নারী নিগ্রহ- আক্রান্ত মেয়েটির পাশে রাষ্ট্র দাঁড়াক by সুলতানা কামাল
চলন্ত
মাইক্রোবাসে একজন তরুণীকে তুলে নিয়ে গণধর্ষণের ঘটনাটি আমাদের সমাজের বিকট
ও বীভৎস চেহারাই তুলে ধরেছে। এ ধরনের ঘটনা যখন শুনি কিংবা পত্রিকায় পড়ি,
তখন প্রচণ্ডভাবে বিক্ষুব্ধ হই, বিচলিত বোধ করি। ভাবি, এর প্রতিকার করা
যাঁদের দায়িত্ব তঁারা কী করছেন? এই ঢাকা শহরে এ রকম একটি ঘৃণ্য ঘটনা ঘটতে
পারল, অথচ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দুর্বৃত্তদের ধরতে পারল না। তাদের
নিস্পৃহতা ও নিষ্ক্রিয়তার সুযোগেই একের পর এক নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটে
চলেছে। অথচ অপরাধীরা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।
বাংলাদেশে যেন এক প্রতিকারহীনতার সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। পয়লা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় দুর্বৃত্তদের হাতে যে মেয়েরা নিগৃহীত হলো, সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উদাসীনতা ছিল অমার্জনীয়। সিসিটিভি বসানো হয়েছে কেন? সিসিটিভি মনিটর করার দায়িত্ব যাঁদের, তাঁরা কী করছিলেন? মেয়েদের লাঞ্ছনার ছবি সিসিটিভিতে আসার সঙ্গে সঙ্গে কেন বিষয়টি সংশ্লিষ্ট বিভাগে জানানো হলো না? আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে গেলে তো তাৎক্ষণিকভাবে দুর্বৃত্তদের ধরা যেত। এখানে তাঁরা সুস্পষ্টভাবে কর্তব্য পালনে অবহেলা করেছেন। পরবর্তীকালে সেই নারী লাঞ্ছনার প্রতিবাদ করতে গিয়েও নারীরা পুলিশের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছেন। সেই ঘটনায় কেবল পুলিশ নয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরও তাঁর ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন। তাঁকে সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি জানানোর পরও তিনি গুরুত্ব দেননি। রাষ্ট্র ও সমাজে পদাধিকারী ব্যক্তিরা যদি যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন না করেন, তাহলে অপরাধ দমন হবে কীভাবে? দুর্বৃত্তদের বিচারের আওতায় আনা যাচ্ছে না বলেই নারী লাঞ্ছনাসহ সব অপরাধের মাত্রা বেড়ে চলেছে। অপরাধীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।
বৃহস্পতিবারের রাতের ঘটনা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, দুর্বৃত্তরা পরিকল্পিতভাবে এই অপরাধ ঘটিয়েছে। তারা আগেই জানত, মেয়েটি কখন দোকানে আসে, কখন দোকান থেকে বাড়িতে যায়। তারা সুযোগ বুঝে মেয়েটির ওপর আক্রমণ চালিয়েছে। কিন্তু এই দুর্বৃত্তদের ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যদি সতর্ক দৃষ্টি রাখত, তাহলে তারা সংঘবদ্ধ হয়ে অপরাধ ঘটাতে পারত না। আরও উদ্বেগের বিষয় হলো, আগে এ ধরনের অপরাধ করত একক ব্যক্তি; অনেকটা লোকচক্ষুর আড়ালে। এখন সংঘবদ্ধ হয়ে তারা অপরাধ করছে। আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম, তখন দেখেছি একটি মেয়ে রাস্তায় একটি ছেলেকে দেখলে ভয় পেলেও একাধিক ছেলে থাকলে ভয় পেত না। ভাবত, এদের সবাই নিশ্চয়ই খারাপ নয়; কেউ না কেউ অন্যায়ের প্রতিবাদ করবে। এখন সংঘবদ্ধ হয়ে নারীর ওপর নির্যাতন চালানো হলেও সমাজ থেকে সেভাবে প্রতিবাদ হচ্ছে না। এর পেছনে এই ধারণাটিই কাজ করে যে প্রতিবাদ করে কোনো লাভ হবে না। দ্বিতীয়ত অনেক সময় প্রতিবাদ করলেও নির্যাতনের শিকার হতে হয়। এমনকি আক্রান্ত নারীর স্বজনেরা প্রতিবাদ করলে তাদের ওপরও আক্রমণ হয়। দুর্বৃত্তরা ভয়ভীতি দেখায়। অনেক ক্ষেত্রে আক্রান্ত নারী আত্মহননের পথ বেছে নেয়। এটি সামগ্রিকভাবে সমাজের অসংবেদনশীলতার ফল।
