কেমন আছেন এডওয়ার্ড স্নোডেন? by মশিউল আলম
ব্যর্থ নন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থার (এনএসএ) সাবেক কর্মী এডওয়ার্ড স্নোডেন |
দুই
বছর হতে চলল এডওয়ার্ড স্নোডেন মস্কোতে নির্বাসিত জীবন যাপন করছেন।
আমেরিকান এই যুবক মোটা বেতনের চাকরি, সুন্দরী মেয়েবন্ধু, আয়েশি জীবন ছেড়ে
স্বদেশ থেকে পালাতে বাধ্য হয়েছেন। কারণ তাঁর সরকার তাঁর বিরুদ্ধে
গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে মামলা করেছে, তাঁর দেশের রাজনীতিক ও ক্ষমতাধর
ব্যক্তিরা তাঁকে আখ্যায়িত করেছেন বিশ্বাসঘাতক, রাষ্ট্রদ্রোহী, এমনকি চোর
বলে। কেন? এই জন্য যে তিনি আমেরিকার মহাক্ষমতাধর রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান
ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সির (এনএসএ) এমন সব কর্মকাণ্ডের প্রামাণ্য তথ্য
ফাঁস করেছেন, যা করার অধিকার ওই প্রতিষ্ঠানের নেই। ব্রিটেন ও আমেরিকার
মূলধারার দুটি সংবাদপত্রের সাংবাদিকদের মাধ্যমে তিনি আমেরিকার জনগণসহ
বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁদের প্রত্যেকের ব্যক্তিগত টেলিফোন আলাপ
গোপনে রেকর্ড করছে এনএসএ। যাঁদের করের টাকায় রাষ্ট্র চলে, যাঁদের ভোটে
সরকার নির্বাচিত হয়, তাঁদের চলাফেরা থেকে শুরু করে সব কাজের ওপর গোয়েন্দা
নজরদারি করছে সরকার!
স্নোডেন একসময় মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা (সিআইএ) ও এনএসএর সঙ্গে ঠিকাদার হিসেবে কাজ করতেন। তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে অসাধারণ দক্ষতার অধিকারী এই তরুণ এনএসএর গোয়েন্দা নজরদারি কর্মসূচির বেআইনি কার্যকলাপ ধরে ফেলেন, নিজের কম্পিউটারে গোপনে কপি করে নেন এনএসএর বিপুল পরিমাণ তথ্য। ২০১৩ সালে তাঁর যোগাযোগ ঘটে আমেরিকান আইনজীবী ও সাংবাদিক গ্লেন গ্রিনওয়াল্ডের সঙ্গে, যিনি তখন ব্রিটেনের দৈনিক গার্ডিয়ান-এর জন্য লিখতেন। স্নোডেন সে সময় কর্মরত ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই দ্বীপে, আমেরিকান নিরাপত্তা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বাজ অ্যালান হ্যামিল্টনের কর্মী হিসেবে, যে প্রতিষ্ঠানটি ছিল এনএসএর ঠিকাদার। এনএসএর ‘টপ সিক্রেট’ শ্রেণির বিপুল পরিমাণ তথ্যের ভান্ডার দৈনিক গার্ডিয়ান-এর হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন স্নোডেন। তবে সেটা করার আগে তিনি আমেরিকার ভূখণ্ড ছেড়ে চলে যান হংকং। সেখান থেকেই তিনি কাজটা করেন। তাঁর দেওয়া প্রামাণ্য তথ্যের ভিত্তিতে ২০১৩ সালের জুন মাসে গ্লেন গ্রিনওয়াল্ড গার্ডিয়ান-এ লিখতে শুরু করেন ধারাবাহিক প্রতিবেদন। আমেরিকান শাসকদের মাথায় বাজ পড়ে, ক্রোধে ফেটে পড়ে হোয়াইট হাউস। এডওয়ার্ড স্নোডেন হন তাঁর স্বদেশের সরকারের কাছে ‘মোস্ট ওয়ান্টেড আমেরিকান’। তাঁর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক হুলিয়া জারি করে আমেরিকার সরকার।
