আবগারি শুল্কারোপে অর্থমন্ত্রীর কঠোর সমালোচনা সংসদে
ব্যাংকের আমানতের ওপর আবগারী শুল্ক আরোপের বিরুদ্ধে সরকার ও বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা কঠোর সমালোচনা করে বলেছেন, আগে ব্যাংকে সুদ থেকে শুল্ক কাটা হতো, এবারের বাজেটে জনগণের গচ্ছিত আসল টাকাতেই হাত দেয়া হয়েছে। এতে সরকারের শুধু ইমেজই ক্ষুণ্ন হয়নি, ভোট ব্যাংকেও আঘাত হানবে। জবাবে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, এটি নতুন কোনো কর নয়। বহু বছর ধরেই মানুষ এই কর দিয়ে যাচ্ছে। এবারের বাজেটে আমি শুধু করের হার একটু বাড়িয়েছি। আর আমি কখনোই জাতীয় পার্টি করিনি, এ দলটির সদস্য কিংবা মন্ত্রীও ছিলাম না। আজ মঙ্গলবার প্রথমে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী এবং পরে ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বি মিয়ার সভাপতিত্বে সম্পূরক বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে অর্থমন্ত্রী ও সংসদ সদস্যরা এসব কথা বলেন। পরে কন্ঠভোটে সম্পূরক বাজেট জাতীয় সংসদে পাস হয়। আলোচনায় অংশ নেন সরকারি দলের আ খ ম জাহাঙ্গীর হোসাইন, অ্যাডভোকেট সোহরাব উদ্দিন, মেজর জেনারেল (অব.) এটিএম আবদুল ওয়াহাব, জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদ, ফখরুল ইমাম ও নুরুল ইসলাম ওমর। আলোচনায় অংশ নিয়ে সমাপনী বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, অনেকে বলেছেন, আমি নাকি জাতীয় পার্টির মন্ত্রী হিসেবে সংসদে প্রথম বাজেট দিয়েছি।
বাস্তবে এটি ঠিক নয়। আমি কখনো জাতীয় পার্টি করিনি, জাতীয় পার্টির সদস্য বা মন্ত্রীও ছিলাম না। হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ সাহেব একজন স্বজ্জন মানুষ। উনি যখন অন্তবর্তীকালীন সরকার প্রধান হন, তখন ওই অন্তবর্তীকালীন সরকারের অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করি। ওই সময় আমার সঙ্গে তার কথা হয়েছিল, আমি কোনো দলের সদস্য হব না। এরশাদ দল করলে মন্ত্রী থেকে চলে যাব। দেশের একমাত্র মন্ত্রী হিসেবে আমি পদত্যাগপত্র দিয়ে পদত্যাগ করেছি। এর আগে জাতীয় নেতা তাজউদ্দীন আহমদ পদত্যাগ করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বলেন, ১৯৮৩ সালে এরশাদ সাহেব আমাকে বললেন, আমি একটি পার্টি করবো। আপনি থাকেন। আমি বলেছি, আমার সিদ্ধান্তে আমি অটল। রাজনৈতিক দলে থাকতে পারবো না। তখন তিনি আমাকে বললেন, আপনি যেতে পারেন। আমি পদত্যাগ করলাম। তখন আমাকে বলা হলো দল গঠনে আরও কিছুদিন বিলম্ব হবে। আপনি মন্ত্রী থাকেন। আমি থাকলাম। পরে ১৯৮৪ সালের ৮ জানুয়ারি আমাকে এরশাদ সাহেব বিদায় দিলেন। অত্যন্ত সদয় বিদায় দিয়েছিলেন মন্ত্রিসভায় অনুষ্ঠান করে। এজন্য সাবেক রাষ্ট্রপতি চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদকে ধন্যবাদও জানান অর্থমন্ত্রী। সম্পূরক বাজেট প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বলেন, প্রত্যেকটা খরচের জন্য সংসদ অনুমতি দেয়। বাজেট বরাদ্দের অতিরিক্ত ব্যয় হলেও সংসদের অনুমতি নিতে হয়। সব টাকা দেয়ার ক্ষমতা একমাত্র সংসদের। ব্যাংকের কর ধার্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটি নতুন কোনো কর নয়। বহু বছর ধরে মানুষ তা দিয়ে যাচ্ছে। আমি শুধু কর একটু বাড়িয়েছি। দেশ থেকে টাকা পাচার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিদেশে টাকা পাচার রোধে যেসব প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে সেটা বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। টাকা পাচার বেআইনি। দেশে কালো টাকা তৈরির সুযোগ কমাতে অনেক ব্যবস্থা নিয়েছি। আগামী মাসের মধ্যে দেখবেন কী কী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। কালো টাকা সাদা করার সুযোগ নাকচ করে দিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, কালো টাকা সাদা করার প্রস্তাব কয়েক বছর ধরে দিচ্ছি না। তবে নিয়মিতভাবে কালো টাকা সাদা করার আইন বাংলাদেশে আছে, সেক্ষেত্রে শতকরা ২০ ভাগ জরিমানা দিয়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রয়েছে।
