কৃষি খাতে ভর্তুকি কমানোর প্রবণতা বন্ধ হোক -সাক্ষাৎকারে : মাহবুব হোসেন by মশিউল আলম
মাহবুব হোসেন
১৯৬৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতি বিষয়ে স্নাতক, ১৯৬৯ সালে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৭০ সালে
পাকিস্তান ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (এখনকার বিআইডিএসের
পূর্বসূরি) স্টাফ অর্থনীতিবিদ হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৭৭ সালে
কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে পিএইচডি। ১৯৮৮ সালে বিআইডিএসের
মহাপরিচালক হন। ১৯৯২ সালে ফিলিপাইনে আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটে
সামাজিক বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে
ব্র্যাকের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
. সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মশিউল আলম
প্রথম আলো . এবার ধানের ফলন খুব ভালো হয়েছে। দেখা যায়, যখন যে ফসলের ফলন ভালো হয়, কৃষকেরা তার দাম কম পান, তাঁদের খুব ক্ষতি হয়। আবার দেশে চালের দাম কম থাকুক, এটাও মানুষ চায়। এবারও সে রকম পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে। এই সমস্যার সমাধান কী?
মাহবুব হোসেন . কৃষিপণ্যের চাহিদা সব সময় মোটের ওপর স্থির থাকে, শুধু জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ধীরে ধীরে কিছু চাহিদা বাড়ে। সারা বছর চাহিদা মোটামুটি একই রকম থাকে; শুধু রোজার মাসে কিছু পণ্যের চাহিদা বাড়ে, তা ছাড়া সারা বছর চাহিদা একই রকম থাকে। এই অবস্থায় কৃষিপণ্যের জোগান যদি হঠাৎ করে বেড়ে যায়, তাহলে তার দামের ওপর একটা প্রভাব অবশ্যই পড়ে। এটা শুধু অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির ক্ষেত্রে ঘটে, এখন এর সঙ্গে আরেকটা বড় ফ্যাক্টর যোগ হয়েছে, সেটা হলো বৈশ্বিক অর্থনীতি। আমরা চাই বা না চাই, বিশ্ববাজারের একটা প্রভাব বাংলাদেশের বাজারের ওপর পড়ে।
প্রথম আলো . দেশের ভেতরেই ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে, তার ওপর ভারত থেকে চাল আমদানি করার কারণ কী?
মাহবুব হোসেন . কারণ হলো, আন্তর্জাতিক বাজারে হঠাৎ করে চালের দাম কমে গেছে। অনেকটা থাইল্যান্ডের কারণে এটা ঘটেছে। সে দেশের সরকার চাষির কাছ থেকে বেশি দামে চাল কিনে সংরক্ষণ করে পরে বিক্রি করত। এটা করতে গিয়ে থাইল্যান্ড সংকটে পড়ে গেছে এবং এ কারণে এর আগের সরকারের পতন ঘটেছে। তারপর তারা এই নীতি ত্যাগ করার ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদার তুলনায় চালের জোগান বেড়ে গেছে। তার ফলে গত এক বছরে চালের দাম টনপ্রতি ৫০ থেকে ১০০ মার্কিন ডলার কমে গেছে। ভারতের চালের বাজারেও এর প্রভাব পড়েছে। আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরা দেখছেন, বিশ্ববাজার থেকে চাল আমদানি করে দেশের বাজারে বিক্রি করলে তাঁদের বেশ লাভ হয়। আমাদের দেশে যথেষ্ট পরিমাণ চাল আছে কি না, এটা কিন্তু ব্যবসায়ীদের বিবেচনায় নেই।
প্রথম আলো . এই সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে সরকারের কিছু করণীয় নেই?
