কেন কাতারের সঙ্গে আরব দেশগুলোর এই ‘আকস্মিক’ বৈরিতা? by নাজমুল আহসান
কাতারের
সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন ও মিশর।
পরে একই পদক্ষেপ নিয়েছে সৌদি আরবে অবস্থানরত ইয়েমেনের অন্তর্বর্তীকালীন
সরকার ও লিবিয়ার একটি সরকার। সৌদি আহবানে সাড়া দিয়ে সম্পর্কচ্ছেদ করেছে
মালদ্বীপও। তবে এই আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেছে পাকিস্তান। সৌদি আরব, আমিরাত,
বাহরাইন ও কাতার প্রভাবশালী আঞ্চলিক সংগঠন গালফ কোঅপারেশন কাউন্সিলের
(জিসিসি)’র সদস্য। জিসিসি’র মধ্যে শুধুমাত্র কুয়েত ও ওমানই কাতারের সঙ্গে
সম্পর্ক বজায় রেখেছে। মধ্যপ্রাচ্যে তেলসমৃদ্ধ ধনী দেশগুলো সাংস্কৃতিক,
ভৌগোলিক ও ধর্মীয় অনেক কারণেই একতাবদ্ধ ছিল যুগের পর যুগ। তাহলে কী এমন
ঘটলো যে, কাতারকে আজ একঘরে করার চেষ্টা করছে দেশটিরই ‘আরব ভাতৃবৃন্দ’?
কারণটা সম্পূর্ণ স্বার্থসংশ্লিষ্ট। তবে এই বিরোধ মোটেই আকস্মিক নয়।
তেল ও তরল গ্যাসে সমৃদ্ধ কাতার মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে ছোট দেশগুলোর একটি। কিন্তু দেশটির নাগরিকরা পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ৩৩৫০০ কোটি ডলারের বিনিয়োগ আছে দেশটির। এবারের আগে ২০১৪ সালে ও ১৯৯৫ সালে কাতারের সঙ্গে উপসাগরীয় তিন দেশ সৌদি আরব, আমিরাত ও বাহরাইনের সম্পর্কে উত্তেজনা দেখা দেয়।
১৯৯৫ সালে কাতারের তৎকালীন আমির খলিফা বিন হামাদ আল থানিকে তারই ছেলে পদচ্যুত করে ক্ষমতা দখল করেন। তখন খলিফা বিন হামাদ আল থানিকে আবুধাবিতে আশ্রয় দেয় আমিরাত। এ ঘটনায় ক্ষুদ্ধ তার ছেলে ও আমির হামাদ বিন খলিফা আল থানি আমিরাত, সৌদি আরব ও বাহরাইনের বিরুদ্ধে তাকে নিয়ে ষড়যন্ত্র করার অভিযোগ আনেন। তবে তিন দেশই এ অভিযোগের বিরোধীতা করে।
এছাড়া ২০১৪ সালে মিশরের মুসলিম ব্রাদারহুডকে সমর্থনদানের অভিযোগ এনে কাতার থেকে নিজেদের রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার করে এই তিন দেশ ও মিশরের সামরিক শাসক আবদেল ফাতাহ আল সিসি। পরে অবশ্য সমঝোতা হয় দু’ পক্ষের মধ্যে। ২০১৪ সালে তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন কিছু ইমেইল আদানপ্রদান করেন, যা পরে উইকিলিকস ফাঁস করে। ওই ইমেইলে দেখা যায়, হিলারি বলছেন, সৌদি আরব ও কাতার মধ্যপ্রাচ্যে আধিপত্য বিস্তারের প্রতিযোগিতা করছে সিরিয়ায় বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীকে সহায়তা করার মাধ্যমে। এবারের বিরোধ মূলত ইরান ও ব্রাদারহুডকে কাতারের সমর্থন দেওয়া নিয়ে সূত্রপাত।
ইরান/শিয়া ফ্যাক্টর
কাতারের প্রায় ১০ শতাংশ নাগরিক শিয়া মুসলিম। এছাড়া ঐতিহ্যগতভাবেই কাতারের শীর্ষ কিছু ব্যবসায়ী পরিবারও শিয়া। সুন্নি সংখ্যাগরিষ্ঠ উপসাগরীয় আরব দেশগুলোতে শিয়ারা কোণঠাসা থাকলেও, কাতারে পরিস্থিতি একেবারে বিপরীত। সেখানে শিয়ারা তুলনামূলক অনেক ধর্মীয় ও রাজনৈতিক সুবিধা ভোগ করেন। শিয়া-সুন্নি বিরোধের ব্যাপারে শাসকগোষ্ঠীও সতর্ক। শিয়া সংখ্যালঘুদের ওপর যেকোন হামলার ব্যাপারে রাজপরিবার নিন্দা জানিয়েছে।
সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত প্রায় নিয়মিতভাবেই শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ ইরানের সমালোচনা করলেও, কাতার এ থেকে বিরত থেকেছে। কারণ, তেল ও গ্যাস খাতে ইরানের সঙ্গে কাতারের সম্পর্ক অনেক নিবিড়। অনেক বড় তেল ও গ্যাস খনিতে যৌথ আংশীদারিত্ব আছে দুই দেশের।
২০১৫ সালে ইরানের সঙ্গে পরাশক্তিধর ৫টি দেশের চুক্তির পর, পারমাণবিক কর্মসূচি সীমিত করার বিনিময়ে বিপুল আর্থিক ছাড় পায় ইরান। এছাড়া দেশটিতে বৈদেশিক বিনিয়োগের পথও তৈরি হয়। এর পর থেকেই ইরানকে নিজেদের এক নম্বর শত্রু জ্ঞান করছে সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন দেশগুলো।