হাওয়াইতে স্নোডেনের সঙ্গে একত্রবাস করতেন তাঁর গার্লফ্রেন্ড লিন্ডসে মিলস। গার্ডিয়ান-এ গ্লেন গ্রিনওয়াল্ডের সাড়া জাগানো প্রতিবেদনগুলো প্রকাশের একপর্যায়ে যখন প্রকাশ হয়ে পড়ে, ইতিহাসের সর্ববৃহৎ গোপন তথ্য ফাঁসের এ ঘটনার নেপথ্যে আছেন স্নোডেন, তখন লিন্ডসে মিলসের হাওয়াইয়ের বাসায় সরকারের লোকজন যায়। তারপর থেকে মিলস লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যান। গুজব রটে স্নোডেন তাঁকে ছেড়ে দিয়েছেন।
স্নোডেন হংকংয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে শুরু করেন, কারণ আমেরিকান সরকার হংকং কর্তৃপক্ষের ওপর চাপ দিচ্ছিল স্নোডেনকে গ্রেপ্তার করে তাদের হাতে তুলে দিতে। সেই চাপে হংকং কর্তৃপক্ষকে নতি স্বীকার করার সুযোগ না নিয়ে স্নোডেন হংকং ত্যাগ করেন। এর মধ্যে গোপনে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ ঘটে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের, যিনি আশ্রয় নিয়েছেন লন্ডনে ইকুয়েডরের দূতাবাসে। অ্যাসাঞ্জ স্নোডেনকে ইকুয়েডরে পাঠানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু হংকং থেকে বিমানে চড়ে ইকুয়েডরে পৌঁছানো স্নোডেনের পক্ষে সম্ভব হয় না; মাঝপথে তিনি থেকে যান মস্কো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ট্রানজিট লাউঞ্জে। আমেরিকার চাপে কোনো দেশের বিমান কোম্পানি স্নোডেনকে বহন করে ইকুয়েডর কিংবা কিউবা নিয়ে যাওয়ার সাহস পায় না। স্নোডেন রাশিয়ায় রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেন। রাশিয়া সঙ্গে সঙ্গে সে প্রার্থনা মঞ্জুর করে না, আমেরিকার কূটনৈতিক চাপ রাশিয়ার ওপরেও ছিল প্রচণ্ড। আর তখনো ওবামার সঙ্গে পুতিনের সম্পর্কের এতটা অবনতি ঘটেনি, যতটা ঘটেছে ইউক্রেনে রাশিয়ার ‘আগ্রাসন’ ও ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত করার পর।
তবে শেষ পর্যন্ত রাশিয়ায় স্নোডেনের ‘সাময়িক’ রাজনৈতিক আশ্রয় মেলে। তিনি প্রায় দেড় মাস পর বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে মস্কো শহরের কোনো এক অজ্ঞাত স্থানে আশ্রয় নেন। সেই থেকে তিনি মস্কোতেই আছেন। তাঁর সঙ্গে ছিল তিনটি ল্যাপটপ, কানাঘুষা চলে, তাঁর কাছে আমেরিকার যত ‘টপ সিক্রেট’ তথ্য রয়েছে, তার সবই দিয়ে দিয়েছেন রুশ গোয়েন্দা কর্তৃপক্ষকে। স্নোডেন অবশ্য এটা অস্বীকার করেন।
এসব প্রায় দুই বছর আগের ঘটনা। এ সময়ের মধ্যে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে স্নোডেনের নাম ও কাজের কথা বলা হয়েছে কদাচিৎ। বাংলাদেশে সম্ভবত আমরা তাঁকে ভুলতে বসেছি। কিন্তু তাঁকে ভোলা চলে না, তাঁর কাজের দৃষ্টান্ত আমাদের জন্যও খুব গুরুত্বপূর্ণ।
নাগরিকদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, বিশেষত তাঁদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার বিষয়টি আমাদের সমাজে তেমনভাবে উপলব্ধি করা হয় না। এই দেশে টেলিফোনে ব্যক্তিগত কথোপকথন গোপনে রেকর্ড করা হয়। কারা তা করে, কী প্রক্রিয়ায় করে, কেন, কী পরিস্থিতিতে সেগুলো ইন্টারনেটে ছেড়ে দেয়, এসব করার আইনগত অধিকার তাদের আছে কি না, এটা করা বৈধ না অবৈধ—এসব প্রশ্ন তোলা হয় না। ধরা যাক, আমি একটা বেসরকারি মোবাইল ফোন কোম্পানির সংযোগ ব্যবহার করি। সেই কোম্পানি আমাকে নিশ্চয়তা দেয় না যে তারা নিজেরা আমার কথোপকথন গোপনে রেকর্ড করবে না। এমন নিশ্চয়তাও তারা দেয় না যে তৃতীয় কোনো পক্ষ, যেমন সরকারি কোনো গোয়েন্দা সংস্থাকে তারা আমার টেলিফোন কথোপকথন রেকর্ড করতে দেবে না। আমিও তাদের কাছে এসব বিষয়ে নিশ্চয়তা দাবি করি না। এমন নিশ্চয়তা যে দাবি করা যায় এবং তা করা উচিত এবং সে দাবি পূরণ করতে মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলো যে বাধ্য (যদি তারা আমাকে গ্রাহক হিসেবে পেতে চায়)—এমন ভাবনাই আমাদের মনে কাজ করে না।
এ দেশে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব থেকে শুরু করে দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক পর্যন্ত অনেকের ব্যক্তিগত টেলিফোন কথোপকথন গোপনে রেকর্ড করে ইন্টারনেটে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ‘আমার ফোনালাপ অন্যরা রেকর্ড করতে পারল কীভাবে?’—এমন প্রশ্ন এযাবৎ কেউ সেবাদানকারী মোবাইল ফোন কোম্পানিকে করেছেন বলে আমার জানা নেই। গ্রামীণফোনের কাস্টমার কেয়ারের একাধিক কর্মী আমাকে টেলিফোনে বলেছেন, ব্যক্তিগত ফোনালাপ রেকর্ড করা ও তা ইন্টারনেটে প্রকাশের ব্যাপারে তাঁরা কোনো অভিযোগ পান না। সরকার কিংবা গোয়েন্দা সংস্থাকে এ ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞাসা করা তো অচিন্তনীয়।
কিন্তু আমেরিকান সমাজে এই উপলব্ধি প্রবল যে নাগরিকদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ভঙ্গ করার অধিকার কারও নেই। তাই স্নোডেনের কল্যাণে তাঁরা যখন জানতে পেরেছেন, তাঁদের সরকারি নিরাপত্তা সংস্থা ‘সন্ত্রাসবাদ দমনে’র নামে তাঁদের ব্যক্তিগত ফোনালাপ গোপনে, বছরের পর বছর ধরে রেকর্ড করে আসছে, তখন তাঁরা প্রতিবাদে ফেটে পড়েছেন। তাঁরা সরকারের উদ্দেশে প্রশ্ন তুলেছেন, কেন তোমরা এই অন্যায়, অবৈধ কাজ করছ? তোমরা কি আমেরিকার সংবিধান মানো না? তার ফলে কাজ হয়েছে: আমেরিকার আদালত গত মাসে রায় দিয়েছেন, নাগরিকদের ওপর এনএসএর গণগোয়েন্দাগিরি বেআইনি। ওই গোয়েন্দা কর্মসূচি বাতিল করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ওবামা। ৪ জুন নিউইয়র্ক টাইমস-এ প্রকাশিত এক নিবন্ধে এডওয়ার্ড স্নোডেন এসব অর্জনের কথা উল্লেখ করে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