মাহবুব হোসেন . অবশ্যই আছে এবং আমরা সেটা বলেছিও। সেটা হলো, চালের ওপর আমদানি শুল্ক আরোপ করা। দেরিতে হলেও সরকার আমাদের এ পরামর্শ গ্রহণ করেছে। এ ছাড়া যে বছর ধানের জোগান বাড়ে, সে বছর অতিরিক্ত ধান সরকারি উদ্যোগে কম দামে কিনে রাখা এবং যে বছর ধানের ঘাটতি কম হয় এবং দাম বাড়ে, সে বছর ওই সংরক্ষিত ধান বাজারে ছাড়া। কম দামে কিনে বেশি দামে বিক্রি করলে সরকারের অপারেশনাল ব্যয়টা সেখান থেকেই উঠে আসে, অতিরিক্ত সরকারি বরাদ্দের প্রয়োজন হয় না। এটা অনেক বছর ধরেই চলছে, কিন্তু সরকার এই খাতে পর্যাপ্ত অর্থের জোগান দেয় না এবং যে পরিমাণ ধান সংগ্রহ করা দরকার, সে পরিমাণ সংগ্রহ করে না। অর্থের জোগান ও সংগ্রহ বাড়ানো প্রয়োজন।
প্রথম আলো . বাংলাদেশের কৃষিতে ধানের প্রাধান্য খুব বেশি, ফসলবৈচিত্র্য কম। ফসলবৈচিত্র্য বেশি হলে কি কৃষকদের ক্ষতির ঝুঁকি কমতে পারত না?
মাহবুব হোসেন . ফসলবৈচিত্র্য কিছু আছে। সাম্প্রতিক সময়ে ভুট্টার চাষ বেশ বাড়ছে, শাকসবজির চাষও বেড়েছে। আগের তুলনায় শহরাঞ্চলের বাজারে শাকসবজির বৈচিত্র্য ও পরিমাণ অনেক বেশি বেড়েছে। কিন্তু ধান চাষের জন্য যে বিপুল পরিমাণ জমি ব্যবহার করা হয়, সেটা আমাদের মোট জমির প্রায় ৭৫ শতাংশ। শাকসবজি চাষের জন্য ব্যবহৃত হয় মাত্র ১ শতাংশ জমি। এখন ধান থেকে যদি ১ শতাংশ জমিও সরানো হয়, তাহলে শাকসবজির উৎপাদন দ্বিগুণ হয়ে যাবে এবং এটার একটা প্রভাব বাজারে পড়বে।
প্রথম আলো . শহরের বাসিন্দাদের যে দামে শাকসবজি কিনতে হয়, সে দাম তো কৃষকেরা পান না। এটাও তো একটা বড় সমস্যা।
মাহবুব হোসেন . এর একটা বড় কারণ পরিবহন খরচ। গ্রামের সঙ্গে শহরের যোগাযোগব্যবস্থা বেড়েছে এবং উন্নত হয়েছে। এর ফলে পরিবহন খরচ কমে যাওয়ার কথা, কিন্তু সেটা হচ্ছে না। তার অন্যান্য কারণও আছে: একটা হলো জ্বালানি তেলের দাম বেশি, এ ছাড়া আছে জায়গায় জায়গায় চাঁদাবাজি, রাজনৈতিক অস্থিরতা ইত্যাদি। এসবের ফলে খরচটা বেড়ে যায় এবং সেই খরচ ব্যবসায়ীরা সংগ্রহ করেন উৎপাদক ও ভোক্তাদের কাছ থেকে। আরেকটা ফ্যাক্টর হলো খুব বেশি লোক কৃষিপণ্যের ব্যবসায় নিয়োজিত থাকা। যে পরিমাণ ব্যবসা একজন লোক করতে পারেন, গ্রামে সেই পরিমাণ ব্যবসা ১০-১২ জন লোক করছেন এবং এটার একটা কারণ হলো যে লোকজনের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নেই। তিনি অন্য কিছু করতে পারছেন না, তাই ৫ হাজার, ১০ হাজার টাকা নিয়ে ছোটখাটো ব্যবসায় নেমে পড়লেন। তাঁকে তো তাঁর সংসারের খরচটা জোগাড় করতে হবে। তার ফলে শাকসবজির দামের মার্জিনটা খুব বেশি হয়। তবে এই ক্ষেত্রে একটা ইতিবাচক পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। গ্রামের মানুষ শহরমুখী হচ্ছেন, ফলে গ্রামে ছোট ব্যবসায়ীর সংখ্যা আস্তে আস্তে কমছে। এটা কমলে সবজিচাষি ও ভোক্তা পর্যায়ে সবজির দামের যে বিরাট পার্থক্য, সেটাও কমবে।
প্রথম আলো . কৃষিকাজ ও কৃষিপণ্য পরিবহনের সঙ্গে জ্বালানি তেলের দামের সম্পর্ক নিবিড়। বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমে গেছে। কিন্তু আমাদের দেশে কমানো হয়নি। এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য কী?