এছাড়া, লেবানন, সিরিয়া, ইরাক ও ঘরের কাছে ইয়েমেনে ইরানের সরাসরি প্রভাবের কারণে উদ্বিগ্ন সৌদি আরব। সিরিয়া-ইরাকে সৌদি আরবের সমর্থনপুষ্ট বিদ্রোহীরা লড়ছে ইরানের মিত্র বাশার আল আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে। ইয়েমেনে ইরান সমর্থিত হুতি বিদ্রোহীরা দেশটি দখলে নিয়ে নিয়েছে। প্রতিক্রিয়ায় সৌদি আরব সামরিক হামলা শুরু করলেও প্রত্যাশিত বিজয় পায়নি।
অবশ্য, ইয়েমেনে সৌদি নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটে ছিল কাতার। এছাড়া সিরিয়া-ইরাকে জঙ্গি-গোষ্ঠী আইএস বিরোধী মার্কিন সামরিক জোটেও অংশ আছে কাতারের। কিন্তু ইরানের সঙ্গে কাতারের ঘনিষ্ঠতা সন্দেহের দৃষ্টিতেই দেখেছে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত।
অপরদিকে শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ বাহরাইনে সুন্নি শাসক বিরাজমান। এই শাসকগোষ্ঠী সৌদি ও আমিরাতি সমর্থনপুষ্ট। বাহরাইনে শিয়ারা গণঅভ্যুত্থান করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু সৌদি সাহায্যে টিকে যায় সুন্নি শাসক পরিবার। আর অভ্যুত্থানের জন্য ইরানকে দায়ী করে বাহরাইন সরকার। এছাড়া কাতারের বিরুদ্ধেও বিভিন্ন গোষ্ঠীকে সহযোগিতা দেওয়ারও অভিযোগ আনে দেশটির। আর লিবিয়ায় প্রতিপক্ষ বিভিন্ন গোষ্ঠীকে সহায়তা দিয়েছে আমিরাত ও কাতার।
ব্রাদারহুড ও আল জাজিরা
মিশরে কাতার মুসলিম ব্রাদারহুডকে সমর্থন দিয়ে থাকে। মিশরে মুসলিম ব্রাদারহুডের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসিকে সামরিক বাহিনী উৎখাত করলে এর নিন্দা জানায় কাতার। পালিয়ে আসা অনেক ব্রাদারহুড নেতাকে আশ্রয়ও দেয় দেশটি। এছাড়া ব্রাদারহুডের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ফিলিস্তিনি সংস্থা হামাসকেও সমর্থন দেয় কাতার। হামাসের প্রভাবশালী নেতা খালেদ মেশাল এখন দোহায় থাকেন। ফলে, অবধারিতভাবেই মিশরের বর্তমান সামরিক শাসক আবদেল ফাতাহ আল-সিসি কাতারকে শত্রু জ্ঞান করেন। সিসির পেছনে সমর্থন আছে সৌদিরও। কারণ, রাজতন্ত্র বিরোধী ব্রাদারহুডকে অপছন্দ করে সৌদি, আমিরাত ও বাহরাইন। ব্রাদারহুড মিশর ছাড়াও, সৌদি আরব ও অন্যান্য আরব দেশে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে নিবন্ধিত। এ কারণে ব্রাদারহুড নেতৃবৃন্দকে কাতার আশ্রয় দেওয়ায় দেশটির উপর নাখোশ হয় এই চার আরব দেশ। ২০১৩ সালে মুরসিকে উৎখাতের সময় কাতার ব্রাদারহুডের সমর্থনে এগিয়ে আসার জেরে দেশটি থেকে রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার করে তারা। তখনই জিসিসি থেকে কাতারকে বহিষ্কারের আলোচনা চলছিল। পরে কুয়েতের মধ্যস্থতায় সব ঠিক হয়। বিনিময়ে কাতার কয়েকজন ব্রাদারহুড নেতাকে বহিষ্কার করে।
তবে দৃশ্যত, দেশ দু’টোর সম্পর্কোবনতি অতটা প্রকাশ্যে ছিল না। কিন্তু কাতারের অর্থায়নে পরিচালিত মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে প্রভাবশালী টিভি স্টেশন আল জাজিরাকে নিয়ে অস্বস্তি ছিল বিভিন্ন আরব দেশে। মিশরে আরব বসন্তের প্রচার ও মুরসিকে সমর্থন দেওয়ায় আল জাজিরা নিষিদ্ধ। আর সৌদি আরব, বাহরাইন ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে আল জাজিরার কার্যক্রম নিয়ে উষ্মা ছিল।
ফেক নিউজ থেকে সংকট
