বাজেট নিয়ে স্বস্তিতে নেই আওয়ামী লীগ
২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে স্বস্তিতে নেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। বাজেটে ভ্যাট ও ব্যাংকে আমানতের ওপর শুল্কের হার বৃদ্ধি, রফতানিতে উৎসে কর, করপোরেট ট্যাক্স না কমানো এবং সঞ্চয়পত্রে সুদের হার কমানোর প্রস্তাবে ুব্ধ সংশ্লিষ্ট মহল। বিশেষ করে আশ্বাসের পরও ভ্যাটের হার না কমানো এবং ব্যাংকে আমানতের ওপর শুল্কের হার বৃদ্ধির প্রস্তাবে বাজেট নিয়ে সমালোচনার ঝড় বইছে দেশজুড়ে। অর্থনীতিবিশ্লেষক ছাড়াও ফেসবুক, টুইটারসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরকার এবং অর্থমন্ত্রীর সমালোচনায় মুখর সর্বস্তরের মানুষ। বিষয়টি সরকারের নীতি নির্ধারকদের বেশ বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে। এমন প্রেক্ষাপটে টনক নড়ছে সরকারের নীতিনির্ধারকদের। বাজেটে জনগণের আকাক্সক্ষার বিষয়গুলো সমাধানের আশ্বাসও দিচ্ছেন তারা। প্রস্তাবিত বাজেটের বেশ কিছু বিষয় সংশোধনে অর্থ প্রতিমন্ত্রীর ইঙ্গিতের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বলেছেন, ‘বাজেট কেবল পেশ করা হয়েছে। তা সংসদে এখন আলোচনা হবে। আলোচনা শেষে কোনো দুর্বলতা থাকলে তা সংশোধন করা হবে।’ বাজেটে ব্যাংকে আবগারি শুল্ক বাড়ানোর প্রস্তাব সংশোধনের কথা জানিয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গতকাল সোমবার বলেছেন, ‘এটা সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসা হবে। জনগণের কোনো ধরনের তি হয় এমন বাজেট জনবান্ধব সরকার গ্রহণ করবে না। আবগারি শুল্ক নিয়ে কোনো রাজনীতি করার সুযোগ নেই। এটা পরিবর্তন করে সহনীয় পর্যায়ে আনা হবে। গত বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জন্য এ যাবৎকালের সর্ববৃহৎ ৪০০,২৬৬ কোটি টাকার বাজেট পেশ করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত। ‘উন্নয়নের মহাসড়কে বাংলাদেশ : সময় এখন আমাদের’ শীর্ষক এ বাজেটে ব্যবসায়ীদের দাবি পুরোপুরি উপেক্ষা করে শেষ পর্যন্ত ভ্যাটের নতুন হার ১৫ শতাংশই রাখা হলো।
১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া নতুন অর্থবছরে ব্যবসায়ীরা এই হারেই ভোক্তাদের কাছ থেকে ভ্যাট আদায় করবেন। এর ফলে এক বছরেই ভ্যাটের মাধ্যমে জনগণের পকেট থেকে নিয়ে নেয়া হবে প্রায় লাখ কোটি টাকা। বর্ধিত এই ভ্যাটের হারে নির্দিষ্ট আয়ের মানুষেরা চাপে পড়লেও অর্থমন্ত্রী সাফ জানিয়ে দেন, ‘আগামী তিন বছর ১৫ শতাংশ হারেই ভ্যাট আদায় করা হবে।’ শুধু তা-ই নয়, ব্যাংকে আমানতের ওপর শুল্ক হার বৃদ্ধি এবং সঞ্চয়পত্রে সুদের হার কমানোরও প্রস্তাব করেন তিনি। এ ছাড়া রফতানিতে উৎসে কর, করপোরেট ট্যাক্স না কমানোর প্রস্তাবে ুব্ধ সংশ্লিষ্ট মহল। বিশ্লেষকেরা এ বাজেটকে ‘ভ্যাটের মহাসড়কে দেশ’ বলেও মন্তব্য করেন। বিশেষ করে ব্যাংক আমানতে শুল্ক বৃদ্ধির প্রস্তাবের সমালোচনা করে তারা বলছেন, এ প্রস্তাবের ফলে মানুষ ব্যাংকবিমুখ হয়ে অবৈধ লেনদেনের দিকে ঝুঁকবে। এতে অনিরাপদ ও ঝুঁকিপূর্ণ খাতে বিনিয়োগের সম্ভাবনা দেখা দেবে। অর্থমন্ত্রীর এ প্রস্তাবে বিভিন্ন গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরকারের সমালোচনায় মুখর সাধারণ মানুষ। ুব্ধ মানুষদের আগুনে ঘি ঢালার মতো হয় বাজেটের পরদিন শুক্রবার অর্থমন্ত্রীর আরেক মন্তব্য। তিনি বললেন, ‘ব্যাংকে লাখ টাকা আমানতকারীরা যথেষ্ট সম্পদশালী।’ সংবাদ সম্মেলনে তার এ মন্তব্যের পর যোগাযোগ মাধ্যমে নিন্দা-ধিক্কারের ঝড় বইছে। নানা ধরনের ব্যঙ্গাত্মক কার্টুনে ক্ষোভ প্রকাশ করছে মানুষ। সমালোচনাকারীরা বলছেন, হলমার্ক ও বিসমিল্লাহ কেলেঙ্কারি নিয়ে এ অর্থমন্ত্রীই বলেছিলেন, ‘৪ হাজার কোটি টাকা কিছুই না।’ এখন তিনিই আবার বলছেন, ‘এক লাখ টাকার আমানতকারীরা সম্পদশালী।’ আসলে তার কথার কোনো ঠিক নেই। সমালোচনাকারীদের কেউ কেউ অর্থমন্ত্রীকে ‘বয়সের ভারে ন্যুব্জ’ উল্লেখ করে রাজনীতিকদের অবসরের বয়সসীমা নিরূপণেরও তাগিদ দেন। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক সূত্র জানায়, সরকারের এ মেয়াদে বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য বড় ধরনের আর্থিক ফান্ড প্রয়োজন। কিন্তু সরকারের হাতে সময় আছে দেড় বছরেরও কম সময়। জাতীয় নির্বাচনের আগে এটিই সরকারের পূর্ণাঙ্গ বাজেট। আগামী অর্থবছরে মাত্র অর্ধবার্ষিক বাজেট দিতে পারবে তারা। সে জন্য এবারের বাজেটকে টাকা নেয়ার বড় উপায় হিসেবে বেছে নিয়েছে সরকার। তাই ভ্যাট হার ১৫ শতাংশ নির্ধারণসহ ট্যাক্সের আওতা বৃদ্ধি এবং ব্যাংকের টাকার ওপর নজর দিয়েছে সরকার। এ বাজেটে জনগণের ওপর বড় ধরনের চাপ পড়লেও নির্বাচনের আগের অর্ধ বার্ষিক বাজেটে তা পুষিয়ে দেয়া হতে পারে। এতে সাধারণ মানুষ এবারের বাজেটের কথা ভুলে গিয়ে ওই বাজেটের সুফল ভোগ করবে এবং নির্বাচনে আবারো আওয়ামী লীগকেই বেছে নেবে। এক কথায় সরকারের বিশাল অঙ্কের টাকার সঙ্কুলান এবং আগামী নির্বাচনের কথা মাথায় রেখেই এবারের বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা আলাপকালে বলেন, এ বাজেটে মধ্যবিত্তের ওপর চাপ পড়লেও কিছু বিষয় অতি মাত্রায় বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে। বিশেষ করে ভ্যাট এবং আমানতের ওপর শুল্ক বৃদ্ধির বিষয়টি। এ দুইটি বিষয় নিয়ে সাধারণ মানুষের মতো সরকারের ভেতরেও বেশ সমালোচনা হচ্ছে। ক্ষমতাসীন দল হিসেবে বাজেটকে সমর্থন দিতে হয়। সে জন্য কেউ হয়তো সরাসরি সমালোচনা করতে পারছেন না। তবে দলের বিভিন্ন ফোরাম এবং ঘরোয়া আলোচনায় এসব বিষয়ে বেশ সমালোচনা চলছে। ক্ষমতাসীন ১৪ দলের শরিকরাও বাজেট নিয়ে দলীয় ফোরামে অনেক সমালোচনা করছেÑ যা সরকারের জন্য চরম বিব্রতকর। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ নয়া দিগন্তকে বলেন, ‘বাজেট কেবল পেশ করা হয়েছে, পাস হয়নি। সংসদে আলোচনার পরই তা পাস হবে। আওয়ামী লীগের রাজনীতি সাধারণ মানুষের জন্য। আর জনগণের ক্ষতি হয় এমন কোনো সিদ্ধান্ত সরকার নেবে না। বাজেটে বিতর্কিত বিষয়গুলো জনস্বার্থে সংশোধনের সুযোগ রয়েছে।’ দলের অন্যতম সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘বাজেট নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা ও সমালোচনা হবে, এটাই স্বাভাবিক। আর এটাই গণতান্ত্রিক সরকারের বৈশিষ্ট্য। এখানে বিব্রত হওয়ার কিছু নেই। সংসদে আলোচনার পর জনগণের জন্য কল্যাণকর হলে যেকোনো বড় বিষয়ও সংশোধন হতে পারে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ইতোমধ্যে এ ব্যাপারে ইঙ্গিত দিয়েছেন।’
No comments