দুর্বৃত্তরা নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ার কারণেই একের পর এক নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। এই দুর্বৃত্তদের নিয়ন্ত্রণ করা যাদের দায়িত্ব, অনেক সময় দেখা যায়, তারাই তাদের সহযোগীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছে। কখনো কখনো অপরাধীরা রাজনৈতিক মহলের আশ্রয়-প্রশ্রয় পেয়ে থাকে। কিন্তু সেটি তো পাওয়ার কথা নয়। আইনের শাসনের মূল কথা হলো দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন। কিন্তু আমাদের সমাজে এর উল্টোটাই ঘটে চলেছে। রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব যাদের, তারাও জনগণের ওপর নির্ভর না করে দুর্বৃত্তদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে।
বৃহস্পতিবার রাতে যে মেয়েটি সংঘবদ্ধ দুর্বৃত্তদের হাতে নিগৃহীত হলো সে গারো সম্প্রদায়ের। সে একটি দোকানে কাজ করত; কাজ শেষে বাড়ি যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিল। এ সময়ই দুর্বৃত্তরা অস্ত্রের মুখে তাকে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায়। আমাদের সমাজের দুর্বল ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী নানাভাবেই নিগৃহীত হচ্ছে। পাহাড়ে ও সমতলে আদিবাসী মেয়েরা নিগৃহীত হচ্ছে। কিন্তু কোনো প্রতিকার হচ্ছে না। অপরাধীরা ধরা পড়ছে না। বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদছে। দুর্বৃত্তদের মধ্যে এ রকম ধারণা হয়েছে যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর কোনো মেয়ে লাঞ্ছিত হলে প্রতিবাদ হলেও হতে পারে। কিন্তু মেয়েটি যখন গারো বা আদিবাসী সম্প্রদায়ের, তখন আর তারা প্রতিবাদ করার সাহস পাবে না। একই চিত্র দেখেছি ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বেলায়। সমাজে যখন মানবিক বোধ ও চেতনা হারিয়ে যায়, তখনই এ রকম পরিস্থিতির তৈরি হয়। আমরা চাই, দুর্বৃত্তদের গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হোক। আক্রান্ত মেয়েটির পাশে রাষ্ট্র দাঁড়াক।
প্রথমেই যে প্রশ্নটি আসে তা হলো, যে গাড়িতে মেয়েটিকে তুলে নেওয়া হয়েছে, সেই গাড়ির মালিক আছেন। চালক আছেন। এ রকম ঘৃণ্য অপরাধ ঘটনার পরও সেই গাড়িটি কেন খুঁজে বের করা যাবে না? গাড়ি খুঁজে পেলে তার আরোহীদের বের করা কঠিন নয়। কোথাও নারী নিগ্রহের ঘটনা ঘটলেই অনেকে মেয়েটি কোথায় ও কেন গিয়েছিল, কী পোশাক পরেছিল, তার সঙ্গে কেউ ছিল কি না, এসব প্রশ্ন করেন। এসব প্রশ্ন তাঁরাই করেন, যাঁরা চান না মেয়েরা ঘরের বাইরে যাক। আমি তাঁদের জিজ্ঞেস করতে চাই, ছেলেরা যদি বাইরে বেরোতে পারে, মেয়েরা কেন পারবে না? কেন একটি মেয়েকে সমাজ ও রাষ্ট্র নিরাপত্তা দেবে না? একটি মেয়ে কেন ঘর থেকে নিরাপদে কাজের জায়গায় যেতে কিংবা কাজের জায়গা থেকে ঘরে ফিরতে পারবে না? দেশটা তো নারী–পুরুষ সবার।
বাংলাদেশের সংবিধানের ১০ নম্বর ধারায় জনজীবনে নারীর পূর্ণ অধিকার স্বীকৃত। ২৭ ও ২৮ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, নারী-পুরুষভেদে কোনো রূপ বৈষম্য দেখানো যাবে না। ২৮ নম্বর ধারার ক অনুচ্ছেদে সমাজের পশ্চাৎপদ অংশকে অগ্রবর্তী অংশের সমপর্যায়ে নিয়ে আসার কথা বলা হয়েছে।