তবে বর্তমানের এই কূটনীতিক অচলাবস্থার সৃষ্টি একটি ‘ফেইক নিউজ’ থেকে। কয়েকদিন আগে কাতারের রাষ্ট্রায়ত্ত মিডিয়া ও সোস্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টে দেশটির আমির তামিম বিন খলিফা আল থানির একটি বক্তব্য প্রকাশিত হয়। এতে তিনি ইরানের প্রতি শত্রুতা পোষণ করা উচিৎ নয় বলে মন্তব্য করেন। এছাড়া ব্রাদারহুড ও হামাসের প্রশংসা করেন। সমালোচনা করেন মার্কিন পররাষ্ট্র নীতির। এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় আল জাজিরা সহ কাতারের বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম ব্লক করে দেয় সৌদি আরব, মিশর, বাহরাইন ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। কিন্তু কাতার দাবি করে, রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদ সংস্থার ওয়েবসাইট হ্যাক করে আমিরের ভুয়া বক্তব্য প্রচার করা হয়েছে। কাতার এই ঘটনার তদন্ত করারও প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু ওই চার দেশের সংবাদমাধ্যমগুলোতে এই দাবি ধোপে টিকেনি। এই দেশগুলোর প্রত্যেকটি বড় সংবাদ মাধ্যমে কাতারের দাবিকে প্রত্যাখ্যান করে বলা হয়েছে, এই মন্তব্য আসলেই করা হয়েছে। এখন চাপে পড়ে হ্যাকের অজুহাত দিচ্ছে কাতার। কিন্তু ওই ফেইক নিউজ সৃষ্ট উত্তেজনায় দমে যায়নি কাতার। বরং, কয়েকদিন পরই নব নির্বাচিত ইরানি প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানিকে ফোন করে অভিনন্দন জানিয়েছেন কাতারের শাসক।
ফের ইরান...
কাকতালীয়ভাবে, এই ফেক নিউজ কেলেঙ্কারি ঘটে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের সৌদি আরব পর। ওই সফরে উপস্থিত ছিল কাতার। ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাতও করেন কাতারের আমির। সৌদি আরবে এক সম্মেলনে, সুন্নি মুসলিম দেশগুলোর উপস্থিতিতে ট্রাম্প ঘোষণা করে, বিশ্বে সন্ত্রাসবাদের মূল হোতা ইরান।
কাউন্সিল অব ফরেইন রিলেশন্স থিংকট্যাংকের জ্যেষ্ঠ ফেলো গেইল জেম্যাক লেমন বলেন, ‘মূলত, দুইটি থিওরি এখন কাজ করছে। একটি হলো, ডনাল্ড ট্রাম্পের সফরের পর সৌদি আরব সাহস পেয়েছে। আর ট্রাম্প প্রশাসন ইরান নিয়ে কড়া অবস্থান নিয়েছে, যেখানে ইরানকে সমর্থন দেয় কাতার। আরেকটি থিওরি হলো, গত এক মাসের উত্তেজনার ফলেই এই অবস্থা। কাতারের সরকারী সংবাদ সংস্থার ওই ফেক নিউজের পরেই সব তুঙ্গে উঠেছে।’
ট্রাম্পের সৌদি সম্মেলনে যোগদানের পূর্বে কাতার অভিযোগ করে, আরব কয়েকটি দেশের সংবাদ মাধ্যমে অ্যান্টি-কাতার সংগঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট লোকেরা মতামত কলাম লিখছে। এসব কলামে কাতারকে সন্ত্রাসবাদের জন্য দায়ী করা হচ্ছে। এ ধরণের একটি সংগঠন ছিল ফাউন্ডেশন ফর ডিফেন্স অব ডেমোক্রেসিস (এফডিডি)। ইসরাইলপন্থী এই সংগঠনটি আবার ইরানের কড়া বিরোধী।
মজার ব্যাপার হলো, দুই দিন আগে হাফিংটন পোস্ট, দ্য ইন্টারিসেপ্ট ও দ্য ডেইলি বিস্টে এক হ্যাকার কিছু ফাইল পাঠায়। সেখানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রভাবশালী রাষ্ট্রদূত ইউসেফ আল ওতাইবার হ্যাককৃত ইমেইল। এই ইমেইলে দেখা যায়, এফডিডি’র সঙ্গে ঘনিষ্ঠ উঠাবসা রয়েছে আমিরাত রাষ্ট্রদূতের। এফডিডি’র অনেক আলোচ্যসূচিতে কাতার, ব্রাদারহুড, তুরস্ক ও কুয়েত অন্তর্ভূক্ত ছিল। কাতার ও কুয়েতের বিরুদ্ধে প্রচার চালানোর কথাও উঠেছে। তুরস্কের শাসক দলের সঙ্গেও ব্রাদারহুডের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। একটি ইমেইলে নাম ছিল সাবেক মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রবার্ট গেটসও। রবার্ট গেটস আমিরাতে বেশ সমাদৃত। সেখানে কাতার ও আল জাজিরার সমালোচনা করা হয়। রাষ্ট্রদূত আল ওতাইবা এক কথোপকথনে কাতার থেকে মার্কিন সেনা ঘাঁটি সরিয়ে নেওয়ারও প্রস্তাব দেন। এই সংবাদ প্রকাশের একদিন পরই কাতারের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা দেয় চার দেশ।
পরিণতি কী?