কিন্তু স্নোডেন এখনো স্বদেশে ফিরতে পারছেন না। তাঁকে থাকতে হচ্ছে এমন এক দেশে, যেখানে গণতন্ত্র, নাগরিক স্বাধীনতা, ব্যক্তিগত গোপনীয়তা সুরক্ষার অবস্থা আমেরিকার থেকে বেশি শোচনীয়। যদিও বাহ্যত, মস্কোতে তিনি ভালোই আছেন, তাঁর বান্ধবী নিন্দুকদের মুখে চুনকালি দিয়ে মস্কো গিয়ে মিলিত হয়েছেন তাঁর সঙ্গে, তবু পুতিনের দেশে তাঁর মানসিক অসহায়ত্ব অনুভব করা যায়।
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
mashiul.alam@gmail.com
স্নোডেন একসময় মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা (সিআইএ) ও এনএসএর সঙ্গে ঠিকাদার হিসেবে কাজ করতেন। তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে অসাধারণ দক্ষতার অধিকারী এই তরুণ এনএসএর গোয়েন্দা নজরদারি কর্মসূচির বেআইনি কার্যকলাপ ধরে ফেলেন, নিজের কম্পিউটারে গোপনে কপি করে নেন এনএসএর বিপুল পরিমাণ তথ্য। ২০১৩ সালে তাঁর যোগাযোগ ঘটে আমেরিকান আইনজীবী ও সাংবাদিক গ্লেন গ্রিনওয়াল্ডের সঙ্গে, যিনি তখন ব্রিটেনের দৈনিক গার্ডিয়ান-এর জন্য লিখতেন। স্নোডেন সে সময় কর্মরত ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই দ্বীপে, আমেরিকান নিরাপত্তা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বাজ অ্যালান হ্যামিল্টনের কর্মী হিসেবে, যে প্রতিষ্ঠানটি ছিল এনএসএর ঠিকাদার। এনএসএর ‘টপ সিক্রেট’ শ্রেণির বিপুল পরিমাণ তথ্যের ভান্ডার দৈনিক গার্ডিয়ান-এর হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন স্নোডেন। তবে সেটা করার আগে তিনি আমেরিকার ভূখণ্ড ছেড়ে চলে যান হংকং। সেখান থেকেই তিনি কাজটা করেন। তাঁর দেওয়া প্রামাণ্য তথ্যের ভিত্তিতে ২০১৩ সালের জুন মাসে গ্লেন গ্রিনওয়াল্ড গার্ডিয়ান-এ লিখতে শুরু করেন ধারাবাহিক প্রতিবেদন। আমেরিকান শাসকদের মাথায় বাজ পড়ে, ক্রোধে ফেটে পড়ে হোয়াইট হাউস। এডওয়ার্ড স্নোডেন হন তাঁর স্বদেশের সরকারের কাছে ‘মোস্ট ওয়ান্টেড আমেরিকান’। তাঁর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক হুলিয়া জারি করে আমেরিকার সরকার।
হাওয়াইতে স্নোডেনের সঙ্গে একত্রবাস করতেন তাঁর গার্লফ্রেন্ড লিন্ডসে মিলস। গার্ডিয়ান-এ গ্লেন গ্রিনওয়াল্ডের সাড়া জাগানো প্রতিবেদনগুলো প্রকাশের একপর্যায়ে যখন প্রকাশ হয়ে পড়ে, ইতিহাসের সর্ববৃহৎ গোপন তথ্য ফাঁসের এ ঘটনার নেপথ্যে আছেন স্নোডেন, তখন লিন্ডসে মিলসের হাওয়াইয়ের বাসায় সরকারের লোকজন যায়। তারপর থেকে মিলস লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যান। গুজব রটে স্নোডেন তাঁকে ছেড়ে দিয়েছেন।