সঞ্চয়পত্র প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বলেন, সঞ্চয়পত্রে যে সুদের হার রয়েছে, তা কিছুটা কমানো হবে। তবে বাজারে যে সুদের হার রয়েছে তার চেয়ে দুই ভাগ বেশি হবে। রেমিট্যান্স কমার কারণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অনেক প্রবাসীই বিদেশে স্থায়ী হচ্ছেন, সেখানে বিপুল পরিমাণ অর্থ রাখছেন। বেসরকারি সূত্রে রেমিটেন্স প্রবাহ বৃদ্ধির জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। সহজশর্তে রেমিটেন্স দেশে পাঠাতে পারেন সেজন্য একটি স্ক্রিম তৈরি করছি। আগামী দু’মাসের মধ্যে তা বাস্তবায়ন করা হবে। ৮৪ বছরের অভিজ্ঞতা ও কর্মদক্ষতা দিয়ে অত্যন্ত ভালো বাজেট দিয়েছি উল্লেখ করে আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, সম্পূরক বাজেটে যে দাবিগুলো আনা হয়েছে, তা জনগণের কল্যাণেই ব্যয় করা হয়েছে। আমি আশা করি, খুশি মনে সংসদ সদস্যরা সম্পূরক বাজেট পাস করে দেবেন। জাতীয় পার্টির ফখরুল ইমাম বলেন, একজন সিনিয়র মন্ত্রী সংসদে বলেছেন সমুদ্র কি নৌকা দিয়ে পাহারা দেওয়া যায়? আমিও তাই বলি, যায় না। গত তিন তিনবার আমরা লাঙ্গল দিয়ে আপনাদের (আওয়ামী লীগ) সাহায্য করেছি। আরও চাইলে দেয়া হবে। তিনি বলেন, এডিবি বাস্তবায়নের ৭০ শতাংশ বাকি আছে। এটা কী বাকি তিন মাসে বাস্তবায়ন সম্ভব? ব্যাংক গ্রাহকদের আমানতের ওপর আবগারি ট্যাক্স আরোপে জনগণ আতঙ্কিত। তবে কী মানুষ ব্যাংকে টাকা না রেখে বালিশের নিচে, মাটির নিচে রাখবে? আর ১২ বছরে এক লাখ কোটি টাকার গরমিল হয়েছে। ৩০ জুনের মধ্যে অর্থমন্ত্রী কীভাবে ম্যানেজ করবেন জানি না। তিনি বলেন, দেশ থেকে অবাধে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হয়ে যাচ্ছে। পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারে কোনো উদ্যোগ নেই। মেগা প্রকল্প নিয়ে সরকার মেগাজটে পড়েছে। দেশে প্রবৃদ্ধি বাড়লেও কর্মসংস্থান বাড়ছে না। অর্থনীতি ভয়াবহ অবস্থায় আছে। আশা করি অর্থমন্ত্রী সবকিছু উৎরিয়ে দেশকে এগিয়ে নেবেন। সরকারি দলের সোহরাব উদ্দিন অনাদায়ী ট্যাক্স আদায়ে ট্যাক্সেস আপীল ট্রাইব্যুনালকে আরও সক্রিয় করার পরামর্শ দিয়ে বলেন, তাহলে বাজেটের বড় একটি অংশ এখান থেকে আসতে পারে। কালো টাকা সাদা করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অপ্রদর্শিত আয় প্রকাশের সুযোগ দেওয়া উচিত। তাহলে অর্থনীতি চাঙ্গা হবে।
ব্যাংকের আমানতের ওপর আবগারী শুল্ক আরোপের বিষয়ে তিনি বলেন, এর সঙ্গে প্রান্তিক মানুষ জড়িত। আমি মনে করি না প্রধানমন্ত্রী এতে সমর্থন দেবেন। কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, জনগণের ট্যাক্সের টাকা যেনতেনভাবে খরচ করা হচ্ছে। অর্থমন্ত্রী দেশের সব মানুষকে পুতুল মনে করেন। যেন জনগণ বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে। এক লাখ কোটি টাকা বিদেশে ইতোমধ্যে পাচার হয়ে গেছে। অনেক মন্ত্রী ৯ মাস পর্যন্ত বিদেশে থাকেন, কিন্তু কী অর্জন করে নিয়ে আসেন কেউ জানে না। ব্যাংকে আবগারি শুল্ক আরোপের নামে বর্তমান সরকারের ভোট বিপুল পরিমাণ নষ্ট হয়ে গেছে। ক্ষমতার কালো চশমা পড়ে তারা তা দেখছে না। ব্যাংকগুলো অবাধ লুটপাটের জায়গায় পরিণত হয়েছে। লুটেরাদের বিচার না করে ব্যাংকগুলোকে বাঁচাতে জনগণের ওপর ট্যাক্স-ভ্যাট বসাচ্ছে। সব কালো টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, সরকার আস্তিক-নাস্তিক, বামপন্থী-চরমপন্থী সব উঠানোর কারণে নৌকা এখন ডুবুডুবু। জাতীয় পার্টির আরেক সংসদ সদস্য নুরুল ইসলাম ওমর ব্যাংক আমানতের ওপর আরোপিত আবগারি শুল্ক আরোপের কঠোর সমালোচনা করে বলেন, ব্যাংকে টাকা রাখা নিয়ে দেশের জনগণের মধ্যে তীব্র আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। যেভাবে বিষয়টি প্রচার হয়েছে তাতে আবগারী শুল্ক প্রত্যাহার করে নিলেও সরকারের যে ইমেজ ক্ষুন্ন হয়েছে তা পূরণ হবে না। তিনি বলেন, অর্থমন্ত্রী বলেন- পৃথিবীর সব দেশে নাকি ব্যাংকে চুরির ঘটনা ঘটে। কিন্তু বাংলাদেশের মতো কোথাও এভাবে সাগর চুরির ঘটনা ঘটে না।
No comments