এবারের সম্পর্কচ্ছেদ ২০১৪ সালের উত্তেজনার তুলনায় অনেক কঠোর। ২০১৪ সালে শুধুমাত্র রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার করেই খ্রান্ত ছিল সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন চার দেশ। কিন্তু এবার কূটনীতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার পাশাপাশি কাতারের সঙ্গে নৌ ও বিমান যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সৌদি আরব স্থল সীমান্তও বন্ধ করে দিয়েছে। কাতারি কূটনীতিকদের দেশত্যাগের ৪৮ ঘন্টা ও নাগরিকদেরকে দুই সপ্তাহের মধ্যে এসব দেশ ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ সুয়েজ খালের মালিক মিশর বলেছে, কাতারকে কোন বন্দর ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না। এছাড়া ইয়েমেনে সৌদি নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট থেকে কাতারকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তবে জিসিসিতে কাতারের অবস্থান কী হবে, জানা যায়নি।
২০১৪ সালের বিরোধের সময় কাতারের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসে অর্থায়নের অভিযোগ আনে মিশর। তবে তখন বিরোধীতা সত্ত্বেও এই অভিযোগের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয় উপসাগরীয় তিন দেশ সৌদি, আমিরাত ও বাহরাইন। তবে এবার চার দেশই ‘মুসলিম ব্রাদারহুড, আল কায়দা ও আইএস সহ সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে কাতারের অর্থায়ন ও সমর্থন’কে সম্পর্ক ছিন্ন করার কারণ হিসেবে তুলে ধরেছে।
প্রাথমিকভাবে চুপ থাকার পর, কাতার এই সম্পর্ক ছিন্ন করার কড়া প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। এক সরকারী বিবৃতিতে কাতার বলেছে, এই সম্পর্ক ছিন্ন করার কোন যৌক্তিকতা নেই। কড়া ভাষায় লেখা প্রতিক্রিয়ায় বলা হয়, ‘এর উদ্দেশ্য পরিষ্কার। সেটি হলো, এই রাষ্ট্রের ওপর নিজেদের অভিভাবকত্ব প্রয়োগ করা। এটি কাতারের স্বার্বভৌমত্বের লঙ্ঘণ।’
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রী বলেছেন, নিজেদের মধ্যকার বিরোধ আলাপ আলোচনার মাধ্যমে মিটিয়ে ফেলা ভালো। জিসিসি ঐক্যবদ্ধ থাকাটাই সবার স্বার্থের পক্ষে। তবে তিনি মনে করেন, এই সম্পর্কচ্ছেদের কারণে সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ে কোন প্রভাব পড়বে না। উল্লেখ্য, কাতারে মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে বড় মার্কিন ঘাঁটি অবস্থিত।
যে-ই ইরানকে নিয়ে এত জল ঘোলা হলো, সেই ইরানও প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। ইরানের প্রেসিডেন্টের ডেপুটি চীফ অব স্টাফ হামিদ আবুতালেবি টুইট করেছেন, ‘কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন বা সীমান্ত বন্ধ করার যুগ এখন আর নেই। সংকট সমাধানের উপায় এটি নয়।’ ইয়েমেনে আরব জোট বাহিনীর সামরিক হস্তক্ষেপের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমি আগে যেমনটা বলেছি, আগ্রাসন ও দখলদারিত্ব অস্থিতিশীলতা ছাড়া কিছু বয়ে আনে না।’
কাতারের ওপর এই পরিস্থিতির নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। তবে সরকারী বিবৃতিতে দেশবাসীকে আশ্বস্ত করে বলা হয়েছে, তাদের প্রাত্যাহিক জীবনে এই সম্পর্কচ্ছেদের কোন প্রভাব পড়বে না। তবে ইতিমধ্যে আরব আমিরাতের জাতীয় বিমান পরিবহণ সংস্থা ইত্তিহাদ এয়ারওয়েজ মঙ্গলবার থেকে কাতারে আর যাত্রী আনা নেওয়া না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে একই পদক্ষেপ নেয় দুবাই ভিত্তিক দুই জনপ্রিয় এয়ারলাইন এমিরেটস ও ফ্লাইদুবাই। অপরদিকে কাতারের জনপ্রিয় বিমান সংস্থা কাতার এয়ার ওয়েজও এই চার দেশে উঠানামা করতো। তাই ক্ষতিগ্রস্থ হবে কাতার। মধ্যপ্রাচ্যে প্রবেশের জন্য জর্দান, ইরান ও ইরাক এবং ইউরোপে যাতায়াতের জন্য ইরান বা তুরস্ক হয়ে যেতে হবে।
আর্থিক বাজারে এই সম্পর্কহানির প্রভাব পড়েছে। তেলের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। কাতারের শেয়ার স্টকের মূল্য হ্রাস পেয়েছে। মিডলইস্ট ইন্সটিটিউটের জ্যেষ্ঠ ফেলো চার্লস লিস্টার বলেছেন, কাতার খাদ্যদ্রব্য আমদানির জন্য সৌদি আরবের ওপর নির্ভরশীল। স্থলসীমান্ত বন্ধ হওয়ায় তাই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে দোহা।