স্নোডেন হংকংয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে শুরু করেন, কারণ আমেরিকান সরকার হংকং কর্তৃপক্ষের ওপর চাপ দিচ্ছিল স্নোডেনকে গ্রেপ্তার করে তাদের হাতে তুলে দিতে। সেই চাপে হংকং কর্তৃপক্ষকে নতি স্বীকার করার সুযোগ না নিয়ে স্নোডেন হংকং ত্যাগ করেন। এর মধ্যে গোপনে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ ঘটে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের, যিনি আশ্রয় নিয়েছেন লন্ডনে ইকুয়েডরের দূতাবাসে। অ্যাসাঞ্জ স্নোডেনকে ইকুয়েডরে পাঠানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু হংকং থেকে বিমানে চড়ে ইকুয়েডরে পৌঁছানো স্নোডেনের পক্ষে সম্ভব হয় না; মাঝপথে তিনি থেকে যান মস্কো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ট্রানজিট লাউঞ্জে। আমেরিকার চাপে কোনো দেশের বিমান কোম্পানি স্নোডেনকে বহন করে ইকুয়েডর কিংবা কিউবা নিয়ে যাওয়ার সাহস পায় না। স্নোডেন রাশিয়ায় রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেন। রাশিয়া সঙ্গে সঙ্গে সে প্রার্থনা মঞ্জুর করে না, আমেরিকার কূটনৈতিক চাপ রাশিয়ার ওপরেও ছিল প্রচণ্ড। আর তখনো ওবামার সঙ্গে পুতিনের সম্পর্কের এতটা অবনতি ঘটেনি, যতটা ঘটেছে ইউক্রেনে রাশিয়ার ‘আগ্রাসন’ ও ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত করার পর।
তবে শেষ পর্যন্ত রাশিয়ায় স্নোডেনের ‘সাময়িক’ রাজনৈতিক আশ্রয় মেলে। তিনি প্রায় দেড় মাস পর বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে মস্কো শহরের কোনো এক অজ্ঞাত স্থানে আশ্রয় নেন। সেই থেকে তিনি মস্কোতেই আছেন। তাঁর সঙ্গে ছিল তিনটি ল্যাপটপ, কানাঘুষা চলে, তাঁর কাছে আমেরিকার যত ‘টপ সিক্রেট’ তথ্য রয়েছে, তার সবই দিয়ে দিয়েছেন রুশ গোয়েন্দা কর্তৃপক্ষকে। স্নোডেন অবশ্য এটা অস্বীকার করেন।
এসব প্রায় দুই বছর আগের ঘটনা। এ সময়ের মধ্যে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে স্নোডেনের নাম ও কাজের কথা বলা হয়েছে কদাচিৎ। বাংলাদেশে সম্ভবত আমরা তাঁকে ভুলতে বসেছি। কিন্তু তাঁকে ভোলা চলে না, তাঁর কাজের দৃষ্টান্ত আমাদের জন্যও খুব গুরুত্বপূর্ণ।
নাগরিকদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, বিশেষত তাঁদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার বিষয়টি আমাদের সমাজে তেমনভাবে উপলব্ধি করা হয় না। এই দেশে টেলিফোনে ব্যক্তিগত কথোপকথন গোপনে রেকর্ড করা হয়। কারা তা করে, কী প্রক্রিয়ায় করে, কেন, কী পরিস্থিতিতে সেগুলো ইন্টারনেটে ছেড়ে দেয়, এসব করার আইনগত অধিকার তাদের আছে কি না, এটা করা বৈধ না অবৈধ—এসব প্রশ্ন তোলা হয় না। ধরা যাক, আমি একটা বেসরকারি মোবাইল ফোন কোম্পানির সংযোগ ব্যবহার করি। সেই কোম্পানি আমাকে নিশ্চয়তা দেয় না যে তারা নিজেরা