আমরা যে মুক্তিযুদ্ধ করেছি, তার মূলেও ছিল নারী-পুরুষ, ধর্মবর্ণনির্বিশেষে সামাজিক ন্যায় ও সমতা। তাহলে নারীর ওপর এসব বিধিনিষেধ আরোপ করা হবে কেন? সমাজের সবক্ষেত্রে নারী সম-অধিকার ভোগ করবে, স্বাধীনভাবে চলাফেরা করবে, সেটাই সভ্য সমাজের রীতি। এ কথাও সত্য যে বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়ন হচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রে নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু রাষ্ট্র যদি তাদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়, দুর্বৃত্তদের নিবৃত্ত করতে না পারে, তাহলে আমাদের সব অর্জনই তো ধূলিসাৎ হয়ে যাবে।
রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে যখনই আমাদের আলোচনা হয়, তখন তাঁরা বলেন, অপরাধ সব সমাজে ও সব রাষ্ট্রেই ঘটছে। আমরাও স্বীকার করি, এটি পৃথিবীব্যাপী সমস্যা। কিন্তু অন্য দেশের সঙ্গে আমাদের পার্থক্য হলো, সেখানে অপরাধ করলে তার বিচারও হয়, অপরাধীরা ধরা পড়ে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের এখানে বিচার হয় না। অপরাধীরা ধরা পড়ে না। অর্থাৎ সমাজে বিচারহীনতা ও প্রতিকারহীনতার সংস্কৃতি চলছে। কোনো সমাজে বা রাষ্ট্রে যখন অপরাধ করে কেউ পার পায়, অপরাধীকে বিচারের আওতায় আনা না যায়, তাহলে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি হয়।
একটি দেশ বা সমাজে সভ্যতার মাপকাঠি হচ্ছে সেখানে অপরাধের বিচার হচ্ছে কি না। সাম্প্রতিক কালে অনেকগুলো নারী নিগ্রহের ঘটনা ঘটলেও দু-একটি ব্যতিক্রম বাদে অপরাধীরা ধরা পড়েনি। ধরা পড়লেও তাদের শাস্তি হয়নি। এই বিচারহীনতাই অপরাধীদের উৎসাহিত করছে। কেবল নারী নিগ্রহ নয়, মুক্তবুদ্ধির চর্চা যাঁরা করেন, তাঁদের ওপরও আঘাত হানছে দুর্বৃত্তরা। মুক্তবুদ্ধির কয়েকজন ব্লগার ও লেখককে হত্যা করেছে তারা। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের ধরতে পারেনি। দেশে আইনানুগ সরকার থাকা সত্ত্বেও দুর্বৃত্তরা মুক্তচিন্তার মানুষকে প্রাণনাশের হুমকি দিচ্ছে।
মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত বাংলাদেশের জন্য এর চেয়ে বেদনাদায়ক আর কী হতে পারে?
সুলতানা কামাল: আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক এবং সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা।
বাংলাদেশে যেন এক প্রতিকারহীনতার সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। পয়লা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় দুর্বৃত্তদের হাতে যে মেয়েরা নিগৃহীত হলো, সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উদাসীনতা ছিল অমার্জনীয়। সিসিটিভি বসানো হয়েছে কেন? সিসিটিভি মনিটর করার দায়িত্ব যাঁদের, তাঁরা কী করছিলেন? মেয়েদের লাঞ্ছনার ছবি সিসিটিভিতে আসার সঙ্গে সঙ্গে কেন বিষয়টি সংশ্লিষ্ট বিভাগে জানানো হলো না? আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে গেলে তো তাৎক্ষণিকভাবে দুর্বৃত্তদের ধরা যেত। এখানে তাঁরা সুস্পষ্টভাবে কর্তব্য পালনে অবহেলা করেছেন। পরবর্তীকালে সেই নারী লাঞ্ছনার প্রতিবাদ করতে গিয়েও নারীরা পুলিশের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছেন। সেই ঘটনায় কেবল পুলিশ নয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরও তাঁর ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন। তাঁকে সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি জানানোর পরও তিনি গুরুত্ব দেননি। রাষ্ট্র ও সমাজে পদাধিকারী ব্যক্তিরা যদি যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন না করেন, তাহলে অপরাধ দমন হবে কীভাবে? দুর্বৃত্তদের বিচারের আওতায় আনা যাচ্ছে না বলেই নারী লাঞ্ছনাসহ সব অপরাধের মাত্রা বেড়ে চলেছে। অপরাধীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।