সিএনএনকে একজন আরব পর্যবেক্ষক বলেছেন, আরব দেশগুলো চায় ২০১৪ সালের মতো এবারও ক্ষমা চাক কাতার। আর কাতার পরিচালিত আল জাজিরায় জ্যেষ্ঠ মধ্যপ্রাচ্য প্রতিবেদক হাশেম আহেলবারা বলেন, ‘কাতার মনে করে এই সমন্বিত প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছে কাতারকে আরও কোনঠাসা করার জন্য। শেষ পর্যন্ত কূটনৈতিক পর্যায়েই এই সংকটের সুরাহা হতে হবে।’
(সিএনএন, বিবিসি, এপি, দ্য ইন্টারসেপ্ট, আল জাজিরা, উইকিপিডিয়া অবলম্বনে।)
তেল ও তরল গ্যাসে সমৃদ্ধ কাতার মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে ছোট দেশগুলোর একটি। কিন্তু দেশটির নাগরিকরা পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ৩৩৫০০ কোটি ডলারের বিনিয়োগ আছে দেশটির। এবারের আগে ২০১৪ সালে ও ১৯৯৫ সালে কাতারের সঙ্গে উপসাগরীয় তিন দেশ সৌদি আরব, আমিরাত ও বাহরাইনের সম্পর্কে উত্তেজনা দেখা দেয়।
১৯৯৫ সালে কাতারের তৎকালীন আমির খলিফা বিন হামাদ আল থানিকে তারই ছেলে পদচ্যুত করে ক্ষমতা দখল করেন। তখন খলিফা বিন হামাদ আল থানিকে আবুধাবিতে আশ্রয় দেয় আমিরাত। এ ঘটনায় ক্ষুদ্ধ তার ছেলে ও আমির হামাদ বিন খলিফা আল থানি আমিরাত, সৌদি আরব ও বাহরাইনের বিরুদ্ধে তাকে নিয়ে ষড়যন্ত্র করার অভিযোগ আনেন। তবে তিন দেশই এ অভিযোগের বিরোধীতা করে।
এছাড়া ২০১৪ সালে মিশরের মুসলিম ব্রাদারহুডকে সমর্থনদানের অভিযোগ এনে কাতার থেকে নিজেদের রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার করে এই তিন দেশ ও মিশরের সামরিক শাসক আবদেল ফাতাহ আল সিসি। পরে অবশ্য সমঝোতা হয় দু’ পক্ষের মধ্যে। ২০১৪ সালে তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন কিছু ইমেইল আদানপ্রদান করেন, যা পরে উইকিলিকস ফাঁস করে। ওই ইমেইলে দেখা যায়, হিলারি বলছেন, সৌদি আরব ও কাতার মধ্যপ্রাচ্যে আধিপত্য বিস্তারের প্রতিযোগিতা করছে সিরিয়ায় বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীকে সহায়তা করার মাধ্যমে। এবারের বিরোধ মূলত ইরান ও ব্রাদারহুডকে কাতারের সমর্থন দেওয়া নিয়ে সূত্রপাত।
ইরান/শিয়া ফ্যাক্টর
কাতারের প্রায় ১০ শতাংশ নাগরিক শিয়া মুসলিম। এছাড়া ঐতিহ্যগতভাবেই কাতারের শীর্ষ কিছু ব্যবসায়ী পরিবারও শিয়া। সুন্নি সংখ্যাগরিষ্ঠ উপসাগরীয় আরব দেশগুলোতে শিয়ারা কোণঠাসা থাকলেও, কাতারে পরিস্থিতি একেবারে বিপরীত। সেখানে শিয়ারা তুলনামূলক অনেক ধর্মীয় ও রাজনৈতিক সুবিধা ভোগ করেন। শিয়া-সুন্নি বিরোধের ব্যাপারে শাসকগোষ্ঠীও সতর্ক। শিয়া সংখ্যালঘুদের ওপর যেকোন হামলার ব্যাপারে রাজপরিবার নিন্দা জানিয়েছে।
সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত প্রায় নিয়মিতভাবেই শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ ইরানের সমালোচনা করলেও, কাতার এ থেকে বিরত থেকেছে। কারণ, তেল ও গ্যাস খাতে ইরানের সঙ্গে কাতারের সম্পর্ক অনেক নিবিড়। অনেক বড় তেল ও গ্যাস খনিতে যৌথ আংশীদারিত্ব আছে দুই দেশের।
২০১৫ সালে ইরানের সঙ্গে পরাশক্তিধর ৫টি দেশের চুক্তির পর, পারমাণবিক কর্মসূচি সীমিত করার বিনিময়ে বিপুল আর্থিক ছাড় পায় ইরান। এছাড়া দেশটিতে বৈদেশিক বিনিয়োগের পথও তৈরি হয়। এর পর থেকেই ইরানকে নিজেদের এক নম্বর শত্রু জ্ঞান করছে সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন দেশগুলো।
এছাড়া, লেবানন, সিরিয়া, ইরাক ও ঘরের কাছে ইয়েমেনে ইরানের সরাসরি প্রভাবের কারণে উদ্বিগ্ন সৌদি আরব। সিরিয়া-ইরাকে সৌদি আরবের সমর্থনপুষ্ট বিদ্রোহীরা লড়ছে ইরানের মিত্র বাশার আল আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে। ইয়েমেনে ইরান সমর্থিত হুতি বিদ্রোহীরা দেশটি দখলে নিয়ে নিয়েছে। প্রতিক্রিয়ায় সৌদি আরব সামরিক হামলা শুরু করলেও প্রত্যাশিত বিজয় পায়নি।
অবশ্য, ইয়েমেনে সৌদি নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটে ছিল কাতার। এছাড়া সিরিয়া-ইরাকে জঙ্গি-গোষ্ঠী আইএস বিরোধী মার্কিন সামরিক জোটেও অংশ আছে কাতারের। কিন্তু ইরানের সঙ্গে কাতারের ঘনিষ্ঠতা সন্দেহের দৃষ্টিতেই দেখেছে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত।