আমার কথোপকথন গোপনে রেকর্ড করবে না। এমন নিশ্চয়তাও তারা দেয় না যে তৃতীয় কোনো পক্ষ, যেমন সরকারি কোনো গোয়েন্দা সংস্থাকে তারা আমার টেলিফোন কথোপকথন রেকর্ড করতে দেবে না। আমিও তাদের কাছে এসব বিষয়ে নিশ্চয়তা দাবি করি না। এমন নিশ্চয়তা যে দাবি করা যায় এবং তা করা উচিত এবং সে দাবি পূরণ করতে মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলো যে বাধ্য (যদি তারা আমাকে গ্রাহক হিসেবে পেতে চায়)—এমন ভাবনাই আমাদের মনে কাজ করে না।
এ দেশে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব থেকে শুরু করে দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক পর্যন্ত অনেকের ব্যক্তিগত টেলিফোন কথোপকথন গোপনে রেকর্ড করে ইন্টারনেটে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ‘আমার ফোনালাপ অন্যরা রেকর্ড করতে পারল কীভাবে?’—এমন প্রশ্ন এযাবৎ কেউ সেবাদানকারী মোবাইল ফোন কোম্পানিকে করেছেন বলে আমার জানা নেই। গ্রামীণফোনের কাস্টমার কেয়ারের একাধিক কর্মী আমাকে টেলিফোনে বলেছেন, ব্যক্তিগত ফোনালাপ রেকর্ড করা ও তা ইন্টারনেটে প্রকাশের ব্যাপারে তাঁরা কোনো অভিযোগ পান না। সরকার কিংবা গোয়েন্দা সংস্থাকে এ ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞাসা করা তো অচিন্তনীয়।
কিন্তু আমেরিকান সমাজে এই উপলব্ধি প্রবল যে নাগরিকদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ভঙ্গ করার অধিকার কারও নেই। তাই স্নোডেনের কল্যাণে তাঁরা যখন জানতে পেরেছেন, তাঁদের সরকারি নিরাপত্তা সংস্থা ‘সন্ত্রাসবাদ দমনে’র নামে তাঁদের ব্যক্তিগত ফোনালাপ গোপনে, বছরের পর বছর ধরে রেকর্ড করে আসছে, তখন তাঁরা প্রতিবাদে ফেটে পড়েছেন। তাঁরা সরকারের উদ্দেশে প্রশ্ন তুলেছেন, কেন তোমরা এই অন্যায়, অবৈধ কাজ করছ? তোমরা কি আমেরিকার সংবিধান মানো না? তার ফলে কাজ হয়েছে: আমেরিকার আদালত গত মাসে রায় দিয়েছেন, নাগরিকদের ওপর এনএসএর গণগোয়েন্দাগিরি বেআইনি। ওই গোয়েন্দা কর্মসূচি বাতিল করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ওবামা। ৪ জুন নিউইয়র্ক টাইমস-এ প্রকাশিত এক নিবন্ধে এডওয়ার্ড স্নোডেন এসব অর্জনের কথা উল্লেখ করে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
কিন্তু স্নোডেন এখনো স্বদেশে ফিরতে পারছেন না। তাঁকে থাকতে হচ্ছে এমন এক দেশে, যেখানে গণতন্ত্র, নাগরিক স্বাধীনতা, ব্যক্তিগত গোপনীয়তা সুরক্ষার অবস্থা আমেরিকার থেকে বেশি শোচনীয়। যদিও বাহ্যত, মস্কোতে তিনি ভালোই আছেন, তাঁর বান্ধবী নিন্দুকদের মুখে চুনকালি দিয়ে মস্কো গিয়ে মিলিত হয়েছেন তাঁর সঙ্গে, তবু পুতিনের দেশে তাঁর মানসিক অসহায়ত্ব অনুভব করা যায়।
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
mashiul.alam@gmail.com
No comments