বৃহস্পতিবারের রাতের ঘটনা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, দুর্বৃত্তরা পরিকল্পিতভাবে এই অপরাধ ঘটিয়েছে। তারা আগেই জানত, মেয়েটি কখন দোকানে আসে, কখন দোকান থেকে বাড়িতে যায়। তারা সুযোগ বুঝে মেয়েটির ওপর আক্রমণ চালিয়েছে। কিন্তু এই দুর্বৃত্তদের ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যদি সতর্ক দৃষ্টি রাখত, তাহলে তারা সংঘবদ্ধ হয়ে অপরাধ ঘটাতে পারত না। আরও উদ্বেগের বিষয় হলো, আগে এ ধরনের অপরাধ করত একক ব্যক্তি; অনেকটা লোকচক্ষুর আড়ালে। এখন সংঘবদ্ধ হয়ে তারা অপরাধ করছে। আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম, তখন দেখেছি একটি মেয়ে রাস্তায় একটি ছেলেকে দেখলে ভয় পেলেও একাধিক ছেলে থাকলে ভয় পেত না। ভাবত, এদের সবাই নিশ্চয়ই খারাপ নয়; কেউ না কেউ অন্যায়ের প্রতিবাদ করবে। এখন সংঘবদ্ধ হয়ে নারীর ওপর নির্যাতন চালানো হলেও সমাজ থেকে সেভাবে প্রতিবাদ হচ্ছে না। এর পেছনে এই ধারণাটিই কাজ করে যে প্রতিবাদ করে কোনো লাভ হবে না। দ্বিতীয়ত অনেক সময় প্রতিবাদ করলেও নির্যাতনের শিকার হতে হয়। এমনকি আক্রান্ত নারীর স্বজনেরা প্রতিবাদ করলে তাদের ওপরও আক্রমণ হয়। দুর্বৃত্তরা ভয়ভীতি দেখায়। অনেক ক্ষেত্রে আক্রান্ত নারী আত্মহননের পথ বেছে নেয়। এটি সামগ্রিকভাবে সমাজের অসংবেদনশীলতার ফল।
দুর্বৃত্তরা নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ার কারণেই একের পর এক নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। এই দুর্বৃত্তদের নিয়ন্ত্রণ করা যাদের দায়িত্ব, অনেক সময় দেখা যায়, তারাই তাদের সহযোগীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছে। কখনো কখনো অপরাধীরা রাজনৈতিক মহলের আশ্রয়-প্রশ্রয় পেয়ে থাকে। কিন্তু সেটি তো পাওয়ার কথা নয়। আইনের শাসনের মূল কথা হলো দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন। কিন্তু আমাদের সমাজে এর উল্টোটাই ঘটে চলেছে। রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব যাদের, তারাও জনগণের ওপর নির্ভর না করে দুর্বৃত্তদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে।
বৃহস্পতিবার রাতে যে মেয়েটি সংঘবদ্ধ দুর্বৃত্তদের হাতে নিগৃহীত হলো সে গারো সম্প্রদায়ের। সে একটি দোকানে কাজ করত; কাজ শেষে বাড়ি যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিল। এ সময়ই দুর্বৃত্তরা অস্ত্রের মুখে তাকে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায়। আমাদের সমাজের দুর্বল ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী নানাভাবেই নিগৃহীত হচ্ছে। পাহাড়ে ও সমতলে আদিবাসী মেয়েরা নিগৃহীত হচ্ছে। কিন্তু কোনো প্রতিকার হচ্ছে না। অপরাধীরা ধরা পড়ছে না। বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদছে। দুর্বৃত্তদের মধ্যে এ রকম ধারণা হয়েছে যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর কোনো মেয়ে লাঞ্ছিত হলে প্রতিবাদ হলেও হতে পারে। কিন্তু মেয়েটি যখন গারো বা আদিবাসী সম্প্রদায়ের, তখন আর তারা প্রতিবাদ করার সাহস পাবে না। একই চিত্র দেখেছি ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বেলায়। সমাজে যখন মানবিক বোধ ও চেতনা হারিয়ে যায়, তখনই এ রকম পরিস্থিতির তৈরি হয়। আমরা চাই, দুর্বৃত্তদের গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হোক। আক্রান্ত মেয়েটির পাশে রাষ্ট্র দাঁড়াক।