মাহবুব হোসেন . বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের বিপণন হয় সরকারের নির্ধারিত মূল্যে। এটা যদি মুক্তবাজারে ছেড়ে দেওয়া হতো তাহলে বিশ্ববাজারে তেলের দামের ওঠানামার সঙ্গে সঙ্গে এই দেশের বাজারেও তেলের দাম বাড়ত এবং কমত। কৃষি উন্নয়নের নীতি হিসেবেই তেলের মতো সার ও অন্যান্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপকরণের দাম নির্ধারিত করে দেওয়া হয়। সরকার হয়তো ডিজেলের ক্ষেত্রে একসময় ভর্তুকি দিয়েছে, এখন বিশ্ববাজারে দাম কমে যাওয়ায় সরকারও ডিজেলের দাম কমাতে পারে। কিন্তু তা করছে না, তারা হয়তো ভাবছে আগে যে ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে এখন তা তুলে নেওয়া যাবে। কিন্তু এই ক্ষেত্রে দেখতে হবে, সরকারের নির্ধারিত দাম যে বিশ্ববাজারের তুলনায় অনেক বেশি না হয়ে যায়, তাহলে সেটা হবে কৃষকের জন্য শোষণমূলক।
প্রথম আলো . আমরা এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ, কিন্তু জনসংখ্যা বাড়ছে ১ দশমিক ২ শতাংশ হারে, প্রতিবছর গড়ে ১৮ লাখ। এই হারে জনসংখ্যা বাড়লে আমরা কি একটা সময় খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ থাকতে পারব?
মাহবুব হোসেন . আমাদের কৃষি উন্নয়ন হয়েছে প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণের মাধ্যমে। ২০-৩০ বছর আগে আমরা যখন মান্ধাতার আমলের ধান চাষ করতাম, তখন এক বিঘাতে আট মণ ধান পেতাম এবং বছরে হয়তো একটাই ধান হতো। কারণ, ধান চাষ ছিল বৃষ্টিনির্ভর। এখন আমরা এক বিঘাতে বোরো ধান পাই ২০-২২ মণ, আমন পাই ১৫-১৬ মণ। সারা বছরে দুইটা ধান করে পাওয়া যাচ্ছে ৩৮ থেকে ৪০ মণ ধান, আগে যেখানে পাওয়া যেত মাত্র আট মণ। এভাবেই অতিরিক্ত জনসংখ্যার খাদ্যচাহিদা মেটানো গেছে। আপনার প্রশ্ন অনুযায়ী, এই প্রক্রিয়াটা আর কত দূর টানা যায়? খুব বেশি দূর টানা যাবে না, এর একটা সীমা আছে এবং সেই সীমায় গিয়ে এটা থেমে যাবে। আমাদের দেশে যেসব জমি সেচের আওতায় আছে, সেগুলোতে এই প্রক্রিয়া শেষ সীমার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। এখন আমন আর আউশের ক্ষেত্রে কিছু করার আছে, অবশ্য কিছু কিছু প্রযুক্তি ইতিমধ্যে উদ্ভাবিত হয়েছে, কিন্তু সেগুলোর সম্প্রসারণ ঘটেনি। সম্প্রসারণ করা গেলে আমন ও আউশের উৎপাদন আরও বাড়ানো সম্ভব। এখন আমাদের নজর দিতে হবে সারা বছরে উৎপাদন বাড়ানোর দিকে।
প্রথম আলো . সামনে আগামী অর্থবছরের জাতীয় বাজেট ঘোষণা করা হবে। দেখা যায় প্রাক্-বাজেট আলোচনায় নানা খাতের, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষেরা নিজেদের দাবি-দাওয়া তুলে ধরে। কিন্তু কৃষকদের পক্ষ থেকে কোনো দাবি-দাওয়া ওঠে না। আপনি কৃষি খাতের তরফ থেকে আগামী জাতীয় বাজেটের জন্য কী পরামর্শ দেবেন?