অপরদিকে শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ বাহরাইনে সুন্নি শাসক বিরাজমান। এই শাসকগোষ্ঠী সৌদি ও আমিরাতি সমর্থনপুষ্ট। বাহরাইনে শিয়ারা গণঅভ্যুত্থান করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু সৌদি সাহায্যে টিকে যায় সুন্নি শাসক পরিবার। আর অভ্যুত্থানের জন্য ইরানকে দায়ী করে বাহরাইন সরকার। এছাড়া কাতারের বিরুদ্ধেও বিভিন্ন গোষ্ঠীকে সহযোগিতা দেওয়ারও অভিযোগ আনে দেশটির। আর লিবিয়ায় প্রতিপক্ষ বিভিন্ন গোষ্ঠীকে সহায়তা দিয়েছে আমিরাত ও কাতার।
ব্রাদারহুড ও আল জাজিরা
মিশরে কাতার মুসলিম ব্রাদারহুডকে সমর্থন দিয়ে থাকে। মিশরে মুসলিম ব্রাদারহুডের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসিকে সামরিক বাহিনী উৎখাত করলে এর নিন্দা জানায় কাতার। পালিয়ে আসা অনেক ব্রাদারহুড নেতাকে আশ্রয়ও দেয় দেশটি। এছাড়া ব্রাদারহুডের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ফিলিস্তিনি সংস্থা হামাসকেও সমর্থন দেয় কাতার। হামাসের প্রভাবশালী নেতা খালেদ মেশাল এখন দোহায় থাকেন। ফলে, অবধারিতভাবেই মিশরের বর্তমান সামরিক শাসক আবদেল ফাতাহ আল-সিসি কাতারকে শত্রু জ্ঞান করেন। সিসির পেছনে সমর্থন আছে সৌদিরও। কারণ, রাজতন্ত্র বিরোধী ব্রাদারহুডকে অপছন্দ করে সৌদি, আমিরাত ও বাহরাইন। ব্রাদারহুড মিশর ছাড়াও, সৌদি আরব ও অন্যান্য আরব দেশে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে নিবন্ধিত। এ কারণে ব্রাদারহুড নেতৃবৃন্দকে কাতার আশ্রয় দেওয়ায় দেশটির উপর নাখোশ হয় এই চার আরব দেশ। ২০১৩ সালে মুরসিকে উৎখাতের সময় কাতার ব্রাদারহুডের সমর্থনে এগিয়ে আসার জেরে দেশটি থেকে রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার করে তারা। তখনই জিসিসি থেকে কাতারকে বহিষ্কারের আলোচনা চলছিল। পরে কুয়েতের মধ্যস্থতায় সব ঠিক হয়। বিনিময়ে কাতার কয়েকজন ব্রাদারহুড নেতাকে বহিষ্কার করে।
তবে দৃশ্যত, দেশ দু’টোর সম্পর্কোবনতি অতটা প্রকাশ্যে ছিল না। কিন্তু কাতারের অর্থায়নে পরিচালিত মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে প্রভাবশালী টিভি স্টেশন আল জাজিরাকে নিয়ে অস্বস্তি ছিল বিভিন্ন আরব দেশে। মিশরে আরব বসন্তের প্রচার ও মুরসিকে সমর্থন দেওয়ায় আল জাজিরা নিষিদ্ধ। আর সৌদি আরব, বাহরাইন ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে আল জাজিরার কার্যক্রম নিয়ে উষ্মা ছিল।
ফেক নিউজ থেকে সংকট
তবে বর্তমানের এই কূটনীতিক অচলাবস্থার সৃষ্টি একটি ‘ফেইক নিউজ’ থেকে। কয়েকদিন আগে কাতারের রাষ্ট্রায়ত্ত মিডিয়া ও সোস্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টে দেশটির আমির তামিম বিন খলিফা আল থানির একটি বক্তব্য প্রকাশিত হয়। এতে তিনি ইরানের প্রতি শত্রুতা পোষণ করা উচিৎ নয় বলে মন্তব্য করেন। এছাড়া ব্রাদারহুড ও হামাসের প্রশংসা করেন। সমালোচনা করেন মার্কিন পররাষ্ট্র নীতির। এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় আল জাজিরা সহ কাতারের বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম ব্লক করে দেয় সৌদি আরব, মিশর, বাহরাইন ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। কিন্তু কাতার দাবি করে, রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদ সংস্থার ওয়েবসাইট হ্যাক করে আমিরের ভুয়া বক্তব্য প্রচার করা হয়েছে। কাতার এই ঘটনার তদন্ত করারও প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু ওই চার দেশের সংবাদমাধ্যমগুলোতে এই দাবি ধোপে টিকেনি। এই দেশগুলোর প্রত্যেকটি বড় সংবাদ মাধ্যমে কাতারের দাবিকে প্রত্যাখ্যান করে বলা হয়েছে, এই মন্তব্য আসলেই করা হয়েছে। এখন চাপে পড়ে হ্যাকের অজুহাত দিচ্ছে কাতার। কিন্তু ওই ফেইক নিউজ সৃষ্ট উত্তেজনায় দমে যায়নি কাতার। বরং, কয়েকদিন পরই নব নির্বাচিত ইরানি প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানিকে ফোন করে অভিনন্দন জানিয়েছেন কাতারের শাসক।
ফের ইরান...
