদিকে আমজনতার নাভিশ্বাস। কিন্তু কে শোনে কার কথা। উত্তর সিটি কর্পোরেশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তাব্যক্তিদের অজুহাতের শেষ নেই। এই যখন অবস্থা, তখন ভুক্তভোগী জনসাধারণ দুষছেন সিটি মেয়রকে। লম্বা যানজটে আটকা পড়া হাজার হাজার মানুষ শুধু হাঁসফাঁস করছেন আর বলছেন, কোথায় মেয়র সাহেব। তিনি কী এ দৃশ্য দেখেন না। এমন দুর্ভোগের খোঁজখবর নিতে রোববার যুগান্তর প্রতিবেদক সরেজমিন ভুক্তভোগী অনেকের সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় তাদের মুখে এমন সব তির্যক মন্তব্য শোনা যায়। তারা বলেন, দৈনন্দিন কাজে প্রতিদিন গুরুত্বপূর্ণ এ সড়ক দিয়ে যাতায়াত করতে হয়। কিন্তু এখন যা দেখছি তাতে দু’মাস কেন, আরও তিন মাসেও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার লক্ষণ নেই। এ অবস্থায় সংকট নিরসনে সিটি মেয়র যদি ত্বরিত পদক্ষেপ না নেন তাহলে তাদের রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানানো ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর থাকবে না।
তাদের প্রশ্ন- সারা বছর ফাঁকা রেখে কেন রোজার মাসে সাধারণ মানুষকে এভাবে কষ্ট দিচ্ছেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের অপরিকল্পিত সমন্বয়হীন উন্নয়ন কাজের কারণে জনগণের এই ভোগান্তি। সেবা সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বয় সাধন করে কাজ না করার কারণে নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করা সম্ভব হচ্ছে না। দুই মাস ধরে বসুন্ধরা গেট সংলগ্ন অংশে অর্ধেক সড়ক খুঁড়ে ফেলে রাখা হয়েছে। এখানে পাইপ লাইন বসানোসহ সড়ক দ্বীপ ও ফুটপাতের উন্নয়ন কাজ করা হচ্ছে। মন্থরগতির কাজের কারণে সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত এ সড়কে ভয়াবহ যানজটের সৃষ্টি করছে। সড়কের অপরাংশের ড্রেন এবং ফুটপাতের উন্নয়ন কাজের কারণে সীমাহীন ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে উন্নয়ন কাজের প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী সৈয়দ কুদরত উল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, সেবা সংস্থার লাইন অপসারণ নিয়ে জটিলতার কারণে কাজের গতি কিছুটা কমেছে। সেটা সমাধানের প্রচেষ্টা চালাচ্ছি আমরা। দ্রুততম সময়ের মধ্যে সৃষ্ট সমস্যার সমাধান করে দুর্ভোগ অনেকাংশে লাঘব করা সম্ভব হবে। সরেজমিন দেখা গেছে, রোববার সকাল ৯টা থেকে যানজটের তীব্রতা বাড়তে থাকে। দুপুর ১২টা নাগাদ যানজট আরও তীব্র আকার ধারণ করে। এভাবে গভীর রাত পর্যন্ত সীমাহীন জনদুর্ভোগে পড়ে ভুক্তভোগীদের ত্রাহি অবস্থা। বসুন্ধরা গেট বরাবর পানি নিষ্কাশন ড্রেনের কাজ চলার কারণে ওই অংশের সড়ক খুবই সরু হয়ে পড়েছে। আর সড়কের ওপর রাখা হয়েছে ইট, খোয়া, সুরকি ও বালু। এরই মধ্য দিয়ে কোনো রকম করে চলছে পরিবহনগুলো। আরও দেখা গেছে, নর্দা ফুটওভার ব্রিজের নিচের সড়কের একাংশ অবৈধ দখলদারদের দৌরাত্ম্য। এছাড়া কিছু অংশে জলাবদ্ধতাও লক্ষ্য করা গেছে। এর বাইরে নর্দা থেকে নতুন বাজার পর্যন্ত ফুটপাতের একাংশে রাখা হয়েছে সড়ক নির্মাণ, সংস্কার ও ফুটপাত উন্নয়নের বিভিন্ন সামগ্রী। ফলে এ অংশের সড়কেও চলাচল করা খুবই দুষ্কর হয়ে পড়েছে। যানজটে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকা আকিক পরিবহনের গাড়িচালক আমিনুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, কুড়িল চৌরাস্তা থেকে নতুনবাজার পর্যন্ত দূরত্ব পাড়ি দিতে আগে সময় লাগত ২ মিনিট। আর এখন লাগে এক থেকে দেড় ঘণ্টা। কখনও এর চেয়েও বেশি