মাহবুব হোসেন . আমাদের দেশে এখন প্রায় ১ কোটি ৬০ লাখ কৃষক আছেন, তাঁরা প্রান্তিক কৃষক। অন্যান্য খাতের মানুষের মতো তাঁরা সংগঠিত নন বলে তাঁদের কণ্ঠস্বর শোনা যায় না। আমরা লক্ষ করি, বাজেট বক্তৃতায় সব সময়ই বলা হয় যে কৃষি আমাদের অগ্রাধিকারের খাত। কিন্তু আমরা যখন বাজেটে অর্থ বরাদ্দ দেখি, তখন দেখা যায়, বছরে বছরে কৃষির ভাগটা আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছে। এই সরকারের আমলেই গত পাঁচ বছরে জাতীয় বাজেটে কৃষির ভাগ ১১ শতাংশ থেকে ৭-৮ শতাংশে নেমে এসেছে। প্রথমেই এ প্রবণতা বন্ধ করা দরকার। আরেকটা হলো, কৃষি বলতে মূলত শস্য খাতকে বোঝানো হচ্ছে। কিন্তু কৃষিতে মৎস্য খাত, পশুপালন খাতও গুরুত্বপূর্ণ। এই দুই খাতের ওপর জোর দেওয়া অত্যন্ত জরুরি। এ বছর সরকারকে সারে ভর্তুকি কম দিতে হবে, কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে সারের দাম কমে গেছে। এখানে যে অর্থ বাঁচবে তা মৎস্য ও পশুপালন খাতে ব্যবহার করা যেতে পারে। শস্য খাতে গবেষণায় আরও অনেক কিছু করার আছে। এ জন্য অর্থ প্রয়োজন। আর মৎস্য ও পশুপালন খাতে রোগবালাই নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ; এদিকেও বেশি নজর দিতে হবে, এ জন্য অর্থ বরাদ্দ বাড়াতে হবে।
প্রথম আলো . আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
মাহবুব হোসেন . আপনাকেও ধন্যবাদ।
. সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মশিউল আলম
প্রথম আলো . এবার ধানের ফলন খুব ভালো হয়েছে। দেখা যায়, যখন যে ফসলের ফলন ভালো হয়, কৃষকেরা তার দাম কম পান, তাঁদের খুব ক্ষতি হয়। আবার দেশে চালের দাম কম থাকুক, এটাও মানুষ চায়। এবারও সে রকম পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে। এই সমস্যার সমাধান কী?
মাহবুব হোসেন . কৃষিপণ্যের চাহিদা সব সময় মোটের ওপর স্থির থাকে, শুধু জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ধীরে ধীরে কিছু চাহিদা বাড়ে। সারা বছর চাহিদা মোটামুটি একই রকম থাকে; শুধু রোজার মাসে কিছু পণ্যের চাহিদা বাড়ে, তা ছাড়া সারা বছর চাহিদা একই রকম থাকে। এই অবস্থায় কৃষিপণ্যের জোগান যদি হঠাৎ করে বেড়ে যায়, তাহলে তার দামের ওপর একটা প্রভাব অবশ্যই পড়ে। এটা শুধু অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির ক্ষেত্রে ঘটে, এখন এর সঙ্গে আরেকটা বড় ফ্যাক্টর যোগ হয়েছে, সেটা হলো বৈশ্বিক অর্থনীতি। আমরা চাই বা না চাই, বিশ্ববাজারের একটা প্রভাব বাংলাদেশের বাজারের ওপর পড়ে।
প্রথম আলো . দেশের ভেতরেই ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে, তার ওপর ভারত থেকে চাল আমদানি করার কারণ কী?