কাকতালীয়ভাবে, এই ফেক নিউজ কেলেঙ্কারি ঘটে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের সৌদি আরব পর। ওই সফরে উপস্থিত ছিল কাতার। ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাতও করেন কাতারের আমির। সৌদি আরবে এক সম্মেলনে, সুন্নি মুসলিম দেশগুলোর উপস্থিতিতে ট্রাম্প ঘোষণা করে, বিশ্বে সন্ত্রাসবাদের মূল হোতা ইরান।
কাউন্সিল অব ফরেইন রিলেশন্স থিংকট্যাংকের জ্যেষ্ঠ ফেলো গেইল জেম্যাক লেমন বলেন, ‘মূলত, দুইটি থিওরি এখন কাজ করছে। একটি হলো, ডনাল্ড ট্রাম্পের সফরের পর সৌদি আরব সাহস পেয়েছে। আর ট্রাম্প প্রশাসন ইরান নিয়ে কড়া অবস্থান নিয়েছে, যেখানে ইরানকে সমর্থন দেয় কাতার। আরেকটি থিওরি হলো, গত এক মাসের উত্তেজনার ফলেই এই অবস্থা। কাতারের সরকারী সংবাদ সংস্থার ওই ফেক নিউজের পরেই সব তুঙ্গে উঠেছে।’
ট্রাম্পের সৌদি সম্মেলনে যোগদানের পূর্বে কাতার অভিযোগ করে, আরব কয়েকটি দেশের সংবাদ মাধ্যমে অ্যান্টি-কাতার সংগঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট লোকেরা মতামত কলাম লিখছে। এসব কলামে কাতারকে সন্ত্রাসবাদের জন্য দায়ী করা হচ্ছে। এ ধরণের একটি সংগঠন ছিল ফাউন্ডেশন ফর ডিফেন্স অব ডেমোক্রেসিস (এফডিডি)। ইসরাইলপন্থী এই সংগঠনটি আবার ইরানের কড়া বিরোধী।
মজার ব্যাপার হলো, দুই দিন আগে হাফিংটন পোস্ট, দ্য ইন্টারিসেপ্ট ও দ্য ডেইলি বিস্টে এক হ্যাকার কিছু ফাইল পাঠায়। সেখানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রভাবশালী রাষ্ট্রদূত ইউসেফ আল ওতাইবার হ্যাককৃত ইমেইল। এই ইমেইলে দেখা যায়, এফডিডি’র সঙ্গে ঘনিষ্ঠ উঠাবসা রয়েছে আমিরাত রাষ্ট্রদূতের। এফডিডি’র অনেক আলোচ্যসূচিতে কাতার, ব্রাদারহুড, তুরস্ক ও কুয়েত অন্তর্ভূক্ত ছিল। কাতার ও কুয়েতের বিরুদ্ধে প্রচার চালানোর কথাও উঠেছে। তুরস্কের শাসক দলের সঙ্গেও ব্রাদারহুডের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। একটি ইমেইলে নাম ছিল সাবেক মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রবার্ট গেটসও। রবার্ট গেটস আমিরাতে বেশ সমাদৃত। সেখানে কাতার ও আল জাজিরার সমালোচনা করা হয়। রাষ্ট্রদূত আল ওতাইবা এক কথোপকথনে কাতার থেকে মার্কিন সেনা ঘাঁটি সরিয়ে নেওয়ারও প্রস্তাব দেন। এই সংবাদ প্রকাশের একদিন পরই কাতারের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা দেয় চার দেশ।
পরিণতি কী?