সময় লাগছে। কুড়িল চৌরাস্তা এলাকার রিকশাচালক মুসলেহ উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, সিটি কর্পোরেশন কী উন্নয়ন কাজ করছে, মানুষের ভোগান্তির শেষ নেই। ২ মিনিটের দূরত্ব পাড়ি দিতে সময় লাগছে এক থেকে দেড় ঘণ্টা। একটি ট্রিপ দিয়ে ফিরে আসতে যানজটের ধকল সামলে যেতে কাহিল হয়ে পড়ছি। কুড়িল এলাকায় কর্মরত বেসরকারি কোম্পানির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা আয়নাল হক যুগান্তরকে বলেন, অফিসের কাজ শেষ করতে রাত ১০টা বাজে। সেই সময় বের হয়েও এ এলাকা পার হতে ৪৫ মিনিট থেকে এক ঘণ্টা সময় লাগে। তিনি বলেন, দুই মাস ধরে এ ভোগান্তি মাড়িয়ে চলাচল করতে হচ্ছে। এ ভোগান্তির শেষ কোথায়, এভাবে কতদিন পথ চলা যায়। বিকল্প ব্যবস্থা থাকলে আমরা সেটাই বেছে নিতাম, কিন্তু সে রকম তো কোনো পথ নেই। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের তথ্যমতে, ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক অবকাঠামো উন্নয়নসহ নর্দমা-ফুটপাত মেগা প্রকল্পের আওতায় নতুনবাজার থেকে বসুন্ধরা গেট পর্যন্ত সড়কের উন্নয়ন কাজ করা হচ্ছে। প্রায় ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা ব্যয়ে এ প্রকল্পের আওতায় মহানগরীর বিভিন্ন এলাকায় উন্নয়ন কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এপ্রিলের শুরু থেকে এ সড়কের উন্নয়ন কাজ শুরু করেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জনি এন্টারপ্রাইজ। কাজের মেয়াদকাল ডিসেম্বর পর্যন্ত। জনসাধারণের প্রশ্ন, এটুকু কাজ শেষ করতে এত সময় লাগার কথা নয়। কিন্তু সিটি কর্পোরেশনের মন্থরগতিতে কাজ করার জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে এ সুযোগ করে দিয়েছে। ব্যস্ততম এ সড়কে এত ধীরগতির উন্নয়ন কাজ করলে মানুষের ভোগান্তির শেষ থাকে না। সেই ভোগান্তি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন প্রগতি সরণি সড়কে চলাচলকারীরা। এ প্রসঙ্গে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জনি এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী দীলিপ কুমার ঘোষ যুগান্তরকে বলেন, নতুন বাজার থেকে বসুন্ধরা গেট পর্যন্ত সড়কের পাইপ স্থাপন কাজ প্রায় শেষ। এখন বালু ভরাটের কাজ চলছে। কয়েক দিনের মধ্যে বালু ভরাট কাজ শেষ হবে। তবে এরপরও সড়কের এ অংশ ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া যাবে না। প্রকৌশল কাজের পদ্ধতি অনুযায়ী সড়কের খননকৃত অংশের মাটি মজবুতভাবে বসতে এক থেকে দেড় মাস সময় লাগে। তবে এর আগে ভারি বর্ষা হলে আরও তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে। এ বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ও ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক অবকাঠামো উন্নয়নসহ নর্দমা-ফুটপাত মেগা প্রকল্পের পরিচালক সৈয়দ কুদরত উল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, ঢাকা শহরে সেবা সংস্থাগুলোর সংযোগ লাইন বিচ্ছিন্নভাবে রয়েছে। নতুনবাজার থেকে বসুন্ধরা গেট পর্যন্ত অংশের পাইপ লাইন বসানোর কাজ করতে গিয়ে পানি-বিদ্যুৎ-গ্যাস সরবরাহ লাইন ঠিক করতে গিয়ে আমরা বেশ কিছু পয়েন্টে কঠিন সমস্যার মুখোমুখি হয়েছি। বিদ্যমান অবস্থায় সেখানকার কাজ করা সম্ভব হচ্ছে না। এ কারণে আমরা প্রকৌশলীরা ওই এলাকার বিদ্যমান সমস্যা সমাধানের প্রচেষ্টা চালাচ্ছি। আমরা আশা করছি, দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিকল্প পন্থা বের করে ওই সমস্যাগুলোর সমাধান করতে পারব।
No comments