প্রথমেই যে প্রশ্নটি আসে তা হলো, যে গাড়িতে মেয়েটিকে তুলে নেওয়া হয়েছে, সেই গাড়ির মালিক আছেন। চালক আছেন। এ রকম ঘৃণ্য অপরাধ ঘটনার পরও সেই গাড়িটি কেন খুঁজে বের করা যাবে না? গাড়ি খুঁজে পেলে তার আরোহীদের বের করা কঠিন নয়। কোথাও নারী নিগ্রহের ঘটনা ঘটলেই অনেকে মেয়েটি কোথায় ও কেন গিয়েছিল, কী পোশাক পরেছিল, তার সঙ্গে কেউ ছিল কি না, এসব প্রশ্ন করেন। এসব প্রশ্ন তাঁরাই করেন, যাঁরা চান না মেয়েরা ঘরের বাইরে যাক। আমি তাঁদের জিজ্ঞেস করতে চাই, ছেলেরা যদি বাইরে বেরোতে পারে, মেয়েরা কেন পারবে না? কেন একটি মেয়েকে সমাজ ও রাষ্ট্র নিরাপত্তা দেবে না? একটি মেয়ে কেন ঘর থেকে নিরাপদে কাজের জায়গায় যেতে কিংবা কাজের জায়গা থেকে ঘরে ফিরতে পারবে না? দেশটা তো নারী–পুরুষ সবার।
বাংলাদেশের সংবিধানের ১০ নম্বর ধারায় জনজীবনে নারীর পূর্ণ অধিকার স্বীকৃত। ২৭ ও ২৮ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, নারী-পুরুষভেদে কোনো রূপ বৈষম্য দেখানো যাবে না। ২৮ নম্বর ধারার ক অনুচ্ছেদে সমাজের পশ্চাৎপদ অংশকে অগ্রবর্তী অংশের সমপর্যায়ে নিয়ে আসার কথা বলা হয়েছে।
আমরা যে মুক্তিযুদ্ধ করেছি, তার মূলেও ছিল নারী-পুরুষ, ধর্মবর্ণনির্বিশেষে সামাজিক ন্যায় ও সমতা। তাহলে নারীর ওপর এসব বিধিনিষেধ আরোপ করা হবে কেন? সমাজের সবক্ষেত্রে নারী সম-অধিকার ভোগ করবে, স্বাধীনভাবে চলাফেরা করবে, সেটাই সভ্য সমাজের রীতি। এ কথাও সত্য যে বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়ন হচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রে নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু রাষ্ট্র যদি তাদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়, দুর্বৃত্তদের নিবৃত্ত করতে না পারে, তাহলে আমাদের সব অর্জনই তো ধূলিসাৎ হয়ে যাবে।
রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে যখনই আমাদের আলোচনা হয়, তখন তাঁরা বলেন, অপরাধ সব সমাজে ও সব রাষ্ট্রেই ঘটছে। আমরাও স্বীকার করি, এটি পৃথিবীব্যাপী সমস্যা। কিন্তু অন্য দেশের সঙ্গে আমাদের পার্থক্য হলো, সেখানে অপরাধ করলে তার বিচারও হয়, অপরাধীরা ধরা পড়ে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের এখানে বিচার হয় না। অপরাধীরা ধরা পড়ে না। অর্থাৎ সমাজে বিচারহীনতা ও প্রতিকারহীনতার সংস্কৃতি চলছে। কোনো সমাজে বা রাষ্ট্রে যখন অপরাধ করে কেউ পার পায়, অপরাধীকে বিচারের আওতায় আনা না যায়, তাহলে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি হয়।
একটি দেশ বা সমাজে সভ্যতার মাপকাঠি হচ্ছে সেখানে অপরাধের বিচার হচ্ছে কি না। সাম্প্রতিক কালে অনেকগুলো নারী নিগ্রহের ঘটনা ঘটলেও দু-একটি ব্যতিক্রম বাদে অপরাধীরা ধরা পড়েনি। ধরা পড়লেও তাদের শাস্তি হয়নি। এই বিচারহীনতাই অপরাধীদের উৎসাহিত করছে। কেবল নারী নিগ্রহ নয়, মুক্তবুদ্ধির চর্চা যাঁরা করেন, তাঁদের ওপরও আঘাত হানছে দুর্বৃত্তরা। মুক্তবুদ্ধির কয়েকজন ব্লগার ও লেখককে হত্যা করেছে তারা। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের ধরতে পারেনি। দেশে আইনানুগ সরকার থাকা সত্ত্বেও দুর্বৃত্তরা মুক্তচিন্তার মানুষকে প্রাণনাশের হুমকি দিচ্ছে।
মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত বাংলাদেশের জন্য এর চেয়ে বেদনাদায়ক আর কী হতে পারে?
সুলতানা কামাল: আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক এবং সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা।
No comments