এবারের সম্পর্কচ্ছেদ ২০১৪ সালের উত্তেজনার তুলনায় অনেক কঠোর। ২০১৪ সালে শুধুমাত্র রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার করেই খ্রান্ত ছিল সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন চার দেশ। কিন্তু এবার কূটনীতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার পাশাপাশি কাতারের সঙ্গে নৌ ও বিমান যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সৌদি আরব স্থল সীমান্তও বন্ধ করে দিয়েছে। কাতারি কূটনীতিকদের দেশত্যাগের ৪৮ ঘন্টা ও নাগরিকদেরকে দুই সপ্তাহের মধ্যে এসব দেশ ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ সুয়েজ খালের মালিক মিশর বলেছে, কাতারকে কোন বন্দর ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না। এছাড়া ইয়েমেনে সৌদি নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট থেকে কাতারকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তবে জিসিসিতে কাতারের অবস্থান কী হবে, জানা যায়নি।
২০১৪ সালের বিরোধের সময় কাতারের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসে অর্থায়নের অভিযোগ আনে মিশর। তবে তখন বিরোধীতা সত্ত্বেও এই অভিযোগের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয় উপসাগরীয় তিন দেশ সৌদি, আমিরাত ও বাহরাইন। তবে এবার চার দেশই ‘মুসলিম ব্রাদারহুড, আল কায়দা ও আইএস সহ সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে কাতারের অর্থায়ন ও সমর্থন’কে সম্পর্ক ছিন্ন করার কারণ হিসেবে তুলে ধরেছে।
প্রাথমিকভাবে চুপ থাকার পর, কাতার এই সম্পর্ক ছিন্ন করার কড়া প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। এক সরকারী বিবৃতিতে কাতার বলেছে, এই সম্পর্ক ছিন্ন করার কোন যৌক্তিকতা নেই। কড়া ভাষায় লেখা প্রতিক্রিয়ায় বলা হয়, ‘এর উদ্দেশ্য পরিষ্কার। সেটি হলো, এই রাষ্ট্রের ওপর নিজেদের অভিভাবকত্ব প্রয়োগ করা। এটি কাতারের স্বার্বভৌমত্বের লঙ্ঘণ।’
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রী বলেছেন, নিজেদের মধ্যকার বিরোধ আলাপ আলোচনার মাধ্যমে মিটিয়ে ফেলা ভালো। জিসিসি ঐক্যবদ্ধ থাকাটাই সবার স্বার্থের পক্ষে। তবে তিনি মনে করেন, এই সম্পর্কচ্ছেদের কারণে সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ে কোন প্রভাব পড়বে না। উল্লেখ্য, কাতারে মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে বড় মার্কিন ঘাঁটি অবস্থিত।
যে-ই ইরানকে নিয়ে এত জল ঘোলা হলো, সেই ইরানও প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। ইরানের প্রেসিডেন্টের ডেপুটি চীফ অব স্টাফ হামিদ আবুতালেবি টুইট করেছেন, ‘কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন বা সীমান্ত বন্ধ করার যুগ এখন আর নেই। সংকট সমাধানের উপায় এটি নয়।’ ইয়েমেনে আরব জোট বাহিনীর সামরিক হস্তক্ষেপের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমি আগে যেমনটা বলেছি, আগ্রাসন ও দখলদারিত্ব অস্থিতিশীলতা ছাড়া কিছু বয়ে আনে না।’
কাতারের ওপর এই পরিস্থিতির নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। তবে সরকারী বিবৃতিতে দেশবাসীকে আশ্বস্ত করে বলা হয়েছে, তাদের প্রাত্যাহিক জীবনে এই সম্পর্কচ্ছেদের কোন প্রভাব পড়বে না। তবে ইতিমধ্যে আরব আমিরাতের জাতীয় বিমান পরিবহণ সংস্থা ইত্তিহাদ এয়ারওয়েজ মঙ্গলবার থেকে কাতারে আর যাত্রী আনা নেওয়া না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে একই পদক্ষেপ নেয় দুবাই ভিত্তিক দুই জনপ্রিয় এয়ারলাইন এমিরেটস ও ফ্লাইদুবাই। অপরদিকে কাতারের জনপ্রিয় বিমান সংস্থা কাতার এয়ার ওয়েজও এই চার দেশে উঠানামা করতো। তাই ক্ষতিগ্রস্থ হবে কাতার। মধ্যপ্রাচ্যে প্রবেশের জন্য জর্দান, ইরান ও ইরাক এবং ইউরোপে যাতায়াতের জন্য ইরান বা তুরস্ক হয়ে যেতে হবে।
আর্থিক বাজারে এই সম্পর্কহানির প্রভাব পড়েছে। তেলের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। কাতারের শেয়ার স্টকের মূল্য হ্রাস পেয়েছে। মিডলইস্ট ইন্সটিটিউটের জ্যেষ্ঠ ফেলো চার্লস লিস্টার বলেছেন, কাতার খাদ্যদ্রব্য আমদানির জন্য সৌদি আরবের ওপর নির্ভরশীল। স্থলসীমান্ত বন্ধ হওয়ায় তাই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে দোহা।
সিএনএনকে একজন আরব পর্যবেক্ষক বলেছেন, আরব দেশগুলো চায় ২০১৪ সালের মতো এবারও ক্ষমা চাক কাতার। আর কাতার পরিচালিত আল জাজিরায় জ্যেষ্ঠ মধ্যপ্রাচ্য প্রতিবেদক হাশেম আহেলবারা বলেন, ‘কাতার মনে করে এই সমন্বিত প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছে কাতারকে আরও কোনঠাসা করার জন্য। শেষ পর্যন্ত কূটনৈতিক পর্যায়েই এই সংকটের সুরাহা হতে হবে।’
(সিএনএন, বিবিসি, এপি, দ্য ইন্টারসেপ্ট, আল জাজিরা, উইকিপিডিয়া অবলম্বনে।)
No comments