মাহবুব হোসেন . কারণ হলো, আন্তর্জাতিক বাজারে হঠাৎ করে চালের দাম কমে গেছে। অনেকটা থাইল্যান্ডের কারণে এটা ঘটেছে। সে দেশের সরকার চাষির কাছ থেকে বেশি দামে চাল কিনে সংরক্ষণ করে পরে বিক্রি করত। এটা করতে গিয়ে থাইল্যান্ড সংকটে পড়ে গেছে এবং এ কারণে এর আগের সরকারের পতন ঘটেছে। তারপর তারা এই নীতি ত্যাগ করার ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদার তুলনায় চালের জোগান বেড়ে গেছে। তার ফলে গত এক বছরে চালের দাম টনপ্রতি ৫০ থেকে ১০০ মার্কিন ডলার কমে গেছে। ভারতের চালের বাজারেও এর প্রভাব পড়েছে। আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরা দেখছেন, বিশ্ববাজার থেকে চাল আমদানি করে দেশের বাজারে বিক্রি করলে তাঁদের বেশ লাভ হয়। আমাদের দেশে যথেষ্ট পরিমাণ চাল আছে কি না, এটা কিন্তু ব্যবসায়ীদের বিবেচনায় নেই।
প্রথম আলো . এই সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে সরকারের কিছু করণীয় নেই?
মাহবুব হোসেন . অবশ্যই আছে এবং আমরা সেটা বলেছিও। সেটা হলো, চালের ওপর আমদানি শুল্ক আরোপ করা। দেরিতে হলেও সরকার আমাদের এ পরামর্শ গ্রহণ করেছে। এ ছাড়া যে বছর ধানের জোগান বাড়ে, সে বছর অতিরিক্ত ধান সরকারি উদ্যোগে কম দামে কিনে রাখা এবং যে বছর ধানের ঘাটতি কম হয় এবং দাম বাড়ে, সে বছর ওই সংরক্ষিত ধান বাজারে ছাড়া। কম দামে কিনে বেশি দামে বিক্রি করলে সরকারের অপারেশনাল ব্যয়টা সেখান থেকেই উঠে আসে, অতিরিক্ত সরকারি বরাদ্দের প্রয়োজন হয় না। এটা অনেক বছর ধরেই চলছে, কিন্তু সরকার এই খাতে পর্যাপ্ত অর্থের জোগান দেয় না এবং যে পরিমাণ ধান সংগ্রহ করা দরকার, সে পরিমাণ সংগ্রহ করে না। অর্থের জোগান ও সংগ্রহ বাড়ানো প্রয়োজন।
প্রথম আলো . বাংলাদেশের কৃষিতে ধানের প্রাধান্য খুব বেশি, ফসলবৈচিত্র্য কম। ফসলবৈচিত্র্য বেশি হলে কি কৃষকদের ক্ষতির ঝুঁকি কমতে পারত না?
মাহবুব হোসেন . ফসলবৈচিত্র্য কিছু আছে। সাম্প্রতিক সময়ে ভুট্টার চাষ বেশ বাড়ছে, শাকসবজির চাষও বেড়েছে। আগের তুলনায় শহরাঞ্চলের বাজারে শাকসবজির বৈচিত্র্য ও পরিমাণ অনেক বেশি বেড়েছে। কিন্তু ধান চাষের জন্য যে বিপুল পরিমাণ জমি ব্যবহার করা হয়, সেটা আমাদের মোট জমির প্রায় ৭৫ শতাংশ। শাকসবজি চাষের জন্য ব্যবহৃত হয় মাত্র ১ শতাংশ জমি। এখন ধান থেকে যদি ১ শতাংশ জমিও সরানো হয়, তাহলে শাকসবজির উৎপাদন দ্বিগুণ হয়ে যাবে এবং এটার একটা প্রভাব বাজারে পড়বে।
প্রথম আলো . শহরের বাসিন্দাদের যে দামে শাকসবজি কিনতে হয়, সে দাম তো কৃষকেরা পান না। এটাও তো একটা বড় সমস্যা।
মাহবুব হোসেন . এর একটা বড় কারণ পরিবহন খরচ। গ্রামের সঙ্গে শহরের যোগাযোগব্যবস্থা বেড়েছে এবং উন্নত হয়েছে। এর ফলে পরিবহন খরচ কমে যাওয়ার কথা, কিন্তু সেটা হচ্ছে না। তার অন্যান্য কারণও আছে: একটা হলো জ্বালানি তেলের দাম বেশি, এ ছাড়া আছে জায়গায় জায়গায় চাঁদাবাজি, রাজনৈতিক অস্থিরতা ইত্যাদি। এসবের ফলে খরচটা বেড়ে যায় এবং সেই খরচ ব্যবসায়ীরা সংগ্রহ করেন উৎপাদক ও ভোক্তাদের কাছ থেকে। আরেকটা ফ্যাক্টর হলো খুব বেশি লোক কৃষিপণ্যের ব্যবসায় নিয়োজিত থাকা। যে পরিমাণ ব্যবসা একজন লোক করতে পারেন, গ্রামে সেই পরিমাণ ব্যবসা ১০-১২ জন লোক করছেন এবং এটার একটা কারণ হলো যে লোকজনের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নেই। তিনি অন্য কিছু করতে পারছেন না, তাই ৫ হাজার, ১০ হাজার টাকা নিয়ে ছোটখাটো ব্যবসায় নেমে পড়লেন। তাঁকে তো তাঁর সংসারের খরচটা জোগাড় করতে হবে। তার ফলে শাকসবজির দামের মার্জিনটা খুব বেশি হয়। তবে এই ক্ষেত্রে একটা ইতিবাচক পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। গ্রামের মানুষ শহরমুখী হচ্ছেন, ফলে গ্রামে ছোট ব্যবসায়ীর সংখ্যা আস্তে আস্তে কমছে। এটা কমলে সবজিচাষি ও ভোক্তা পর্যায়ে সবজির দামের যে বিরাট পার্থক্য, সেটাও কমবে।
প্রথম আলো . কৃষিকাজ ও কৃষিপণ্য পরিবহনের সঙ্গে জ্বালানি তেলের দামের সম্পর্ক নিবিড়। বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমে গেছে। কিন্তু আমাদের দেশে কমানো হয়নি। এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য কী?
মাহবুব হোসেন . বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের বিপণন হয় সরকারের নির্ধারিত মূল্যে। এটা যদি মুক্তবাজারে ছেড়ে দেওয়া হতো তাহলে বিশ্ববাজারে তেলের দামের ওঠানামার সঙ্গে সঙ্গে এই দেশের বাজারেও তেলের দাম বাড়ত এবং কমত। কৃষি উন্নয়নের নীতি হিসেবেই তেলের মতো সার ও অন্যান্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপকরণের দাম নির্ধারিত করে দেওয়া হয়। সরকার হয়তো ডিজেলের ক্ষেত্রে একসময় ভর্তুকি দিয়েছে, এখন বিশ্ববাজারে দাম কমে যাওয়ায় সরকারও ডিজেলের দাম কমাতে পারে। কিন্তু তা করছে না, তারা হয়তো ভাবছে আগে যে ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে এখন তা তুলে নেওয়া যাবে। কিন্তু এই ক্ষেত্রে দেখতে হবে, সরকারের নির্ধারিত দাম যে বিশ্ববাজারের তুলনায় অনেক বেশি না হয়ে যায়, তাহলে সেটা হবে কৃষকের জন্য শোষণমূলক।
প্রথম আলো . আমরা এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ, কিন্তু জনসংখ্যা বাড়ছে ১ দশমিক ২ শতাংশ হারে, প্রতিবছর গড়ে ১৮ লাখ। এই হারে জনসংখ্যা বাড়লে আমরা কি একটা সময় খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ থাকতে পারব?
মাহবুব হোসেন . আমাদের কৃষি উন্নয়ন হয়েছে প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণের মাধ্যমে। ২০-৩০ বছর আগে আমরা যখন মান্ধাতার আমলের ধান চাষ করতাম, তখন এক বিঘাতে আট মণ ধান পেতাম এবং বছরে হয়তো একটাই ধান হতো। কারণ, ধান চাষ ছিল বৃষ্টিনির্ভর। এখন আমরা এক বিঘাতে বোরো ধান পাই ২০-২২ মণ, আমন পাই ১৫-১৬ মণ। সারা বছরে দুইটা ধান করে পাওয়া যাচ্ছে ৩৮ থেকে ৪০ মণ ধান, আগে যেখানে পাওয়া যেত মাত্র আট মণ। এভাবেই অতিরিক্ত জনসংখ্যার খাদ্যচাহিদা মেটানো গেছে। আপনার প্রশ্ন অনুযায়ী, এই প্রক্রিয়াটা আর কত দূর টানা যায়? খুব বেশি দূর টানা যাবে না, এর একটা সীমা আছে এবং সেই সীমায় গিয়ে এটা থেমে যাবে। আমাদের দেশে যেসব জমি সেচের আওতায় আছে, সেগুলোতে এই প্রক্রিয়া শেষ সীমার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। এখন আমন আর আউশের ক্ষেত্রে কিছু করার আছে, অবশ্য কিছু কিছু প্রযুক্তি ইতিমধ্যে উদ্ভাবিত হয়েছে, কিন্তু সেগুলোর সম্প্রসারণ ঘটেনি। সম্প্রসারণ করা গেলে আমন ও আউশের উৎপাদন আরও বাড়ানো সম্ভব। এখন আমাদের নজর দিতে হবে সারা বছরে উৎপাদন বাড়ানোর দিকে।
প্রথম আলো . সামনে আগামী অর্থবছরের জাতীয় বাজেট ঘোষণা করা হবে। দেখা যায় প্রাক্-বাজেট আলোচনায় নানা খাতের, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষেরা নিজেদের দাবি-দাওয়া তুলে ধরে। কিন্তু কৃষকদের পক্ষ থেকে কোনো দাবি-দাওয়া ওঠে না। আপনি কৃষি খাতের তরফ থেকে আগামী জাতীয় বাজেটের জন্য কী পরামর্শ দেবেন?
মাহবুব হোসেন . আমাদের দেশে এখন প্রায় ১ কোটি ৬০ লাখ কৃষক আছেন, তাঁরা প্রান্তিক কৃষক। অন্যান্য খাতের মানুষের মতো তাঁরা সংগঠিত নন বলে তাঁদের কণ্ঠস্বর শোনা যায় না। আমরা লক্ষ করি, বাজেট বক্তৃতায় সব সময়ই বলা হয় যে কৃষি আমাদের অগ্রাধিকারের খাত। কিন্তু আমরা যখন বাজেটে অর্থ বরাদ্দ দেখি, তখন দেখা যায়, বছরে বছরে কৃষির ভাগটা আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছে। এই সরকারের আমলেই গত পাঁচ বছরে জাতীয় বাজেটে কৃষির ভাগ ১১ শতাংশ থেকে ৭-৮ শতাংশে নেমে এসেছে। প্রথমেই এ প্রবণতা বন্ধ করা দরকার। আরেকটা হলো, কৃষি বলতে মূলত শস্য খাতকে বোঝানো হচ্ছে। কিন্তু কৃষিতে মৎস্য খাত, পশুপালন খাতও গুরুত্বপূর্ণ। এই দুই খাতের ওপর জোর দেওয়া অত্যন্ত জরুরি। এ বছর সরকারকে সারে ভর্তুকি কম দিতে হবে, কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে সারের দাম কমে গেছে। এখানে যে অর্থ বাঁচবে তা মৎস্য ও পশুপালন খাতে ব্যবহার করা যেতে পারে। শস্য খাতে গবেষণায় আরও অনেক কিছু করার আছে। এ জন্য অর্থ প্রয়োজন। আর মৎস্য ও পশুপালন খাতে রোগবালাই নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ; এদিকেও বেশি নজর দিতে হবে, এ জন্য অর্থ বরাদ্দ বাড়াতে হবে।
প্রথম আলো . আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
মাহবুব হোসেন . আপনাকেও ধন্যবাদ।
No comments